খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর সূচনাকাল পর্যন্ত প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকাকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। মগধ সাম্রাজ্য, মৌর্য সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য কার্যত; মগধকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। অন্যদিকে কুষাণরা বিদেশি হলেও সমগ্র উত্তর ভারতকেই অভিন্ন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিয়ে এসেছিল। পাশাপাশি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর সূচনাকালের আগে পর্যন্ত বিন্ধ্যর দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যকে কেন্দ্র করে কেবলমাত্র দুবার স্বতন্ত্র রাজ বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত সাতবাহন রাজবংশ এবং গুপ্ত সমসাময়িক কালে (৩০০-৫৫০) বাকাটকরা দাক্ষিণাত্যের বৃহদাংশকে ঐক্যবদ্ধভাবে শাসন করে। এছাড়াও অবশ্য মৌর্যরা দক্ষিণে মহীশূর পর্যন্ত অঞ্চল উত্তর ভারত থেকেই শাসন করেছিল। সুতরাং গুপ্ত যুগ পর্যন্ত সময়ে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য ছিল রাজনৈতিক কেন্দ্রিকতা (স্বল্পকালীন কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে)। কিন্তু গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবসানের পর থেকেই বা খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগ থেকেই প্রাচীন ভারতের ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার এই প্রবণতা নষ্ট হয়ে যায়। রাজনৈতিক পরিবর্তন হিসেবে দেখা যায় যে ভারতের বিভিন্ন স্থানে কি উত্তর, কি দক্ষিণ – সর্বত্রই আঞ্চলিক রাজশক্তির উত্থান ঘটছে। আঞ্চলিক রাজ শক্তির উত্থানের এবং পতনের এই প্রক্রিয়া ৬০০ খ্রিস্টাব্দের সমসাময়িক সময় থেকে শুরু হয়ে সুলতানি শাসনের সময়কাল পর্যন্ত বজায় ছিল। মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের মতে বিকেন্দ্রীকরণ এবং সামন্ততান্ত্রিক পরিকাঠামোর আবর্তে সমসাময়িক কালের রাজনৈতিক ইতিহাসে আঞ্চলিকতাবাদের বিকাশ ঘটেছিল। এই অধ্যায় আমরা দেখব গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের পর কিভাবে ভারতে আঞ্চলিক শক্তির উদ্ভব ঘটে এবং তা আদি মধ্যযুগীয় (৬০০-১২০০) ভারতীয় রাজনীতিকে কিভাবে প্রভাবিত করে।
৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শেষ শক্তিশালী গুপ্ত সম্রাট স্কন্দ
গুপ্তর রাজত্বকাল যখন শেষ হয় তখন কাথিয়াবাড়, সৌরাষ্ট্র, বাঘেলখন্ড ও মধ্য ভারত
এবং পুণ্ড্রবর্ধন (উত্তরবঙ্গ) ও কলিঙ্গ (উড়িষ্যার অঞ্চল বিশেষ) গুপ্ত সাম্রাজ্য ভুক্ত ছিল। কিন্তু স্কন্দ গুপ্তর মৃত্যুর মাত্র
অর্ধশতাব্দীর মধ্যেই গুপ্তদের এই উত্তর ভারতীয় সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। ৫৭৩ খ্রিস্টাব্দের সারনাথ লেখ, নালন্দা সীল, ১৯১ অব্দ – ৫১০ খ্রিস্টাব্দের এরান
লেখ, ভিতরী সীল, মুদ্রা, হিউয়েন সাঙের বিবরণ ও অন্যান্য উপাদান থেকে যে সকল তথ্য
পাওয়া যায় তার থেকে মনে হয় যে স্কন্দগুপ্তর পর অসংখ্য গুপ্ত রাজা শাসন করলেও
তারা কেউই স্বরূপ শক্তিশালী ছিলেন না। স্কন্দ গুপ্তর পর মোটামুটি উল্লেখযোগ্য গুপ্ত রাজারা হলেন দ্বিতীয় কুমার
গুপ্ত (৪৭৩-৭৪), বুদ্ধগুপ্ত (৪৭৮-৫০০), বৈন্য গুপ্ত (৫০৭-৮), নরসিংহ গুপ্ত, ভানু গুপ্ত (৫১০-১১), বিষ্ণু গুপ্ত, দ্বিতীয় সমুদ্রগুপ্ত। উপরোক্তদের মধ্যে অনেকেই রাজত্ব করেননি। নরসিংহ গুপ্ত বালাদিত্য খুনদের বিরুদ্ধে
সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। বাকিরা কোনক্রমে গুপ্ত শাসনকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন যদিও তাদের সেই
প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
সমসাময় কতগুলি ঐতিহাসিক বাস্তব গুপ্ত সাম্রাজ্যের
অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে। ৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বহিরাগত হুনদের প্রথম আক্রমণ ভারতবর্ষে রক্ষাকর্তা
স্কন্দ গুপ্ত প্রতিহত করলেও পরবর্তী পর্বের হুন আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা তার
দুর্বল উত্তরাধিকারীদের ছিল না। দক্ষিণপূর্ব আফগানিস্তানের কাবুল এলাকা থেকে এই সময়কার হুন নেতা তোরমান ভারত
আক্রমণ করেন এবং ষষ্ঠ শতকের গোড়ায় পাঞ্জাবের একাংশ উত্তরপ্রদেশের অংশবিশেষ এবং
পূর্ব মালব দখল করে নেন। পাঞ্জাবের কুরা, উত্তরপ্রদেশের কোসাম এবং মধ্যপ্রদেশের এরান নামক স্থানে
প্রাপ্ত লেখগুলি প্রমাণ করে যে উক্ত অঞ্চল গুলি তোরমানের অধিকারে এসেছিল। উপরোক্ত অঞ্চলগুলি থেকে তোরমানের মূর্তি এবং
ময়ূর প্রতিকৃতিযুক্ত মুদ্রা পাওয়া গেছে। বুদ্ধগুপ্তর শাসনকালের অবহিত পরেই ৪৯৫/৯৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু করে
৫১৪/১৫ খ্রিষ্টাব্দ
পর্যন্ত তোরমান উপরোক্ত অঞ্চলগুলি শাসন করেছিলেন। পরের দিকে গুজরাট এবং
কাখিয়াবাড় অঞ্চলেও তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং বলা চলে যে শতকের শেষ দিকেই পশ্চিম
ভারতের এক বিশাল অংশ গুপ্তদের অধিকারের বাইরে চলে যায়। তোরমানের পর তাঁর পুত্র মিহিরকুল পশ্চিম মালব, মধ্যভারত,
গন্ধার, কাশ্মীর প্রভৃতি অঞ্চলে শাসন করতে থাকেন। মস ইন্ডিকোব্লিয়াসটেসের
ক্রিশ্চিয়ান টপোগ্রাফি, চীনা লেখক সুঙ উনি এর বিবরণ কলহনের রাজতরঙ্গিনী, মিহিরকুলের গোয়ালিয়ার লেক
এবং অসংখ্য মুদ্রা থেকে এই হুন শাসকের ভারতীয় সাম্রাজ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘ক্রিশ্চিয়ান টপোগ্রাফি’তে উত্তর ভারতের শ্বেত হুনদের রাজা গোল্লাস বা
মিহিরকুলকে অত্যাচারী শাসক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মিহিরকুলের শাসন ভারতে ৫৩০ খ্রিস্টাব্দের
কাছাকাছি সময় পর্যন্ত বলবৎ ছিল, যতদিন পর্যন্ত না তিনি প্রথমে গুপ্ত রাজা নরসিংহগুপ্ত
বালাদিত্য এবং পরে বাকাটক বংশের রাজা যশোবর্মনের হাতে চূড়ান্তভাবে পরাজিত
হয়েছিলেন।
হুন রাজা তোরমান ও মেহেরকুল কর্তৃক পশ্চিম ও মধ্য ভারতের
একাংশ শাসন প্রতিষ্ঠা খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের শেষ দিকে দাক্ষিণাত্যের বাকাটক বংশের
একটি শাখার রাজা হরিসেন গুপ্ত কর্তৃক শাসন ও গুজরাটে আধিপত্য বিস্তার শেষ পর্বের
গুপ্ত রাজাদের কাছে বড় ধাক্কা ছিল। বহিরা আক্রমণের এই ধাক্কা তাদের পক্ষে সামলানো সম্ভব ছিলনা। কেননা গুপ্তদের
প্রশাসনিক পরিকাঠামো এতদিনে ভেঙ্গে পড়েছিল। স্কন্দ গুপ্তর পর গুপ্ত সিংহাসনে কোন যোগ্য ও শক্তিশালী
শাসক বসেননি। স্কন্দ গুপ্তর
মৃত্যুর পর পুরোগুপ্ত ও দ্বিতীয় কুমার গুপ্তর মধ্যে গৃহযুদ্ধ, বুদ্ধগুপ্তর পর বৈন্য গুপ্ত ও
ভানু গুপ্তর মধ্যে সিংহাসন নিয়ে গৃহবিবাদ কেন্দ্রীয় শাসনকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর
করে তুলেছিল। বংশানুক্রমিক পদ্ধতিতে (অম্বয় প্রাপ্ত সাচিব্য) মন্ত্রী বা অন্যান্য রাজ কর্মচারীদের নিয়োগ
পদ্ধতিও প্রশাসনের পক্ষে খুব একটা মঙ্গল কর হয়নি। রামসদন শর্মার মতে গুপ্ত যুগ থেকেই ব্রাহ্মণ বা
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রচুর পরিমাণে নিস্কর জমি (অগ্রহার) চিরকালীনভাবে (অক্ষয়নিবি) দান করা শুরু হয়। এর ফলে দান-গ্রহীতার নিজস্ব অঞ্চলে আর্থিক ও
প্রশাসনিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং স্বাভাবিকভাবেই ওই সকল অঞ্চলে রাজার
ক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পায়। স্কন্দ গুপ্তর পরবর্তী সময়কালে রাজাদের স্বর্ণ মুদ্রার সংখ্যা কমে যাওয়া
এবং মুদ্রা তে ধাতুর পরিমাণ কমে গিয়ে খাদের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া গুপ্ত রাজকোষের
অবস্থা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ার সাক্ষ্য বহন করে। অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে
যাওয়া গুপ্ত সাম্রাজ্যের নানা স্থানে আঞ্চলিক সামন্ত জাতীয় ক্ষুদ্র শাসকদের
উত্থান ঘটতে থাকে এবং এদের উত্থানকে বাধা দিতে ব্যর্থ গুপ্ত রাজারাও সাম্রাজ্যের
বিভিন্ন এলাকা হারাতে থাকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন