ভূমি রাজস্ব
ব্যবস্থা:
খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রায়
পুরোটাই তুর্কি সুলতানগঞ্জ প্রচলিত ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা কোন পরিবর্তন সাধন করেননি। হিন্দু রাই ও রায়ানগণ প্রদত্ত রাজস্বেই
তারা সন্তুষ্ট থাকতেন। কৃষকদের কাছ
থেকে খাজনা আদায়ের রীতিনীতি আগের মতই থাকে।
জিয়াউদ্দিন বারানীর রচনা থেকে জানা যায়
গিয়াস উদ্দিন বলবন তার পুত্র বুখরা খাঁনকে যথেচ্ছ খারাজ বা ভূমিরাজস্ব আদায় করে
কৃষকদের দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে না দিতে আবার সামান্য রাজস্ব আদায় করে তাদের ধনী
অবস্থায় রেখে বিদ্রোহের পথ প্রশস্ত না করারও পরামর্শ দিচ্ছেন।
সুলতানি শাসনের কোরানের নির্দেশে একজন
মুসলিম শাসক চার রকমের কর ধার্য করতে পারতেন। ভূমিকর ‘খারাজ’, লুণ্ঠিত
দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ ‘খামস’, অমুসলমানদের ওপর স্থাপিত কর ‘জিজিয়া’ এবং ধনী
মুসলমানদের দেয় আয়ের অংশ ‘জাকাত’।
আলাউদ্দিন খলজি: জিয়াউদ্দিন বারণিক রচনা
থেকে আলাউদ্দিন খলজির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। দিল্লির সুলতানদের মধ্যে তিনিই প্রথম যিনি ব্যাপক
জমি জরিপ করে ও উৎপন্ন সর্ষের হিসাব প্রস্তুত করে জমির মোট উৎপাদন নির্ধারণ করেন। আলাউদ্দিনের রাজস্ব মন্ত্রী শরাফ কাইনি সুলতানি
রাজ্যের সমস্ত কৃষি পণ্যের পৃথক হিসাব করেন।
আলাউদ্দিন খলজি ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সব
কৃষকের ওপর তিন ধরনের পর ধার্য করেন। এগুলি
হল খারাজ বা ভূমি রাজস্ব, চরাই বা গবাদি পশু কর, ঘরি বা
গৃহকর, উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ ভূমি রাজস্ব
হিসেবে ভাজ্য হত। দোয়াক অঞ্চলে
নগদ টাকায় ও অন্যত্র শস্যের মাধ্যমে রাজস্ব দিতে হত। জিয়াউদ্দিন বারানি দেখিয়েছেন যে পাঞ্জাব ও
রাজস্থান থেকে বর্তমান উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা কার্যকরী হয়েছিল। খুৎ, মুকদ্দম চৌধুরীর মত সাবেকি
রাজস্ব আদায়কারীর স্থলে রাজস্ব আদায়ের জন্য তিনি মুহাশিল, আমিল,
গোমস্তা, মুতাসরিফ, কারকুন
ও পাটোয়ারীর মতো বহু সংখ্যক কর্মচারী নিযুক্ত করেন।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক পুনরায় খুৎ ও
মুকদ্দমদের মাধ্যমে ভূমি রাজস্ব আদায়ের প্রথা চালু করেন। তিনি তাদের ভূমি রাজস্ব থেকে অব্যাহতি দেন। তবে বাড়তি কর কিসমৎ আপনের অধিকার ফিরিয়ে দেননি।
কৃষকদের ওপর ধার্য অতিরিক্ত কর
প্রত্যাহার করে নেন গিয়াজউদ্দিন তুঘলক। ভূমি
রাজস্ব দাবি হ্রাস করে উৎপাদনের এক দশমিকংশ করা হয়। অনাবাদি জমিকে নিষ্কর করা হয়। খালিফা জমি অর্থাৎ
সুলতানের খাস জমির যে ইক্তা ছিল সেখানে সুলতান হঠাৎ বহুগুণ রাজস্ব বৃদ্ধিতে আপত্তি
করেন। তিনি ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে রাজস্ব
বৃদ্ধির পক্ষপাতী ছিলেন। তা না হলে
কৃষকের অবস্থা খারাপ হবে, অগ্রগতির পথ ও
রুদ্ধ হবে। মহম্মদ বিন
তুঘলক খারাজ, চরাই, ঘরি
কঠোরভাবে আদায় করা শুরু করেন। এর
জন্য আবওয়াব বা বাড়তি কর চাপান, কারণ যুদ্ধবিগ্রহ ও বিদ্রোহ দমনে
রাজকোষ শূন্য হয়েছিল।
মহম্মদ বিন তুঘলক: কৃষকদের
প্রকৃত উৎপাদনের হিসাব না করে সরকারি গড় উৎপাদন ও সরকারি মূল্যমানের ভিত্তিতে
রাজস্ব নির্ধারণ করা হত। ফলে কৃষকদের
ওপর রাজস্বের চাপ ছিল অত্যধিক। এর ফলে
সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দোয়াবের বিদ্রোহ। জিয়াউদ্দিন বারানির রচনায় এই বিদ্রোহের বিশদ
বর্ণনা পাওয়া যায়। বিদ্রোহের ফলে
কৃষিকার্য বন্ধ হয়, সুলতানি সেনার অত্যাচারে বিদ্রোহী
কৃষকেরা শস্য ধ্বংস করে অরণ্যে পালিয়ে যায়। বহু খুৎ ও মুকদ্দম নিহত হয়,
কৃষকদেরও হত্যা করা হয়। বিদ্রোহ সম্ভবত
১৩২৬-২৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হলেও ১৩৪২
খ্রিস্টাব্দে কোল বা বর্তমান আলিগড় অঞ্চলে বিদ্রোহীদের অস্তিত্ব ছিল।
কৃষক বিদ্রোহ ও কৃষিকার্যের ক্ষতির সঙ্গে
যুক্ত হয় অনাবৃষ্টি। ফলে ১৩৩৫
খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে
দুর্ভিক্ষ চলে। এই পরিস্থিতিতে
মহম্মদ বিন তুঘলক কৃষি উন্নয়নের জন্য কিছু ব্যবস্থা নেন। এর ফলে উল্লেখযোগ্য কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা হয়। এই
দিনের সাহায্যে কুক্ষন ও কৃষি সম্প্রসারণের কাজে হাত দেওয়া হয়। কারণ এর সঙ্গে যুক্ত সরকারি আম্লাদের স্থানীয়
অবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ছিল না ও সুলতানি অর্থের অধিকাংশই তারা আত্মসাৎ করে।
ফিরোজ শাহ তুঘলক: ফিরোজ
শাহ তুঘলকের শাসনকালে গ্রামীণ সমৃদ্ধি ফিরে আসে। বারানি ও আফিফ উভয়েরই রচনা থেকে জানা যায় যে, এই
সময়ে কৃষির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। দোয়াক
অঞ্চলে একটি গ্রাম ও ছিল না যেখানে কৃষিকাজ্য হত না। সাধারণ কৃষকের অবস্থার উন্নতি হয়। ফিরোজ তুঘলক কোরান নির্ধারিত মাত্র চারটি কর ধার্য
করেন। অন্যান্য পরগুলি তিনি প্রত্যাহার করে নেন। তবে সেচ জমিতে উৎপন্ন ফসলের ওপর সার্চ বা উৎপাদনের
এক দশমাংশ কর ধার্য করা হয়। সুলতান
ব্যাপক জমি জরিপের ও ব্যবস্থা করেন।
ফিরোজপুর ব্লকের পরবর্তীকালে দিল্লি
সুলতানের রাজস্ব ও ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। সম্ভবত ভূমি ও রাজস্ব ব্যবস্থায় বিশেষ কোনো
কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেনি। সুলতানি যুগের
শেষ দিকে বিশেষ করে নদীদের আমলে নগদ অর্থের পরিবর্তে উৎপন্ন শস্যের একাংশ
রাষ্ট্রীয় কর দেওয়া হত। জিনিসপত্রের
বিশেষ করে কৃষিজ পণ্যের দাম খুব নেমে গিয়েছিল। পৃথিবীব্যাপী রুপোর দুষ্প্রাপ্যতা ছিল এর কারণ। বহলুল লোদীর আমলে একটা রুপোর টাকা দিয়ে ১০ মন
খাদ্যশস্য কেনা যেত। সুলতান
ইব্রাহিম লোদী কৃষকদের অবস্থা অনুভব করে উৎপন্ন শস্যে রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ দেন।
আমেরিকার রূপ্য ভান্ডার ইউরোপ হয়ে ভারতে
এসে পৌঁছালে ভারতে আবার কৃষিজ পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। শেরশাহ ও আকবরের শাসনকালে মুদ্রা নির্ভর অর্থনীতির
প্রচলন হয়। নগদ মুদ্রায়
রাজস্ব আদায়ের কাজ চলতে থাকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন