সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুসোলিনীর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের উত্থান

 


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের তথা আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধানতম বিষয় ছিল পরস্পর বিরোধী শক্তির সমাবেশ ইউরোপে গণতন্ত্রের মোড়গ শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে ইতালি, জার্মানি, স্পেন ইত্যাদি দেশে গণতন্ত্রের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবেশ তৈরি হয় যুদ্ধ পরবর্তীকালে বিশের দশকে যখন ইউরোপীয় রাজনীতিতে স্থিতাবস্থা ও স্থায়িত্ব বজায় রাখার চেষ্টা চলছিল সেই সময় ইতালিতে ইউরোপে প্রথম একনায়কতন্ত্রী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় ফ্যাসিস্ট দলের নেতা বেনিটো মুসোলিনী ছিলেন একনায়কতন্ত্রী ব্যবস্থার রূপকার

মুসোলিনীর নেতৃত্বে ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান কোন আকস্মিক ঘটনা নয়, নানা কারণে ইতালিতে এক সংকট জনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল এবং সমাজ জীবনে হতাশা ও রাজনৈতিক জীবনে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় ইতালি জার্মানির পক্ষ ত্যাগ করে মিত্র পক্ষের সঙ্গে যুক্ত হয় ইউরোপীয় রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি ও ইউরোপের বাইরে উপনিবেশ লাভের আশায় ইতালি মিত্র পক্ষে যোগদান করে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন চুক্তিতে মিত্র পক্ষ ইতালিকে যে সকল স্থান দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাস্তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরিত হলে ইতালিকে বঞ্চিত করা হয় কোন অঞ্চলের ওপর ইতালির অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি ফিয়ুমের অধিকার নিয়ে ইতালির সঙ্গে যুগোশ্লোভাকিয়ার তীব্র মত বিরোধ সৃষ্টি হয়। আলবেনিয়ার উপর ইতালির অধিকার স্বীকৃত হয়নি ইতালি বিজয়ী রাষ্ট্র হয়েও ভার্সাই চুক্তি বিরোধী হয়ে পড়েছিল

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ইতালির আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে এবং কলকারখানা বন্ধ হতে থাকে, খাদ্য সংকট, বেকারত্ব ইতালির অর্থনীতিকে নাজেহাল করে দেয়, মুদ্রাস্ফীতি তীব্র আকার ধারণ করে এই অবস্থায় শ্রমিক অসন্তোষ ও আন্দোলন তীব্র আকার নেয় কৃষকরা জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে ফলে ইতালির জনজীবনে যে নৈরাশ্য নেমে এসেছিল তার সুযোগ নেয় দক্ষিণপন্থী দলগুলি

ইতালি রাজনৈতিক পরিস্থিতও অস্থির হয়ে উঠেছিল এ কথা সত্য উনিশ শতকে ইতালি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং ব্রিটেনের ধাঁচে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় কিন্তু এই গণতন্ত্রের ভিত্তি ইতালিতে কোনদিনই শক্তিশালী ছিল না ১৯১৯-২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পরপর কয়েকটি মন্ত্রিসভার পতন ঘটেছিল। গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা কমে গিয়েছিল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ইতালির গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল এই অবস্থার সুযোগ নেয় সাম্যবাদীরা জাতীয় জীবনে এই সংকটময় কালে মুসোলিনী নামক নেতার উদ্ভব হয় তিনি ও তার ফ্যাসিস্ট দল ইতালির জনগণকে নতুন পথের সন্ধান দেয় এবং তিনি ইতালির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে মিলান শহরে ফ্যাসিস্ট দল নামে রাজনৈতিক দলের পত্তন করেন এই দলের প্রতীক ছিল ফ্যাসিস বা দড়ি বাঁধা কাষ্ঠদন্ড

মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট দল সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাদের সভা সমিতি ভেঙে দেয় প্রকাশ্যে সমাজতন্ত্রীদের ভীতি প্রদর্শন এবং এমনকি তাদের হত্যা পর্যন্ত করা হয় ফ্যাসিসদের ক্রমবর্ধমান শক্তির বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রীরা কোন সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলো না ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে ইতালির সংসদীয় নির্বাচনেও ফ্যাসিস্টরা প্রথম অংশগ্রহণ করে এবং আশাতীত সাফল্য লাভ করে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে রোমে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্যাসিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা ঘোষিত হয় কালো পোশাকে সজ্জিত সশস্ত্র ফ্যাসিস্ট স্বেচ্ছাসেবকরা বিত্তবান শ্রেণীর সক্রিয় সমর্থনের ফলে ক্রমশ পরিপুষ্ট হয়ে উঠতে লাগলো পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ ২৮ শে অক্টোবর মুসোলিনী তাঁর ফ্যাসিস্ট বাহিনী নিয়ে রোম অভিমুখে অভিযান শুরু করলেন মুসোলিনীর দাবি মত ইতালির মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করলে রাজা ভিক্টর ইমানুয়েল বাধ্য হয়ে মুসোলিনীকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানায় ৩০ অক্টোবর মুসোলিনী মন্ত্রিসভা গঠন করলেন চেম্বার অফ ডেপুটি ভোটের দ্বারা মুসোলিনীর হাতে এক বছরের জন্য দেশের সমস্ত ক্ষমতা দেওয়া হয় তিনি সমস্ত বিরোধী শক্তির কণ্ঠরোধ করেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করেন, এমনভাবে নির্বাচন বিধিকে সংস্কার করা হয় যাতে পুনরায় ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতায় আসতে পারে মুসোলিনী ক্রমশ প্রধানমন্ত্রী থেকে ডিক্টেটারে পরিণত হয় তাকে 'ইলডুচে' বলা হয়।

ফ্যাসিবাদের চরিত্র সম্পর্কেও ঐতিহাসিকরা একমত নন মাকসীয় লেখকদের মতে ফ্যাসিবাদ ছিল পুঁজিবাদের আর এক সংস্করণ তাঁদের বক্তব্য হলো ইতালিতে পুঁজিবাদের অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছিল তাই এক নিয়ন্ত্রণবাদী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন পড়েছিল আন্তনিও গ্রামসি প্রমুখ সৃজনশীল মার্কসীয় চিন্তাবিদদের মতে ফ্যাসিবাদকে নিছক পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্রের পরিণতি বলা চলে না এর পেছনে গণ সমর্থনের বিষয়টি একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না ঐতিহাসিক রাইকার বলেছেন 'It is fairly evident that fascism would not have been successful if it had not enjoyed the passive approval of a large, Perhaps preponderant section of public opinion’. অনেকে আবার ফ্যাসিবাদকে বৈপ্লবিক ব্যবস্থা বা revolutionary phenomena বলতেও কুন্ঠিত হননি তাদের মতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ইতালি তার হতাশা থেকে মুক্তি পেয়েছিল

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস

    মার্টিন লুথার ছিলেন লুথা রিয়ান মতবাদের প্রবক্তা । জার্মানির স্যাক্সসনিতে ইসলিবেন নামে একটি গ্রামে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের জন্ম হয় । ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ইউটে ম বা র্গ চা র্চে র দরজায় তিনি তাঁ র ৯৫ তত্ত্ব ঝু লিয়ে দেন । এটি ছিল পোপের স্বর্গীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ । সমস্ত জার্মানির শিক্ষিত মানুষেরা লুথারের তত্ত্বে র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । এই ৯৫টি ছিল তাত্ত্বিক প্রশ্ন , এতে বাইবেল ও খ্রিস্টান দর্শন সম্বন্ধে তাত্ত্বিক গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রশ্ন ছিল । উইলিয়াম ওকামের চিন্তাভাবনা দ্বারা মার্টিন লুথার প্রভাবিত হয়েছিলেন । ইউরোপের এই চিন্তা ধারা পরিণত ছিল nominalism নামে । নমিনালিস্ট চিন্তাধারায় উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্বাস ও নিবেদিতপ্রাণতা । নমিনালিস্টরা মনে করত বিশ্বাসই মুক্তি আনবে , তবে এই বিশ্বাস অর্জনের জন্য শাস্ত্র পড়তে হবে এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের বোধগম্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করতে হবে । লুথার এইমতে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হওয়া উচিত এবং আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল রচনা করা একান্ত দরকার । তিনি খ্...