ব্রিটিশ ভারতে ভূমি রাজ্য বন্দোবস্তের আঞ্চলিক তারতম্য ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা জমিদারি ব্যবস্থা, মাদ্রাজ ও বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের মহলওয়ারি বন্দোবস্ত এবং অযোধ্যা অঞ্চলে তালুকদারী বন্দোবস্ত প্রচলিত হয়েছিল। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের ফলশ্রুতি হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বনিক ও মহাজনদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। রাষ্ট্রের রাজস্ব চ চাহিদা মেটাতে গিয়ে কৃষকরা প্রায়ই বণিক ও মহাজনদের দারস্ত হতেন। জমি ক্রমশ অধমর্ন কৃষকদের হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী কালীন সময়ে ভারতে উপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে ও দেশীয় রাজ্য জন্য বর্গের বিরুদ্ধে কৃষক অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ইউরোপীয় আবাদকারী ও দেশীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষক অভ্যুত্থান শুরু হয়। এই আন্দোলনগুলির মধ্যে ছিল দ্বারভাঙ্গার চাষীদের প্রজাস্বত্ব আদায়ের সংগ্রাম এবং ভাগলপুরে নীলকর বিরোধী আন্দোলন। ১৯১৯ - ২০ খ্রিস্টাব্দে বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সংগঠিত আন্দোলনগুলির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বামী বিদ্যানন্দ। বিহারের প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভায় বিদ্যানন্দ প্রস্তাব দেন যে দ্বারভাঙ্গার মহারাজার অধীনস্থ কৃষকদের ক্ষোভ ও অসন্তোষের বিষয়ে জানার জন্য কংগ্রেস একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করুক। কিন্তু বিদ্যানন্দের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন রাজেন্দ্র প্রসাদ। বিদ্যানন্দ কৃষকদের সমর্থনে একটি জনসভার আয়োজন করলে কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকরা এই সভায় ভাঙচুর চালিয়ে সভা বন্ধ করে দেন। কৃষকরা জমিদারি ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে থেকেই তারা নিজেদের অবস্থার উন্নতি চেয়েছিলেন, তা সত্ত্বেও কংরেস কৃষকদের দাবি সমর্থন করেনি। ভাগলপুর নীলচাষীদের আন্দোলনে কংগ্রেস যেমন বিরোধিতা করেননি, তেমনি সমর্থনও করেননি।
১৯২০ দশকের শুরুর দিকে সামন্ততন্ত্র বিরোধী কৃষক অভ্যুত্থানের উল্লেখযোগ্য কেন্দ্রভূমি ছিল রাজস্থান। ১৯১৫ – ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বিজলিয়াতে কৃষক প্রতিরোধ হয়েছিল। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে উইলকিনশনের রাজপুতানা এজেন্সি রিপোর্টে বলা হয়েছে মেবার বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। একদল দেশদ্রোহী সেখানে প্রচার করছে সমস্ত মানুষের সমান অধিকার। জমির ওপর কৃষকের অধিকার রয়েছে, জমির মালিকানা রাষ্ট্র বা জমিদারের নয়। যদিও আন্দোলন শুরু হয়েছিল মহারানার বিরুদ্ধে, তথাপি তা যেকোনো সময় ব্রিটিশ বিরোধী রূপ নিতে পারে বলে উইলকিনশন আশঙ্কা করেছিলেন। তবে তার সেই আশঙ্কা অমূলক ছিল না। বিজয় সিং পথিক ও মানিকলাল ভার্মার নেতৃত্বে ওই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন সংগটিত হয়। মতিলাল তেজাওয়াতা নামে উদয়পুরের এক মসলা ব্যবসায়ী নিজেকে গান্ধীর প্রতিনিধি বলে দাবি করে মেবারের বিল জনগোষ্ঠীকে আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকে। উদয়পুরের মহারানা কঠোর দমনন নীতি গ্রহণ করে কৃষক অভ্যুত্থান দমন করতে চেয়েছিলেন। কংগ্রেস মহারানা সরকারের দমননীতির নিন্দা করে। তবে মদনমোহন মালব্য মহারানাকে রাজি করিয়ে কৃষকদের জন্য কিছু সুযোগ সুবিধা আদায়ের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কৃষক বিদ্রোহ দমন করার তাগিদে ভিল চাষী অধ্যুষিত মেবারের দুটি গ্রাম পুলিশ ভস্মীভূত করে। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে রাজস্থানের আলোড়শ অঞ্চলে প্রতিবাদী কৃষকদের ওপর গুলি চালিয়ে পুলিশ ১৫৬ জনকে হত্যা করে।
অসহযোগ আন্দোলনের সমসাময়িক জঙ্গি কৃষক বিদ্রোহ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দক্ষিণ ভারতের মালাবার অঞ্চলে মোপলা বিদ্রোহ। মোপলারা ছিলেন মুসলিম ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্গত একটি গোষ্ঠী। হিন্দু-জেনমি’দের বা জমিদারদের শোষণ দরিদ্র মোপলা কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। উনিশ শতকে তারা বহুবার জেনমি'দের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসের নতুন করে মোপলা কৃষকদের বিদ্রোহ শুরু হয়। মুসলমান ইজারাদার ও চাষীদের ওপর হিন্দু জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচার এবং মুসলমান ধর্মীয় জঙ্গি মনোভাবের দীর্ঘ পরম্পরা এই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারিতে মোপলাদের মধ্যে প্রচার চালাতে গিয়ে গ্রেফতার মাধবন নায়ার, গোপাল মেনন, ইয়াকুব হাসান ও মোইদিন কোয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেস ও খিলাফৎ নেতারা। এর ফলে মোপলাদের ধুমায়িত ক্ষোভ একটি সহিংস বিদ্রোহ প্রজ্বলিত করে। বিদ্রোহীরা সরকারি দপ্তর, পুলিশ চৌকি আক্রমণ করে, অত্যাচারী ভূস্বামীদের বাড়িতে হামলা চালায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ব্রিটিশ সরকার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস প্রয়োগ করে মোপলা বিদ্রোহ দমন করে।
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে কৃষক বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল যুক্তপ্রদেশ। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে মদন মোহন মালকদের উদ্যোগে প্রথম যুক্তপ্রদেশে কিষান সভা গঠিত হয় এলাহাবাদ জেলায়। এই কিষান সভার কর্মসূচিতে বলা হয় যে ক) কৃষক ও জমিদারদের মধ্যে শত্রুতামূলক সম্পর্কের অবসান করে সুসম্পর্ক স্থাপন করা। খ) কৃষকদের স্বার্থ রক্ষাকারী আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। গ) গ্রাম পঞ্চায়েত গঠন করে তার মাধ্যমে কৃষকদের উন্নতি ঘটানো। ঘ) শাসক ও শাসিতের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯২০ দশকের শুরুর দিকে যুক্ত প্রদেশে রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিল কৃষক আন্দোল। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যা তালুকে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করতে প্রয়াসী হন ঝিঙ্গুরি সিং ও দুর্গাপাল সিং। এছাড়া অপুর এক কৃষক নেতার আবির্ভাব ঘটেছিল, যিনি বাবা রামচন্দ্র নামে খ্যাত ছিলেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে বাবা রামচন্দ্র জৌনপুর ও প্রতাপগড় জেলার কয়েকশ রায়তকে নিয়ে এলাহাবাদ জান ও গৌরীশংকর মিশ্র ও জহরলাল নেহেরুর সঙ্গে দেখা করে কৃষকদের দুর্দশা সম্পর্কে তাদের অবহিত করেন।
প্রতাপগড় জেলায় জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করার ঘটনা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। এলাকার তালুকদাররা নিয়মিত খাজনার বাইরে কৃষকদের কাছ থেকে 'বেদখালী' ও 'নজরানা' নামে কর আদায় করতেন। কৃষক নেতা গৌরী শংকর মিশ্র কৃষকদের থেকে বেদখলী ও নজরানা, কৃষক উচ্ছেদ এর মত বিষয়গুলি প্রতাপগড়ের ডেপুটি কমিশনারকে জানান। ডেপুটি কমিশনার মেহতা কৃষকদের অভিযোগের তদন্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কমিশনার ছুটিতে গেলে তালুকদাররা কৃষক আন্দোলনের ওপর আঘাত হানে। চুরির মিথ্যা অভিযোগ এনে বাবা রামচন্দ্রকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে প্রতাপগড় জেল অবরোধ করে কৃষকেরা এবং রামচন্দ্রকে মুক্তি দেয়। অযোধ্যা তালুকের কৃষকদের এই বিজয় তাদের ঐক্য আরও সুদৃঢ় করে। অযোধ্যার কিষান সভা কৃষকদের কাছে বে দখলি জমি চাষ না করতে, হারি ও বেগারসম না দিতে, যারা এই শর্ত মানবে না তাদের বয়কট করতে ও পঞ্চায়েতের মাধ্যমে নিজেদের বিরোধ মীমাংসা করতে আহ্বান জানান। বাবা রাম চন্দ্র ছাড়াও আর্য সমাজী কেদারনাথ, বেনারস গান্ধী আশ্রমের দেও নারায়ণ পান্ডে প্রমূখ এই কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। উঁচু ও অনগ্রসর উভয় জাতির কৃষকরা এই আন্দোলনে যোগ দেয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলনের লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে। রায়বেরেলির ফয়জাবাদ ও সুলতানপুর জেলায় বাজার ও শস্যগোলা লুট এবং পুলিশের সঙ্গে কৃষকদের সংঘর্ষ ঘটে। তালুকদারদের বাড়ি ও সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়।
১৯২১ ২২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-পশ্চিম অযোধ্যায় হয়দই, বাহরাইচ, বরাবাঁকি ও সীতাপুর জেলায় একা আন্দোলন শুরু হয়। একা আন্দোলন শুরু করেন স্থানীয় কিছু কংগ্রেস নেতা। কিন্তু এই আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ কমে চলে যায় Radical মাদারি পারসির হাতে। অন্যান্য অনগ্রসর জাতির নেতারাও আন্দোলনের শামিল হয়। আন্দোলনের মূল দাবি ছিল পণ্যের বদলে নগদ টাকায় খাজনা দেওয়া। কৃষকরা এতে লাভবান হতে পারত কারণ পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মাদারি পাসিকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং সরকার দমননীতি চালিয়ে একা আন্দোলন দমন করে।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় অসহযোগ আন্দোলনের নেতারা গ্রামাঞ্চলে চাষীদের পাট চাষ বন্ধ করার দাগ দেন। উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ মালিকানাধীন চটকল গুলির ক্ষতি সাধন। কিন্তু কৃষকদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে রাজশাহী নদিয়া ও পাবনা মুর্শিদাবাদ সীমান্তে শ্বেতাঙ্গ মালিকানাধীন মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন সংঘটিত করার প্রয়াস অনেক বেশি সফল হয়েছিল। কৃষক সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কলকাতার ছাত্র সোমেশ্বর প্রসাদ চৌধুরী। চিত্তরঞ্জন দাস সোমেশ্বর প্রসাদকে ব্যক্তিগতভাবে কৃষক আন্দোলন সংঘটিত করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তবে তিনি সতর্ক করেছিলেন যে খাজনা বন্ধের উদ্যোগ কংগ্রেস সরকারিভাবে সমর্থন করবে না। তবে অসহযোগ আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে বাংলার ঢাকা পাবনা খুলনা ও নদীয়ার ভাগচাষী বা বর্গাদাররা ভূমিস্বত্ব লাভের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনকারীরা অধিকাংশই ছিলেন নমঃশূদ্র ও মুসলমান। বাংলা রাজনীতিতে প্রভাবশালী চিত্তরঞ্জন দাসের নেতৃত্বাধীন স্বরাজ্য দল বর্গাদারদের ভূমিস্বত্ব দানের বিষয়টি সমর্থন করেননি। ১৯২০ দশকের শেষ দিকে বাংলার কৃষিতে কতগুলি নতুন বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ ও কৃষি ক্ষেত্রে পরিবর্তিত শ্রেণীবিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে এক নতুন সম্পন্ন কৃষক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছিল।
দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রের গুন্টুর জেলায় কৃষক আন্দোলন ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই সময়ের কৃষকরা সরকারকে রাজ্য দেওয়া বন্ধ করেন। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন আঞ্চলিক কৃষক নেতারা এবং কোন্ডা ভেঙ্কটাপ্পাইয়া, টি. প্রকাশন প্রমূখ শীর্ষস্থানীয় কংগ্রেস নেতারা। অন্ধ্রপ্রদেশে আন্দোলনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল রাম্পা অঞ্চলের আধা জনগোষ্ঠীর আন্দোলন। রামপাল অঞ্চলের এই জঙ্গি অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন আল্লুরি সীতারাম রাজু। আল্লু দি সীতারাম রাজু নেতৃত্বে 1922 খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাম্পা অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল স্থানীয় মহাজনদের চিরাচরিত শোষণ এবং বিভিন্ন অরণ্য আইন। এই আইন গুলি জারি করে সরকার স্থানীয় মানুষের ঝুম চাষ করার অধিকার এবং ঐতিহ্যগত চারণ অধিকার খর্ব করেছিল। আল্লুরি সীতারাম রাজুর নেতৃত্বে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু করলে মালাবার অঞ্চলে নিযুক্ত বিশেষ পুলিশ বাহিনী ও আসাম রাইফেলের সাহায্যে রাম্পা বিদ্রোহ দমন করতে মাদ্রাস সরকার ১৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ছয় মেয়ে আল্লুরি সীতারাম রাজুকে পুলিশ হত্যা করে। সীতারাম রাজুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে রাম্পা প্রতিবাদী অভ্যুত্থানের পরিসমাপ্তি ঘটে।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুরাট জেলায় বারডুলি তালুতে খাজনা বন্ধের যে আন্দোলন হয়েছিল গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহী পন্থার সফল প্রতিফলন ঘটেছিল এই আন্দোলনের মধ্যে। এই অঞ্চলের পাতিদাররা ছিলেন সম্পন্ন কৃষক। কুনবি পাতিদার জাতির লোক হিসেবে তারাই বারদলি তালুকে জমির মালিকানা ভোগ করতেন। কুনওয়ারজি মেহতা, কল্যাণজী মেহতা, দয়ালজি দেশাই প্রমূখ গান্ধীবাদী নেতার নেতৃত্বে তারা সংঘটিত হয়। পাতিদার যুবক মন্ডলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্যাটেল বাদ্দলিতে আসেন এবং অন্যান্য আঞ্চলিক নেতাদের সহযোগিতায় উচ্চবর্গীয় পাতিদার ও নিম্নবর্গীয় কালিপারাজ'দের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের জন্য জাতপাতের সম্পর্ক, সামাজিক বয়কট, ধর্মীয় আবেদন ও ভজনগানের প্রচন্ড কুশলী ব্যবহার করেন। প্যাটেল দরিদ্র ও শোষিত রায়তদের উপদেশ দেন তাদের সাহুকারদের (মহাজন) সঙ্গে মিশে কাজ করতে হবে। সরকারের তরফ থেকে রাজস্ব চাহিদা হ্রাস করার জন্য পাতিদারদের রাজস্ব বন্ধ আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিল নিম্নবর্গীয় অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কৃষকদের অকুন্ঠ সমর্থন। কিছুদিনের মধ্যেই বারদলি একটি জাতীয় বিষয়ে পরিণত হয়। আমেদাবাদের বস্ত্র কারখানার সমীদ্রা বারদলি আন্দোলনকারীদের সংহতি জানানোর জন্য এগিয়ে আসেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার বারদলি আন্দোলন দমন করার জন্য পুলিশ ও সামরিক বাহিনী পাঠানোর পরিকল্পনা করে। তবে সরকার এই পরিকল্পনা থেকে সরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় বারদলির বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে এবং কৃষকদের বাজেয়াপ্ত জমি তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তদন্ত কমিটির সুপারিশে রাজস্বের হার কমানোর আন্দোলনে বারদলি সত্যাগ্রহ চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে। তবে এই আন্দোলনের সাফল্য সম্পন্ন কৃষকদের স্বার্থে পরিচালিত হয়েছিল।
১৯২০ দশকের শেষ দিকে বামপন্থী শক্তি কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। ১৯২৬ সালে কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী রাজনীতিবিদরা ওয়ার্কার্স এন্ড পিজেন্টস পার্টি গঠন করেন। বাংলা বোম্বে উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের এই সংগঠন সক্রিয় ছিল। ১৯২৬২৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলায় প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ধরণী গোস্বামী ইয়ং কমরেডস্ লিগ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। এই সংগঠনের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের রাজশাহী ও ময়মনসিংহ জেলায় একটি জমিদার ও মহাজন বিরোধী কৃষক অভ্যুত্থান শুরু হয়। ব্রিটিশ সরকার একদিকে জমিদার ও মহাজনদের স্বার্থ রক্ষা করতে এগিয়ে আসে, অন্যদিকে আবার মুসলমান চাষীদের পরোচিত করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর প্রয়াস চালায়।
১৯৩০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল এবং কংগ্রেসের বামপন্থী অংশ সম্মিলিতভাবে একটি সার্বভারতীয় কৃষক সংগঠন গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে সারা ভারত কিষান সভা গঠিত হয়। কমিউনিস্টরা কৃষক সভায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। ১৯৩৫ থেকে ৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিহারে স্বামী সহজানন্দের নেতৃত্বে কৃষক সভার সদস্য সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিহার কিষান সভার মূল সামাজিক ভিত্তি ছিল ভূমিহারারা, হরিজন বা জনগোষ্ঠীর খেদমজুররা নন। ফ্লাউড কমিশনের কাছে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার স্মারকলিপিতে জমিদারি বিলোপের দাবি করা হয়। কিন্তু বর্গাদার বা ভাগচাষীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন দাবি সেখানে রাখা হয়নি।
১৯৩৭ - ৩৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজ্য জন্য শাসিত দেশীয় রাজ্য গুলিতে কৃষক প্রতিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। উড়িষ্যার ঢ়েঙ্কানলে জনগোষ্ঠীর মানুষ প্রতিবাদী সংগ্রামে শামিল হন। বেগার শ্রম, বনজ উৎপাদনের ওপর কর, উৎসব উপলক্ষে উচ্চবর্ণজাত ভূস্বামীদের বলপূর্বক উপহার আদায়, রায়তির অধিকার ইত্যাদি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ক্ষুব্ধ হয় জনগোষ্ঠীর মানুষ। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে সমাজবাদী কংগ্রেস নেতা নবকৃষ্ণ চৌধুরী নেতৃত্বে ঢ়েঙ্কানলের রণপুর অঞ্চলের ব্রিটিশ রাজনৈতিক এজেন্ট মেজর বারজেলগেট জনতার ওপর গুলি চালালে তাকে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা হয়। রাজ্য জন্য শাসিত হায়দ্রাবাদের নিজামের অত্যাচারী শাসনের জর্জরিত ছিলেন এলাকার মানুষ। নিজাম ও ইত্তাহাত উল মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচার চালায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি আর্য সমাজ ও হিন্দু মহাসভা।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনার পরই দেখা যায় সারা ভারত কৃষক সভার ওপর কমিউনিস্টদের প্রভাব সুদৃঢ় হয়েছে। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধ লাইন গ্রহণ করে এবং সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলার নীতি গ্রহণ করে। এর ফলে কমিউনিস্ট প্রভাবিত কৃষক সভার অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা কমিউনিস্টদের ভাবমূর্তি পুরোপুরি নষ্ট করেছিল। এন জি রাঙ্গা এই পরিস্থিতিতে কৃষক সভা পরিত্যাগ করে সারা ভারত কিষান কংগ্রেস গঠন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন গণ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কমিউনিস্টরা তাদের বিনষ্ট ভাবমূর্তি অনেকটাই উজ্জ্বল করে তুলতে সফল হয়।
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতবর্ষে গান্ধীবাদী জাতীয় সংগ্রামকে কেন্দ্র করে কৃষক আন্দোলন নতুন করে উঠে আসে। শোষণ ও বঞ্চনার জর্জরিত কৃষকরা জাতীয় মূর্তি সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গতি দেখে তাদের প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু কৃষক বিদ্রোহ গুলি কখনোই সর্বভারতীয় রূপ পায়নি, কারণ কংগ্রেস কখনোই দরিদ্র কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। কৃষক বিদ্রোহীরা অনেক সময়ই গান্ধীর নামে আন্দোলনে অবতীর্ণ হলেও গান্ধী বিদ্রোহীদের পাশে এসে দাঁড়াননি। কোনো কোনো কংগ্রেস নেতা ব্যক্তিগতভাবে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু সংগঠন হিসাবে কংগ্রেস কৃষক বিদ্রোহকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইনি। জমিদারদের সম্পত্তির অধিকার লঙ্ঘিত হোক কংগ্রেস নেতৃত্ব তা চাইনি। যে কোনো জঙ্গি কৃষক বিদ্রোহের মুখে কংগ্রেস কার্যনির্বাহী কমিটি বা নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি অনেকবারই শ্রেণী যুদ্ধকে নিন্দা করে প্রস্তাব নিয়েছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন