সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার ওপর একটি টীকা

 


বিশ্বায়ন এমন একটি অমক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া যার সঙ্গে রাজনীতি সংস্কৃতি ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় যুক্ত থাকলেও এটির চরিত্র ছিল মূলত অর্থনৈতিক অল্প কথায় বিশ্বায়ন হলো বিশ্বজুড়ে বাজার অর্থনীতির নজিরবিহীন বিস্তারের প্রেক্ষিতে উৎপাদন ও মূলধনের আন্ত:রাষ্ট্রীয়করণ। বর্তমানে বিশ্বায়ন কথাটি বহু আলোচিত এক শব্দ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিল্প বাণিজ্য সংস্থার চত্বরে বিশ্বায়নের উপর আলোচনা ও বিতর্ক চলছে, সর্বস্তরের মানুষ এর সুফল ও কুফল সম্পর্কে জানতে আগ্রহী উন্নত দেশগুলি বিশ্বায়নের পক্ষে ঢাকঢোল পেটাচ্ছে এবং অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের মানুষেরা বিশ্বায়নের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে প্রমাদ গুনছে, প্রকৃতপক্ষে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে বিশ্বায়নকে কেন্দ্র করে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়েছে একথা অস্বীকার করা যাবে না যুগ ধর্মের প্রয়োজনে রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন নতুন ধ্যান ধারণা গড়ে ওঠে পুরাতন চিন্তা ভাবনাকে সরিয়ে দিয়ে নতুন চিন্তা ভাবনা জায়গা করে নেয় বিশ্বায়ন কথাটি ঠিক তেমনি বর্তমান যুগের পরিবর্তন পরিস্থিতির অনিবার্য ফলশ্রুতি

বর্তমানে আমরা এক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছি, ফলে কোন রাষ্ট্র নিঃসঙ্গ হয়ে থাকতে পারে না বিগত দুই দশক ধরে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া ও কর্মসূচি বিশ্ব সমাজ অন্তর্গত ধনী-দরিদ্র সুবিধাভোগী সুবিধা হীন সব শ্রেণীর মানুষকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে চলেছে মানুষের জীবন জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রুত ভাবে জড়িয়ে থাকার দরুন মূলত তৃতীয় বিশ্বের আমজনতার কাছে বিশ্বায়ন বা ভুবনীকরণ একালে কোন অচেনা শব্দ নয়, এক ক্রমবর্ধমান ভীতিপূর্ণ আবহ। বিশ্বায়নের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে দেশে দেশে জনসমাজ ও তাদের জীবনচর্চার ওপর

সাধারণভাবে বিশ্বায়নের অর্থ হলো অর্থনৈতিক নীতি পদ্ধতি কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত অবস্থা যেখানে মূল লক্ষ্য হিসেবে নির্দিষ্ট বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও মূলধনের একাধারে বিরাষ্ট্রীকরণ ও আন্ত:রাষ্ট্রীয়করণ। খুব সহজভাবে বললে বিশ্বাস বলতে বোঝায় এমন একটি ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়া যেখানে এক মেরুকৃত সীমানা বিহীন বিশ্বে প্রতিটি দেশের অর্থনীতি একসময় সম্পূর্ণ রূপে উন্মুক্ত হবে এবং তার ফলে বিশ্বজুড়ে পণ্য সামগ্রীর উৎপাদন বন্টন ও বিপণন চালু থাকবে, বাজার অর্থনীতির নিজস্ব নিয়ম অনুসারে চলবে। বিশ্বায়নের সঙ্গে তাই উন্মুক্ত পরিবেশ উদারীকরণের সম্পর্ক এত নিবিড়। বুঝিনির্ভর অর্থনীতির দাপটে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও কর্মকান্ড ক্রমে বিলীন হতে চলেছে বিশ্বায়নের পরিসরে এমন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সক্রিয় আছে যারা উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের বহু রাষ্ট্রের আর্থিক সঙ্গতির চেয়ে অনেক বেশি সম্পন্ন ও ক্ষমতাবান মানুষের জীবনযাত্রার এমন কোন ক্ষেত্র নেই যা বর্তমান সময়ে বিশ্বায়নের দ্বারা প্রভাবিত অথবা আলোরিত নয় বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী অমিয় কুমার বাগচী অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ভাবে বলেছেন 'বিশ্বায়ন একটি জগৎব্যাপী প্রক্রিয়া বা প্রক্রিয়ার সম্পর্কিতবিশ্বায়নের এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংস্থাগুলি বিশ্বজুড়ে নিজেদের মধ্যে একটি সম্পর্কের কাঠামোর অংশীদার হয়ে ওঠে, এখন তা প্রকৃতিতে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক থাকে না পূর্ণমাত্রায় বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে

বিশ্বায়নের প্রথম প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত মনে করেন বিশ্বায়ন পৃথিবী কে কার্যত বিশ্বগ্রাম এ পরিণত করছে এবং সংহতিকে দৃঢ় করেছে, দেশে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য সংস্কৃতি ও জীবনধারার মধ্যে সমন্বয়ে গড়ে তুলেছে অমিয় বাগচীর মতে বিশ্বায়ন বিশেষ কতগুলি আর্থিক নীতির সমন্বিত রূপ বিশ্বায়নের অন্যতম মৌলিক নীতিটি হল রাষ্ট্রীয় ও শিল্প উদ্যোগ সমূহের বিরাষ্ট্রীয়করণ যা দেশে দেশে সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিরোধী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে কেউ কেউ মনে করেন যে সোভিয়েত উত্তর এক মেরু বিশ্বে যেখানে পুঁজির চলাচলের প্রতিষ্ঠানিক বাধা দ্রুত অপসারিত করা হচ্ছে বিশ্বায়ন সেখানে নয়া উপনিবেশবাদের এক নতুন প্রয়োগ কৌশল ভিন্ন অন্য কিছু নয়

বিশ্বায়ন জাতি রাষ্ট্রকে উত্তরোত্তর গুরুত্ব গুরুত্বহীন করে তুলেছে বিশ্ববাজার ও আন্তর্জাতিক আর্থ ব্যবস্থার নিকট আত্মসমর্পণ ভিন্ন রাষ্ট্রগুলির সামনে আজ বিকল্প পথ নেই, দীপক নায়ার বলেন যে অর্থনৈতিক ধবনীকরণ আজ সেই ক্ষমতা অর্জন করেছে যার ভীতিতে সে রাষ্ট্রনৈতিক শক্তিকে পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত বাজারকেন্দ্রিক এই বিস্তারিত বিশ্বে চূড়ান্ত নির্ণায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে চারটি দিক যথা – industry, investment, information technology এবং individualism আমেরিকার সহ উন্নত জনতান্ত্রিক দেশগুলি এই ধারণার নিবিড় অনুসারী

 

বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে প্রথমে বলা যায় যে রাজনীতি সাংস্কৃতি সমাজ ইত্যাদি পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকলেও বিশ্বায়ন প্রধানত একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া এবং সুনির্দিষ্ট ভাবে বললে একগুচ্ছ আর্থ বাণিজ্যিক নীতির সমাহার। সোভিয়েত উত্তর পৃথিবীতে বিশ্বায়নের অর্থ হলো বিশ্ব বাজারের চাহিদা মেনে অর্থনীতির উন্মুক্তকরণ যেখানে পণ্য উৎপাদন, বন্টন ও বিপণনে কোন বাধা থাকবে না এবং পাশাপাশি পুঁজির চলাচল হবে অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত এই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিচালকের ভূমিকায় থাকবে বহুজাতিক কর্পোরেশন গুলির পাশাপাশি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WHO) মতো অধি রাষ্ট্রিক সংগঠনসমূহ।

বিশ্বায়নের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বিশ্বের অর্থনৈতিক সংহতি সাধনের নামে দেশে দেশে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সীমান্তকে অতিক্রম করা বৃহৎ পুঁজির নিয়ন্ত্রকরা সীমানা নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয় এবং পুঁজির বাধাহীন চলাচলের জন্যই তাদের এই সীমানা বিরোধিতা বিশ্বায়নের প্রবক্তা ও সমর্থকরা মনে করেন শুধুমাত্র আন্তর্জাতিকীকরণই যথেষ্ট নয়, ভৌগোলিক প্রাচীর ভেঙে জাতি রাষ্ট্রের সীমানা লঙ্ঘন করে দুনিয়াকে প্রকৃত অর্থে গ্লোবাল চরিত্র অর্জন করতে হবে এর ফলে জাতি রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বাড়বে দেশে দেশে বিভাজন ও খন্ডীকরণের পরিবর্তে এক অখন্ড ও অভিন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদয় হবে

বিশ্বায়নের সাথে উদারীকরণের যোগসূত্র নিবিড় উদারীকরন পুঁজিবাদ ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের সহায়ক শক্তি, তবে সমাজতন্ত্র বাদের বিরোধী কমিউনিস্টরা মনে করেন তথাকথিত উদারনীতিকরাত শ্রমের উপর পুঁজির একচেটিয়া অধিকার কায়েম কে সমর্থন করে এবং পরোক্ষ পুঁজিবাদী শোষণের সহায়ক হয়ে ওঠে বিশ্বায়ন সেই নবকলে বর প্রাপ্ত উদারীকরণের নীতিকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করে চলেছে সোভিয়েত পরবর্তী জমানায় এই আর্থিক উদারীকরণের তত্ত্বকে ব্যবহার করে কর্পোরেট বিশ্বায়নকে পূর্ণতা দিয়ে চলেছে আমেরিকা সহ পশ্চিমে পুঁজিবাদী শক্তিগুলি নয়া উদারীকরণ তাই বিশ্বায়নের অন্যতম সেরা হাতিয়ার, বাজারিকরণের অন্যতম তাত্ত্বিক ভিত্তি উদারীকরণ ব্যতীত বিশ্বায়ন অসম্ভব

বিশ্বায়নের সঙ্গে ওতপ্রুত ভাবে জড়িত উদ্যোগটি হল রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক সুস্থিতি করুন ও প্রয়োজনীয় কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস অর্থনীতির মৌলিক নিয়ম মেনে বিশ্বায়ন ভারসাম্য রক্ষায় সচেষ্ট বিশ্বব্যাপী যোগান ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার মধ্য দিয়ে আর্থিক সুস্থিতিকরণ আসে বিশ্বায়ন পন্থীদের মতে কাঠামো গত পুনর্বিন্যাসের অর্থ হল রাষ্ট্রের মান্ধাতা আমলের নিয়ন্ত্রণ ও কঠোর নিয়ম কানুন থেকে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক সংগঠনগুলিকে মুক্ত করা বিশ্বায়নের শর্ত মেনে কাঠামোগত পরিবর্তনে বিরাষ্ট্রীয়করণ ও বেসরকারি করনের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়

বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক সংহতিকরণের সাথে সাথে শিক্ষা জ্ঞান বিজ্ঞান সংস্কৃতি পরিবেশ সচেতনতা সহ সবক্ষেত্রেই বিস্তারিত পরিচালন ব্যবস্থা বা global management এর ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছে আজকের তথ্যনির্ভর ও জ্ঞান নির্ভর সমাজ ও বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত দেশে দেশে ভৌগলিক দূরত্ব আজ সম্পর্ক স্থাপনে কোনরূপ বাধা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না যেকোনো আবিষ্কার আজ নিমেষে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে

বিশ্বায়নের দরুন রাষ্ট্রের কাজের পরিধির সংকোচন ঘটলেও তা জনগণের দুরবস্থা কিংবা দুর ভাবনার কারণ হবে না রাষ্ট্রীয় ও সংস্থার বিলুপ্তি সাধনের সমান্তরাল পথে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও স্বাধীন কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বাড়বে, উন্নয়ন ও অগ্রগতির সুফল ভোগ করবে সব দেশের মানুষ উন্নততর পরিস্থিতির জন্য প্রাথমিকভাবে মানুষকে ত্যাগ স্বীকার করতে হতে পারে মুক্ত অর্থনীতিতে উজির বিশ্বায়ন যে সব প্রয়োজনীয় সংস্কার আনছে তার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল দেশি-বিদেশী বেসরকারি পুঁজি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ যতদূর সম্ভব হ্রাস করা পরি নামে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গুলির আর্থিক বুনিয়াদ সুদৃঢ় হবে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে অর্থনীতি

বিশ্বায়নের বিরোধিরা মনে করেন এই এক মেরু বিশ্বের মত বিশ্বায়ন এক মুখী ও পক্ষপান্ত সে দুষ্টু তৃতীয় দুনিয়ার জনসাধারণের নিকট এই বিশ্বায়ন আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ রূপে হাজির হয়েছে, কারণ বিশ্বায়নী প্রক্রিয়ায় দুনিয়াকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলার যে প্রয়াস চলছে তা ধর্মতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থার স্বার্থে আমজনতার কল্যাণের লক্ষ্যে নয় বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে ধনী দেশগুলি তাদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণাধীন উন্নততর প্রযুক্তি প্রকৌশল ও পরিকাঠামো ব্যবহার করে যে পণ্য উৎপাদন ও বিপণন করছে তার সুফল তারাই আত্মস্যাৎ করছে পরিণতিতে পশ্চাৎ পথ দেশগুলিতে হাজার হাজার ছোট ও মাঝারি শিল্প কারখানা রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় শিল্পদ্মক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং কাজ হারাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ বিশ্বায়ন যেভাবে জাতি রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ধ্বংস করে চলেছে তার পরিণতি হয়ে উঠছে ভয়াবহ নাগরিক সমাজের উপর এর প্রতিক্রিয়া কোনোভাবেই কল্যাণকর হতে পারে না

নিরপেক্ষভাবে বললে বিশ্বায়ন এমন এক প্রক্রিয়া যার আবির্ভাব হঠাৎ একদিনে ঘটেনি অর্থ সামাজিক ব্যবস্থার এক অনিবার্য পরিবর্তনের পরিণতি বিশ্বায়ন মানব সভ্যতার অগ্রগতি ও রূপান্তর, গেম ভান্ডারের নতুনতর উন্মোচন, বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগমন, এসব কিছুর সমন্বয়েই পর্যায়ক্রমিক আদিকল্প বিশ্বায়ন শ্রী চন্দ্র সিদ্ধান্তে এসেছেন বিশ্বায়ন বা ভূবন আয়ন এমন এক অনির্বাহ্য ভবিতব্য যাকে এড়িয়ে যাওয়ার পথ নেই, ছিলনা পাঁচ মতে বিশ্বায়ন যেমন কোনো দেশ, কোন শক্তির একক ও সচেতন প্রচেষ্টায় ঘটেনি, তাই এর ফল ক্ষতিকর হলেও বিশেষভাবে কাউকে দায়ী করা যায় না বিশ্বায়নের সঙ্গে মানিয়ে চলার একমাত্র পথ হল প্রতিটি দেশ বা রাষ্ট্রকে তার নিজের মতো করে নিজস্বতা নির্ভর উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করে এই প্রক্রিয়া বা উদ্যোগকে কাজে লাগাতে হবে

বিশ্বায়নের প্রবক্তাদের বক্তব্য হল জাতিরাষ্ট্রে স্বতন্ত্র অথবা সার্বভৌম ক্ষমতার দোহাই দিয়ে বিশ্বায়নের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি কোন পরিস্থিতিতে বাঞ্ছনীয় নয় তাদের বিশ্বাস একমাত্র ভুবনায়নই পারে উন্নয়নশীল দেশগুলি থেকে দারিদ্র নিরক্ষরতা মহামারীর মতো স্থায়ী ব্যাধিগুলির প্রতিকার করতে কিন্তু তাদের এই আশা ও আশ্বাস সত্ত্বেও বিশ্বায়ন নতুন শতাব্দীতে নিত্যনতুন সমস্যা ও সংকটের সম্মুখীন হয়েছে প্রথমতঃ বিস্তারিত অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে যে পরিচালন ব্যবস্থা গড়ে ওঠা জরুরি তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি দ্বিতীয়তঃ বিশ্বায়ন বাস্তবে সমাজ রাষ্ট্রে যে বৈষম্য সৃষ্টি করে চলেছে তা এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে দেশে দেশে মানুষের অন্তরে প্রবল ক্ষোভ খুব বিক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে তৃতীয়তঃ এক মেরু বিশ্বের প্রথম দিকে যেমন বিশ্বায়নের বিস্তার ঘটেছিল দুর্বার গতিতে, তুলনায় বর্তমান সময়ে দেশে দেশে নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার অবদান হিসেবে এই নতুন প্রক্রিয়া পদে পদে বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে, আমেরিকার মতো পুঁজিবাদী মহা শক্তিধর রাষ্ট্র নানাভাবে রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাজে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে ও তার ওপর চাপ তৈরীর মধ্য দিয়ে সমস্যা কে জটিল করে তুলছে চতুর্থতঃ বিশ্বায়নের সুযোগ নিয়ে বহুজাতিক সংস্থাগুলির কাজকর্ম বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছে এর ফলে জাতীয় রাষ্ট্র গুলির সার্বভৌমিকতা ক্ষুন্ন হচ্ছে

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে পরিশেষে বলতে পারি যে, বিশ্বায়নের অগ্রগতির পশ্চাতে তার বিরোধিতায় শামিল হয়েছে দেশে দেশে বঞ্চিত কর্মহীন মানুষের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, ক্ষোভ বিক্ষোভ তৃতীয় বিশ্বে বিশ্বায়নের প্রথম সূচনা হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার ২০০১ সালে আর্জেন্টিনায় প্রতিবাদী জনতা সেখানে জনবিরোধী বিশ্বায়ন অনুগামী সরকারের পতন ঘটিয়েছিল বিশ্বায়নের বিরোধিতায় নেমেছেন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দেশে দেশে বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদরা, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন পল মার্লোর সুইজি, লিওহিউবার ম্যান হ্যারি ম্যাগডফ, পল বারান, জন বেলামি, ফস্টার নোয়াম চমস্কি, অমিয় বাগচী প্রমূখ বিশ্বায়ন বিরোধী আন্দোলনে এদের অন্যতম হাতিয়ার রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানব উন্নয়ন বিষয়ক দলিল ও প্রতিবেদন ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে একটি রিপোর্টে তৃতীয় বিশ্বের ৬৭ টি রাষ্ট্র নিয়ে দরিদ্র রাষ্ট্র গোষ্ঠী চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে ৩৭টি রাষ্ট্রের দারিদ্র্য ক্রমবর্ধমান, ১৯ টি রাষ্ট্রের জনগণের প্রতি চারজনের মধ্যে একজনকে দৈনিক অনাহারে থাকতে হয় এই জায়গা থেকে বিশ্বায়ন বিরোধীরা গড়ে তুলেছে বিকল্প বিশ্বের সন্ধান কর্মসূচিকে সামনে রেখে বিশ্ব সামাজিক মঞ্চ সিয়াটল থেকে এই প্রতিরোধ সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস

    মার্টিন লুথার ছিলেন লুথা রিয়ান মতবাদের প্রবক্তা । জার্মানির স্যাক্সসনিতে ইসলিবেন নামে একটি গ্রামে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের জন্ম হয় । ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ইউটে ম বা র্গ চা র্চে র দরজায় তিনি তাঁ র ৯৫ তত্ত্ব ঝু লিয়ে দেন । এটি ছিল পোপের স্বর্গীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ । সমস্ত জার্মানির শিক্ষিত মানুষেরা লুথারের তত্ত্বে র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । এই ৯৫টি ছিল তাত্ত্বিক প্রশ্ন , এতে বাইবেল ও খ্রিস্টান দর্শন সম্বন্ধে তাত্ত্বিক গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রশ্ন ছিল । উইলিয়াম ওকামের চিন্তাভাবনা দ্বারা মার্টিন লুথার প্রভাবিত হয়েছিলেন । ইউরোপের এই চিন্তা ধারা পরিণত ছিল nominalism নামে । নমিনালিস্ট চিন্তাধারায় উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্বাস ও নিবেদিতপ্রাণতা । নমিনালিস্টরা মনে করত বিশ্বাসই মুক্তি আনবে , তবে এই বিশ্বাস অর্জনের জন্য শাস্ত্র পড়তে হবে এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের বোধগম্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করতে হবে । লুথার এইমতে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হওয়া উচিত এবং আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল রচনা করা একান্ত দরকার । তিনি খ্...