ভারতীয়
কৃষি অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক শ্রেণী হল জমিদার। আবুল ফজল ‘জমিদার’ ও ‘বুমি‘ শব্দ
দুটি সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ফরাসি বুম এর
অর্থ হল জমি, অর্থাৎ জমির মালিকই হলেন বুমি। একইভাবে ফরাসি শব্দ জমিদার এর অর্থ হল যার জমি আছে। মুঘল আমলে রাজস্ব সংক্রান্ত দলিলে জমিদার শব্দটির সঙ্গে মালেক শব্দটির
ব্যবহার দেখা যায়, যার অর্থ হল সম্পত্তির অধিকারী।
জমিদারি
কথাটি দুই ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এক মিলকিয়াতৎ এর (মালিকের
অধিকার) বিশেষ রূপ হচ্ছে জমিদারি। দুই জমির উপর সব রকমের মিলকিয়াৎ এর অধিকার এর কথা জমিদারি
শব্দের মধ্যে ব্যক্ত আছে। আনন্দরাম মুখলিস লিখেছেন জমিদারের অর্থ
হলো এমন লোক যে জমির কর্তা (সাহির ই জামিন)। কিন্তু বর্তমানে যে লোক গ্রাম বা শহরের জমির অধিকারী এবং
কৃষি কাজে নিয়োজিত তাকেই জমিদার বলা হয়। অর্থাৎ
কেবল জমি থাকলেই কেউ জমিদার হয় না, যদি বিভিন্ন লোকের দখলিকৃত জমির
ওপর কারুর ব্যাপক অধিকার থাকে সেই-ই হচ্ছে জমিদার।
খাজা
ইয়াসিন লিখেছেন, “জমিদারের বিভিন্ন অধিকার হলো মালিকানা, নানকর, সির, যৌথ ইত্যাদি। অর্থাৎ জমিদারির সঙ্গে বিশেষ কতগুলি দাবি সংশ্লিষ্ট এবং
সেগুলি বিশেষ একটি শ্রেণীর হাতে করায়ত্ত। এই
শ্রেণীটি কৃষকদের থেকে স্বতন্ত্র এবং কৃষকদের উপরেই তাদের বিশেষ দাবিগুলি প্রয়োগ
করে।
জমিদারদের
অধিকার ও ভূমিকার প্রশ্নে যাওয়ার আগে মুঘল যুগে জমিদারদের স্তরবিন্যাসের দিকটি
একটু আলোকপাত করে নেওয়া দরকার। নোয়াম
আহম্মদ সিদ্দিকী মুঘল যুগের জমিদারদের দু ভাগে ভাগ করেছেন – পেশকোশী
ও মালগুজারী। নুরুল হাসান ও ইরফান হাবিব
জমিদারদের তিন ভাগে ভাগ করেছেন যথা,- ওয়আতন, মধ্যস্বত্বভোগী
ও প্রাথমিক মালগুজারী। গৌতম ভদ্র ও তিন শ্রেণীর জমিদারের কথা
উল্লেখ করেছেন, যথা- ভূম্যধিকারী
যারা স্থানীয়ভাবে স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী, অন্তবর্তী
জমিদার এবং প্রাথমিক শ্রেণীর ক্ষুদে জমিদার। তিনি
আরো বলেছেন বহু ক্ষেত্রেই তিনটি স্তরের মধ্যে সংমিশ্রণ ও সংযোগ ছিল।
ভূম্যধিকারী
ওয়াতন শ্রেণীর জমিদাররা হলেন স্থানীয়ভাবে স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী সামন্ত রাজা। এদের (কিলাচা) দুর্গ এবং সৈন্যবাহিনী ছিল। আকবর শাহী দরবারে উচ্চ পথ বা মসনদ দিয়ে এই সকল ‘রাজা’, ‘রানা’, ‘রায়’
উপাধিধারী জমিদারদের মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করে নেন। অনেক সময় উত্তরাধিকার প্রশ্নে হস্তক্ষেপ
করে সম্রাটরা তাদের উচ্চতর ক্ষমতা কায়েম করার চেষ্টা করেন। জাহাঙ্গীর বিকানিদের রাজার মৃত্যুর পর ছোট ছেলের দাবিকে নাকচ করে বড়
ছেলেকেই রাজা হিসেবে স্বীকার করেছেন। আবার অনেক সময় এই সমস্ত রাজাদের অধীনস্থ সর্দারদের সঙ্গে সম্পর্ক
স্থাপন করে তাদের উচ্চতর মনসব দেওয়া হয়েছে। মারওয়াড়ের দুর্গা দাসের দৃষ্টান্ত এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা
যেতে পারে। এই সমস্ত সামন্ত রাজাদের অধিকাংশই ছিলেন
পেশকশী জমিদার অর্থাৎ এদের ক্ষেত্রে অন্যান্য মালগুজারী জমিদারদের মত জমি জরিপ করে
রাজস্ব নির্ধারণ করতে হতো না। একটি
নির্দিষ্ট পরিমাণ পেশকাশ বা রাজস্ব এরা রাজকোষে জমা দিতেন। তা সত্ত্বেও বহু
