৫৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আঞ্চলিক শক্তির উত্থান হর্ষবর্ধন কর্তৃক উত্তর ভারতের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস
৫৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে দেখা যায় যে উত্তর ভারতে
গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তুপ এর উপর বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক শক্তি বা রাজবংশের
উত্থান ঘটেছে। বলভির মৈত্রক, মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমাংশে উলিকর
রাজবংশ ছাড়াও রাজপুতানার যোধপুর এবং গুজরাটের ব্রোচ অঞ্চলে গুর্জর রাজবংশ।
স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেছিল। প্রতিহারদের যোধপুর লেখ থেকে জানা যায় যে
হরিচন্দ্র বর্তমান যোধপুর অঞ্চলে গুর্জর বংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তার পুত্ররা
মান্তব্যপুরে রাজধানী স্থাপন করে রাজত্ব করতে থাকেন। হরিচন্দ্রের উত্তরাধিকারী রচিচর, নরভট্ট এবং নাগভট্ট ৫৫০-৬৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজত্ব
করেছিলেন। অন্যদিকে উত্তর প্রদেশকে কেন্দ্র করে মৌখরী রাজবংশের উত্থান
ঘটেছিল। রাজকীয় সীল থেকে জানা যায় যে এই বংশের প্রথম তিন শাসক হরিবর্মন, আদিত্যবর্মন এবং
ঈশ্বরবর্মনের উপাধি ছিল মহারাজ কিন্তু পরবর্তী শাসক ঈশানবর্মন সর্ববর্মন
অবন্তিবর্মনদের উপাধি ছিল মহারাজাধিরাজ, এর থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে ঈশানবর্মনের সময় থেকেই
গুপ্তদের অধীনতা ঝেড়ে ফেলে মৌখরি রাজারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। হরাহা লেখ থেকে
জানা যায় যে ঈশানবর্মন অন্ধ্র, উড়িষ্যার শূলিক এবং উত্তরবর্ষ বা গৌড়ের শাসককে
পরাজিত করেছিলেন। মৌখরিদের মতোই অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক রাজবংশ হিসেবে
পরবর্তী গুপ্তদের উত্থান ঘটেছিল। এরাও প্রথম পর্বে গুপ্তদের অধীনস্থ সামন্ত ছিল পরে গুপ্তদের দুর্বলতার সুযোগে
স্বাধীন হয়ে যায়। গয়ার কাছে পাওয়া
আপসাদ লেখ থেকে এই বংশের কয়েকজন রাজার নাম পাওয়া যায়, তারা হলেন কৃষ্ণগুপ্ত, হর্সগুপ্ত, জীবিত গুপ্ত,
কুমার গুপ্ত, দামোদর গুপ্ত, মহাসেন গুপ্ত, মাধব গুপ্ত এবং আদিত্য সেন। দামোদর গুপ্তর পুত্র মহাসেন গুপ্ত লোহিত বা ব্রহ্মপুত্র নদী পর্যন্ত অগ্রসর
হয়ে কামরুপের ভৌমনরক বংশীয় রাজা সুস্থিতবর্মনকে পরাজিত করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ
শতাব্দীর শেষ দিকে দাক্ষিণাত্যের চালুক্য রাজ কীর্তি বর্মন এবং তিব্বত রাজ শ্রোনবৎসান
ভারতের কেন্দ্রাঞ্চল আক্রমণ করেছিলেন। ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার মনে করেন এই
দুই আক্রমণের ধাক্কায় মৌখুরিরা দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং সেই সুযোগে তাদের
প্রতিদ্বন্দ্বী, পরবর্তী গুপ্তরা মানব থেকে বাংলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর
অধিকার স্থাপন করেছিল মহাসেন গুপ্তর দুই পুত্র পুষ্যভূতিরাজ প্রভাকর বর্ধনের
আশ্রয় লাভ করেছিলেন এবং দেব গুপ্ত নামক অপর এক পরবর্তী গুপ্ত শাসক মানব অঞ্চলে
রাজত্ব করতেন এবং পুষ্যভূতিদের সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
মধ্য ও পশ্চিম ভারতের মতো বাংলাতেও আঞ্চলিক রাজ শক্তির উদ্ভব
ঘটে। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের তৃতীয়
দশক থেকেই পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গ কে শাসন করেছিলেন গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য এবং
সমাচারদেবের মত ক্ষুদ্র রাজারা। অন্যদিকে উত্তরবঙ্গে মালদা বা গৌড় কে কেন্দ্র করে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর
গোড়ায় শশাঙ্ক একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। বর্তমান আসামের অন্তর্গত কামরূপ রাজ্যটি
গুপ্তদের সময়কাল থেকেই শাসন করত ভৌমনরক বংশ। এই বংশের রাজা ভাস্করবর্মার নিধনপুর
তাম্রপট্ট থেকে জানা যায় যে, ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই ভৌমনরক বংশীয় রাজারা
স্বাধীনভাবে কামরূপ, কপিলি নদীর তীরে ডবাক অঞ্চল এবং সুর্মা উপত্যকায় (বর্তমান সিলেট) রাজত্ব করতে
থাকে। ভাস্করবর্মার ডুবি তাম্রশাসন থেকে আরও জানা যায় যে, এই বংশের রাজা
সুস্থিতবর্মন গৌড়ের রাজার (মহাসেন গুপ্ত বা শশাঙ্ক) কাছে পরাজিত হয়েছিলেন এবং তাঁর আনুগত্য স্বীকার
করে নিয়েছিলেন। আলোচ্য সময়কালেই বর্তমান হরিয়ানার অন্তর্গত থানেশ্বর বা
স্থান্বীস্বর নামক স্থানে পুষ্যভূতি রাজারাও (হর্ষচরিত অনুসারে এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন
জনৈক পুষ্যভূতি) ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। পুষ্যভূতিদের রাজকীয় শীল থেকে এই বংশের যে সকল
রাজার নাম জানা যায়, তাঁরা হলেন মহারাজা, নরবর্ধন, মহারাজা রাজ্যবর্ধন, মহারাজা আদিত্যবর্ধন,
পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ প্রভাকরবর্ধন, পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ রাজ্যবর্ধন উপাধি
থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে প্রভাকর বর্ধনের সময় থেকেই পুষ্যভূতি রাজাদের শক্তি
বহুলাংশে বৃদ্ধি পেতে থাকে। হর্ষবর্ধনের সভাকবি বানভট্টর 'হর্ষচরিত' নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে
পুষ্যভূতিরা ঈশানবর্মনের রাজত্বকাল পর্যন্ত সম্ভবত মৌখরিদের অধীনস্থ সামন্ত ছিল। মৌখরিদের ক্রমশ
দুর্বলতার ফলে এবং পরবর্তী গুপ্তদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপিত হওয়ায় (পরবর্তী গুপ্ত বংশীয় রাজকন্যা
মহাসেন গুপ্তা দেবীর সঙ্গে পুষ্যভূতি রাজা আদিত্যবর্ধনের বিবাহ হয়েছিল) পুষ্যভূতিদের শক্তি ও মর্যাদা
বৃদ্ধি পায়। এই বংশের প্রথম
শক্তিশালী রাজা প্রভাকরবর্ধন উত্তর ও পশ্চিমে হূন, গান্ধার ও সিন্ধু রাজ্যের একটি
মিলিত জোট এবং দক্ষিণে মানব লাট এবং গুর্জরদের সঙ্গে লড়াই চালিয়েছিলেন। যমুনা এবং বিয়াম
নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল এবং রাজপুতানার একাংশকে নিয়ে তার স্বাধীন রাজ্য গড়ে
তুলেছিলেন।
উপরে যে আলোচনা করা হলো তা থেকে স্পষ্ট যে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ
শতকের শেষ দিকে উত্তর ভারতে কোন রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। পুষ্যভূতি, মৌখরি, পরবর্তী গুপ্ত, শশাঙ্ক এবং ভৌমনরক বংশ এক একটা
অঞ্চলকে অধিকার করে ছিল। বানভট্ট রচিত
হর্ষচরিত অনুসারে রাজনৈতিক অনৈকের এই বাড়বাড়ন্তেই সমসাময়িক উত্তর ভারতে দুটি
রাজনৈতিক জোট তৈরি হয়েছিল। একদিকে পুষ্যভূতিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে মৌখরি এবং কামরূপের ভৌমনরকরা ঐক্যবদ্ধ
হয়েছিলেন এবং অন্যদিকে বাংলার অপর স্বাধীন শক্তিশালী রাজা শশাঙ্ক হাত মিলিয়ে
ছিলেন পরবর্তী গুপ্ত বংশীয় মালব রাজ দেবগুপ্তর সঙ্গে। এই দুই রাজনৈতিক জোট সপ্তম
শতাব্দীর গোড়ায় পারস্পরিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। এই সংগ্রাম এবং তার পরিণতির ইতিহাস আলোচনা করলে
আমরা হর্ষবর্ধন এবং শশাঙ্কের উত্থান ও রাজ্য শাসনের কাহিনী সম্পর্কে অবগত হতে পারব।
হর্ষবর্ধনের উত্থানের ইতিহাসের অনেকটাই জানা যায় বানভট্টের
হর্ষচরিত গ্রন্থ থেকে। প্রভাকর বর্ধনের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজ্যবর্ধন (হর্ষবর্ধনের দাদা) থানেশ্বরের সিংহাসনে বসেছিলেন। অন্যদিকে রাজ্যবর্ধনের বোন রাজ্যশ্রীর সঙ্গে
বিয়ে হয়েছিল কনৌজের মৌখরি রাজ গ্রহবর্মনের। ৬০৫ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে
পুষ্যভূতি মৌখরীদের শত্রু মালবের পরবর্তী গুপ্ত বংশীয় রাজা দেবগুপ্ত কনৌজ আক্রমণ করেন, গ্রহবর্মাকে হত্যা করেন এবং
রাজ্যশ্রীকে বন্দী করেন। এমতাবস্থায়
রাজ্যবর্ধন দেবগুপ্তকে পরাজিত ও নিহত করলেও স্বয়ং বাংলার শাসক ও দেবগুপ্তর মিত্র
শশাঙ্কের হাতে মারা যান; রাজশ্রীও শশাঙ্কের হাতে বন্দি হয়। একই সঙ্গে কনৌজ এবং
থানেশ্বরের সিংহাসনের এই সংকটকালে হর্ষবর্ধন বাধ্য হন উভয় রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ
করতে। সিংহাসনে আরোহন করে হাস্যবর্ধন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন গৌড় রাজ কে নিশ্চিহ্ন করে
রাজ্যশ্রী কে উদ্ধার না করতে পারলে তিনি আগুনে আত্মহুতি দেবেন। শেষ পর্যন্ত রাজশ্রীকে বিন্ধ পর্বতের অরণ্য
অঞ্চল থেকে হর্ষবর্ধন উদ্ধার করতে পারলেও তিনি শশাঙ্কের সময়কালে বাংলা জয় করতে
পারেননি। শশাঙ্ককেও
নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হননি। তবে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন তার মিত্র কামরূপ রাজ ভাস্কর বর্মার
সহায়তায় বাংলার অংশবিশেষ এবং দক্ষিণে কঙ্গোদ রাজ্য (গুঞ্জাম) জয় করেছিলেন বলে জানা যায়। হিউয়েন সাং
লিখেছেন যে পঞ্চ ভারতের সঙ্গে নাকি হর্ষবর্ধন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। যদিও অন্য কোন সাহিত্যে হর্ষবর্ধনের এই ব্যাপক
যোদ্ধা অভিযানের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে সৌরাষ্ট্রের বলভৃতে রাজ্য শাসনকারী মৈত্রক বংশীয় রাজা
ধ্রুবসেনের সঙ্গে হর্ষবর্ধনের সংঘর্ষ হয়েছিল। হর্ষবর্ধন প্রথমদিকে
সাফল্য লাভ করলেও সমসাময়িক গুর্জর বংশীয় রাজা দ্বিতীয় দদ্দের সাহায্যে ধ্রুবসেন
তাঁর রাজ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন। পরে হর্ষবর্ধন তার কন্যার সঙ্গে ধ্রুব সেনের বিবাহ দিয়ে মৈত্রক বংশের উপর
প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক সময়ে দাক্ষিণাত্যের বাদামির চালুক্য বংশের রাজা ছিলেন
দ্বিতীয় পুলকেশী। সে সত্য রাজার
আইহোল শিলালিপি থেকে জানা যায় যে নর্মদা নদীর তীরে ৬৩০ – ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কালীন
সময়ে হর্ষবর্ধনের সঙ্গে পুলকের শীত একটি যুদ্ধ হয়েছিল এবং এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে
হর্ষবর্ধন পালিয়ে গিয়েছিলেন। যুদ্ধে হর্ষবর্ধনের হস্তি বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তবে অন্যান্য কোন ঐতিহাসিক সূত্রে এই যুদ্ধের
কাহিনী লিপিবদ্ধ নেই। হিউয়েন সাং
অস্পষ্ট ভাবে বলেছেন যে হর্ষবর্ধন দাক্ষিণাত্য জয় করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পণ্ডিতের অনুমান হর্ষবর্ধন এবং পুলকেশীর রাজ্যের
মধ্যস্থলে অবস্থিত লাট, মালব, গুর্জর প্রভৃতি করদ রাজ্যগুলির উপর আধিপত্য স্থাপনের
উদ্দেশ্যেই এই যুদ্ধ ঘটেছিল যাতে দ্বিতীয় পুলকেশী কিছুটা হলেও সাফল্য লাভ
করেছিলেন। বানভট্ট উল্লেখ
করেছেন হর্ষবর্ধন সিন্ধু নদের তীরবর্তী অঞ্চলের অভিযান সম্ভবত ব্যর্থ হয়েছিল। কেননা হিউয়েন সাঙের রচনা থেকে জানা যায় যে
সিন্ধু সেসময় একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল।
চালুক্যদের লেখতে হর্ষবর্ধনকে সকল উত্তরা প্রথনাথ বা সমগ্র
উত্তর ভারতের অধিপতি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু হিউয়েন সাঙের বিবরণ, বানভট্টের হর্ষচরিত, মধুবন ও বাঁশখেরা লেখ থেকে
প্রাপ্ত তথ্যকে বিশ্লেষণ করে রমেশচন্দ্র মজুমদার, আর এস ত্রিপাঠী প্রমুখ ঐতিহাসিকরা সিদ্ধান্তে
এসেছেন যে, উত্তর ভারতে গন্ধার, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, সিন্ধু, মালোফ সহ গুজরাটের সিংহভাগ, পূর্ব বিহার এবং বাংলা
নিশ্চিতভাবেই হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের বাইরে ছিল। হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য প্রথমদিকে উত্তর প্রদেশ
এবং হরিয়ানা নিয়ে গড়ে উঠেছিল পরে মগধ এবং উড়িষ্যার গঞ্জাম অঞ্চল তার
সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। সুতরাং হর্ষের
জীবনীকার এম এটিন পানিক্কর প্রমুখরা তাকে সকল উত্তর ভারতের অধীশ্বর বললেও এই মত
গ্রহণযোগ্য নয়।
হর্ষবর্ধনের সময়কালে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসনে
গুপ্ত যুগিও বৈশিষ্ট্যই লক্ষণীয়। হর্ষ স্বয়ং ছিলেন শাসনব্যবস্থার
প্রধান। মধুবন তাম্রপত্রে মহাসামন্ত, মহারাজ, দৌহসদিক, রাজস্থানীয় কুমারামাত্য, উপরিক, বিষয়পতি, চাটভাট ইত্যাদি রাজকীয় ব্যক্তি বা কর্মচারীর
নাম পাওয়া যায়। গুপ্ত যুগের মতই
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ব্রাহ্মণদের জমি দান করা হত। রাজপুরুষদেরও বেতনের পরিবর্তে
জমি দানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। উৎপন্ন ফসলের এক ষষ্ঠাংশ সাধারণভাবে রাজস্ব হিসেবে আদায় করা হত। প্রথমদিকে সইবো থাকলেও পড়ে হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ
ধর্ম গ্রহণ করেন। হিউয়েন সাঙের
রচনা থেকে জানা যায় যে, ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন কনৌজে এক বিরাট ধর্ম সভার
আয়োজন করেছিলেন যে সভায় চার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুক এবং তিন হাজার ব্রাহ্মণ ও জৈন
সাধু উপস্থিত হয়েছিলেন। এছাড়াও হর্ষের
রাজত্বকালে প্রয়াগে ত্রিবেনী সঙ্গমস্থলে ৭৫ দিন ধরে মেলা বসত। হর্ষবর্ধন স্বয়ং
এখানে বুদ্ধ, শিব ও সূর্যের উপাসনা করতেন এবং ব্রাহ্মণ, সন্ন্যাসী ও দরিদ্রদের
দানধ্যান করতেন। হর্ষবর্ধন পন্ডিত
মানুষ ছিলেন, তিনি স্বয়ং রত্নাবলী নাগানন্দ এবং প্রিয়দর্শিকা নামক তিনটি নাটক রচনা
করেছিলেন; তার রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন হাস্যচরিত এবং কাদম্বরীর লেখক বানভট্ট। হর্ষবর্ধন পৃষ্ঠপোষকতায় নালন্দা সমসাময়িক
কালের শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সর্বোপরি হর্ষবর্ধনের সময় কালে উত্তর ভারতের
রাজনীতির প্রধান কেন্দ্র পাটলিপুত্র থেকে সরে গিয়েছিল কনৌজে।
উত্তর ভারতে হর্ষবর্ধনের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিলেন গৌড়ের
রাজা শশাঙ্ক। শশাঙ্কের
রাজত্বকালের ইতিহাস জানা যায় রোটাস গড়ের সীল, মেদনীপুর তাম্র শাসন (প্রথম ও দ্বিতীয়), এগ্রা ও গঞ্জাম
তাম্র শাসন থেকে। প্রথম জীবনের শ্মশাঙ্ক ছিলেন পরবর্তী গুপ্ত রাজা মহাসেন
গুপ্ত বা মৌখরি রাজ অবন্তিবর্মনের অধীনস্থ সামন্ত। পরে তিনি স্বাধীন হয়ে যান এবং কর্ণসুবর্ণ (মুর্শিদাবাদ জেলার
রাঙ্গামাটি) নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। শশাঙ্কের মিত্র ছিলেন পরবর্তী গুপ্ত রাজা
দেবগুপ্ত। দেবগুপ্ত এবং
শশাঙ্ক মিলিতভাবে লড়াই করেছিলেন পুষ্যভূতি মৌখরি জোটের বিরুদ্ধে। পুষ্যভূতি রাজা
রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের হাতে নিহত হয়েছিলেন এবং রাজ্যবর্ধন ও হর্ষবর্ধনের বোন
রাজর্ষি শশাঙ্কের হাতে বন্দি হয়েছিলেন বলে হর্ষচরিত থেকে জানা যায়। তবে শশাঙ্ক সম্ভবত রাজর্ষিকে মুক্তি দিয়েছিলেন
কেননা হর্ষবর্ধন তাকে উদ্ধার করেছিলেন বিন্ধ পর্বতের অরণ্য থেকে। শশাঙ্ক কনৌজের উপর কোনরূপ রাজনৈতিক অধিকার
প্রতিষ্ঠা না করতে পারলেও পূর্ব ভারতকে নিজ অধিকারের রেখেছিলেন। সমসাময়িক লেখ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং হিউয়েন
সাঙের বিবরণের ভিত্তিতে জানা যায় যে, বর্তমান উত্তরবঙ্গ পশ্চিমবাংলার দক্ষিণ দিক, বর্তমান উড়িষ্যা রাজ্যের
অন্তর্গত উৎকল এবং কঙ্গোদ, বিহারের মগধ ও বারানসির নিকটবর্তী কিছু অঞ্চল শশাঙ্কের
রাজ্যভুক্ত ছিল। শশাঙ্কের সময়কালে
দন্ডভক্তি বা বর্তমান মেদিনীপুর অঞ্চলের শাসক ছিলেন মহাপ্রতিহার শুভকীর্তি কঙ্গোদ (উড়িষ্যার চিলকা হ্রদ নিকটস্থ
অঞ্চল) অঞ্চলের রাজা শৈলোদ্ভব বংশীয় শ্রীমাধবরাজ (দ্বিতীয়) শশাঙ্কের অধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। হিউয়েন সাঙের
বর্ণনা এবং মা তোয়ান লীনের বিবরণ থেকে ধারণা করা যায় যে শশাঙ্ক খ্রিস্টীয় সপ্তম
শতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মগধ অধিকার করে রেখেছিলেন। তারপর শশাঙ্কের মৃত্যু হয় এবং হর্ষবর্ধন একে
একে মগধ (৬৪১ খ্রিষ্টাব্দ) এবং কঙ্গোদের উপর (৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দ) অধিকার স্থাপন করতে সক্ষম হন। স্বাধীন বঙ্গের
প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নরপতি শশাঙ্ক শৈব ধর্মাবলম্বী ছিলেন। হিউয়েন সাঙ শশাঙ্ককে বৌদ্ধ ধর্ম বিদ্বেষী বলে
চিহ্নিত করলেও শশাঙ্কের সমকালে বাংলার কজঙ্গলে সাতটি, পুণ্ড্রবর্ধনে কুড়িটি, সমতটে তিরিশটি, কর্ণসুবর্নে ও তাম্রলিপ্ততে দশটি
করে বৌদ্ধ বিহারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক কালে কর্ণসুবর্ণে খননকার্য চালিয়ে হিউয়েন সাঙ
বর্ণিত রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে।
আনুমানিক ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত
উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস যথেষ্ট ঘটনাবহুল, যদিও এই সময় কালে উত্তর ভারতে কোন স্থায়ী
সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গৌড়বঙ্গ অঞ্চলটিতে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তার পুত্র মানব রাজত্ব করেন। পরে জয়নাগ নামে এক রাজা রাজত্ব করেছিলেন। ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে তিব্বতের রাজা
স্ট্রই জান গামপো উত্তর ভারতে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়েছিলেন বলে তিব্বতি গ্রন্থ থেকে
জানা যায়। এই আক্রমণের ফলেও
উত্তর ভারতের রাজনৈতিক জীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর ৬৫০ – ৭২৫ খ্রিষ্টাব্দ
পর্যন্ত মগধ ও গৌড়বঙ্গের একাংশে রাজত্ব করেছিলেন আদিত্য সেন, দেব গুপ্ত, বিষ্ণু গুপ্ত ও জীবিত গুপ্ত
নামক চারজন পরবর্তীগুপ্ত বংশীয় রাজা। এরা সকলেই পরমভট্টারক ও মহারাজাধিরাজ উপাধি নিয়েছিলেন; তাছাড়া আদিত্য সেন
তিনটি অশ্বমেধ যজ্ঞ ও করেছিলেন। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধে কনৌজের
সিংহাসন অধিকার করেছিলেন জনৈক্য যশোবর্মন। তার সভাকরি বাকপতি’র ‘গৌড়বহো'বা গৌড়বধ(গৌড়ের রাজাকে নিধন) নামুক প্রাকৃতিক
কাব্য থেকে জানা যায় যে ৭২৫ থেকে ৭৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোন এক সময় যশো
বর্মন সমসাময়িক গৌড় ও মগধের রাজাকে পরাজিত ও নিহত করেন। মনে হয় সমসাময়িক মগধ এবং গৌড় একজন শাসক
দ্বারাই শাসিত হত এবং তিনি ছিলেন সম্ভবত শৈল বংশীয় রাজা জয়বর্ধন বা তাঁর কোন
বংশধর। যশো বর্মনের এই সাফল্য অবশ্য
দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কেননা সমসাময়িক
কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় তাঁকে পরাজিত করেছিলেন। কলহনের রাজতরঙ্গিনী
এবং হিউয়েন সাঙের রচনা থেকে জানা যায় যে ৬২৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রায় ৪৫১
খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাশ্মীর রাজ্যটি শাসন করছিলেন দুর্লভবর্ধন প্রতিষ্ঠিত কার্কোট
বা নাগ বংশের শাসকরা। এই বংশেরই শাসক চন্দ্রাপীড় এবং ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়
সিংহাসনে বসার সময় চীন সম্রাট এর কাছ থেকে রাজা উপাধি লাভ করেন। রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায় যে, ললিতাদিত্য দিগ্বিজয়ে
অগ্রসর হয়ে কনৌজ রাজ যশোবর্মনকে পরাজিত করেছিলেন। গৌড় এবং কলিঙ্গ অতিক্রম করে দক্ষিণ ভারতে
কাবেরী নদী এবং মলয় (পশ্চিমঘাট) পর্বতমালা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। ললিতাদিত্য’র আদেশে ই সমসাময়িক গৌড়রাজ কাশ্মীরে গিয়ে নিহত হন। রাজ তরঙ্গিনী থেকে আরো জানা যায় যে ললিতাদিত্যর
পৌত্র জয়াপীড় কাঞ্চির রাজ্য হারিয়ে পুন্ড্রবর্ধনে এসেছিলেন। এবং সেখানকার রাজা জয়ন্তর কন্যাকে বিবাহ
করেছিলেন। আসলে সমসাময়িক
গৌড়বঙ্গে শক্তিশালী কোন রাজা ছিলেন না, দক্ষিণ বঙ্গ খড়গ নাথ, রাত, চন্দ্র প্রভৃতি বংশের রাজারা রাজত্ব করেছিল। গৌড় অঞ্চলটিতে রাজত্ব করেছিল শৈল বংশীয় শাসকরা। রাজনৈতিকভাবে দুর্বল বঙ্গদেশে তাই অনেকগুলি
বৈদেশিক আক্রমণও হয়েছিল। ধর্মপালের
খালিমপুর তাম্র শাসনে ৬৫০ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে বাংলার রাজনৈতিক
অরাজকতাকে মাৎস্যন্যায় শব্দটির দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শক্তিশালী রাজার অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন অঞ্চলের
ক্ষুদ্র শাসকরা যখন জোর যার মুলুক তার নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে রাজত্ব করে এবং এর
ফলশ্রুতি স্বরূপ রাজনৈতিক ও সামাজিক অরাজকতা সৃষ্টি হয় তখন এই ধরনের অবস্থা কে
বলা হয় মাৎস্যন্যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন