সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দক্ষিণ ভারতে আঞ্চলিক শক্তির উত্থান এবং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম

 

 


 

উপদ্বীপীয় দক্ষিণ ভারতকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়) উত্তরে বিন্ধ্য পর্বতমালা থেকে দক্ষিনে কৃষ্ণানদী মধ্যবর্তী অঞ্চলকে সাধারণভাবে বলা হয় দাক্ষিণাত্য, যার অন্তর্ভুক্ত হল বর্তমান মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কর্নাটকের অংশবিশেষ ) কৃষ্ণার দক্ষিণ দিকে কন্যাকুমারি পর্যন্ত অঞ্চল ঐতিহাসিক পরিভাষায় পরিচিত সুদূর দক্ষিণ হিসাবে বর্তমান কর্নাটকের অংশবিশেষ, অন্ধ্র দক্ষিণাংশ, তামিলনাড়ু ও কেরালা সুদূর দক্ষিণের অন্তর্ভুক্ত ৬০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালীন সময়ে দাক্ষিণাত্য এবং সুদূর দক্ষিনে অনেকগুলি রাজবংশ পর্যায়ক্রমে রাজত্ব করেছিল রাজবংশগুলির মধ্যে বাদামির চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, কল্যাণীর চালুক্য, বেঙ্গির চালুক্য, পল্লব, চোল, পান্ড্যরা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠলেও কারোর পক্ষেই সমগ্র দক্ষিণ ভারত জুড়ে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি এখানে দক্ষিণ ভারতের শক্তিশালী রাজবংশগুলির ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

গুপ্তদের সমসাময়িক সময়ে মধ্যভারত ও দাক্ষিণাত্য অঞ্চলটি শাসন করত বাকাটক রাজ বংশ খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে বাকাটকদের পতন ঘটে এবং দাক্ষিণাত্যে অনেকগুলি রাজবংশের উত্থান ঘটে যেমন উড়িষ্যার নল, অন্ধ্রতে সালঙ্কায়ন, বিষ্ণুকুন্তিন এবং বেঙ্গির চালুক্য; পশ্চিম দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য রাজবংশ এই রাজবংশগুলির মধ্যে বাদামির চালুক্যদের ইতিহাস বিশেষ উল্লেখযোগ্য এই বংশের গুরুত্বপূর্ণ রাজারা হলেন প্রথম পুলকেশী, প্রথম কীর্তিবর্মন, দ্বিতীয় পুলকেশী, প্রথম বিক্রমাদিত্য, বিনয়াদিত্য, বিজয়াদিত্য, দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য এবং দ্বিতীয় কীর্তি বর্মন উপরোক্ত রাজাদের মধ্যে দ্বিতীয় পুলকেশী সাম্রাজ্য বিজয়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন দ্বিতীয় পুলকেশীর সভাকবি রবিকীর্তি বিরচিত 'আইহোল শিলালিপি' থেকে তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় দ্বিতীয় পুলকেশী তাঁর কাকা মঙ্গলেসের কাছ থেকে সিংহাসন দখল করেছিলেন, কদম্বদের রাজধানী বনবাসী অধিকার করেছিলেন দক্ষিণ মহীশুরের গঙ্গদের পরাজিত করেছিলেন কোঙ্কন উপকূলের মৌর্যদের পরাজিত করেছিলেন এবং লাট, মালব এবং গুর্জর রাজাদের অধীনস্থ সামন্তে পরিণত করেছিলেন। গুজরাট অঞ্চলের ক্ষুদ্র সামন্ত প্রজাতির রাজ্যগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে পুলকেশীর সঙ্গে সমসাময়িক কনৌজের রাজা 'সকলউত্তরাপথনাথ' হর্ষবর্ধনেরও সংঘর্ষ হয়েছিল চালুক্যদের পরবর্তীকালের লেখ এবং আইহোল শিলালিপি অনুসারে এই যুদ্ধে হর্ষবর্ধন পরাজিত হয় এবং তাঁর হস্তিবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায় উত্তর দিকে সাফল্য পাওয়ার পাশাপাশি পুলকেশী সমগ্র মহারাষ্ট্র রাজ্যের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকালেই বাদামির চালুক্যদের সঙ্গে সুদূর দক্ষিণের শক্তি কাঞ্চিপুরমের পল্লব রাজবংশের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল প্রথমদিকে দ্বিতীয় পুলকেশী পল্লব রাজ প্রথম মহেন্দ্রবর্মনকে পরাজিত করেছিলেন এবং পল্লবদের রাজধানী কাঞ্চিপুরম পর্যন্ত অগ্রসর হন কিন্তু পরে পল্লব রাজ প্রথম নরসিংহবর্মন পুলকেশীকে একাধিক যুদ্ধে পরাজিত করার পর চালুক্যদের রাজধানী বাতাপি/বাদামি লুণ্ঠন করেন, পুলকেশীকে হত্যা করেন এবং বাতাপিকোন্ডা উপাধি গ্রহণ করেন চালুক্য রাজবংশকে এই সংকটের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন দ্বিতীয় পুলকেশীর পুত্র প্রথম বিক্রমাদিত্য দ্বিতীয় পুলকেশীর সমসাময়িক পারস্যের রাজা দ্বিতীয় খুসরাও এর দরবারে ৬২৫ - ২৬ খ্রিস্টাব্দে দূত প্রেরণ করেছিলেন; তিনি সম্ভবত পারস্যিকদের কাছ থেকে শক্তিশালী যুদ্ধাস্ত্র লাভ করার জন্য এই দৌত্য প্রেরণ করেন চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ পুলকেশীর রাজত্বকালে (৬১০-৬৪২) ৬৪১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মহারাষ্ট্র অঞ্চল পরিভ্রমণ করেছিলেন এবং এই রাজ্যের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন পুলকেশীর উত্তরাধীকারীদের মধ্যে প্রথম বিক্রমাদিত্য ও দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য দক্ষিণে পল্লবদের বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করেছিলেন এবং গুজরাট অঞ্চলটির উপরও পরোক্ষভাবে সামন্তদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলেন বাদামির চালুক্য বংশের শেষ শাসক ছিলেন দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যর পুত্র দ্বিতীয় কীর্তিবর্মন, যিনি ৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন ৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে চালুক্যদের অধীনস্থ সামন্ত শাসক রাষ্ট্রকূট দন্তিদুর্গ এবং প্রথম কৃষ্ণ চালুক্য রাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মনকে পরাজিত করে চালুক্য রাজ্য অধিকার করে নিয়েছিল

বাদামী চালুক্যদের সমসাময়িক সময়কালে সুদূর দক্ষিনে রাজ্য শাসন করত দুটি বংশ কাঞ্চীপুরমের পল্লব রাজবংশ যাদের রাজ্যের মূল অংশ (কাবেরী উপত্যকা) টোন্ডাইমন্ডলম নামে পরিচিত ছিল উত্তরে কৃষ্ণা তুঙ্গ ভদ্রা থেকে দক্ষিনে কাবেরী পর্যন্ত তাদের রাজ্য বিস্তৃত ছিল এবং কাবেরী নদীর দক্ষিণ দিকটি শাসন করত পাণ্ড্য রাজারা। এদের রাজধানী ছিল বর্তমান তামিলনাড়ুর অন্তর্গত মাদুরাই ইতিহাসের নিয়ম মেনেই সুদূর দক্ষিণ ভারতের এই দুই রাজশক্তি সাম্রাজ্য স্থাপনের লক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছিল মাদুরাই শাসনকারী পান্ড্য রাজাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মারবর্মা, অবনিশূলামনি, মেন্দন, অরিকেষরি মারবর্মন, প্রথম রাজসিংহ জটিল পরান্তক, শ্রীবল্লভ শ্রীমান, বর্ষাবর্মন প্রমুখ এই রাজাদের মধ্যে প্রথম রাজসিংহ বড়সবর্মন এব্ং শ্রীর্মার উত্তর দিকে পল্লব রাজ্যে সামরিক অভিযান চালিয়ে সাফল্য লাভ করেছিলেন বলে পান্ড্য লেখমালায় দাবী করা হয়েছে পল্লবদের বিরূদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধ করলেও পরে দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা চোলদের বিরুদ্ধে পান্ড্যরা সেভাবে লড়াই করতে পারেনি

আদি মধ্যযুগের দক্ষিণ ভারতীয় শক্তিগুলির মধ্যে পল্লবদের ইতিহাস ছিল যথেষ্ট গৌরবোজ্জ্বল পল্লব লেখসমূহ ও অন্যান্য সাহিত্যিক উপাদান থেকে সিংহবিষ্ণু, প্রথম মহেন্দ্রবর্মন, প্রথম নরসিংহবর্মন, দ্বিতীয় মহেন্দ্রবর্মন, প্রথম পরমেশ্বরবর্মন, দ্বিতীয় নরসিংহবর্মন, দ্বিতীয় পরমেশ্বরবর্মন, দ্বিতীয় নন্দীবর্মন, দন্তিবর্মন, তৃতীয় নন্দীবর্মন, নৃপতুঙ্গবর্মন এবং অপরাজিতর নাম পাওয়া যায় মত্তবিলাস বিচিত্রচিত্ত প্রথম মহেন্দ্রবর্মন পল্লব রাজ্যসীমা উত্তরে কৃষ্ণা থেকে দক্ষিনে কাবেরী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল এছাড়াও প্রথম মহেন্দ্র বর্মন চালুকরাজ পুলকেশীর আক্রমণের হাত থেকে পল্লব রাজধানী কাঞ্চীপুরমকে রক্ষা করেছিলেন মহেন্দ্রবর্মনের উত্তরাধিকারী প্রথম নরসিংহবর্মন মনিমঙ্গল এবং পরে বাতাপির যুদ্ধে চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশিকে পরাজিত ও নিহত করেন বাতাপি লুণ্ঠন করেছিলেন এবং বাতাপিকোন্ডা উপাধি গ্রহণ করেছিলেন যার অর্থ বাতাপি বিজেতা পরবর্তী পল্লব রাজ দ্বিতীয় মহেন্দ্র বর্মনের উত্তরাধিকারী প্রথম পরমেশ্বর বর্মন চালুক্য ও চালুক্যদের সামন্ত গঙ্গ রাজাদের কাছে পরাজিত হলেও নিজ রাজ্য ও রাজধানীকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন প্রথম পরমেশ্বরবর্মনের পৌত্র দ্বিতীয় পরমেশ্বরবর্মন চালুক্যদের আক্রমণের হাত থেকে কাঞ্চীপুরমকে রক্ষা করলেও নিজে গঙ্গরাজ শ্রীপুরুষের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন এবং পল্লব রাজ্যে এক রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয় পল্লবদের অন্য শাখার রাজা দ্বিতীয় নন্দীবর্মন কোনক্রমে দক্ষিণ দিক থেকে পান্ড্য এবং উত্তর দিক থেকে বাদামির চালুক্যদের আক্রমণের বিরুদ্ধে রাজ্যকে টিকিয়ে রেখেছিলেন ৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ নাগার বাদামির চালুক্য বংশের অবসান ঘটলে পরের দিকের পল্লব রাজা তৃতীয় নন্দীবর্মন, নৃপতুঙ্গবর্মন এবং অপরাজিত দক্ষিণ দিকস্থ শত্রু পাণ্ড্যদের বিরুদ্ধে বহুবার রাজনৈতিক জোট গঠন করে যুদ্ধ করেছিলেন যদিও দক্ষিণ দিকে পল্লব রাজ্যসীমা খুব একটা বিস্তৃত হয়নি বরং উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে ক্রমাগত যুদ্ধ চালাতে গিয়ে পল্লবরা দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং সেই সুযোগে অপরাজিত অধীনস্থ সামন্ত আদিত্য চোল ৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর উদ্ধতন প্রভু (অপরাজিত) কে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত ও নিহত করে পল্লব রাজ্য বা টোন্ডাইমণ্ডলম অধিকার করে নেন এইভাবে কাবেরী উপত্যকায় পল্লব রাজবংশের পতন ঘটে এবং চোল রাজবংশের উত্থান হয় দক্ষিণ ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে পল্লব রাজত্বকাল ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ

সুদূর দক্ষিনে চোরদের রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনার পূর্বে দাক্ষিণাত্যের দুটি শক্তিশালী রাজবংশের ইতিহাস সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যেতে পারে প্রথমটি হল রাষ্ট্রকূট রাজবংশ, যারা পূর্বোল্লেখিত ত্রিশক্তি সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করেছিল এবং দ্বিতীয়টি কল্যাণীর চালুক্য রাজ বংশ যারা রাষ্ট্রকূট রাজবংশের অবসান ঘটিয়ে পশ্চিম দাক্ষিণাত্যকে অধিকার করেছিল রাষ্ট্রকুদ্ধের আদি বংশপরিচয় ঐতিহাসিকদের কাছে খুবই অস্পষ্ট, তবে প্রথম দিকে তাঁরা বেরার অঞ্চলে বাদামির চালুক্যদের অধীনস্থ সামন্ত ছিল ৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রাষ্ট্রকূটরাজ প্রথম কৃষ্ণ বাদামির চালুক্যদের রাজ্য দখল করার পর বেঙ্গি শাসনকারী পূর্ব চালুক্যদের (দ্বিতীয় পুলকেশী গোদাবরীর মোহনা অঞ্চল বা বেঙ্গি জয় করে তাঁর ভাই বিষ্ণুবর্ধনকে সেখানকার রাজা হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন, এই বংশই বেঙ্গির চালুক্য বা পূর্ব দিকের চালুক্য বংশ নামে পরিচিত) পরাজিত করেছিলেন এবং কোঙ্কন অধিকার করেছিলেন প্রথম কৃষ্ণ, দ্বিতীয় গোবিন্দর পর রাষ্ট্রকূট সিংহাসনে বসেছিলেন ধ্রুব, তিনি প্রতিহার রাজা বৎসরাজকে পরাজিত করেন এবং রাষ্ট্রকূট রাজবংশকে ত্রিশক্তি সংঘর্ষে জড়িয়ে ফেলেন পরবর্তী শাসক তৃতীয়গোবিন্দ মহীশূর অঞ্চলে গঙ্গবাড়ি এবং নোলম্ববাড়ি অধিকার করেছিলেন এবং উত্তর দিকে অভিযান চালিয়ে প্রতিহার রাজ দ্বিতীয় নাগভট্টকে পরাজিত করেছিলেন। পাল রাজা ধর্মপাল এবং কনৌজে তাঁর প্রতিনিধি শাসক চক্রায়ুধও তৃতীয় গোবিন্দর আনুগত্য স্বীকার করে নেন তৃতীয় গোবিন্দর রাজত্বকালেই পল্লব, পান্ড্য, কেরল ও গঙ্গদের নিয়ে গঠিত দক্ষিণী জোট রাষ্ট্রকূট রাজ্য আক্রমণ করেছিল যদিও ৮০২০৩ খ্রিস্টাব্দে গোবিন্দ এই আক্রমণ প্রতিহত করেন তৃতীয় গোবিন্দর সময়কালে রাষ্ট্রকূট রাজ্য উত্তরে নর্মদা থেকে দক্ষিনে তুঙ্গভদ্রা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল রাষ্ট্রকূট বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন তৃতীয় গোবিন্দর পুত্র অমোঘবর্ষ যার রাজত্বকাল সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যায় সঞ্জান লেখ থেকে। তিনি পূর্ব চালুক্যদের পরাজিত করেছিলেন, প্রতিহার রাজ প্রথম ভোজের দক্ষিণ দিকস্থ অভিযান ব্যর্থ করেছিলেন এবং মান্যখেদ বা মান্যক্ষেত্র নামক স্থানে তৃতীয় রাজধানী স্থাপন করেছিলেন তবে অমোঘবর্ষের রাজত্বকালেই রাষ্ট্রকূ্রা বেঙ্গি অথবা গঙ্গাবাড়ি অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়, গুজরাটেও সমস্যা দেখা দেয় আসলে অমোঘবর্ষ সমরকুশলী বীর ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিদ্যুৎসাহী, ধার্মিক এক ব্যক্তি যার আমলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। অমোঘবর্ষের পরবর্তী রাষ্ট্রকূট রাজাদের মধ্যে তৃতীয় ইন্দ্র এবং তৃতীয় কৃষ্ণ ছিলেন খুবই শক্তিশালী শাসক তৃতীয় ইন্দ্র প্রতিহারদের অর্ন্তদ্বন্দ্বের সুযোগ গ্রহণ করে কনৌজ আক্রমণ করেছিলেন, পরাজিত পতিহার রাজ রাজধানী ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন অন্যদিকে তৃতীয় কৃষ্ণ দক্ষিণ দিকে চোল রাজ্যে অভিযান চালিয়ে কাঞ্চি এবং তাঞ্জোর দখল করে নিয়েছিলেন রাষ্ট্রকূট রাজ বংশের শেষ রাজা ছিলেন দ্বিতীয় কর্ক, বাদামির চালুক্য বংশের অন্য একটি শাখার সদস্য দ্বিতীয় তৈল (রাষ্ট্রকুটদের অধীনে বিজাপুরের এক ক্ষুদ্র অঞ্চলের শাসক ছিলেন) ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে কর্নাটকের উত্তরাংশের একটি স্থানে দ্বিতীয় কর্ককে পরাজিত করলে রাষ্ট্রকূট রাজবংশের অবসান ঘটে, পশ্চিম দাক্ষিণাত্য পুনরায় চালুক্যদের হাতে চলে যায় ইতিহাসে এই চালুক্য বংশ পরবর্তী চালুক্য বা কল্যাণীর চালুক্য বংশ নামে পরিচিত

কল্যাণীর চালুক্য বংশের রাজাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দ্বিতীয় তৈল, সত্যাশ্রয়, পঞ্চম বিক্রমাদিত্য, দ্বিতীয় জয়সিংহ, প্রথম সোমেশ্বর, দ্বিতীয় সোমেশ্বর এবং ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য ৯৭৩ থেকে ১১৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই রাজবংশ পশ্চিম দাক্ষিণাত্যে রাজত্ব করেছিল এবং সাম্রাজ্যিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য চোলদের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য যার রাজত্বকালের ইতিহাস জানা যায় তাঁর সভাকবি বিহ্লন রচিত 'বিক্রমাঙ্কদেব চরিত্' ও অন্যান্য লেখতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে তাঁর রাজত্বকালেই পরবর্তী চালুক্যরা চোলদের কাছ থেকে বেঙ্গি অঞ্চলটি ছিনিয়ে নিয়েছিল এবং দক্ষিণ দিকে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়েছিল দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে কল্যাণীর চালুক্য রাজবংশের পতন ঘটলে দাক্ষিণাত্যে শেষ কয়েকটি আঞ্চলিক রাজবংশের উত্থান হয় ওয়ারঙ্গলে কাকাতেয়, দেবগিরিতে যাদব এবং মহীশূরের নিকটবর্তী দ্বারসমুদ্রে হোয়সল। দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খলজি চতুর্দশ শতকে উক্ত রাজ্যগুলি জয় করেছিলেন

চোল রাজবংশের ইতিহাস আলোচনা করে আদি মধ্যযুগীয় দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের আলোচনা শেষ করা যেতে পারে চোল বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয়ালয়, তাঁর পুত্র প্রথম আদিত্য পল্লবদের কাছ থেকে টোন্ডাইমন্ডলম কেড়ে নিয়েছিলেন এবং কঙ্গুদেশ (কোয়েম্বাটোর ও সালেম) জয় করেছিলেন পরবর্তী শাসক পরান্তক চোল (৯০৮-৯৫৮) পান্ড্যদের পরাজিত করে মাদুরাই এর উপর অধিকার স্থাপন করেন যদিও উত্তর দিকে রাষ্ট্রকূট রাজ তৃতীয় কৃষ্ণ এবং গঙ্গ শাসকের মিলিত বাহিনীর নিকট তিনি পরাজিত হন পরান্তক চোলের মৃত্যুর পর চোল সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ পুনরায় দেখা যায় রাজারাজ চোলের (৯৮৫-১০১৪) রাজত্বকালে তামিল প্রশস্তি থেকে জানা যায় যে রাজারাজ দক্ষিণ দিকে অভিযান চালিয়ে পান্ড্য-চের-সিংহল জোটকে পরাজিত করেন এবং কান্দালুর সালাই নামক স্থানে শত্রুপক্ষের একটি জাহাজ ঘাঁটি ধ্বংস করেন সমসাময়িক সিংহল রাজ পঞ্চম মহেন্দ্রর বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনীর অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে রাজারাজ সিংহলের উত্তরাংশ দখল করে নেন এছাড়াও রাজারাজ উত্তর দিকে অভিযান চালিয়ে গঙ্গবাড়ি, নোলম্ববাড়ি জয় করেছিলেন এবং কল্যাণীর চালুক্য বংশীয় রাজা সত্যাশ্রয়কে পরাজিত করে রায়চুর, বনবাসী, বিজাপুর, মান্যখেত অঞ্চলগুলির উপর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন এছাড়াও সমুদ্রপথে অভিযান প্রেরণ করে রাজারাজ মালদ্বীপ জয় করেছিলেন রাজারাজ চোলের পুত্র রাজেন্দ্র চোল (১০১৪-১০৪৪) ছিলেন চোল বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট পিতার যোগ্যতম উত্তরাধিকারী রাজেন্দ্রর আমলেই চোল সাম্রাজ্যবাদ গৌরবের চরমসীমায় পৌঁছায় যুবরাজ থাকাকালীন তিনি চালুক্যদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিলেন রাজেন্দ্রর সময়কালে চোল সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ শ্রীলঙ্কা জয় করেছিল এবং দ্বীপটি একটি চোল প্রদেশে পরিণত হয়েছিল। দক্ষিণ দিকে পান্ড্য ও কেরলদের বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ, উত্তর দিকে কল্যাণীর চালুক্যদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে তুঙ্গভদ্রা পর্যন্ত সাম্রাজ্যসীমাকে বিস্তৃত করা, বেঙ্গির চালুক্য রাজবংশকে চোল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা; সেনাপতি চোল বরাইনের নেতৃত্বে উড়িষ্যা ও বঙ্গে সামরিক অভিযানকে সাফল্যের সঙ্গে প্রেরণ করা ও গঙ্গার জল নিয়ে গিয়ে সাম্রজ্যিক বিজয়ের চিহ্নস্বরূপ 'গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরম' মন্দির নগর প্রতিষ্ঠা করা, রাজেন্দ্র চোলের সামরিক কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। তবে উপরোক্ত সাফল্যের থেকেও অনেক কঠিন এক সামুদ্রিক অভিযানে তিনি তাঁর নৌবাহিনীকে প্রেরণ করেছিলেন ১০২২-১০২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজেন্দ্র চোলের নৌবাহিনী কড়ারম (মলয় উপদ্বীপের কেদ্দা) অভিযান চালিয়ে সুমাত্রা-মলয় উপদ্বীপের রাজা শৈলেন্দ্র বংশীয় সংগ্রাম বিজয়তুঙ্গবর্মনকে পরাজিত করেছিলেন রাজেন্দ্রর পর রাজাধিরাজ দ্বিতীয় রাজেন্দ্র, বীররাজেন্দ্র, কুলোতুঙ্গ, বিক্রম চোল প্রমুখ রাজা চোল সিংহাসনে বসেছিলেন রাজেন্দ্র চোলের এই উত্তরাধিকারীরাও সিংহল ও মলয় উপদ্বীপে অভিযান প্রেরণের কৃতিত্বের দাবি করেছেন সকলকেই উত্তরে কল্যাণীর চালুক্য এবং দক্ষিণে পান্ড্যদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। অবশেষে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধে (১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ) চোল সাম্রাজ্যের উত্তরাংশ দ্বারসমুদ্র'র হোয়সলরা এবং দক্ষিণাংশ পুনরুজ্জীবিত পান্ড্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়

পাল-প্রতিহার-সেন-রাষ্ট্রকূট-চোল প্রভৃতি আদি মধ্যযুগীয় রাজ্যগুলির প্রশাসনিক ব্যবস্থার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয় - প্রত্যেক রাজবংশের রাজারাই ব্রাহ্মণ পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষুক বা যেকোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে এবং পরের দিকে প্রশাসনিক প্রদাধিকারীদের নিষ্কর ভূমিদান  করতেন। মার্কসবাদী পন্ডিত রামশরণ শর্মা মনে করেন যে, এই নিষ্কর জমিদারের ফলে ভারতে সামন্ততান্ত্রিক পরিকাঠামোর আবির্ভাব ঘটে তবে প্রত্যেক শাসনব্যবস্থারই মূল স্তম্ভ ছিলেন রাজা - তিনি প্রশাসন, আইন, সমর, বিচার সব বিভাগেরই প্রধান ছিলেন রাজাকে প্রশাসনে সাহায্য করার জন্য মহাসান্ধিবিগ্রহিক (পররাষ্ট্রমন্ত্রী), মহাক্ষপটলিক (প্রধান গাণনিক), মহাসেনাপতি, মহাদন্ডনায়ক, উপরিক, বিষয়পতি, মহাপ্রতিহার (প্রাসাদ রক্ষকদের প্রধান), দন্ডনায়ক, বলাধিকৃত, পুরোহিত (নগর প্রধান), গ্রামকূট (গ্রাম প্রধান) প্রমুখ রাজকর্মচারীরা থাকতেন সমগ্র রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে শাসন কার্য পরিচালনা করা হত, উত্তর ভারতে যাকে বলা হত ভুক্তি, দক্ষিণ ভারতে বলা হত মন্ডল চোল শাসনব্যবস্থায় মন্ডল বা প্রদেশগুলি আবার বলনাড়ু ও নাড়ুতে বিভক্ত ছিল কয়েকটি গ্রামের সমষ্টি কুররম বা কোট্টম বিভাগগুলিকে একত্রিত করে নাড়ুগুলি গড়ে উঠত। চোলরা চমৎকার একটি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল গ্রামগুলিতে সভা অথবা মহাসভা (ঊর) এবং নগরগুলিতে নগরম নামক স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ভোগকারী প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হত। রাজস্ব আদায়, রাস্তা নির্মাণ, জলাশয় খনন, হিসাব রাখা, বিচার ইত্যাদি বিষয়গুলিকে দেখার জন্য সভা বা নগরমগুলি আবার বিভিন্ন কমিটি বা করিয়াম তৈরি করত সভার সদস্য হতে হলে একজন ব্যক্তিকে বেদে জ্ঞানী হতে হত, নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হতে হত, সৎ চরিত্রবান হতে হত। দক্ষিণ ভারতের গ্রাম ও নগরগুলি চোল শাসনকালে শাসন সংক্রান্ত ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করত।

গুপ্ত রাজশক্তির অবক্ষয়ের পর থেকে সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের যে চিত্র তুলে ধরা হল তার কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ সহজেই বোঝা যায় আলোচ্য সময়কালে সমগ্র ভারত জুড়ে একই সঙ্গে অনেকগুলি রাজবংশ শাসন করেছিল - এদের মধ্যে কতগুলি ছিল বড় রাজ্য যেমন হর্ষবর্ধনের রাজ্য, পাল বংশ, সেন বংশ, রাষ্ট্রকূট, প্রতিহার, পল্লব, চালুক্য এবং চোলদের রাজ্য অন্যদিকে কতকগুলি ছিল ছোট রাজ্য যেমন গঙ্গ, বাণ, চৌলক্য, চান্দেল্ল, চের, লাট, ইত্যাদি রাজ্য সমসাময়িক কালের বড় এবং ছোট উভয় রাজ্যগুলি নিজেদের মধ্যে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রণবীর চক্রবর্তী প্রমুখরা মনে করেন যে প্রধান শক্তিগুলি ছোট বা অধীন শক্তিগুলির উপর বেশি করে নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা করার জন্য এই ধরনের পারস্পরিক সংগ্রামে লিপ্ত হত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় গঙ্গ, নোলম্ব, বাণ প্রভৃতি ক্ষুদ্র শাসকদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য চালুক্য-পল্লব, রাষ্ট্রকূট-চোল বা পরবর্তী চালক্য ও চোলদের মধ্যে লড়াই, অন্যদিকে গুজরাট, লাট, বলভি প্রভৃতি অঞ্চলের ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হর্ষবর্ধন ও পুলকেশীর মধ্যে লড়াই এবং পরে প্রতিহার ও রাষ্ট্রকুরদের মধ্যে লড়াই আঞ্চলিক শক্তিগুলির লড়াই এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণও নিহিত ছিল দাক্ষিণাত্যের বাদামির চালুক্য, রাষ্ট্রকূট বা কল্যাণীর চালুক্যরা সুদূর দক্ষিণের পল্লব এবং চোল রাজবংশের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল কৃষ্ণা-তুঙ্গভদ্রা দোয়াব, কোঙ্কন উপকূল এবং গোদাবরী নিম্ন অপবাহিকায় অবস্থিত বেঙ্গির উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের জন্য রায়চুর দোয়াব ও বেঙ্গিতে উর্বর কৃষি ক্ষেত্র ছিল, অন্যদিকে কোঙ্কনের বাণিজ্যিক গুরুত্ব অপরিসীম ছিল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকেই আরব-চীন-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতীয় উপকূল ভাগের গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছিল। পূর্ব উপকূল এবং বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই চোররা শক্তিশালী নৌবহর তৈরি করেছিল শ্রী বিজয় বা মলয় এবং সিংহলে সামুদ্রিক অভিযান প্রেরণ করেছিল দ্বিতীয়ত আদি মধ্যযুগ নামে পরিচিত এই সময়কালেই ভারতে বিকেন্দ্রীকৃত রাষ্ট্রনৈতিক পরিকাঠামোর আবির্ভাব ঘটেছিল এর ফলেই আঞ্চলিকতা প্রকট হয়ে উঠেছিল বলে রামশরণ শর্মা মনে করেন আধুনিক গবেষক হারমান কুলকে লিখেছেন বিকেন্দ্রীকরণের ফলেই সামন্ত শক্তির ক্ষমতা ক্রমশ বাড়ছিল, কেন্দ্রীয় শাসন ক্রমশু ভেঙে পড়ছিল এই ব্যবস্থাকে কুলকে বলেছেন সামন্তিকীকরণ বা Samantisation অন্যদিকে মার্কিন গবেষক স্পেনসারও বার্টন স্টাইন দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার নাম দিয়েছেন 'বিভিন্ন অংশ বিভাজিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা' বা 'segmentary model of state' তবে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে যে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা গিয়েছিল তার মধ্যে দিয়েই সমগ্র ভারতে ব্যবস্থামূলক ঐক্যর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল বলে পন্ডিত ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় মনে করেন।

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস

    মার্টিন লুথার ছিলেন লুথা রিয়ান মতবাদের প্রবক্তা । জার্মানির স্যাক্সসনিতে ইসলিবেন নামে একটি গ্রামে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের জন্ম হয় । ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ইউটে ম বা র্গ চা র্চে র দরজায় তিনি তাঁ র ৯৫ তত্ত্ব ঝু লিয়ে দেন । এটি ছিল পোপের স্বর্গীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ । সমস্ত জার্মানির শিক্ষিত মানুষেরা লুথারের তত্ত্বে র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । এই ৯৫টি ছিল তাত্ত্বিক প্রশ্ন , এতে বাইবেল ও খ্রিস্টান দর্শন সম্বন্ধে তাত্ত্বিক গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রশ্ন ছিল । উইলিয়াম ওকামের চিন্তাভাবনা দ্বারা মার্টিন লুথার প্রভাবিত হয়েছিলেন । ইউরোপের এই চিন্তা ধারা পরিণত ছিল nominalism নামে । নমিনালিস্ট চিন্তাধারায় উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্বাস ও নিবেদিতপ্রাণতা । নমিনালিস্টরা মনে করত বিশ্বাসই মুক্তি আনবে , তবে এই বিশ্বাস অর্জনের জন্য শাস্ত্র পড়তে হবে এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের বোধগম্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করতে হবে । লুথার এইমতে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হওয়া উচিত এবং আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল রচনা করা একান্ত দরকার । তিনি খ্...