ক্ষেত্রেই মুঘল সম্রাটরা এদের জমিদারি অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্কে নানা রকম
তথ্য সংগ্রহ করে বহু পেশকশী জমিদারকে মালগুজারী জমিদারের রূপান্তরিত করেন (যেমন বীরভূমের রাজা)। ব্যবসা-বাণিজ্যের কিছু বিধি-নিষেধ মেনে চলা ছাড়া এই
পেসকোষী জমিদাররা মোটামুটিভাবে স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং মুঘল
রাষ্ট্রশক্তির প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে নিয়ে নিজস্ব ওয়াতন জায়গীরের উদ্বৃত্ত
সম্পদের ওপর এদের ক্ষমতা ছিল নিরঙ্কুশ। ওয়াতন সারদাররা অনেক সময় সম্রাটকে সৈন্যবাহিনী দিয়ে সাহায্য করত। পোয়াতুন সর্দার শাসিত অঞ্চলে কৃষকেরা অপেক্ষাকৃত সরল ছিল বার্নিয়ে
এই মত অধুনা পরিত্যক্ত হয়েছে।
ওয়াতান
জমিদার এবং প্রাথমিক স্তরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান ছিল মধ্যবর্তী বা
মধ্যস্বত্তভোগী জমিদারদের। এরা প্রাথমিক
জমিদার ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটি যোগসূত্র রচনা করেন। অনেক সময়ই কোন বিশেষ জমিদারকে বেছে নেওয়া হতো যারা নিজের জমিদারি
ছাড়াও অন্যান্য জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করে জায়গীরদারদের হাতে তুলে
দিতেন। এদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এই যে এই অধিকারের
সঙ্গে জমির উপর কোন স্বতন্ত্র অধিকার বা স্বত্বর সম্পর্ক জড়িত ছিল না। এর সঙ্গে জড়িত ছিল সেবার সম্পর্ক, কাজের
সম্পর্ক মধ্যযুগীয় দলিলে যাকে বলা হত খিদমত। এই খিদমৎগুজারি জমিদাররা রাজস্ব সংগ্রহ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়
রাষ্ট্রকে সাহায্য করতেন। এর বদলে তারা নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা
ভোগ করতো ও উদ্বৃত্ত সম্পদের একাংশ ভোগ করতো। চৌধুরী, মুখিয়া, মুকাদ্দম, কানুনগো, দেশমুখ, দেশাই, দেশপান্ডে,
তালুকদার ইত্যাদি নামে এই শ্রেণীকে অভিহিত করা হতো।
গ্রামের
প্রাথমিক জমিদারদের মধ্য থেকেই মুখিয়া বা মুকাদ্দম নিযুক্ত হতো। পরগনার ভিত্তিতে নির্বাচিত হতো চৌধুরী। কানুনগোর কাজ ছিল জমি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও তার রক্ষণাবেক্ষণ ও জমি
জরিপে সহায়তা করা। দাক্ষিণাত্য
ের চৌধুরী ও মুকাদ্দম এর অধিকাংশকেই দেশমুখ বা দেশপান্ডে বলে স্বীকার করা হয়। বাংলার তালুকদার হল সেই সব ভূম্যধিকারী যারা জমিদারদের মাধ্যমে
সরকারকে রাজস্ব দিত। আবার অযোধ্যার তালুকদার বলা হত তাদেরকে
যারা অন্য জমিদারের হয়ে সরকারকে খাজনা দিত। এই সকল
জমিদাররা সেবার বদলে নিজেদের রাজস্ব থেকে ছাড় আবওয়াবের অংশ নিস্কর জমি ইত্যাদি
অধিকার বংশানুক্রমিকভাবে ভোগ দখল করতে পারত। যদিও
রাষ্ট্র ইচ্ছা করলেই এদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারতো। ত্রিবেনীর তীর্থযাত্রীদের ওপর হামলা করার অপরাধে আকবর এলাহাবাদের
চৌধুরীকে বরখাস্ত করেছিলেন। আবার অনেক সময়
মুঘল সম্রাটরা এই ধরনের জমিদারিও সৃষ্টি করেছেন। আকবর আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ত্রিভুতে গোপাল দাসকে চৌধুরী ও
কানুনগোর অধিকার দেন। এর ফলে
দ্বারভাঙ্গার রাজবংশের জন্ম হয়। সুতরাং মধ্যস্বত্বভোগী
জমিদাররা এই জাতীয় অধিকারের জন্য মুঘল রাষ্ট্রশক্তির ওপরেই নির্ভরশীল ছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন