প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে প্রথম
উল্লেখযোগ্য মুসলিম অভিযান পরিচালিত হয়েছিল সিন্ধু রাজ্যে। ইরাকের উম্ময়িদ শাসক
হজ্জাজ বিন ইউসুফের আদেশে, তাঁর
ভ্রাতুষ্পুত্র মহম্মদ বিন কাসেম ৭১২ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সিন্ধু রাজ্য আক্রমণ করে
দেবাল (সিন্ধুর মোহনার বন্দর নগর) হায়দ্রাবাদ,
সিস্তান, ব্রাহ্মনাবাদ এবং মুলতান জয় করেছিলেন। চাচনামা নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, চাচ
বংশীয় শাসক দাহির এবং পরে তাঁর পুত্র জয়সিংহ যথেষ্ট বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে
মহম্মদ বিন কাসিমের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। সিন্ধু অঞ্চলে আরবদের আধিপত্য অভ্যন্তরীণ গোলযোগের
ফলে বেশী দিন স্থায়ী হয়নি; ঐতিহাসিক স্ট্যানলি লেনপুল
আরবদের সিন্ধু জয়কে ফলাফলহীন ঘটনা বলে চিহ্নিত করেছেন।
পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম
অভিযানের ঘটনা ঘটেছিল ১০০০ থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যখন গজনীর (আফগানিস্তানের
একটি স্থান) সুলতান মামুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ
করেছিলেন। মধ্য এশিয়ার অভিযান পরিচালনার জন্য
সম্পদ সংগ্রহ এবং ভারতীয় রাজাদের মধ্যে আতঙ্কের সঞ্চার করার উদ্দেশ্য নিয়ে
সুলতান মামুদ প্রথমে আফগানিস্তানের শাহী বংশীয় রাজা জয়পালকে ওয়াইহিন্দের যুদ্ধে
এবং জয়পালের পুত্র আনন্দপালকে চাচের যুদ্ধে পরাজিত করে ১০১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে
সমগ্র পাঞ্জাব অধিকার করেন। এর পরে একে
একে বরনের রাজপুত রাজা, মথুরার কলচুরি রাজ দ্বিতীয়
কোক্কল, কনৌজে প্রতিহার বংশীয় রাজাকে পরাজিত
করেন কিন্তু কোন অঞ্চলের উপরেই অধিকার স্থাপন না করে কেবল লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে
দেশে ফিরে যান। মামুদের আক্রমণের চাপে শাহী রাজবংশের
অবসান ঘটে। থানেশ্বর, কনৌজ,
মথুরা লুণ্ঠন ও হত্যালীলার কেন্দ্রে পরিণত হয়। চান্দেল্ল বংশীয় রাজা বিদ্যাধর ও মামুদের বশ্যতা স্বীকার
করে নেয়। ১০২৬ খ্রিস্টাব্দে চৌলক্যরাজ ভীমের বীরত্বপূর্ণ লড়াইকে নস্যাৎ করে কাথিয়াবাড়ের
সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন করেন সুলতান মামুদ। এর ফলে
মন্দিরের বিপুল সম্পদ তাঁর হস্তগত হয়। সোমনাথ থেকে
ফেরার পথে মামুদের বাহিনী সম্ভবত পরমার রাজা ভোজের কঠিন বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন
এবং দুরুহ মরুপথ দিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুদের মৃত্যু হলে ভারতবর্ষ সাময়িকভাবে
রক্ষা পেয়েছিল। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্রের মতে ইসলামের
শত্রুদের ধ্বংস করে ধর্মীয় গৌরব অর্জন করা মামুদের ভারত অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্য
ছিল। এছাড়াও ছিল কাংড়া দুর্গ, মথুরা, কনৌজ প্রভৃতি নগর
এবং সোমনাথ প্রকৃতি মন্দিরের সম্পদ লাভের সীমাহীন লোভ।
সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের
প্রায় ১৫০ বছর পরে ভারতীয় ভূখণ্ডে ইসলাম ধর্মীয় অভিযান কারীদের সবচেয়ে
তাৎপর্যপূর্ণ অভিযানটি ঘটে ঘুরের সুলতান মইজুদ্দিন মহম্মদ বা মহম্মদ ঘুরি ১১৭৫-৭৬
খ্রিস্টাব্দে গুজরাট আক্রমণ করে চৌলক্য রাজ ভীমের কাছে পরাজিত হন; ফলে
তিনি পাঞ্জাবকে আক্রমণের লক্ষ্য করেন এবং পেশোয়ার ও লাহোর দখল করে নেন। ঘুরি এরপর তাবরহিন্দা দুর্গ দখল করলে ১১৯০-৯১
খ্রিস্টাব্দে চৌহান বংশীয় রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজ তরাইনের যুদ্ধে তাঁকে পরাজিত করেন যদিও আহত ঘরিকে
পৃথ্বীরাজ রাজপুত উদারতার সাক্ষী রেখে হত্যা করেননি। এর ফল পৃথ্বীরাজকে ভুগতে হয়েছিল পরের বছর যখন ঘুরি তরাইনের দ্বিতীয়
যুদ্ধে পৃথ্বীরাজকে পরাজিত ও নিহত করেছিলেন। মিনহাজ
উস সিরাজ ও ফিরিস্তার রচনায় এই যুদ্ধের বর্ণনা রয়েছে। এই যুদ্ধে পরাজিত হবার ফলে
চৌহান রাজ্য অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে এবং দিল্লি, আজমীর, হিসার, সিরসা প্রভৃতি অঞ্চল
ঘুরির অধিকারে আসে। এরপর ঘুরির অণুচর কুতুবউদ্দিন দিল্লি ও আজমিরের উপর অধিকার
প্রতিষ্ঠা করেন এবং তুর্কিরা আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে চান্দাবারের যুদ্ধে কনৌজের
গাহড়বাল রাজা জয়চাঁদকে পরাজিত করেন। ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কনৌজ ও বারাণসি পর্যন্ত অঞ্চল ঘুরির অধিকারে
চলে আসে। তিনি তার অনুচর কুতুবুদ্দিন আইবককে
বিজিত অঞ্চল শাসনের দায়িত্ব দিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ত্রয়োদশ শতকের সূচনাতে ভারতের সুলতানি সাম্রাজ্যের
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
বেশ কতগুলি কারণে হিন্দু রাজারা
তুর্কি বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছিল। প্রথমত -
ভারতীয় হিন্দু রাজাদের মধ্যে কোনরূপ ঐক্য ছিল না; মহম্মদ
ঘুরির বিরুদ্ধে একক লড়াইয়ে পৃথ্বীরাজ যখন পরাজিত হন তখন চৌহান বংশের চিরশত্রু
গাহড়বাল রাজা জয়চাঁদ তাঁর রাজসভায় উৎসব পালন করেছিলেন। দ্বিতীয়ত - তুর্কিদের
দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনীর মোকাবিলা করার কৌশল ভারতীয় পদাতিক ও হস্তিবাহিনী ঠিক
রপ্ত করতে পারেনি। দক্ষ অশ্বারোহী হিসেবে তুর্কিরা
ঘোড়ার পিঠ থেকেই চমৎকারভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারত। তৃতীয়ত -
পৃথ্বীরাজের ভ্রান্ত কৌশল তাঁর পতনের জন্য দায়ী ছিল। তিনি প্রথম তরাইনের যুদ্ধে
জয়লাভ করেও মহম্মদ ঘুরিকে বাগে পেয়েও ছেড়ে দেন। এমনকি উত্তর পশ্চিমের সামরিক
ঘাঁটিগুলিকেও তিনি সুরক্ষিত করেননি। চতুর্থত -
সমসাময়িক ভারতে জাতীয়তাবোধের কোন চেতনা ছিলনা; সামন্ততান্ত্রিক
পরিকাঠামোয় উপর তলায় অবস্থিত শাসক অভিজাত শ্রেণীর সঙ্গে কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী
শ্রেণীর সম্পর্ক ছিল যথেষ্টই দুর্বল। নিচুতলার শোষিত
মানুষের সমর্থন ভারতীয় শাসক শ্রেণী সংকটের সময়কালে লাভ করেনি। সর্বোপরি ছিল মানসিকতার ফারাক। যদুনাথ
সরকার লিখেছেন যে, ইসলাম ধর্মী তুর্কি অভিযানকারীরা মনে
প্রাণে বিশ্বাস করত আল্লা সর্বশক্তিমান তাঁর জয় নিশ্চিত -
ধর্মীয় এই আবেগ তাঁদেরকে যুদ্ধ জয় করতে সাহায্য করে। অন্যদিকে হিন্দু রাজাদের মধ্যে কাজ করত
আত্মঅহংকার। আলবেরুনী লিখেছেন যে, হিন্দুরা মনে করত তাঁদের
মত কোন রাজা নেই, তাঁদের মত কোনো দেশ নেই, তাঁদের মত উন্নত বিজ্ঞান অন্য কারোর নেই। অকারণ আত্মঅহংকার ও হিন্দু রাজাদের পতনের জন্য দায়ী ছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন