সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুঘল যুগের শিল্প



মুঘল যুগের শিল্প নিয়ে দুটি পরস্পর বিরোধী মত প্রচলিত একটি হল মুঘল যুগে শিল্প ব্যবস্থা ও শিল্প উৎপাদিত প্রাক শিল্প বিপ্লব যুগের ইউরোপের সমকক্ষ ছিল অপর মতটি হলো ভারত শিল্পপন্ন উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করলেও তার উৎপাদন পদ্ধতি ছিল মধ্যযুগীয় এবং উৎপাদন ছিল বেশ কম ও স্থিতিশীল এদেশের জাতিভেদ প্রথা ও সরকারি নিষ্পেষণ শিল্প ক্ষেত্রে বড় রকমের পরিবর্তনের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে ছিল

মুঘল যুগের শিল্প উৎপাদন সম্পর্কে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তা যথেষ্ট নয় এর জন্য মোট উৎপাদন, শিল্পে নিযুক্ত মোট শ্রমিক বা মোট মূলধনের হিসাব পাওয়া যায় না

আকবরের সময়ে ভারতের লোক সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪০-১৫০ মিলিয়ন এর মধ্যে ১৫ শতাংশ লোক শহরে বাস করত নিজামুদ্দিন আহমেদের তবাকাৎ-আকবরিতে তিন হাজার দুশ কসবা বা ছোট শহর, ২০০ টি ছোট বড় শহরের উল্লেখ আছে মুঘল অভিজাতরা ছিলেন বিলাসী, তাদের বহু ধরনের ভোগ্য ও শৌখিন পণ্যের প্রয়োজন হত অধ্যাপক তপন রায় চৌধুরী দেখিয়েছেন যে, মুঘল শাসনকালে ভারতে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছিল এরা হলো সরকারি কর্মচারী, বিচারক, বুদ্ধিজীবী, হাকিম, কারিগর, মহাজন, প্রমূখ এদের জীবন যাত্রার মান এমন ছিল যে এদের জন্য বিশেষ ধরনের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হতো এক হিসেবে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ভারতে শিল্পপতি চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল

বস্ত্রবয়ন শিল্প: বিদেশি পর্যটক যারা মুঘল যুগে ভারত ভ্রমণ করেন এদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ উন্নত ফলের বিপুল পণ্যসম্ভারের উল্লেখ করেছেন মরল্যান্ড দেখিয়েছেন যে, বস্ত্র বয়ন শিল্পে ভারত ছিল স্বনির্ভর, প্রচুর কার্পাস বস্ত্র ভারতে উৎপন্ন হতো এবং সেই যুগে পৃথিবীতে ভারতের ছিল বিশিষ্ট স্থান

আবুল ফজল সোনার গাঁওয়ের মুসলিম এবং বেনারস, আগ্রা, মালব, দাক্ষিণাত্য ও গুজরাটে তৈরি কাপড়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন বাংলা, গুজরাট ও দাক্ষিণাত্য ছিল বস্ত্র শিল্পের প্রধান কেন্দ্র পাটনা, লাহোর, মুলতান ও এলাহাবাদের বড় ধরনের বস্ত্র শিল্প ছিল ব্রোচ, কাশিমবাজার ও বালাশোর ছিল সুতো উদপাদনের প্রধান খাঁটি। বস্ত্র রং করার জন্য পেশাদার লোক ছিল।

মোরল্যান্ড দেখিয়েছেন যে ভারতে দেড়-শ রকমের তাঁতবস্ত্র উৎপন্ন হত এর মধ্যে অতি মিহি মসলিন যেমন ছিল তেমনি ছিল সাধারণ পরিধেয় মোটা বস্ত্র সিন্ধু, গুজরাট, করমন্ডল এবং বাংলার বন্দর উপকূল হয়ে এসব বস্ত্রের একাংশ বিদেশে রপ্তানি হয়ে যেত এসব বস্ত্রের বাজার ছিল আরব, মিশর, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, ব্রহ্মদেশ মালাক্কা ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ পাইরান্ড জানিয়েছেন যে উত্তম আশা অন্তরের থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-ভাগের নরনারী ভারতের তৈরি তাঁত বস্ত্রে সুসজ্জিত হত

মুঘল যুগে মূলত এলাকাভিত্তিক দক্ষতা গড়ে উঠেছিল গ্রাম ও শহর সর্বত্র সাধারণ মানের বস্ত্র তৈরি হত লাহোর, মুলতান, বুরহানপুর ও গোলকুণ্ডায় উন্নত মানের বস্ত্র তৈরি হত কিন্তু পরিবহন ব্যয় অত্যাধিক হত বলে উৎকৃষ্ট বস্ত্রের বাজার দাম হত আকাশ ছোঁয়া যোগানো ছিল সীমিত, দিল্লি, আগ্রা, অযোধ্যা, ফতেপুর সিক্রি, জৌনপুর, কান্দি, বিহার, বাংলা, উড়িষ্যা, করমন্ডল উপকূল, মালাবার, গুজরাট ও খান দেশে প্রচুর বস্ত্র উৎপন্ন হত পরিধেয় বস্ত্র ছাড়াও রুমাল পাগড়ী সোনার রুপোর কাজ করা কাপড়, লেপ, বিছানা, তাঁবু ইত্যাদি তৈরি হত

রেশন ও পশম বস্ত্র: মুঘল যুগের রেশম বস্ত্র শিল্প ছিল সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রধানত বাংলা গুজরাট ও কাশ্মীর ছিল রেশম শিল্পের প্রধান এলাকা ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে রেশন বস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অর্ধেক ভারতে উৎপন্ন হত আর বাকি অর্ধেক বিদেশ থেকে আমদানি করা হত রেশম আমদানি করা হত চীন ও পারস্য থেকে আকবর রেশম উৎপাদন ও বয়নে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন, রেশম শিল্পের উন্নতির জন্য বিদেশ থেকে কারিগর আনানোর ব্যবস্থা করেন সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে রেশমের চাহিদা বাড়ে যখন ইংরেজ ওলন্দাজরা ভারতীয় রেশম ইউরোপ ও জাপানে রপ্তানি করতে থাকে আগ্রা লাহোর ফতেপুর পাটনা ও থাট্টায় রেশম উৎপাদন কেন্দ্র ও কারখানা ছিল

ভারতের রেশম ও পশমের একপ্রকার মিশ্রবস্ত্র তৈরি হত আবুল ফজল জানিয়েছেন যে আকবর তার নিজের কারখানায় নানা ধরনের পশমীবস্ত্র, শাল, কার্পেট কম্বল ইত্যাদি তৈরির ব্যবস্থা করেন ভারতীয় পশম উচ্চমানের ছিল না তিব্বত ও হিমালয় থেকে ভারতের পশম আমদানি করতে হত কাশ্মীর পাঞ্জাব ও রাজস্থানের এই শিল্প গড়ে উঠেছিল শাল, কম্বল, পাগড়ী, কোমরবন্ধন ইত্যাদি লাহোর গুজরাট ও কাশ্মীরে তৈরি হত শণ থেকে দড়ি তৈরি হত, কাশিমবাজারে দড়ি তৈরির কারখানা ছিল। আলিপুরদের সময়ে বাংলায় তাঁতে পাট থেকে চট তৈরি হত

হস্তশিল্প: ধনী অভিজাতরা কি ধরনের গৃহস্থালির দ্রব্য ব্যবহার করত তার বর্ণনা আছে আইন আকবরীতে এগুলি হল বাসনপত্র, আসবাবপত্র, চামড়ার দ্রব্য, অলংকার, মৃৎপাত্র, কাঁচের জিনিস, সাবান ইত্যাদি সম্রাট ও অভিজাতদের কর্মশালায় এর একাংশ উৎপাদিত হত বেশিরভাগ উৎপন্ন হত হস্তশিল্পীদের বাড়িতে অনেক সময় যজমানি পদ্ধতিতে কর্মকার, সূত্রধর, স্বর্ণশিল্পী, চর্মকার তাদের পণ্য উৎপাদন করত তাম্রশিল্পী, শঙ্খ শিল্পী, হস্তীদন্ত শিল্পী, কুম্ভকার, স্থপতি, জাহাজ কারিগর তাদের পণ্য উৎপাদন করত বাজারে বিক্রির জন্য কাশ্মীর ও গুজরাটের কাঠ শিল্পের সুখ্যাতি ছিল চর্ম শিল্পের জন্য খ্যাতি ছিল মুলতানের এলাহাবাদের কাছে আজাদপুর থেকে বিদেশের বিভিন্ন স্থানে কাগজ রপ্তানি করা হত কাগজ উৎপাদনের জন্য বিহারের খ্যাতি ছিল। ধাতু পাত্রের দাম বেশি হতো এর জন্য মৃৎপাত্রের ব্যাপক প্রচলন ছিল বিহারে অতি উৎকৃষ্ট মানের মৃৎপাত্র তৈরি হত মাটির পেয়ালা দেখে মানুচ্চি চমৎকৃত হয়ে মন্তব্য করেন কাঁচের তৈরি পেয়ালার চেয়ে সুন্দর কাগজের চেয়েও পাতলা মালাবার, কর্ণাটক ও বাংলায় মৃৎশিল্পের উন্নতি হয়েছিল মুঘল যুগে ইঁট, কাঠ ও পাথরের ইমারত ছিল কম বেশিরভাগ বাড়ি তৈরি হত মাটি, বাঁশ, শণ, খড় বা টালি দিয়ে দুর্গ, প্রাসাদ, মন্দির, মসজিদ, সেতু, সৌধ ইত্যাদি নির্মাণের উন্নতশিল্পী ও কারিগর পাওয়া যায় ভারতের বেরার প্রদেশে অল্প পরিমাণে কাঁচ ও সাবান তৈরি হত শুধু অভিজাতরা এগুলি ব্যবহার করত

কৃষিজ শিল্প: অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিচার করলে বয়ন শিল্পের পর ভারতের বড় শিল্প হল চিনি ও রং লাল রঙের উৎস ছিল করমন্ডল উপকূল নীল রং তৈরি হত আগ্রা, গুজরাট ও দক্ষিণ করমন্ডলের বিভিন্ন জায়গায় মুঘল যুগে নীলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এর উৎপাদন বাড়ে এবং দেশীয় ও ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা নীলের ব্যবসায় নেমে পড়ে ভারত থেকে নীল যেত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও পূর্ব ইউরোপে, লেভান্ট, তুরস্ক, পারস্য, বসরা, লোহিত সাগর, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায়

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তিন ধরনের ইক্ষু চিনি তৈরি হত মোটা, সরু ও দানা মোটা এই তিন ধরনের চিনির ব্যবস্থা হত আবুল ফজল পাঁচ ধরনের চিনির উল্লেখ করেছেন এগুলি হল জ্যাগারি বা গুড়, লাল চিনি, সাদা চিনি, গুড়ো দানা, ও বড় দানা সবচেয়ে ভালো চিনি তৈরি হত বাংলায় আবুল ফজল বাংলার চিনিকে প্রথম শ্রেণীভুক্ত করেছেন চিনি তৈরির প্রধান কেন্দ্রগুলি হল আগ্রা, বাংলা, লাহোর, মুলতান ও উড়িষ্যা বাংলার চিনি ইউরোপ ও পারস্যে পাঠানো হত সপ্তদশ শতকের চল্লিশের দশকে ওলন্দাজরা বাংলা থেকে গড়ে প্রতিবছর চার থেকে সাড়ে চার লক্ষ টন চিনি রপ্তানি করত

ভারতের অন্যান্য কৃষিজ শিল্প হল তেল তামাক আফিম ও মদ সিন্ধু, গুজরাট, মহিশূর, ওড়িশা ও বাংলায় তৈলবীজ থেকে তেল নিষ্কাশনের শিল্প ছিল। বইল অভ্যন্তরীণ ও বহিব বাণিজ্যের প্রধান উপাদান ফুল ও সুগন্ধি দ্রব্য থেকে সুরভিত তেল বানানো হত গোয়ালিয়র চামেলি তেলের জন্য বিখ্যাত ছিল আকবরের সময় ভারতে পর্তুগিজরা তামাক নিয়ে এসেছিল পরে অর্থপরী ফসল হিসেবে এর চাষ শুরু হয় দাক্ষিণাত্য, বুরহানপুর, করমন্ডল, উত্তর ভারত ও বাংলায় তামাকের চাষ ছড়িয়ে পড়ে তামাকের উপর উঁচু হারে রাজস্ব ধার্য করা সত্ত্বেও চাষ চলতে থাকে ভারত থেকে তামাক পাতা মোখা, আরাকান ও পেগুতে রপ্তানি হত আকবরের সময় মানব বেরার সাজিপুর খান্দেশ কান্দি বিহার ও বাংলায় আফিম উৎপন্ন হত চীন, পেগু, জাভা, পারস্য ও আরব দেশে এর কিছু পরিমাণ রপ্তানি হত

গৌড় মহুয়া ইত্যাদি থেকে দেশজো কোথায় মদ তৈরি হত এসব কৃষিজ পণ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল কিছু বনজ পণ্য বন থেকে লাক্ষা সোম ইত্যাদি সংগ্রহ করে বাণিজ্য পণ্যে রূপান্তরিত করা হত আসাম বাংলা ও গুজরাটের অরণ্যের ফসল দিয়ে এসব শিল্প গড়ে ওঠে

কারিগরি সংগঠন: আর কে মুখার্জি দেখিয়েছেন যে অষ্টাদশ শতকে কৃষিকাজে ভারত এশিয়ার সর্বাগ্রগণ্য এবং শিল্প ক্ষেত্রে সমগ্র পৃথিবীর ধাত্রী ছিল এই মন্তব্যে অতিসারক্তি আছে সন্দেহ নেই বিভিন্ন কারণে শিল্পের স্থানীয়করণ ঘটেছিল সাধারণত কাঁচামালের উৎস যেখানে সেখানে শিল্প গড়ে ওঠে অভ্যন্তরীণ ও বহিব বাণিজ্যের চাহিদার দিকে তাকিয়ে তাঁত বা রেশন ধাতব দ্রব্য বা আইভরি পণ্যের উৎপাদন করা হত উৎকৃষ্ট সোরা উৎপন্ন হত বিহারে, উৎকৃষ্ট নীল হত আগ্রায়

জাতি বা গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে শিল্পী বা কারিগরের সংগঠন গড়ে উঠেছিল এবং বহুকাল ধরে এই প্রযুক্তি তাদের মধ্যে সীমিত হয়ে থাকত সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয় বণিকরা উৎপাদনের উৎস স্থলে গিয়ে কম দামে পণ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শিল্পী কারিগরদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় বাণিজ্য কেন্দ্র, বন্দর, শহর, বাণিজ্যকুঠি ইত্যাদি কেন্দ্র করে শিল্পী ও কারিগরদের কেন্দ্রিকরণ ঘটে এর আরো একটি কারণ হলো দক্ষ কারিগররা তাদের এলাকার বাইরে গিয়ে উৎপাদন করতে অনিচ্ছুক ছিল শুধু যে শিল্প আঞ্চলিক বা স্থানীয় ছিল তা নয়, উৎপাদিত পণ্যের ও আঞ্চলিক বাজার ছিল মুঘল যুগে কৃষক নিজের প্রয়োজনীয় শিল্পপর্ণ উৎপাদন করে নিত কৃষক নিজেই তার পরিধেয় বস্ত্র বয়ন করত আবার গ্রামের কারিগর দিয়ে তার প্রয়োজনীয় সব পণ্য উৎপাদন করে নিত এই ব্যবস্থা যজমানি পদ্ধতি নামে খ্যাত ছিল।

 বার্নিয়ের ফ্রায়ার ও ওভিংটন ভারতীয় কারিগরদের অবিশ্বাস্য তুলনাহীন উদ্ভাবনী শক্তি ও দক্ষতার প্রশংসা করেছেন তবে পশ্চাৎপথ প্রযুক্তি, মূলধনের অভাব, চাহিদার অপ্রতুলতা, উৎসাহের অভাব, ইত্যাদি কারণে শিল্প পণ্যের উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়নি দক্ষিণ ভারতের বণিকরা কারিগর ও তাদের উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছিল সপ্তদশ শতকে কান্দিবিরান্না ছিলেন একজন অতি ধনী বণিক শিল্পপতি বণিক শিল্পপতিদের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও ছিল জাতি বা গোষ্ঠী শিল্প তারা উৎপাদন ও বন্টনের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছিল রেশম জাহাজ নির্মাণ সোরা নীল ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইউরোপীয় প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল ঢুকেছিল ইউরোপীয় বাণিজ্যিক মূলধন, তবে ভারতের পরিবার নির্ভর ছোট বা মাঝারি ধরনের শিল্প সংগঠনের পরিবর্তন হয়নি

কারখানা: মুঘল যুগের শিল্প পণ্য ক্রয়ে বিদেশি বণিকেরা দাদন প্রথার প্রচলন করেছিল ইউরোপীয় বণিকরা তাদের নিযুক্ত অজস্র দালাল মারফত পণ্য উৎপাদনকারীকে অগ্রিম বা দাদন দিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট পণ্য সংগ্রহের পাকা ব্যবস্থা করে নিত দেশি দালালরা বিভিন্ন উৎপাদন কেন্দ্রে গিয়ে তাঁত ও রেশম বস্ত্র কিনত মুঘল যুগে রাষ্ট্র ছিল সবচেয়ে বড় উৎপাদক রাষ্ট্র ও অভিজাতরা নিজেদের কারখানায় প্রয়োজনীয় সব পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছিলেন কেন্দ্রীয় কারখানা ছাড়াও প্রাদেশিক রাজধানীতে রাষ্ট্রায়ত্ত উঠত কারখানা স্থাপিত হয়েছিল আকবরের আমলে আগ্রা ফতেপুর সিক্রি লাহোর আমেদাবাদ ও অন্যত্র কারখানা ছিল শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের আমলে দিল্লি বোরহানপুর ঔরঙ্গাবাদ ও কাশ্মীরে কারখানা স্থাপিত হয়েছিল রপ্তানির জন্য নিয়মিত সরবরাহ বজায় রাখতে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি তাদের নিজস্ব কারখানা স্থাপন করেছিল পাটনা ও কাশিম বাজারে ইংরেজ ওলন্দাজদের রেশনের কারখানা ছিল মুঘল আমলে স্বাধীন কারিগরদের নিজস্ব কারখানা ছিল, তবে সাধারণত একই পরিবারের লোকেরা কোন শিল্প উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত থাকত নিজেদের মূলধন যথেষ্ট না হলে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিত মুঘল যুগে বেসরকারি উদ্যোগে বিশাল শিল্প পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি ভারতীয় পণ্যের বাজার প্রসারিত হলে শিল্প সংগঠনের ক্ষেত্রে কয়েকটি নতুন প্রবণতা দেখা দেয় নিয়মিত মজুরি দেওয়ার নীতির প্রচলন হয় লখনৌ তে ধনী কারু শিল্পী ও তাঁত শিল্পী তাদের নিজস্ব কারখানায় পাঁচ শতাধিক লোক নিযুক্ত করেছিল। কাশ্মীরে উৎপাদকরা তাদের কারখানায় তিনশর বেশি কারিগর নিযুক্ত করত বার্ণিয়ে জানিয়েছিলেন যে মুঘল যুগে বৃত্তি পরিবর্তনের ঘটনা ঘটত না

প্রযুক্তি: মুঘল যুগের শিল্প পণ্যের উৎপাদন নিশ্চয়ই বেড়েছিল, তবে এজন্য উন্নত প্রযুক্তির কোন ব্যবহার হয়নি কারিগররা সাধারণ মানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করত চীন ও পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে তুলনীয় সংগঠন ও শিল্পপ্রযুক্তি আপেক্ষিক ভাবে ছিল নিশ্চল চীনের বহুচক্র সমন্বিত টেকো অথবা ইতালীয় জল শক্তি চালিত দুশ টেকো সম্মুলিত যন্ত্র ভারতীয় বস্ত্র বা রেশম শিল্পে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। ভারতের সমুদ্রগামী জাহাজ নক্ষত্র দেখে দিক নির্ণয় করত কম্পাস বা টেলিস্কোপের ব্যবহার জানা ছিল না জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার, লোহা ঢালাই, কাঁচ নির্মাণ বা খনি প্রযুক্তি কিছুই ছিল না রাসায়নিক শিল্প প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল এসব দুর্বলতা সুদূরপ্রসারী প্রযুক্তি উন্নয়নের পথরোধ করে দাঁড়িয়ে ছিল। শিল্প বিপ্লবের কোন সম্ভাবনা দেখা যায়নি যন্ত্রের প্রতি অনীহা ভারতীয়দের এত প্রবল ছিল যে মনুষ্য শ্রমের বিকল্প হিসেবে যন্ত্রের ব্যবহারের কথা চিন্তা করেনি

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

       ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাই মুঘলদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বলে মনে করেন শিরিন মুসবি । শিল্প বাণিজ্য থেকে আয়ের পরিমাণ সামান্য । ভূমি রাজস্ব হল ‘ মাল ’ বা ‘ খারাজ ’ । মুঘলরাষ্ট্র সামন্তরাজাদের কাছ থেকে কর পেত । তাছাড়া রাষ্ট্র পেত যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ ( খামস ); স্থানীয় আবওয়াব জিহত , শয়ের - ই - জিহত , ফুরুয়াত , অমুসলমানদের উপর স্থাপিত কর জিজিয়া এবং মুসলমানদের দেয় কর জাকাত ।         আকবরের আমলে সরকারের মোট রাজস্ব পরিমাণ ছিল ১২ , ৮২ , ৮৩ , ৮২৫ টাকা , সুজন রায়ের মতে , ঔরঙ্গজেবের আমলে ৩২ , ৬৮ , ১৬ , ৫৮৪ টাকা , এই রাজস্বের ৬ % ভাগ বাণিজ্য শুল্ক থেকে এবং ৪ % ঔরঙ্গজেব জিজিয়া থেকে পেতেন । বাকি সব রাজস্ব কৃষি খাতে আদায় হত ।       বাবর ভারতবর্ষ জয় করে অধিকৃত অঞ্চলের সমস্ত জমি ইক্তা হিসেবে অভিজাতদের মধ্যে বন্টন করে দেন । দেশের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য ও সংগৃহীত হত । হুমায়ুন এ ব্যাপারে কোন পরিবর্তন ঘটাননি । মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা গঠন করেন আকবর । আকবরের আগ...