সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট আলোচনা কর



১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটায়। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে প্রথম একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়েছিল। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ফসল, ব্রিটিশ শাসকরা একটি সম্ভাব্য গণবিদ্রোহের ভয়ে ভীত হয়ে গণরোষকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে একটি সর্বভারতীয় ব্রিটিশ অনুগ্রহপুষ্ট সংগঠন গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়েছিল। আবার অন্য একদল ঐতিহাসিক মনে করেন যে সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাসমূহের প্রতিক্রিয়া হিসাবে একটি সর্বভারতীয় সংগঠন গড়ে ওঠা অবসম্ভাবী ছিল। ভারতীয় উচ্চবিত্ত ও উচ্চবর্গ এবং বুদ্ধিজীবীরা তদানীন্তন রাজনৈতিক পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিয়ে সচেতনভাবেই এই সর্বভারতীয় সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং সাফল্য লাভ করেছিল।
উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের বিশেষ প্রসার ঘটে এবং এর ফলশ্রুতিতে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়। এই সময় ভারতীয়দের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটলে শিক্ষিত ও সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমশ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দেয়। ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন এবং স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি বিষয়ে তারা সচেতন হয়ে ওঠে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা উত্তরোত্তর উপলব্ধি করতে থাকে যে ব্রিটিশ শাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা। এই অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ভারতীয় ৩ বুদ্ধিজীবী বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এঁরা হলেন দাদাভাই নওরোজি, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে এবং রমেশচন্দ্র দত্ত। দাদাভাই নওরোজি poverty and unbritish rule in India গ্রন্থে ভারতীয়দের সম্পদের নির্গমনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করেন। রানাডে এই সময় ভারতীয়দের আধুনিক শিল্প বিকাশে তাৎপর্য সম্পর্কে অবহিত করেন। অবসরপ্রাপ্ত আইসিএস অফিসার রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর economic history of India গ্রন্থে ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক শোষণের চিত্র সুনিপুণভাবে বিশ্লেষণ করেন। এদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়েছিল যে উনিশ শতকীয় উপনিবেশবাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে ব্রিটেনের খাদ্য ও কাঁচামাল সরবরাহকারী একটি দেশে পরিণত করা। এর ফলে ভারতীয় জনমানুষে ব্রিটিশ বিরোধী উষ্মার সঞ্চার হয়েছিল।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী ২ দশকে জাতীয়তাবাদী কর্মসূচির অগ্রগতি ছিল মন্থর। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড লিটন ভারতের ভাইসরয় হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করার পর তার শাসনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে জাতীয়তাবাদী কর্মধারার মন্থরগতি দ্রুত হয়ে ওঠে। লিটনের পূর্বসূরী ভাইসরয় লর্ড নর্থব্রুক ভারতীয়দের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের কথা মাথায় রেখে ভারতীয় জনবিরোধী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তিনি সংবাদপত্র আইন প্রয়োগ করেননি। তিনি আয়কর তুলে দিয়েছিলেন। ল্যাঙ্কাশায়ার শিল্পপতিদের প্রবল চাপ সত্বেও তিনি ব্রিটিশ শিল্পজাত বস্ত্রের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক তুলে দেন নি। কিন্তু লর্ড লিটল খোলাখুলি ভাবে অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল ও ভারত বিরোধী কর্মসূচি গ্রহণ করেন। যার ফলশ্রুতি হিসেবে ভারতীয় জনমানষে ক্ষোভের সঞ্চার করে। লিটনের উদ্যোগে দেশীয় মুদ্রাযন্ত্র আইন পাশ করে সরকার বিরোধী মতবাদের কণ্ঠরোধ করেন। এই আইনের বিরুদ্ধে সারাদেশব্যাপী তীব্র অসন্তোষ, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ দেখা দেয়। কলকাতা টাউন হলে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এক বিরাট প্রতিবাদ সভা আয়োজিত হয়। বম্বের প্রেসিডেন্সি অ্যাসোসিয়েশন, পুনা সার্বজনিক  সভা মাদ্রাজের মহাজন সভা কলকাতাবাসীর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে লর্ড রিপন এই আইন বাতিল করেন।
লিটনের প্রশাসনিক পদক্ষেপ গুলির বিরুদ্ধে গোটা দেশ জুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সাম্রাজ্যিক দরবার হয়, রানী ভিক্টোরিয়া ভারতের সাম্রাজ্ঞী উপাধি গ্রহণ করেন। লর্ড লিটন বেশ আরাম্বরে সেই অনুষ্ঠান পালন করেন, যদিও তখন দেশের কিছু কিছু জায়গায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। ঔপনিবেশিক সরকার এই বিষয়ে উদাসীনতা দেখালে ব্রিটিশ শাসনের শোষণ মূলক ও সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের নগ্নরূপ উদঘাটিত হয়। লিটনের পর ভারতের ভাইসরয় হিসেবে রিপন নিযুক্ত হয়। তিনি ভারতীয় শিক্ষিতদের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের কারণ অনুসন্ধান করেন এবং এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা শিক্ষিত ও উচ্চবর্গের ভারতীয়দের খুশি করেছিল। প্রশাসনিক উন্নতির স্বার্থে তিনি সীমিত অর্থে ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে রিপন তাঁর স্বায়ত্তশাসন নীতি ঘোষণা করেন। এই নীতির বৈশিষ্ট্য ছিল জেলার পরিবর্তে মহকুমার হবে স্থানীয় শাসনের সর্বোচ্চ ভৌগোলিক পরিধি। এই স্থানীয় বোর্ডের তত্ত্বাবধানে কতকগুলি প্রাথমিক বোর্ড থাকবে। ভারতবর্ষে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের বিষয়ে রিপনের উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপীয় গণতন্ত্রের দাচে একটি প্রতিনিধিত্ব মূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে বুদ্ধিমান ও প্রভাবশালী লোকেরা স্থানীয় ব্যাপারে উৎসাহ এবং সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে।
রিপোর্টের শাসনকালের আরেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ইলবার্ট বিল সংক্রান্ত বিতর্ক। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ২রা ফেব্রুয়ারি ভাইসরয় কাউন্সিলের আইন সদস্য সি পি ইলবার্ট তাঁর কুখ্যাত ইলবার্ট বিল চালু করেন। এই বিলে জেলা শাসকদের এবং দায়রা বিচারকদের ছোট মফ: স্বল শহরে ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। এরফলে বেরিয়ে পড়ে ইঙ্গ ভারতীয় জাতি বৈধতার কুৎসিত রূপ “শ্বেতাঙ্গদের বিদ্রোহ'। ভারতীয়রা ব্রিটিশের বিচার করবে একথা শুনেই ব্রিটিশেরা একেবারে শিউরে ওঠে। এরা বিরাট সংখ্যক ব্রিটিশ আধিকারিক সহ বহু ইঙ্গ ভারতীয় রাও ইলবার্ট বিলের বিরোধিতা করে। এক কলমের খোঁচায় সমতা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে জাতিগত পার্থক্য উপেক্ষা করেছে বলে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর রিভার্স টমপসন উক্ত বিলের নিন্দা করেন বলে জানা যায়। ইলবার্ট বিল বিতর্ক থেকে শিক্ষিত ভারতীয়রা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল বর্তমান ব্রিটিশ শাসনের আমলে জাতিগত সমতার আশা করা বাতুলতা মাত্র। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড রিপন চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন এবং বিলটি প্রত্যাহার করে নেন।  তখন ভারতীয় নেতারা সহজেই বুঝেছিলেন যে সর্বভারতীয় স্তরে আন্দোলনের সমন্বয় ঘটানো সম্ভব হয়নি বলেই তাঁরা ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁদের এই ব্যর্থতা প্রতিহত করার জন্য একটা সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হবার আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমিতি গুলি রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিকাশের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিশেষত প্রেসিডেন্সি গুলিতে এই ধরনের সমিতিগুলি গড়ে উঠেছিল। বাণিজ্য ও কোম্পানি প্রশাসন সর্বপ্রথম এই শহরগুলির সনাতন সাবেকী কাঠামোয় পরিবর্তন এনেছিল। অনিল শীল লিখেছেন সমিতিগুলি ঊনিশ শতকীয় ভারতকে আধুনিক রাজনীতির দ্বার প্রান্তে এনে উপনীত করেছিল। প্রথমদিকে ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত প্রভৃতি বিষয়ের উপরে ভিত্তি করে সমিতি গুলি গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। বহু ক্ষেত্রেই সমিতি গুলি রাজনৈতিক প্রস্তাব গ্রহণ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে সচেতন হয়েছিল। ইংরেজ কোম্পানির প্রশাসন বাণিজ্য নীতি ও ভূমি রাজস্ব নীতির অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে বাংলাদেশে এক নয়া অভিজাত শ্রেণীর সৃষ্টি করেছিল। এদের মধ্যে কেউ ব্রিটিশ বাণিজ্যের সহযোগী মুৎসুদ্ধি হিসাবে যথেষ্ট ধনী হয়ে উঠেছিলেন, আবার কেউ ছিলেন কলকাতায় বসবাসকারী অনুপস্থিত জমিদার। অমলেশ ত্রিপাঠীর ভাষায় বেনিয়ানগিরি ও জমিদারির কল্যাণে অভিজাতকদের সঙ্গে সরকারি বেসরকারি ইংরেজদের সম্পর্ক অনেক নিবিড় ছিল। এই শ্রেণীর মুখপাত্র হিসেবে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণ ভারতীয়দের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষাও এই সমিতির কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যেকোনো প্রজাস্বত্ব আইনের ঘোর বিরোধী ছিল। এই সমিতির নেতৃত্বে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর আলেকজান্ডার ম্যাকেনজি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের এর গুরুত্ব কে স্বীকৃতি দিলেও এই প্রতিষ্ঠান ছিল জমিদার ও বানিয়াদের স্বার্থ রক্ষার দুর্গ। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকলাপ স্পষ্টই প্রমাণ করে যে এই সমিতি সাধারণ দরিদ্র ভারতীয় দূরের কথা এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চাহিদা ও দাবী দেওয়ার বিষয়ে সম্যকভাবে সচেতন ছিল না।
ঔপনিবেশিক ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থকেন্দ্র িক একটি সমিতি প্রয়োজন তীব্র হয়ে উঠেছিল। বাংলার ইংরেজি শিক্ষিত নবোদিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী এমন একটি সংগঠন তৈরি করতে চেয়েছিলেন যেখানে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে এমন ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও দ্বারকানাথ মিত্র। নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত বাঙালি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে মেনে নিতে পারেননি। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে শিশির কুমার ঘোষ এবং তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হেমন্ত কুমার ঘোষ বাংলার সমস্ত জেলার রাজনৈতিক সমিতি গুলিকে সংগঠিত করতে উদ্যোগী হন। ১৮৭৫ এর মধ্যেই বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, যশোহর, খুলনা, ঢাকা, রাজশাহী, হুগলি প্রকৃতি অঞ্চলে রাজনৈতিক সমিতি গুলি সংঘটিত হয়ে ওঠে। এগুলির কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ইন্ডিয়ান লীগ। ইন্ডিয়ান লীগ প্রতিষ্ঠার উপলক্ষে শিশির কুমার ঘোষ লিখেছিলেন ঘোষণার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি প্রথম দৃষ্টান্ত। এই প্রতিষ্ঠান গোটা জাতিকে এতে যোগ দেওয়ার এবং তাদের মনের মত করে এটিকে গড়ে তোলবার আবেদন জানাচ্ছে।
কিন্তু এক বছরের মধ্যে ইন্ডিয়ান লীগের অনৈক্য প্রকট হয়ে ওঠে। শিশির কুমার ঘোষ কে কেন্দ্র করে নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। নব্য শিক্ষিত রাই সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে নতুন সংগঠন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন। এই সংগঠনের স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা। মাৎসিনির প্রেরণাপ্রসূত ঐক্যবদ্ধ ভারত ভাবনা সমগ্র ভারতকে এক সাধারণ মঞ্চে উপস্থাপিত করার ভাবনা বাংলার নেতাদের মন আচ্ছন্ন করেছিল। সিভিল সার্ভিস আইনের বিরুদ্ধে ভারত সভা প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। বিলাকি শ্রুতি বস্ত্রের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার, অস্ত্র আইন, দেশীয় মুদ্রাযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন প্রভৃতি সরকারি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ভারত সভা সরব হয়েছিল। ভারতে ইংরেজ সরকার ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে যখন খাজনা আইনের খসড়া সম্পর্কে কৃষকদের দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই করতে চেয়েছিল তখন ভারত সভা রায়তদের নিয়ে একাধিক জনসভা সংগটিত করেছিল। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ভারত সভা বিলের পরিবর্তিত খসড়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে শেষ পর্বে ভারত সভা বিলের সমর্থনে অনেকগুলি জনসভা করে। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রজাস্বত্ব বিল আইনে পরিণত হয়।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও আদিপর্বের ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা ও অসঙ্গতি বোঝা গিয়েছিল। কারণ এই উচ্চবর্ণীয় হিন্দু নেতারা তাদের সামাজিক রক্ষণশীলতা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পুনা সার্বজনিক সভার দুই নেতা ও তাঁদের অনুগামীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধে যায়। একদিকে ছিলেন অধিকতর রক্ষণশীল বালগঙ্গাধর তিলক, অন্যদিকে উদারনৈতিক সংস্কারপন্থী গোপালকৃষ্ণ গোখলে। এই ভাবেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্ম রক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। বাংলা ও মারাঠি দেশপ্রেম মূলক সাহিত্যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে হিন্দু রূপকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। ঔপনিবেশিক নীতিও হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়াকে উৎসাহ দেয়। আর্য সমাজ গোরক্ষন আন্দোলন শুরু করতেই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ গণ মাত্রা পেয়ে যায়। ১৮৭০ এর দশক থেকে বড় মাপের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উত্তর ভারতকে কাঁপিয়ে তোলে। মাদ্রাজ নেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের নবীন ও প্রবীণ নেতৃত্বদের মধ্যে বিরোধ ক্রমশ বাড়তে থাকে। সরকারি কর্মচারী কারমাইকেলের বিদায় সম্বর্ধনা কে কেন্দ্র করে এই বিরোধ তীব্র রূপ নিয়েছিল। সুব্রহ্মণ্যম আয়ার বিজয়রাঘবাচারী, রঙ্গিয়া নাইডু আনন্দ চারলু প্রভৃতি নবীন নেতারা একটি স্থায়ী সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগী হন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ মহাজন সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এদের লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায়, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে, বিশ্ববিদ্যালয়, বণিক সংগঠন গুলিতে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠা করতে।
এইসব আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল মূলত তাদের নিজেদের অগ্রগতি ঘটানো। তাদের উদীয়মান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানের ওপর ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র বলে মনে করে। এই উপনিবেশিক সরকারকে তারা মনে করত তাদের পৃষ্ঠপোষক ও মুক্তিদাতা। ঔপনিবেশিক ভারতীয় সমাজে এইসব অসংগতির সুযোগ নিয়েছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। তারা মদত যুগিয়ে ছিল যাতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আরও সীমাবদ্ধ ও দুর্বল হয়ে পড়ে। এইরকম পরিস্থিতিতে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়। পরবর্তীকালে সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কংগ্রেস জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে পরিচালনা করে।
ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান না থাকার ফলে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে গড়ে ওঠা সংগঠনগুলি নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি করলেও জাতীয় স্তরে কোন প্রকার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এই রূপ পরিস্থিতিতে ভারতীয় জনসাধারণের মনে ব্রিটিশ বিরোধী ক্ষোভ অসন্তোষ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এইরূপ প্রেক্ষাপটে সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা আবশ্যক হয়ে উঠেছিল। তবে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সর্বাধিক কৃতিত্ব ছিল অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সিভিলিয়নের। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হিউমের অন্য উদ্দেশ্য ছিল। হিউমের জীবনীকার স্যার উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন লিখেছেন যে ৩০ হাজার গোয়েন্দা রিপোর্ট পড়ে হিউম আশঙ্কা করেছিলেন যে ভারত খুব শীঘ্রই একটি ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লব গড়ে তুলবে। এই আশঙ্কা থেকে হিউম বড়লাট ডাফরিনের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে তার পরিকল্পনার কথা জানান। ডাফরিন হিউমের পরিকল্পনা সমর্থন করলে সরকারি আনুকূল্যে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর বোম্বাই শহরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

       ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাই মুঘলদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বলে মনে করেন শিরিন মুসবি । শিল্প বাণিজ্য থেকে আয়ের পরিমাণ সামান্য । ভূমি রাজস্ব হল ‘ মাল ’ বা ‘ খারাজ ’ । মুঘলরাষ্ট্র সামন্তরাজাদের কাছ থেকে কর পেত । তাছাড়া রাষ্ট্র পেত যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ ( খামস ); স্থানীয় আবওয়াব জিহত , শয়ের - ই - জিহত , ফুরুয়াত , অমুসলমানদের উপর স্থাপিত কর জিজিয়া এবং মুসলমানদের দেয় কর জাকাত ।         আকবরের আমলে সরকারের মোট রাজস্ব পরিমাণ ছিল ১২ , ৮২ , ৮৩ , ৮২৫ টাকা , সুজন রায়ের মতে , ঔরঙ্গজেবের আমলে ৩২ , ৬৮ , ১৬ , ৫৮৪ টাকা , এই রাজস্বের ৬ % ভাগ বাণিজ্য শুল্ক থেকে এবং ৪ % ঔরঙ্গজেব জিজিয়া থেকে পেতেন । বাকি সব রাজস্ব কৃষি খাতে আদায় হত ।       বাবর ভারতবর্ষ জয় করে অধিকৃত অঞ্চলের সমস্ত জমি ইক্তা হিসেবে অভিজাতদের মধ্যে বন্টন করে দেন । দেশের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য ও সংগৃহীত হত । হুমায়ুন এ ব্যাপারে কোন পরিবর্তন ঘটাননি । মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা গঠন করেন আকবর । আকবরের আগ...