দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী ছিল কিনা, এটি একটি বিতর্কিত
প্রশ্ন। জিয়াউদ্দিন বারনীর মতো সমসাময়িক
ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে 'জাহানদারী' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবিদ্দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে।
কিন্তু আধুনিক
ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত। একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের
কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথমত,
রাষ্ট্র কোরানের ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শরিয়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত, সব ইসলামীয়
রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন। ফলে সুলতানগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না, তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ। তৃতীয়ত, ইসলামীয় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল 'মিল্লাত' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ। ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা
হত।
ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব, শ্রীরাম শর্মার মতো
ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হিসেবে
বর্ণনা করেছেন। তাঁরা মনে করেন সুলতানগণ নিজেকে আল্লাহর দূত বলে দাবি করেছেন। সুলতান ছিলেন সীজার ও পোপের সমাহার। উলেমারা সুলতানকে রাজকার্যে পরামর্শ দিত। সুলতানদের লক্ষ্য ছিল ভারতবর্ষরূপী দার-উল-হার্বকে (বিধর্মীর দেশ) দার-উল-ইসলামে (ইসলামে বিশ্বাসী দেশ)
পরিণত করা। ইসলামীয় বিধি অনুসারে সুলতানগণ খলিফাকে তাঁদের প্রভু বলে মান্য করতেন।
আলাউদ্দিন খলজি ও
মোবারক খলজি ছাড়া সব সুলতানই নিজেদের খলিফার সহকারি বা অনুগামী হিসেবে হাজির
করেছেন। শরিয়তের বিধি
অনুসারে কোনো অ-মুসলমান ইসলামীয়
রাষ্ট্রে পূর্ণ নাগরিকত্বের অধিকারী নয়। কিন্তু
রাষ্ট্রের আনুগত্য মেনেও 'জিজিয়া' কর প্রদানের বিনিময়ে তাকে 'জিম্মির' মর্যাদা দেওয়া হত। জিম্মির জীবন, ধন ও সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব ছিল সুলতানের। জিম্মিরা সেই সঙ্গে
ধর্মীয় তথা সামাজিক জীবন যাপনের স্বাধীনতা ভোগ করত।
এই গোষ্ঠীর
ঐতিহাসিকগণ দেখিয়েছেন উলেমারা রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিত। তারা শরিয়তের ব্যাখ্যা করত ও
সুলতানের ধর্মীয় উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করত। এই যুক্তিগুলির
ভিত্তিতে এই ঐতিহাসিকগণ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে সুলতানি রাষ্ট্র ছিল
পুরোদস্তুর ধর্মাশ্রয়ী।
বিরুদ্ধ মত
সুলতানি রাষ্ট্রের
উপরোক্ত চরিত্রায়ণ আধুনিক ঐতিহাসিকদের অনেকেই মানেন না। ইস্তিয়াক হুসেন করেশী দেখিয়েছেন
শরিয়ত যে সবসময় গুরুত্ব পেয়েছে তা নয়। উলেমাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক
সংগঠন ছিল না, তারা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশও
নিত না। খলিফাদের প্রতি সুলতানের আনুগত্য ছিল নেহাতই আনুষ্ঠানিক। অভিজাতবর্গ ও সাধারণ মুসলমানের চোখে সুলতানের মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই
খলিফার স্বীকৃতিকে ব্যবহার করা হত। একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন এ. বি. এস.
হাবিবুল্লাহ। তাঁর মতে আপাতদৃষ্টিতে
সুলতানকে ইসলামীয় রাষ্ট্র বলে মনে হলেও বাস্তবে তা ছিল না। সুলতান রাজতন্ত্রের অ-ইসলামীয় চরিত্রটি খুব স্পষ্ট। বারানীর উক্তি উদ্ধৃত করে তিনি দেখিয়েছেন, অ-ইসলামীয় প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠান পালন না করলে
সার্বভৌমত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়।
বারানী
মন্তব্য করেছেন, রাজতন্ত্রের প্রধান উদ্দেশ্যই হল ক্ষমতা দখল, তা আইনের মাধ্যমেই হোক বা শক্তির দ্বারাই হোক। সেক্ষেত্রে সবসময় শরিয়ত মেনে
চলা সম্ভব নয়, মৃত্যুদণ্ড শরিয়ত
বিরোধী, কিন্তু সুলতানের পক্ষে এটি অপরিহার্য। একইভাবে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন হালাল ও হারামের মধ্যে কঠোর পার্থক্য প্রায়ই লঙ্ঘিত হত। উলেমারা বৃথাই প্রতিবাদ
করত।
আর্থিক লেনদেনে সুদ
গ্রহণ শরিয়ত বিরোধী কিন্তু তা উপেক্ষা করা হয়। বারানী কোনো এক সুলতানকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে শরিয়ত বিরোধী আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত নয়, তবে
দেখা উচিত আইনটি যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলবৎ না থাকে।
হাবিব উল্লাহের
মতে উলামাদের অধিকাংশই ছিল দৃষ্টিভঙ্গিতে বস্তুবাদী ও আচরণে সুবিধাভোগী। শরিয়তের নিয়মভঙ্গ করেও তারা
সুলতানের কার্যাবলী অনুমোদন করে যেতে থাকে। তারা সুলতানের
পালনীয় ধর্মীয় অনুশাসনগুলি সংক্ষিপ্ত করে দেয়। এইভাবে দেখা
যায় যে, সুলতান শরিয়তি অনুশাসনে আবদ্ধ ছিলেন না। সুলতানি সাম্রাজ্যে সুলতানই ছিলেন সর্বশক্তিমান। উলেমারা ছিল তাঁর অনুগামী ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সুলতানের সমর্থনে শরিয়তের ব্যাখ্যা করত। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুলতানি রাষ্ট্রকে ধর্মাশ্রয়ী বলা যায় কিনা এ বিষয়ে হাবিবউল্লাহ সন্দেহ প্রকাশ
করেছেন।
মূল্যায়ন : পরিশেষে, এ কথা বলা যায় যে আনুষ্ঠানিকভাবে সুলতানি
ছিল ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র। ইসলামীয় আইনের গুরুতর ব্যতিক্রম সুলতানগণ বরদাস্ত
করতেন না। উলেমারা উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হত, তাদের রাজস্বমুক্ত জমিদার করা হত। কিন্তু সুলতান কখনোই তাদের দ্বারা পরিচালিত হতেন না।
সুলতানগণ
সচেতন ছিলেন যে ভারতবর্ষের মতো দেশে যেখানে অমুসলমানগণ সংখ্যায় অনেক বেশি, সেখানে কঠোরভাবে ইসলামীয় আইন বলবৎ অবাস্তব ও অবিবেচনা প্রসুত। অতএব ইসলামীয় আইনের সঙ্গে ‘জাওয়াচিত’ বা সুলতানের নিজস্ব অনুশাসন সংযোজন করতে
হয়। সেই জন্যই সম্ভবত জিয়াউদ্দিন বারানী সুলতানি রাষ্ট্রকে প্রকৃত ইসলামী ও রাষ্ট্র বলেননি। তাঁর মতে সুলতানি পরিচালিত হত 'জাহানদারীর ভিত্তিতে অর্থাৎ রাষ্ট্রবিদদের চিন্তা ও বৈশয়িক
জ্ঞানের ভিত্তিতে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন