ভারতীয় অর্থনীতির ওপর তুর্কি শাসনের ফল
কি হয়েছিল এ প্রশ্নে ঐতিহাসিক মহলে মতপার্থক্য আছে। ঐতিহাসিক ডি ডি কোশাম্বি তাঁর “An
Introduction to the study of Indian history” গ্রন্থে মন্তব্য
করেছেন যে ইসলামী আক্রমণকারীরা একটি পরিবর্তন এনেছিল, তবে
ভারতে বর্তমান সামন্ততন্ত্রের উৎপাদন গুলিকে অধিকতর সক্রিয় করার বেশি নতুন কিছু
তা ছিল না।
লালনজি গোপাল এর মতভুক্ত একদল ঐতিহাসিক
মনে করেন সুলতানি যুগে ভারতীয় অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যায়। সুশৃংখলভাবে অর্থনৈতিক শোষণ শুরু হওয়ায় ভারত-দরিদ্র হয়ে পড়ে। জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়। মুঘল আমলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়।
দ্বিতীয় শর্তটি হল হাজার হাজার বছর ধরে
ভারতীয় সমাজে কোন পরিবর্তন হয়নি। তৃণমূল স্তরে
মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা একই রকম ছিল। পরিবর্তন
যেটুকু হয়েছিল তা ওপর মহলে, অর্থাৎ রাজপুত ও তাদের
সহযোগীবৃন্দ ও ব্রাহ্মণদের ওপর তুর্কি শাসনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছিল।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ হাবিব যুক্তিসহ
বলেন যে, সুলতানি আমলে নগরের বিস্তার ঘটে এবং
কৃষি সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়। তিনি নগর ও গ্রামীণ ক্ষেত্রে দুটি মৌলিক পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি
আকর্ষণ করেন।
প্রথমতঃ মুসলিম
শাসকেরা শিল্প পণ্যের উৎপাদনে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। শিল্পীর জাত পাত নিয়ে তাদের কোন ছুতমার্ক ছিল না। কিন্তু প্রাক সুলতানি যুগে শিল্পী কারিগরদের জাতপাতের বিধি নিষেধ আন্ত:বৃত্তিজীবী
সচলতার (Inter professional Mobility) বাধা সৃষ্টি করত। এখন সেই বাধা দূর হয়।
দ্বিতীয়তঃ সুলতানেরা গ্রাম থেকে অধিকতর
রাজস্ব সংগ্রহ করতে আগ্রহী ছিলেন। তাই আলাউদ্দিন
খলজি কৃষকদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন আত্মস্যাতকারী ও শোষক মধ্যস্বত্বভোগীদের অপসারিত
করেন। অধ্যাপক হাবিবের মতে এই দুটি পরিবর্তন এতটাই মৌলিক
যে এদের যথাক্রমে ‘নগর বিপ্লব’ ও ‘গ্রামীণ
বিপ্লব’ আখ্যা দেওয়া যায়। অবশ্য
অধ্যাপক হাবিব স্বীকার করেন যে, দিল্লির শাসক গোষ্ঠী বিশুদ্ধ
জনহিতকারী চেতনা থেকে এই উন্নয়নের কাজ করেননি। বস্তুত তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ‘ব্যক্তিগত
উন্নতির ইচ্ছা’।
বিবিধ মতের সমন্বয় সাধন করে ইরফান হাবিব
দেখিয়েছেন যে, সুলতানি আমলের পরিবর্তনগুলিকে সামাজিক
বিপ্লব বলাটা অতিরঞ্জন। তাঁর মতে সুলতানি শাসন ব্যবস্থায়
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। বিশাল উদ্বৃত্ত পুঞ্জিভূত হয়েছিল
শাসকশ্রেণীর হাতে। জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছা নয়, শাসকের
মর্জিই ছিল সমস্ত প্রক্রিয়ার চালিকাশক্তি। সাধারণ কৃষকদের আর্থ-সামাজিক
স্বাধীনতা অস্বীকৃতি তাদের প্রায় দাসত্বের পর্যায়ে থাকতে বাধ্য করেছিল। অন্যদিকে শহর ও বাণিজ্যের প্রসার এবং বিপুল পরিমাণে শিল্প পণ্যের
উৎপাদন এই নতুন শাসনব্যবস্থাকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছিল।
সুলতানি যুগের কৃষি উৎপাদন: সুলতানি
যুগের কৃষি উৎপাদন সম্পর্কে আমাদের প্রধান ঐতিহাসিক উপাদান ইবন বতুতার বৃত্তান্ত। সেখান থেকে জানা যায় যে, উত্তর ভারতে গম
ও তৈলবীজ এবং পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে ধান ও আখ উৎপাদিত হত। তুলো, বার্লি ও তিল উৎপাদন হত প্রচুর। জমি উর্বর হওয়ায় রবি ও খারিফ শস্য উৎপাদিত হত। কিন্তু জমিতে দুবার শস্য হত, তবে বেশিরভাগ
জমি ছিল এক চাষের। দিল্লির থাক্কুরা ফেরু জানিয়েছেন যে
ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকে ভারতে অন্তত পঁচিশ বছরের কৃষিজপণ্য উৎপন্ন হত। তবে ফেরুর বর্ণনায় আফিম ও নীলের কথা নেই। সবচেয়ে বেশি চাষ হত যবের। তারপর গম, যর, ধান, ডাল, জোয়ার, আখ ও
তুলো। বারাণী ও খসরুর রচনা থেকে জানা যায়, এক মন
গমের দাম ৭১/২ জিতল, যব ৪ জিতল, চাল ৫
জিতল, ও ডাল ৫ জিতল।
ইরফান হাবিব অবশ্য মনে করেন এই চাষ
ক্ষুদ্র অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। নীল উৎপাদন হত
ও তা রপ্তানি করাও হত। তাঁর মতে ছোলা ও বার্লির মত
রবিশস্যের দাম কম ছিল, কারণ এগুলি বৃষ্টির জলের উপর নির্ভরশীল। অপরদিকে যে শস্যের জন্য সেচের জলের প্রয়োজন তার দাম ছিল বেশি। কারণ এর উৎপাদন ছিল সীমিত ও এই চাষে কিছু অর্থলগ্নীরও প্রয়োজন হত।
সতীশচন্দ্র দেখিয়েছেন মহম্মদ বিন তুঘলক
ও ফিরোজ তুঘলকের শাসনকালে বহু সংখ্যক বাগান স্থাপন করা হয়। ফিরোজ তুঘলকের
সময়কালে দিল্লি ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে প্রায় বারোশো বাগান ছিল। এই বাগানগুলিতে আঙ্গুর সহ বিভিন্ন ফল ফলত। মিরাট ও আলীগড়ে উৎপাদিত আঙ্গুরজাত সূরা দিল্লিতে চলে যেত বিক্রির
জন্য। জৌনপুর, গোয়ালিয়র ও
যোধপুর উন্নতমানের ফল উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। যোধপুরে ডালিম চাষের উন্নতির দিকে নজর দেওয়া হত। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে কৃষিতে নতুন পণ্যের চাষ শুরু হয় এর মধ্যে
প্রধান হল রেশমের জন্য তুঁতে চাষের প্রচলন।
সুলতানি আমলে মুঘল যুগের তুলনায় চাষের
জমির অভাব ছিল না। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে গাঙ্গেয়
অববাহিকায় বিস্তীর্ণ জঙ্গলও ছিল। একজন কৃষক অনেক
জমির মালিক ছিল। সেই জন্য জমি মালিকানা নিয়ে কোন সমস্যা ছিল না। বলদ, নাঙল, বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ ছিল কৃষকের নিজস্ব সম্পত্তি। গ্রামকে কেন্দ্র করে কৃষি ব্যবস্থা গড়ে
ওঠে। শামস-ই-সিরাজ আফিফের
লেখা থেকে জানা যায় একটি সাধারণ গ্রামে দুশো থেকে তিনশো কৃষক বাস করত। কৃষক পরিবারগুলি নিজে উদ্যোগে চাষ করত। পারিবারিক ক্ষুদ্রায়তন খামার ছিল কৃষির ভিত্তি। কৃষি উপকরণ ছিল কাঠ ও লোহা নির্মিত ব্যাপকভাবে পশুপালন হত বলে জমিতে
সার ব্যবহার করা হত।
সেচের কাজ বেশিরভাগ হত বৃষ্টির জলে। এছাড়া জল সংরক্ষণের জন্য কুপ ও বাঁধ নির্মাণ করা হত। প্রাক সুলতানি যুগে অরহট্টের কথা পাওয়া যায় যেখানে দঁড়ির সঙ্গে
কলসি বেঁধে জল তোলা হত। এই প্রযুক্তি সুলতানি যুগে পার্শিয়ান
হুইল বা এক ধরনের জলচক্রের রূপ নেয়।
তুঘলক সুলতান গিয়াস উদ্দিন প্রথম
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে খাল খনন করে কৃষি কাজে জল সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। সেচ খাল খননের ব্যাপারে ফিরোজ তুঘলক সুলতানি যুগের সবচেয়ে উদ্যোগী
শাসক। তিনি যমুনা থেকে ‘রজবওয়া’ ও ‘উলুখখানি’ নামে
দুটি বড় খাল খনন করেন। এছাড়া শতদ্রুপ ও ঘর্ঘরা নদী থেকে দুটি
সেচ খাল খনন করা হয়। বর্তমান হরিয়ানার হিসার অঞ্চলের
কৃষকেরা এর দ্বারা উপকৃত হয়। এছাড়া সিন্ধু
ও পাঞ্জাবেও ছোট খাল খননের কথা বলা আছে।
গ্রামীণ সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস: সুলতানি
আমলে গ্রামীণ সমাজের চরিত্র কি ছিল এ প্রশ্নে সমকালীন ঐতিহাসিক সূত্রগুলি নিরব।
জিয়াউদ্দিন বারানীর রচনা থেকে জানা যায় যে,
গ্রামের সম্পন্ন কৃষক খুৎ ও একেবারে দরিদ্র চাষী 'বলাহর'। এদের নিচে ছিল ভূমিহীন কৃষক।
ইরফান হাবিব গ্রামীণ কৃষি সমাজকে ত্রিস্তলীয়
বিভাগের শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। প্রথম
শ্রেণি রাই ও রায়ান, দ্বিতীয় শ্রেণি খুৎ,
মুকদ্দম ও চৌধুরী, তৃতীয় শ্রেণি কৃষকগণ, এদের
মধ্যে অবশ্য স্তরভেদ রয়েছে।
রাই ও রায়ান : প্রথম
যুগের তুর্কি সুলতানগন এদের মাধ্যমেই রাজস্ব আদায় করতেন। রাজস্ব আদায়কারী হিসেবে তারা রাজস্বের একাংশ ও নিষ্কর জমি লাভ করত। পরবর্তীকালে এরাই জমিদার নামে পরিচিত হয়।
খুৎ মুকদ্দাম ও
চৌধুরী : এরা ছিল সম্পন্ন কৃষক ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করত। তারা খারাজ (ভূমি রাজস্ব), চরাই (পশুচারণ
কর), ঘরি (গৃহকর) প্রভৃতি
কর দিত না। জিয়াউদ্দিন বারানীর রচনা থেকে জানা
যায় যে তারা ঘোড়ায় চড়ত, মূল্যবান পোশাক পড়ত ও সুখে
স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করত।
আলাউদ্দিন খলজি খুৎ ও মুকদ্দন্দের বিশেষ
অধিকার গুলি প্রত্যাহার করে নিলে তারা দুর্দশার মধ্যে পড়ে। ফিরোজ তুঘলকের সময় তারা আবার লুপ্ত মর্যাদা ফিরে পায়।
এদের মধ্যে চৌধুরীরা ছিল গ্রামীণ
অভিজাতদের মধ্যে উচ্চতম মর্যাদার অধিকারী। ইবন
বতু তার বর্ণনায় প্রায় একশো গ্রাম নিয়ে সাদা ও একটি সাদি ছিল চৌধুরী অধীন। ইরফান হাবিব মনে করেন যে সাদি ও পরগনা একই,
পরবর্তীকালে পরগনার দায়িত্বে থাকা চৌধুরীরা জমিদার নামে পরিচিত হয়।
কৃষক : তৃতীয়
শ্রেণি ভুক্ত কৃষক, যদিও তারা সমগোত্রিয় ছিল না, জমির
পরিমাণ অনুসারে সমাজে তাদের স্থান নির্ধারিত হত। কৃষক সমাজের বড় অংশ ছিল দরিদ্র ও ভূমিহীন। তাদের উপর করের চাপ ছিল অত্যধিক। তারা মাঝে মাঝেই বিদ্রোহ করত।
ধর্মশাস্ত্রের ভাষ্যকারদের রচনা ও পদ্মপুরাণের ভিত্তিতে সতীশচন্দ্র কৃষকদের ভয়াবহ
দারিদ্র্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া গ্রামে
বাস করত কারিগর, চর্মশিল্পী, রজ্জুনির্মাতা,
চৌকিদার। কৃষকসহ সকলেই বর্ণের ভিত্তিতে সংগঠিত হত। চর্মশিল্পী ও ভূমিহীন কৃষকদের অনেকেই অস্পৃশ্য বর্ণভুক্ত ছিল।
মূল্যায়ন : অতএব
সুলতানি যুগে গ্রামীণ সমাজ ছিল ভীষণভাবে অসমান। অর্থ মূল্যে রাজস্ব প্রদানের রীতির ব্যাপক প্রচলন ঘটায় এই বৈষম্য আরও
প্রকট হয়। সতীশ চন্দ্র মন্তব্য করেছেন সুলতানদের
কৃষি-নীতির উদ্দেশ্যই ছিল শাসক ও আমলাদের ব্যয় সুনিশ্চিত করা। কিন্তু গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতির উপর তার প্রভাব অনুভূত হয়েছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন