সাধারণভাবে
ভারতবর্ষ তার তিন দিকেই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিরাপত্তা দ্বারা বেষ্টিত। কিন্তু উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কয়েকটি গিরিপথ প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের
শান্তি ও স্থায়ী নিরাপত্তার পথে বাধাদান করেছে। প্রাচীনকালে শক-হূন প্রভৃতি
জাতি উত্তর পশ্চিমের সীমান্ত পথে ভারত আক্রমণ করে এদেশে প্রবেশ করেছে এবং কালক্রমে
ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে মিশে গেছে। কাবুল, গজনী ও কান্দাহার অঞ্চল উত্তর-পশ্চিম
সীমান্ত পথ ধরে ভারতে ঢোকার পথ নিয়ন্ত্রণ করত। সেই কারণে তুর্কি অনুপ্রবেশকারীরা খুব সহজে ভারতের সীমান্ত দেশ দখল
করতে সক্ষম হয়েছিল। আবার এই কারণে ই বিচক্ষণ ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতে ক্ষমতা দখলের
পর কাবুল-কান্দাহার-গজনী
লাইনকে ‘ভারতের বিভাজন সম্মত সীমানা’ বলেই
গ্রহণ করেছেন। যাইহোক
দিল্লি সুলতানরা (তুর্কো আফগান শাসকেরা) এই
সীমান্ত পথের গুরুত্ব ও সমস্যা দুইই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই প্রথম থেকেই
দিল্লির সুলতানের এই সীমান্ত পথকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়াসী ছিলেন।
মহম্মদ
ঘুরী গজনী ও সন্নিহিত অঞ্চল থেকে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিলেন। স্বভাবতই উত্তর-পশ্চিমের গিরিপথ দিয়ে ঘুরী যোদ্ধারা সহজেই
ভারতের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পেরেছিল।
দিল্লির প্রথম তুর্কি সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবক এই সীমান্ত পথের গুরুত্ব সম্পর্কে
সম্যক সচেতন ছিলেন। তাই মহম্মদ ঘুরীর মৃত্যুর পর গজনী দখল করে দিল্লি সুলতানির
নিরাপত্তা ও নিজের রাজ্যসীমা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন। ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন গজনী দখল
করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সমস্যার সাময়িক ছেদ টানতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এই সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যেই গজনীর শাসক তাজউদ্দিন ইলদুজ কুতুবউদ্দিনকে গজনী থেকে
বিতাড়িত করেন।
মোঙ্গল
আক্রমণ: সুলতানি সাম্রাজ্যের সূচনা কাল থেকেই
ভারতে মোঙ্গল আক্রমণের ঝাঁঝ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তবে ইলতুৎমিসের সময় সম্ভাব্য মোঙ্গল আক্রমণের ভয়ে রাজত্বের শুরুতে
তাকে কিছুটা উদ্বিগ্ন থাকতে হয় (১২১৬-১২১৭)। জালালউদ্দিন মঙ্গাবর্নীকে খার্গভের শেষ সুলতান, মোঙ্গল
নেতা চেঙ্গিস খাঁন কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে পাঞ্জাবে সাময়িক আশ্রয় নেন ও ইলতুৎমিসের
কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় ভিক্ষা করেন। মঙ্গাবর্নীকে অনুসরণ করে মোঙ্গলগণ সিন্ধু
পর্যন্ত অগ্রসর হলে সুচতুর ইলতুৎমিস বিনীতভাবে মঙ্গাবর্নীকে রাজনৈতিক আশ্রয়দানের
প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ভগ্ন মনোরথ
মঙ্গাবর্নী খোক্কর উপজাতির সহায়তায় সিন্ধুর শাসক নাসিরউদ্দিন কুবাচাকে পরাস্ত
করে পারস্যে পলায়ন করেন। মোঙ্গলদের বড় অংশই খার্গভ শাহকে অনুসরণ
করে ভারত ছেড়ে চলে যায়। এইভাবে ইলতুৎমিসের বিচক্ষণতায় সুলতানি
সাম্রাজ্য রক্ষা পায়।
নাসিরুদ্দিন
মাহমুদ শাহ: নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের মন্ত্রী উলুখ খানের (বলবন)
উদ্যোগে মোঙ্গলদের সঙ্গে দিল্লি সুলতানের এক সমঝোতা হয়। ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল নেতা হলাগুর প্রতিনিধি দিল্লিতে
উপস্থিত হলে তাকে সাড়ম্বরে অভ্যর্থনা জানানো হয়। সমঝোতায় স্থির হয় যে, মোঙ্গলরা
বিতস্তা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত তাদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ রাখবে।
গিয়াসউদ্দিন
বলবন: মোঙ্গল আক্রমণের ফলে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তা এই সময় বিঘ্নিত হয়। ইতিপূর্বে নাসিরুদ্দিন মাহমুদের শাসনকালে বলবনের উদ্যোগে মোঙ্গলদের
সঙ্গে দিল্লির সুলতানের এক সমঝোতা হয়েছিল। এরপর মোঙ্গলরা
পাঞ্জাব ও সিন্ধুর দিকে অগ্রসর হলে বলবন সীমান্ত রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠেন। পুরোনো দুর্গের সংস্কার সাধন করা হয় ও নতুন দুর্গ নির্মিত হয়। সীমান্ত অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করে দুই শাহজাদা মুহম্মদ ও বুখরা খানের
অধীনে ন্যস্ত করা হয়। সমান শক্তি সম্পন্ন এক সংরক্ষিত বাহিনী দিল্লিতে মোতায়েন
করা হয়, প্রয়োজনে তারা যাতে সীমান্তে পৌঁছতে পারে। ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলদের পাঞ্জাব
দখলের চেষ্টা প্রতিহত করা হয়। ১২৮৫
খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধ করা গেলেও শাহজাদা মুহম্মদ নিহত হন। কিছুদিনের জন্য অন্তত ভারত মোঙ্গলদের হাত থেকে রক্ষা পায়।
জালালউদ্দিন
ফিরোজ খলজী: ১২৯২ তে
দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা হলাগুর পৌত্র আবদুল্লার নেতৃত্বে এক বিশাল মোঙ্গলবাহিনী
সিন্ধু নদ অতিক্রম করে সুনাম পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সুলতানি বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়ে তারা
সন্ধি করতে বাধ্য হয়। ভবিষ্যতে পুনরায় মোঙ্গল আক্রমণের
সম্ভাবনা নির্মূল করার উদ্দেশ্যে জালাল উদ্দিন তাদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনে আগ্রহী
ছিলেন। অধিকাংশ মোঙ্গল
স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেও চেঙ্গিস খাঁর জনৈক বংশধর উলুখ খান তার বিশাল
অনুগামীদের নিয়ে দিল্লি শহরের উপকণ্ঠে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেন। সুলতানের উৎসাহে তারা ইসলাম ধর্মে
ধর্মান্তরিত হয় এবং ‘নবমুসলমান’ নামে
পরিচিত হয়। ভবিষ্যতে তারা আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
আলাউদ্দিন
খলজী: ১২৯৬ থেকে ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত
আলাউদ্দিন খলজীকে ভয়াবহ মোঙ্গল আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাঁর সময়ে মোঙ্গলদের উদ্দেশ্য শুধু লুণ্ঠন ছিল না, তারা
এখন নির্দিষ্ট ভূভাগ অধিকার করতে চায়। আলাউদ্দিন বলবনের রক্ষণাত্মক নীতি বর্জন করে আক্রমণাত্মক নীতি অনুসরণ
করেন। প্রথমদিকে তিনি ও বলবনের মত সীমান্তবর্তী পুরোনো
দুর্গগুলির সংস্কার সাধন করেন। সামানা ও দীপালপুরের মতো সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে
প্রয়োজনমতো সেনা নিয়োগ করা হয়। আলাউদ্দিন জাফর খানের মত দক্ষ সেনাপতিকে উপদ্রুত অঞ্চলে নিযুক্ত করেন। গাজী মালিককে (পরবর্তীকাল-গিয়াসউদ্দিন
তুঘলক) পাঞ্জাবের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।
আলাউদ্দিন
সিংহাসনে আরোহণের কয়েক মাসের মধ্যেই এক বিশাল মোঙ্গলবাহিনী ভারত আক্রমণ করে। জলন্ধরের কাছে জাফর খান তাদের প্রতিরোধ
করেন। পরের বছর ও অনুরূপ এক আক্রমণ প্রতিহত করা হয়। ১২৯৯ এ কুতলুখাজার নেতৃত্বে মোঙ্গলরা দিল্লির কাছে এসে পৌঁছলে এক
ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। মোঙ্গলরা
পশ্চাদপথরণ করে কিন্তু জাফর খান নিহত হয়। ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে আলী বেগ ও খাজা তাশের
নেতৃত্বে মোঙ্গল আক্রমণ প্রচুর ক্ষয়ক্ষতিসহ ব্যর্থ করে দেওয়া হয়। ১৩০৭-১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে ইকবালমন্দের আক্রমণও
প্রতিহত করা হয় ও তিনি নিহত হন।
পরমাত্মা
শরনের মত ঐতিহাসিক অবশ্য মন্তব্য করেছেন, মোঙ্গলরা
দিল্লি পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আলাউদ্দিন মোঙ্গল সমস্যা সম্পর্কে
সচেতন ছিলেন না। তাছাড়া
সেনাপতি জাফর খানের সাফল্য ও ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় সুলতান ঈর্ষান্বিত হয়ে
তাকে প্রয়োজনমত সাহায্য পাঠাননি। এতো সত্ত্বেও
বলা যায় আলাউদ্দিনের বলিষ্ঠ নীতির জন্য উত্তর ভারত এক দুঃস্বপ্নের হাত থেকে রেহাই
পায়।
গিয়াসউদ্দিন
তুঘলক: ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে একটি মোঙ্গল আক্রমণ
সুলতানি বাহিনী সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করে।
মহম্মদ
বিন তুঘলক: মহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনকালে ১৩২৭-২৮ খ্রিস্টাব্দে
তরমাশিরীনের নেতৃত্বে এক মোঙ্গল বাহিনী পাঞ্জাব জয় করে দিল্লির উপকণ্ঠে এসে
পৌঁছয়। শিরহিন্দি ও
বদায়ুনীর মতে মোঙ্গল নেতা সুলতানি বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়ে ভারত ত্যাগ করেন। কিন্তু ফেরিস্তার বিবরণ থেকে জানা যায়
যে, সুলতান প্রচুর ধনরত্ন উপঢৌকন দিয়ে ভারত ত্যাগে তরমাশিরীনকে
সম্মত করান। প্রকৃত
ঘটনা যাই হোক মোঙ্গল আক্রমণ সুলতানি সাম্রাজ্যের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
তৈমুর
লঙের ভারত আক্রমণ: ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের গোড়ায় তৈমুর লঙের পৌত্র
পীর মহম্মদ সসৈন্যে ভারতের প্রবেশ করে মুলতান দখল করে নেন। সেই বছরই তৈমুর লঙ সিন্ধু, ঝিলাম ও
রাভী নদী অতিক্রম করে দীপালপুর ও ভাতনের অঞ্চলে লুণ্ঠন ও নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়ে
দিল্লির উপকন্ঠে এসে পৌঁছন। তুঘলকবংশীয় সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ ও তার মন্ত্রী মল্লু ইকবাল
বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে তৈমুরকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেও সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত
হন, তৈমুর দিল্লি অধিকার করেন। সুলতান গুজরাটে ও মন্ত্রী বারণ প্রদেশে পলায়ন করেন। মোঙ্গল সৈন্যবাহিনী দিল্লিতে অবর্ণনীয়
অত্যাচার ও লুণ্ঠন চালায়। এর ফলে
লক্ষাধিক মানুষ মারা যায় ও দিল্লি নগরী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। তৈমুর ভারত জয়ের লক্ষ্যে এদেশে আসেননি, ১৫ দিন
অবস্থানের পর তিনি দিল্লি ত্যাগ করেন। তার আত্মজীবনী (মালফুজাত -ই-তিমুরি) থেকে
জানা যায় অসংখ্য নারী, পুরুষ ও শিশুকে বন্দী করে নিয়ে
যাওয়া হয়, প্রচুর পরিমাণে মূল্যবান মণিমুক্তা ও
সঙ্গে যায়। সৈয়দ উলেমা অন্যান্য মুসলিমদের
বাসস্থান ছাড়া সমগ্র দিল্লি শহরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ফেরার পথে তিনি মিরাট হরিদ্বার ও জম্বু শহর লুঠ করেন। ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে মুলতানের পূর্বতন শাসক সৈয়দ বংশীয় খিজির খানকে
মুলতান, লাহোর ও দীপালপুরের দায়িত্ব অর্পণ করে
তৈমুর ভারত ত্যাগ করেন।
মোঙ্গল আক্রমণের
ফলাফল: মোঙ্গলরা ছিল স্বভাবে হিংস্র ও রক্ত
পিপাসু। স্বভাবতই ভারতের বিরুদ্ধে মোঙ্গল অভিযানগুলির
একমাত্র ফল ছিল ভারতের অসংখ্য নিরীহ প্রাণের বিনাশ ও সম্পদের লুণ্ঠন। ঐতিহাসিক এ এল শ্রীবাস্তব এই সহজ সরল
ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করে রক্তপিপাসু মোঙ্গলদের আক্রমণের মধ্যে একটা শুভ সম্ভাবনার
আভাস দেখেছেন। ‘The sultanate of
Delhi’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন যে, মোঙ্গলরা ভারতের উপর রাজনৈতিক
কর্তৃত্ব পেলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় থেকে ভারতবর্ষ রক্ষা পেত। তাঁর মতে মোঙ্গলরা সফল হলে দিল্লির
সুলতানের পতন ঘটত এবং যেহেতু মোঙ্গলরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল, তাই
তারাও গ্রীক, হূন বা শকদের মত একদিন ভারতীয় সংস্কৃতি
গ্রহণ করে এদেশের সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যেত।
শ্রীবাস্তবের
এই মূল্যায়ন কষ্ট কল্পনা মাত্র। কারণ মোঙ্গলদের
মধ্যে যে সহিষ্ণুতা ও সমন্বয়ী আদর্শের একান্ত অভাব ছিল তা অধ্যাপক শ্রীবাস্তব তাঁর
বিবেচনার মধ্যে রাখেননি। মধ্য
এশিয়ার সুসজ্জিত নগরী ও জনপদগুলি আক্রমণ করে মোঙ্গলরা যে নিষ্ঠুরতা চালিয়েছিল, তার
পরিনামে আশ্রয়ের সন্ধানে দলে দলে মানুষ ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। দিল্লি দখল করলেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়।
মঙ্গলদের
জীবন দর্শন সম্পর্কে মাইকেল প্রাউডিন ‘The Mungol Empire : it, ripe
and fall ‘গ্রন্থে যে তথ্য দিয়েছেন তা লক্ষ্যণীয়। চেঙ্গিস খাঁর মতে মানুষের জীবনের সর্বাধিক আনন্দ হল: “…
শত্রুদের জয় করা ও তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া। তাদের
ঘোড়ায় আরোহন করা ও সম্পদ লুট করা, তাদের প্রিয়জনদের চোখের জলে ভরা
মুখ দেখা এবং তাদের স্ত্রী কন্যাদের নিজ বাহুবন্ধনে জড়ানো।”
মোঙ্গল আক্রমণের
ভীতি দিল্লির সুলতানদের সদা বিব্রত রেখেছিল। এর ফলে
সীমান্ত নিরাপত্তা বিধানে ব্যায়িত হয়েছিল প্রভূত সম্পদ, শক্তি ও সময়। তবে মোঙ্গলদের উত্থান পরোক্ষভাবে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে
গুরুতর পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। মধ্য এশিয়ার মোঙ্গলদের উত্থান ও ক্ষমতা দখলের ফলে সেখানকার রাজ্যগুলি
থেকে বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি ও ভাগ্যান্বেষী সৈনিক দিল্লিতে চলে এসেছিলেন -এদের
আক্রমণে দিল্লির তুর্কি অধ্যুষিত রাজনীতিতে অস্থিরতা দেখা দেয়। খলজীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষাপটে মধ্য এশিয়ার মোঙ্গল
আক্রমণের গুরুত্ব বিবেচনা করা অ-প্রাসঙ্গিক নয়।
উত্তর-পশ্চিম
সীমান্ত রেখার সংকোচন ও প্রসারণ:
ইলতুৎমিসের
আমলে মোঙ্গলরা ভারত না আক্রমণ করলেও সিন্ধুর উত্তর তীরে মোঙ্গলরা বেশ সক্রিয় ছিল। ফলে দিল্লির প্রকৃত নিরাপদ সীমা সিন্দুর আরো কিছুটা পূর্বে লাহোর
মুলতান বরাবর সরে এসেছিল। সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদের শাসনকালে
হলাগুর সাথে যে সমঝতা হয় তাতে মোঙ্গলরা বিতস্তা নদীর তীর পর্যন্ত তাদের কার্যকলাপ
সীমাবদ্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। সুলতান বলবনের আমলের প্রথমদিকে মোঙ্গল কার্যকলাপে সীমান্ত রেখা, ঝিলাম
নদী থেকে বিপাশা পর্যন্ত পিছিয়ে আসে।
মোঙ্গল নীতিতে
মৌলিক পরিবর্তন: ১২৪১ খ্রিস্টাব্দ থেকে মোঙ্গলদের ভারত
নীতিতে ও মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। এত কাল পর্যন্ত
মোঙ্গলরা দিল্লি সুলতানের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও সার্বভৌম অধিকারকে মর্যাদা
দিয়েছিল। দিল্লির
সীমান্ত প্রদেশে তাদের সামরিক কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু এখন থেকে মোঙ্গলরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত আক্রমণ করে দিল্লির
সুলতানের অধীনস্থ অঞ্চল আক্রমণ ও লুণ্ঠন করতে থাকে।
মোঙ্গল
আক্রমণ ও আলাউদ্দিনের রাষ্ট্রনীতিতে তার প্রভাব:
মোঙ্গল
আক্রমণের সম্ভাব্যতা ও ভীতি দ্বারা আলাউদ্দিনের রাষ্ট্রনীতি গভীরভাবে প্রভাবিত
হয়েছিল। যেমন এক,-মোঙ্গল
আক্রমণ প্রতিহত করতে আলাউদ্দিন বিশাল সংখ্যক ও শক্তিশালী একটি সামরিক বাহিনী গড়ে
তুলতে বাধ্য করেছিলেন। এই বাহিনীর দ্বারা উত্তর - দক্ষিণ
ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজ সহজ হয়।
দুই,- বিশাল
বাহিনীর সামরিক ব্যয় মেটানোর জন্য প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত অর্থের। এজন্য তিনি
রাজস্ব ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করেন। নতুন নতুন কর
আরোপ করে এবং প্রচলিত করের হার বৃদ্ধি করে রাজকোষকে স্ফীত করতে বাধ্য হন। তিন,- সেনাবাহিনীর
জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দাম তিনি নির্দিষ্ট
করে দেন।
চার,- মোঙ্গলদের
বিরুদ্ধে আলাউদ্দিনের ধারাবাহিক সাফল্য তাঁর মর্যাদা ও প্রতিপত্তি দারুণভাবে
বৃদ্ধি করে। পরাজিত মোঙ্গল সেনাদের নিশংসভাবে হত্যা
করে এবং তাদের স্ত্রী পুত্রদের দাস হিসেবে বিক্রি করে আলাউদ্দিন জনমনে সুলতান
সম্পর্কে একটা ভীতির ভাব গড়ে দেন, যার ফলে
সুলতানের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের আন্দোলনের সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
পাঁচ,- সর্বোপরি
মঙ্গল আক্রমণ রোধ এবং সাম্রাজ্যবাদী কর্মসূচি রূপায়ণকে সুলতান পরিস্থিতির
প্রেক্ষিতে গুরুত্ব দেন। যদিও জনগণের বৈষয়িক উন্নয়নের
দিকটি তাতে অবহেলিত হয়।
মনে
রাখা দরকার যে আলাউদ্দিনের পূর্ববর্তী দিল্লির সুলতানরা মোঙ্গল আক্রমণের বিরুদ্ধে
কূটনৈতিক দিক অবলম্বনে রক্ষণাত্মক নীতি গ্রহণ করেন, কিন্তু
আলাউদ্দিন প্রথম আক্রমণাত্মক মঙ্গল নীতি অনুসরণ করেন।
সুলতান
মাসুদ শাহ ১২৪২ ৪৬ মোঙ্গলিয়া ও চীনের মোঙ্গল শাসক মাংগু খাঁর বশ্যতা স্বীকার করে স্থিতাবস্থা
বজায় রাখেন।
তৈমুরের
আত্মজীবনীর নাম মিলফুজাত -ই- তৈমুরি।
সুলতানি
অর্থনীতির নানা দিক
সুলতানি
আমলের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য: ভারতীয়
অর্থনীতির ওপর তুর্কি শাসনের ফল কি হয়েছিল এ প্রশ্নে ঐতিহাসিক মহলে মতপার্থক্য
আছে।
ঐতিহাসিক
ডি ডি কোশাম্বি তাঁর “An Introduction to the Study of Indian History” গ্রন্থে
মন্তব্য করেন যে, ইসলামী আক্রমণকারীরা একটি পরিবর্তন
এনেছিল, তবে ভারতে বর্তমান সামন্ততন্ত্রের
উপাদান গুলিকে অধিকতর সক্রিয় করার বেশি নতুন কিছু ছিল না।
লালনজী গোপাল
এর মতভুক্ত একদল ঐতিহাসিক মনে করেন সুলতানি যুগে ভারতীয় অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যায়। সুশৃংখলভাবে অর্থনৈতিক শোষণ শুরু হওয়ায় ভারত-দরিদ্র হয়ে পড়ে। জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়। মুঘল আমলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। দ্বিতীয় মতটি হল হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় সমাজে কোন পরিবর্তন
হয়নি। তৃণমূল স্তরে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা একই রকম ছিল। পরিবর্তন যেটুকু হয়েছিল তা ওপর মহলে। অর্থাৎ রাজপুত ও তাদের সহযোগীবৃন্দ ও ব্রাহ্মণদের ওপর তুর্কি শাসনের
প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছিল।
১৯৫২
খ্রিস্টাব্দে মোঃ হাবিব যুক্তিসহ বলেন যে সুলতানি আমলে নগরের বিস্তার ঘটে এবং কৃষি
সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়। তিনি নগর ও গ্রামীণ ক্ষেত্রে দুটি মৌলিক পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি
আকর্ষণ করেছেন। প্রথমত, মুসলিম শাসকেরা শিল্প
পণ্যের উৎপাদনে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। শিল্পীর জাতপাত
নিয়ে তাদের কোন ছুতমার্ক ছিল না। কিন্তু প্রাক
সুলতানি যুগে শিল্পী কারিগরদের জাত পাতের বিধি-নিষেধ আন্ত:বৃত্তিজীবী
সচলতার (Snter -Professional mobility) বাধা সৃষ্টি
করত। এখন থেকে সেই বাধা দূর হয়। দ্বিতীয়ত, সুলতানেরা গ্রাম
থেকে অধিকতর রাজস্ব সংগ্রহ করতে আগ্রহী ছিলেন। তাই আলাউদ্দিন খলজী কৃষকদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন আত্মসাৎকারী ও শোষক মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের
অপসারিত করেন। অধ্যাপক হাবিবের মতে, এই
দুটি পরিবর্তন একটাই মৌলিক যে, এদের যথাক্রমে ‘নগর
বিপ্লব’ ও ‘গ্রামীণ
বিপ্লব’ আখ্যা দেওয়া যায়।
অবশ্য
অধ্যাপক হাবিব স্বীকার করেন যে, দিল্লির শাসক গোষ্ঠী বিশুদ্ধ
জনহিতকারী চেতনা থেকে এই উন্নয়নের কাজ করেননি। বস্তুত তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ‘ব্যক্তিগত
উন্নতির ইচ্ছা’।
বিবিধ মতের
সমন্বয় করে ইরফান হাবিব বলেছেন যে, সুলতানি আমলের পরিবর্তনগুলিকে ‘সামাজিক
বিপ্লব’ বলাটা অতিরঞ্জিত। তার মতে সুলতানি শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক
ক্ষমতা পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। বিশাল উদ্বৃত্ত পুঞ্জিভূত হয়েছিল শাসকশেনীর হাতে। জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছা নয় শাসকের মর্জিই ছিল সমস্ত প্রক্রিয়ার
চালিকাশক্তি। সাধারণ কৃষকদের অর্থ সামাজিক স্বাধীনতার অস্বীকৃতি তাদের ‘প্রায়
দাসত্বের’ পর্যায়ে থাকতে বাধ্য করেছিল। অন্যদিকে শহর ও বাণিজ্যের প্রয়াস এবং বিপুল পরিমাণে শিল্পপণ্যের
উৎপাদন এই নতুন শাসনব্যবস্থাকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছিল।
সুলতানি
যুগের কৃষি উৎপাদন: সুলতানি যুগের কৃষি উৎপাদন সম্পর্কে
আমাদের প্রধান ঐতিহাসিক উপাদান ইবন বতুতার বৃত্তান্ত। সেখান থেকে জানা যায় যে উত্তর ভারতের গম
ও তৈলবিচ এবং পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে ধান ও আখ উৎপাদিত হত। তুলো, বালি ও তিলও উৎপাদন হত প্রচুর। জমি উর্বর হওয়ায় রবি ও খারিফ শস্য উৎপাদিত হত। কিছু জমিতে দুবার শস্য হত। তবে বেশিরভাগ
জমি ছিল এক চাষের। দিল্লির থক্কুরা ফেরু জানিয়েছেন যে
ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকে ভারতে অন্তত পঁচিশ রকমের কৃষিজপণ্য উৎপন্ন হত। তবে ফেরুর বর্ণনায় আফিম ও নীলের কথা
নেই। সবচেয়ে বেশি চাষ হত যবের, তারপর গম, ধান, ডাল, জোয়ার, আখ ও
তুলো। বারানী ও খসরুর রচনা থেকে জানা যায় এক মন গমের দাম
সাড়ে সাত জিতল, যব চার জিতল, চাল পাঁচ জিতল ও ডাল পাঁজ জিতল। বছরে তিনবার ধান চাষ হত।
ইরফান
হাবিব অবশ্য মনে করেন এই চাষ ক্ষুদ্র অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। নীল উৎপাদন হত ও তা রপ্তানি করা হত। তার মতে ছোলা ও বার্লির মতো রবিশস্যের দাম কম ছিল, কারণ
এগুলি বৃষ্টির জলের উপর নির্ভরশীল। অপরদিকে যে শস্যের জন্য সেচের জলের প্রয়োজন তার দাম ছিল বেশি। কারণ এর উৎপাদন ছিল সীমিত ও এই চাষে কিছু অর্থ লগ্নীরও প্রয়োজন হত।
সতীশ
চন্দ্র দেখিয়েছেন যে মহম্মদ বিন তুঘলক ও ফিরোজ তুঘলকের শাসনকালে বহু সংখ্যক বাগান
স্থাপন করা হয়। ফিরোজ
শাহ তুঘলকের শাসনকালে দিল্লি ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে প্রায় বারোশো বাগান ছিল। এই
বাগানগুলোতে আঙ্গুরসহ বিভিন্ন ফল ফলত। মিরাট ও
আলীগড়ে উৎপাদিত আঙ্গুরজাত সূরা দিল্লিতে চলে যেতো বিক্রির জন্য। পেলপুর, গোয়ালিয়র স ও যোধপুর উন্নত
মানের ফল উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। যোধপুরে ডালিম
চাষের উন্নতির দিকে নজর দেওয়া হত। চতুর্দশ ও
পঞ্চদশ শতকে কৃষিতে নতুন পণ্যের চাষ শুরু হয়। এর মধ্যে প্রধান হল রেশমের জন্য তুঁতে চাষের প্রচলন।
সুলতানি
আমলে মুঘল যুগের তুলনায় চাষের জমির অভাব ছিল না। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে গাঙ্গেয় অববাহিকায় বিস্তীর্ণ জঙ্গলও
ছিল। একজন কৃষক অনেক জমির মালিক ছিল। সেই জন্য জমি মালিকানা নিয়ে কোন সমস্যা ছিল না। বলদ, লাঙ্গল, বীজ ও
অন্যান্য কৃষি উপকরণ ছিল কৃষকের নিজস্ব সম্পত্তি। গ্রামকে কেন্দ্র করে কৃষি ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। শামস -ই- সিরাজ আসিফের
লেখা থেকে জানা যায় একটি সাধারণ গ্রামে ২০০ থেকে ৩০০ কৃষক বাস করত। কি সব পরিবার গুলি নিজে উদ্যোগে চাষ করত। পারিবারিক ক্ষুদ্রায়তন খামার ছিল কৃষির ভিত্তি। কৃষি উপকরণ ছিল কাঠ ও লোহার নির্মিত,
ব্যাপকভাবে পশু পালন হত বলে জমিতে সার ব্যবহার করা হত।
সেচের
কাজ বেশিরভাগ হত বৃষ্টির জলে। এছাড়া জল
সংরক্ষণের জন্য কূপ ও বাঁধ নির্মাণ করা হত। প্রাক
সুলতানি যুগে অরহট্টের কথা পাওয়া যায় যেখানে দড়ির সঙ্গে কলসি বেঁধে জল তোলা হত। এই প্রযুক্তি সুলতানি যুগে পার্শিয়ান হুইল বা এক ধরনের
জলচক্রের রূপ নেয়।
তুঘলক
সুলতান গিয়াসউদ্দিন প্রথম রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে খাল খনন করে কৃষি কাজে জল সরবরাহের
ব্যবস্থা করেন। সেচ খাল খননের ব্যাপারে ফিরোজ শাহ তুঘলক
সুলতানি যুগের সবচেয়ে উদ্যোগী শাসক। তিনি যমুনা
থেকে ‘রজবওয়া’ ও ‘উলুখখানি’ নামে
দুটি বড় খাল কাটেন। এছাড়া শতদ্রুপ ও ঘর্ঘরার নদী থেকে দুটি
সেচ খাল খনন করা হয়। বর্তমান হরিয়ানার হিসার অঞ্চলের
কৃষকেরা এর দ্বারা উপকৃত হয়। এছাড়া সিন্ধু
ও পাঞ্জাবেও ছোট খাল খননের কথা বলা আছে।
গ্রামীণ
সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস: সুলতানি আমলে গ্রামীণ
সমাজের চরিত্র কি ছিল এ প্রশ্নের সমকালীন ঐতিহাসিক সূত্রগুলি নীরব। জিয়াউদ্দিন
বারানীর রচনা থেকে জানা যায় যে, গ্রামের সম্পন্ন কৃষক খুৎ ও
একেবারে দরিদ্র চাষী বলাহর, এদের নিচে ছিল ভূমিহীন কৃষক। ইরফান হাবিব গ্রামীণ কৃষি
সমাজকে ত্রিস্তরীয় বিভাগের শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। যথা প্রথম শ্রেণী রাই ও রায়ান,
দ্বিতীয় শ্রেণী খুৎ মুকদ্দম ও চৌধুরী। তৃতীয় শ্রেণী কৃষকগণ, এদের মধ্যে অবশ্য
স্তরভেদ রয়েছে।
রাই ও
রায়ান: প্রথম যুগের তুর্কি সুলতানগণ এদের
মাধ্যমেই রাজস্ব আদায় করতেন। রাজস্ব
আদায়কারী হিসেবে তারা রাজস্বের একাংশ ও নিষ্কর জমি লাভ করত। পরবর্তীকালে এরাই জমিদার নামে পরিচিত হয়।
খুৎ মুকদ্দম
ও চৌধুরী: এরা ছিল সম্পন্ন কৃষক ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করত। তারা খারাজ (ভূমি রাজস্ব), চরাই (পশুচারণ
কর),ঘরি (গৃহকর)
প্রভৃতি কর দিত না। বাড়ানীর রচনা থেকে জানা যায় যে তারা ঘোড়ায় চড়ত,
মূল্যবান পোশাক পড়ত ও সুখে স্বাচ্ছন্দে বাস করত।
আলাউদ্দিন
খলজী খুৎ ও মুকদ্দমদের বিশেষ অধিকারগুলি প্রত্যাহার করে নিলে তারা দুর্দশার মধ্যে
পড়ে। ফিরোজ শাহ
তুঘলকের সময় তারা আবার লুপ্ত মর্যাদা ফিরে পান।
এদের
মধ্যে চৌধুরীরা ছিল গ্রামীণ অভিজাতকদের মধ্যে উচ্চতম মর্যাদার অধিকারী। ইবন বতু তার বর্ণনায় প্রায় একশ গ্রাম নিয়ে সাদি ও একটি সাদি ছিল চৌধুরীর অধীন। ইরফান হাবিব মনে করেন যে সাদি ও পরগনা একই,
পরবর্তীকালে পরগনার দায়িত্বে থাকা চৌধুরীরা জমিদার নামে পরিচিত হয়।
কৃষক: তৃতীয়
শ্রেণি ভুক্ত কৃষক, যদিও তারা সমগোত্রিয় ছিল না, জমির
পরিমাণ অনুসারে সমাজে তাদের স্থান নির্ধারিত হত। কৃষক সমাজের বড় অংশ ছিল দরিদ্র ও ভূমিহীন। তাদের ওপর করের চাপ ছিল অত্যধিক। তারা মাঝে মাঝেই বিদ্রোহ করত।
ধর্মশাস্ত্রের ভাষ্যকার্যের রচনা ও পদ্মপুরাণের ভিত্তিতে সতীশচন্দ্র কৃষকদের
ভয়াবহ দারিদ্র্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া গ্রামে
বাস করত কারিগর, চর্মশিল্পী,
রজ্জুনির্মাতা, চৌকিদার। কৃষকসহ সকলেই বর্ণের ভিত্তিতে সংগঠিত হত। চর্মশিল্পী ও ভূমিহীন কৃষকদের অনেকেই অস্পৃশ্য বর্ণভুক্ত ছিল।
অতএব
সুলতানি যুগে গ্রামীণ সমাজ ছিল ভীষণভাবে অসমান। অর্থমূল্যে রাজস্ব প্রদানের রীতির ব্যাপক প্রচলন ঘটায় এই বৈষম্য আরও
প্রকট হয়। সতীশচন্দ্র মন্তব্য করেছেন,
সুলতানদের কৃষিনীতির উদ্দেশ্যই ছিল শাসক ও আমলাদের ব্যয় সুনিশ্চিত করা। কিন্তু গ্রামীন সমাজ ও অর্থনীতির উপর তার প্রভাব অনুভূত হয়েছিল।
ভূমি
রাজস্ব ব্যবস্থা:
খ্রিস্টীয়
ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রায় পুরোটাই তুর্কি সুলতানগঞ্জ প্রচলিত ভূমি রাজস্ব
ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন সাধন করেননি। হিন্দু রাই ও
রায়ানগণ প্রদত্ত রাজস্বেই তারা সন্তুষ্ট থাকতেন। কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের রীতিনীতি আগের মতই থাকে। বাড়ানিক রচনা থেকে জানা যায় গিয়াস উদ্দিন বলবন তার পুত্র বুখরা
খানকে যথেচ্ছ খারাজ বা ভূমি রাজস্ব আদায় করে কৃষকদের দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে না দিতে,
আবার সামান্য রাজস্ব আদায় করে তাদের ধনী অবস্থায় রেখে বিদ্রোহের পথ প্রশস্ত না
করারও পরামর্শ দিচ্ছেন।
সুলতানি
শাসনে কোরানের নির্দেশে একজন মুসলিম শাসক চার রকমের কর ধার্য করতে পারতেন। ভূমি কর খারাজ, লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ
খামস,
অমুসলমানদের ওপর স্থাপিত কর জিজিয়া এবং ধনী মুসলমানদের দেয় আয়ের অংশ
জাকাত।
আলাউদ্দিন
খলজী: জিয়াউদ্দিন বারানীর রচনা থেকে আলাউদ্দিন
খলজির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। দিল্লির সুলতানদের মধ্যে তিনি প্রথম যিনি ব্যাপক জমি জরিপ করে ও
উৎপন্ন শস্যের হিসাব প্রস্তুত করে জমির মোট উৎপাদন নির্ধারণ করেন। আলাউদ্দিনের রাজস্ব মন্ত্রী শরাফ কাইনি সুলতানি রাজ্যের সমস্ত কৃষি
পণ্যের পৃথক হিসাব করেন।
আলাউদ্দিন
ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সব কৃষকের ওপর তিন ধরনের কর ধার্য করেন। এগুলি হলো খারাজ বা
ভূমি রাজস্ব, চরাই বা গবাদিপশু কর, এবং ঘরি বা গৃহকর। উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ ভূমি রাজস্ব হিসেবে ধার্য করা হয়। বাড়ানি লিখেছেন যে পাঞ্জাব ও রাজস্থান থেকে বর্তমান উত্তর প্রদেশ
পর্যন্ত এই ব্যবস্থা কার্যকরী হয়েছিল। খুৎ,
মুকদ্দম ও চৌধুরীর মতো সাবেকি রাজস্ব আদায়কারীর স্থলে রাজস্ব আদায়ের জন্য তিনি
মহাশিল, অমিল,
গোমস্তা, মতাসরিফ, কারকুন
ও পাটোয়ারীর মতো বহু সংখ্যক কর্মচারী নিযুক্ত করেন।
গিয়াসউদ্দিন
তুঘলক: গিয়াসউদ্দিন পুনরায় খুৎ ও মুকদ্দমদের
মাধ্যমে ভূমি রাজস্ব আদায়ের প্রথা চালু করেন। তিনি তাদের ভূমি রাজস্ব থেকে অব্যাহতি দেন। তবে বাড়তি কর ‘কিসমৎ’
স্থাপনের অধিকার ফিরিয়ে দেননি।
কৃষকদের
ওপর ধার্য অতিরিক্ত কর প্রত্যাহার করে নেন। ভূমি
রাজস্ব দাবি হ্রাস করে উৎপাদনের এক-দশমাংশ করা হয়। অনাবাদী জমিকে
নিষ্কর করা হয়। খালিসা জমি অর্থাৎ সুলতানের খাসজমির যে একটা ছিল সেখানে সুলতান
হঠাৎ বহুগুণ রাজস্ব বৃদ্ধিতে আপত্তি করেন। তিনি
ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে রাজস্ব বৃদ্ধির পক্ষপাতী ছিলেন। তা না হলে কৃষকের অবস্থা খারাপ হবে,
অগ্রগতির পথ ও রুদ্ধ হবে। মহম্মদ বিন তুঘলক খারাজ, চরাই, ঘরি
কঠোরভাবে আদায় করা শুরু করেন। এর জন্য আবওয়াব
বা বাড়তি কর চাপান, কারণ যুদ্ধবিগ্রহ ও বিদ্রোহ দমনে রাজকোষ
শূন্য হয়েছিল।
মহম্মদ বিন
তুঘলক: কৃষকদের প্রকৃত উৎপাদনের হিসাব না নিয়ে
সরকারি গড় উৎপাদন ও সরকারি মূল্যমানের ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ধারণ করা হত। ফলে কৃষকদের ওপর রাজস্বের চাপ ছিল অত্যধিক। এরফলে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দোয়াবের বিদ্রোহ। বানানির রচনায় এই বিদ্রোহের
বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়। বিদ্রোহের ফলে কৃষিকার্য বন্ধ হয়। সুলতানি সেনার অত্যাচারে বিদ্রোহী কৃষকেরা শস্য ধ্বংস করে অরণ্যে
পালিয়ে যায়। বহু খুৎ ও মুকদ্দম নিহত হয়,
কৃষকদেরও হত্যা করা হয়। বিদ্রোহ সম্ভবত ১৩২৬-২৭
খ্রিস্টাব্দে শুরু হলেও ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে কোল বা বর্তমান আলিগর অঞ্চলে
বিদ্রোহীদের অস্তিত্ব ছিল।
কৃষক
বিদ্রোহ ও কৃষিকার্যের ক্ষতির সঙ্গে যুক্ত হয় অনাবৃষ্টি। ফলে ১৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উত্তর ভারতের
বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ চলে। এই
পরিস্থিতিতে মহম্মদ বিন তুঘলক কৃষি উন্নয়নের জন্য কিছু ব্যবস্থা নেন। এর ফলে উল্লেখযোগ্য কৃষি দিনের ব্যবস্থা করা হয়। এই ঋণের সাহায্যে কুপখনন ও কৃষি সম্প্রসারণের কাজে হাত দেওয়া হয়। নতুন শস্য চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মহম্মদ বিন তুঘলকের এই প্রকল্প শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কারণ এর সঙ্গে যুক্ত সরকারি আমলাদের স্থানীয় অবস্থা সম্পর্কে
অভিজ্ঞতা ছিল না ও সুলতানি অর্থের অধিকাংশই তারা আত্মসাৎ করে।
ফিরোজ
শাহ তুঘলক: ফিরোজ তুঘলকের শাসনকালে গ্রামীণ সমৃদ্ধি
ফিরে আসে। বারানী ও আফিফ উভয়ের রচনা থেকে জানা
যায় যে এই সময়ে কৃষির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। দোয়া
অঞ্চলে একটি গ্রাম ও ছিল না যেখানে কৃষিকাজ্য হতো না। সাধারণ কৃষকের অবস্থার উন্নতি হয়। ফিরোজ তুঘলক কোরান নির্ধারিত
মাত্র চারটি কর ধার্য করেন। অন্যান্য
করগুলি তিনি প্রত্যাহার করে নেন। তবে সেচ জমিতে
উৎপন্ন ফসলের ওপর মোট বা উৎপাদনের এক-দশমাংশ কর ধার্য
করা হয়। সুলতান ব্যাপক জমি জরিপেরও ব্যবস্থা
করেন। ফিরোজ তুঘলকের পরবর্তীকালে দিল্লি সুলতানের রাজস্ব ও ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে
বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। সম্ভবত ভূমি ও
রাজস্ব ব্যবস্থায় বিশেষ কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেনি। সুলতানি যুগের শেষ দিকে, বিশেষ করে
লোদীদের আমলে নগদ অর্থের পরিবর্তে উৎপন্ন শস্যের একাংশ রাষ্ট্রীয় কর নেওয়া হত। জিনিসপত্রের বিশেষ করে কৃষি পণ্যের দাম খুব নেমে গিয়েছিল। পৃথিবীব্যাপী রুপোর দুষ্প্রাপ্যতা ছিল এর কারণ। বহুলুল নদীর আমলে একটা রুপোর টাকা দিয়ে দশমন খাদ্যশস্য কেনা যেত। সুলতান ইব্রাহিম লোদী (১৫১৭-২৬)
কৃষকদের অবস্থা অনুভব করে উৎপন্ন শস্যে রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ দেন।
আমেরিকার
রৌপ্য ভান্ডার ইউরোপ হয়ে ভারতে এসে পৌঁছালে ভারতে আবার কৃষিজ পণ্যের দাম বাড়তে
থাকে। শেরশাহ ও আকবরের শাসনকালে মুদ্রা নির্ভর অর্থনীতির
প্রচলন হয়। নগদ মুদ্রায় রাজস্ব আদায়ের কাজ চলতে
থাকে।
সুলতানি
আমলের স্থাপত্য শিল্প
তুর্কি
শাসনকালে ভারতীয় শিল্প স্থাপত্যে হিন্দু বা ভারতীয় ধারার সঙ্গে ইসলামীয় ধারার
সংমিশ্রণ ঘটে। উভয় ধারার সমন্বয়ে শেষ পর্যন্ত এদেশে
এক সমৃদ্ধ শিল্পরীতির বিকাশ হয়। অধ্যাপক
সতীশচন্দ্রের মতে “এই সংমিশ্রনের কাজ চলেছিল দীর্ঘদিন ধরে
বহু উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে। আত্তীকরণ
ও সংঘাত দুটোই পাশাপাশি চলেছিল, তবে স্থান ও কাল বিশেষে কোনটা বেশি বা কোনটা কম।”
সুলতানি
আমলে শিল্প ধারার সমন্বয়ের বা সংমিশ্রণের ক্ষেত্রে প্রচলিত হিন্দুরীতি ও নবাগত
ইসলামীয় রীতির মধ্যে কোনটির প্রভাব বেশি ছিল, সে
বিষয়ে ও পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। হ্যাভেল এর মতে, এই শিল্প রিতির শরীর ও মন দুইই
ছিল ভারতীয়। শিল্প নিদর্শনে হিন্দু স্থাপত্যের প্রাধান্য বেশি। অন্যদিকে ফার্গুশন ভি স্মিথ প্রমুখ মনে করেন,
সুলতানি আমলের শিল্প স্থাপত্যে হিন্দু রীতির প্রভাব ছিল নেতিবাচক। কিন্তু স্যার জন মার্শাল ড. মজুমদার প্রমূখ মনে করেন ইন্দো ইসলামী ও
শিল্প রীতি কেবল ইসলামীয় রীতির স্থানীয় (ভারতীয়) রূপ
কিংবা হিন্দু স্থাপত্যে রূপান্তরিত প্রকাশ ছিল না; এর
মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন শিল্পনীতির সাথে মুসলমান অভিযানকারিগর কর্তৃক বাহিত
পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার শিল্প রিতির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল।
ইন্দো
ইসলামীয় স্থাপত্য নিদর্শন: ৭১১-১২
খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু বিজয়ের পর সেখানে এক ক্ষুদ্র আরোপ
উপনিবেশ গড়ে ওঠে। করাচির কিছু দূরে ভামবোর নামে এক স্থানে
প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন এর ফলে কিছু ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এক মসজিদের নিদর্শন পাওয়া
গেছে। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ মনে করেন ভারতীয় উপমহাদেশে এটিই
সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ।
খ্রিস্টীয়
ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মামেলুক সুলতানদের শাসনকালে ইন্দো ইসলামীয়
স্থাপত্যের ধারাবাহিক ইতিহাসের সূচনা হয়।
কুতুবউদ্দিন
আইবক প্রায় ২৭ টি হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে ‘কোয়াৎ
উল ইসলাম’ বা ‘ইসলামের
শক্তি’ নামে এক মসজিদ নির্মাণ করেন (১১৯২
খ্রিস্টাব্দে)। মসজিদটির
ইসলামীয় চরিত্র প্রমাণ করার জন্য প্রার্থনা কক্ষের সামনে একটি পাঁচ দরজার তোরণ
নির্মাণ করা হয়।
কুতুব
মিনার: কোয়াৎ উল ইসলাম এর অদূরে কুতুবুদ্দিন
একটি মিনার স্থাপন করেন (১১৯৯
খ্রিস্টাব্দে)। একে বলা হয়
মাজানা অর্থাৎ যেখান থেকে আজান দেওয়া হতো (মিনার
ই- শামিস)। পরে কুতুব
মিনার নামকরণের সম্ভাব্য কারণ এটি কুতুব উদ্দিন আইবক কর্তৃক শুরু হয়েছিল, অপর
সুলতান ইলতুৎমিস যখন এর নির্মাণ কার্য শেষ করেন তখন সুফীসন্ত কুতুব উদ্দিন
বখতিয়ার কাকি দিল্লিতে বসবাস করতেন, মিনারটি তার
আধ্যাত্মিক স্বীকৃতি স্বরূপ ইলতুৎমিস থেকে চারটি স্তরে উন্নীত করলে এর উচ্চতা হয়
২৩৮ ফুট। বজ্রপাতে মিনারের অপরামর্শ ক্ষতিগ্রস্ত
হলে ফিরোজ শাহ তুঘলক এর সংস্কারের ব্যবস্থা করেন। চারিদিকে ঘিরে থাকা বেলকনি মিনারের প্যানেলে সাদা ও লাল বেলেপাথরের
ব্যবহার করা হয়। আজমিরে
অপর একটি সৌধ আড়াই দিন কা ঝোপরা নির্মাণ করেন (একটি
বৈষ্ণব মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর)। লালকোট,
কিলা ই রাইপিথোরার নিকট অবস্থিত দিল্লি শহরের প্রথম নগর।
ইলতুৎমিস:
ইলতুৎমিসের রাজত্বকাল থেকে সুলতানি যুগের স্থাপত্যে ইসলামীয় শিল্পরীতির প্রভাব
বৃদ্ধি পায়। তিনি
কুয়াৎ-উল -ইসলাম ও
আড়াই দিন কা ঝোপড়ার সাথে আরও কিছু সংযোজন করেছিলেন।
১২৩১
খ্রিস্টাব্দে সুলতান ঘরী নামে এক স্থানে তেল দুধ মিশ তার প্রয়াত পুত্র
নাসিরউদ্দিন মহম্মদের সমাধি ভবন নির্মাণ করেন। মাটির নিচে পোঁতা একটি আট কোনা কক্ষের
ভিতর সমাধিটি অবস্থিত। কক্ষটিকে ঘিরে রয়েছে উঁচু প্রাচীর যার
চারকোণে শোভা পাচ্ছে চারটি বুরুজ। সুলতান ঘরীর
সমাধিভবন পরবর্তীকালে নির্মিত সমাধিভবনগুলির কাছে দৃষ্টান্ত স্বরূপ ছিল।
ইলতুৎমিসের নিজের বাসভবনের চার কোনা
সমাধি কক্ষটিকে একটি গোলাকার গম্বুজে রূপান্তরিত করা হয়। এই সমাধি ভবনের গায়ে কো কোরানের বাণী উৎকীর্ণ ছিল।
বলবনের
সমাধি ভবন: কোয়াৎ-উল-ইসলামের
অদূরে গিয়াসউদ্দিন বলবনের সমাধিভবন ভগ্ন প্রায় অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়।
আলাউদ্দিন
খলজী ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে খলজী বংশের শাসন শুরু হলে সুলতানি স্থাপত্য শৈলীতে
গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়। মোঙ্গল আক্রমণে
বিধ্বস্ত পশ্চিম এশিয়ার সেলজুক সাম্রাজ্য থেকে অনেক শিল্পী ও স্থপতি ভারতের চলে
আসেন। ফলে সুলতানি স্থাপত্যের আঙ্গিকে সেলজুক শৈলীর
অনুপ্রবেশ ঘটে। খিলানে পদ্মকলি পাড়,
দেওয়ালের ওপর দিকে অলংকৃত বর্তুল, দেওয়ালের পিষ্ঠে হেডার ও
স্রেচার এর ব্যবহার প্রভৃতি এর বৈশিষ্ট্য। এছাড়া
খোলজি স্থাপত্যে দেখা যায় অশ্বক্ষুরাকৃতি খিলান,
বিস্তৃত গম্বুজ, জালিবদ্ধ জানালা, লাল
রংয়ের বেলে পাথরের ওপর মার্বেল বসানো, দেওয়ালের
গায়ে আয়তকার প্যানেল, জ্যামিতিক নকশা ইত্যাদি।
১৩১১
খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন খলজী কোয়াৎ উল ইসলামের দক্ষিণ প্রবেশ পথে আলাই দরওয়াজা
নির্মাণ করেন। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগায় জমায়েত
খানা নামে এক মসজিদ নির্মিত হয়। কুতুব মিনারের
দ্বিগুণ উচ্চতার এক মিনার (আলাই মিনার)
নির্মাণের কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কুতুব মিনার
থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে সিরিতে আলাউদ্দিন এক নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। এখন এর আর কোনো চিহ্ন নেই।
তুঘলক: খলজী
স্থাপত্যের লালিত ও অলংকরণ তুঘলক যুগে ছিল না। লাল বেলে পাথরের স্নিগ্ধতার স্থলে
ধূসর পাথরের রুঢতা স্থাপত্য মানের অবনমন ঘটায়। নির্দিষ্ট মানের পাথরের পরিবর্তে ছোট বড় পাথর খন্ড দিয়ে দেওয়াল
নির্মাণ করা হয়। দেওয়ালে
পুরু পলেস্তারার ওপর রং করা হয়।
গিয়াস
উদ্দিন তুঘলক নগর প্রাসাদ ও দুর্গের সম্মেলনে দিল্লির তৃতীয় নগরী তুঘলকাবাদ
স্থাপন করেন। একটি উঁচু পথ গিয়াস উদ্দিনের
সমাধীভবনের সঙ্গে দুর্গতিকে যুক্ত করেছে।
মহম্মদ
বিন তুঘলক দিল্লির চতুর্থ নগরী স্থাপন করেন যাহানপনায়। ফিরোজ শাহ তুঘলক দিল্লির পঞ্চম নগরী ফিরোজাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। ফিরোজ শাহ কোটলা দুর্গ তারই নির্মিত। বিশাল জলাশয় পরিবেশিত প্রমথ
উদ্যান হাউজ খাস তারই প্রতিষ্ঠা। কালান ও খিরকি
মসজিদ ফিরোজ তুঘলকের শাসনকালে নির্মিত হয়। ফিরোজ
সাহেব প্রধানমন্ত্রী খানী জাহানের সমাধিভবনটি দিল্লির নিমানউদ্দিন অঞ্চলে অবস্থিত।
সৈয়দ ও
লোদী দুর্গ: ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর লঙের আক্রমণের
ফলে উত্তর ভারতে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় তার ফলে সুলতানি যুগের স্থাপত্যের বিকাশ
ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে ও এ যুগে কয়েকটি
সমাধিভবন নির্মিত হয়েছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সৈয়দ সুলতান মুবারক শাহ ও মহম্মদ শাহেদ সমাধিদ্বয়। এছাড়া খিজির খা ও মুবারকসহ যথাক্রমে খিজিরাবাদ ও মাহমুদাবাদ নামে
দুটি নতুন শহর গড়ে তোলেন। লোদীদের আমলে
বড়ে খান, ছোটে খান, মঠ-কা-মসজিদ
প্রভৃতি শেষ পর্বে নির্মিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
আঞ্চলিক
স্থাপত্য: সুলতানি সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে যে
আঞ্চলিক রাজ্য গুলি প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে ও স্থাপত্যকলার বিকাশ ঘটে। খ্রিস্টীয়
পঞ্চদশ শতকে জৌনপুরের শার্কী সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় যে স্থাপত্য রীতির উন্মেষ
ঘটে, তার মধ্যে হিন্দুর রীতির প্রভাব স্পষ্ট। অটলাদেবী মসজিদ, জাম-ই-মসজিদ, লাল
দরওয়াজা মসজিদ প্রভৃতি উল্লেখ্য নিদর্শন।
বাংলাদেশে
ইসলামীয় ও হিন্দু স্থাপত্য রীতির সংমিশ্রণ লক্ষণীয়। বাংলাদেশের স্থাপত্যে পাথরের চেয়ে ইঁটের ব্যবহার বেশি। পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ তার বিশালত্ব ও সৌন্দর্যের জন্য প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া গৌড়ের বড় ও ছোট সোনা মসজিদ, দাখিল
দরওয়াজা, কদম রসূল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য
নিদর্শন।
গুজরাত: আঞ্চলিক
রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম গুজরাতের নিজস্ব শিল্প রীতি ছিল। তুর্কি শাসকগণ এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সুলতান আহমেদ শাহ আহমেদাবাদ শহরে অনেক সৌধ নির্মাণ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাম-ই-মসজিদ। সুলতানের সমাধিভবন অপর এক উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কীর্তি।
অপর
আঞ্চলিক রাজ্য মালবের রাজধানীর ধারে অবস্থিত দুটি মসজিদে হিন্দু স্থাপত্য রীতির
ছাপ সুস্পষ্ট। কিন্তু রাজধানী মান্ডুতে স্থানান্তরিত
হলে সেখানে নির্মিত মসজিদ ও সৌধ গুলিতে ইসলামী ও রীতি প্রাধান্য পায়। এদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল জাম-ই-মসজিদ,
হিন্দোল মহল,জাহাজ মহল ও সুলতান হুসেন শাহর সমাধিভবন। এছাড়া উল্লেখযোগ্য ছিল বেলেপাথর ও
শ্বেতপাথরে নির্মিত বাজবাহাদুর ও রূপমতীর প্রাসাদ।
রাজপুতানায়
হিন্দু স্থাপত্য রীতি দীর্ঘকাল প্রচলিত ছিল।
খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে রানা কুম্ভর কীর্তিস্তম্ভ ও চৌমুক মন্দির অপর
স্থাপত্য শৈলীর স্বাক্ষর বহন করে। দক্ষিণ ভারতীয়
স্থাপত্য রীতিতে তুর্কি, আরবী, পারসিক ও ভারতীয় প্রভাব পড়েছিল। গুলবর্গার জাম-ই-মসজিদ,
দৌলতাবাদের চাঁদমিনার, ও বিদরের মাহমুদ গাওয়ানের মহাবিদ্যালয়ের এই সমন্বয়েই
রীতির প্রভাব লক্ষণীয়। বাহমনী শাসনকালে নির্মিত অনেক সুধে
হিন্দু প্রভাব থাকলেও পরবর্তীকালে পারসিক প্রভাব বৃদ্ধি পায়। আর ও পরে বিজাপুরের আদিল সাহি সুলতানগঞ্জ নির্মিত সৌধগুলিতে ভারতীয়
প্রভাব লক্ষণীয়। বিজয় নগরের নিপতীদের মধ্যে কৃষ্ণদেব
রায়ের শাসনকালে নির্মিত মন্দিরগুলি হিন্দু স্থাপত্য কলার অপরূপ নিদর্শন। বিধল স্বামীর মন্দির এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন