সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

লোকার্ণো চুক্তির গুরুত্ব

 


১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ডাওয়েজ পরিকল্পনার ফলে ক্ষতিপূরণ সমস্যার একটি আপাততঃ সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়। এরফলে ফ্রাঙ্কো জার্মান তিক্ততা হ্রাস পায় এবং উভয় শক্তির মধ্যে বাস্তববোধ দেখা দেয় যে, বিরোধিতা নয় একমাত্র আপোষ ও আলোচনার পথেই ফ্রাঙ্কো জার্মান নিরাপত্তার সমস্যা সমাধান হতে পারে একদিকে জার্মানিতে গুষ্টাভ স্ট্রাসম্যান ক্ষমতায় এলে ফ্রান্সের সঙ্গে পূর্বতন বিরোধের কথা ভুলে একটি পারস্পরিক আক্রমণ চুক্তির প্রস্তাব দেন তিনি প্রস্তাব দেন যে, জার্মানি এই অনাক্রমণ চুক্তিতে আলসাস-লোরেনের ওপর তার দাবি ছেড়ে দেবে জেনেভা প্রোটোকলের বিফলতার ফলে ফ্রান্স তার নিরাপত্তার জন্য চিন্তিত ছিল ব্রিটেন স্ট্র্যাসম্যানের প্রস্তাবকে গ্রহণযোগ্য মনে করায় এবং ভাসাই সন্ধির দ্বারা স্থিরীকৃত ফ্রাঙ্কো-জার্মান সীমান্তে স্থিতাবস্থা রক্ষার গ্যারান্টি দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করায় ফ্রান্স উৎসাহ বোধ করে তবে ইংল্যান্ড আগাম জানিয়ে দেয় যে, ফ্রাঙ্কো-জার্মান সীমান্ত সম্পর্কে ব্রিটেন গ্যারান্টি দিতে প্রস্তুত থাকলেও জার্মানির পূর্ব সীমান্তে পোল্যান্ড ও চেকোশ্লোভাকিয়ার ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড কোন গ্যারান্টি দেবে না

এইভাবে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে লোকার্ণো কংগ্রেসের পথ পরিষ্কার করা হয়। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে সুইজারল্যান্ডের লোকার্ণো শহরে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি, পোল্যান্ড ও চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রতিনিধিরা এক অভূতপূর্ব মিত্রতা ও সখ্যতার আবহাওয়ায় লোকার্ণো চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত হন লোকার্নোতে ফ্রাঙ্কো জার্মান ও অন্যান্য শক্তিগুলির মধ্যে যে সদিচ্ছা ও মৈত্রীর পরিবেশ দেখা দেয়, তাকে বলা হয় লোকার্ণোর মৈত্রীর ভাবধারা ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ফ্রাঙ্কো জার্মান ও ইঙ্গ ফরাসি মতভেদ, রূঢ় দখল, প্রতিহিংসা নীতি প্রভৃতির ফলে ইউরোপে শান্তির বাতাবরণ বিনষ্ট হয়েছিল

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে অস্ত্রের যুদ্ধ বন্ধ হলেও কূটনীতি ও অর্থনীতির যুদ্ধ চলছিল লোকার্ণোর মিত্রতাপূর্ণ ভাবধারার ফলে এই তিক্ত, কটু ও সংঘাতময় যুগের অবসান হয় পারস্পরিক বিশ্বাস ও সদিচ্ছার যুগের সূচনা হয় এজন্য ঐতিহাসিক ল্যাংস্যাম মন্তব্য করেছেন যে লোকার্ণো সন্ধির দ্বারা এক যুগের অবসান ও নতুন একটি যুগের সূচনা হয়

ব্রিটিশ মন্ত্রী চেম্বারলিনও মন্তব্য করেছেন যে, 'লোকার্ণো ছিল যুদ্ধ ও শান্তির বছরগুলির মধ্যে প্রকৃত বিভাজন রেখা যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধ পরবর্তী ঠান্ডা লড়াই, স্নায়ু যুদ্ধ সকল কিছুকে লোকার্ণো অতীতের ঘটনায় পর্যবসিত করে এবং নতুন ভাবে পারস্পরিক আস্থা ও সহাবস্থানের যুগ শুরু হয় এই মনোভাবকে 'লোকার্ণোর ভাবধারা' বলা হয় লোকার্ণোর সন্ধি অপেক্ষা লোকার্ণোর ভাবধারা কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না লোকার্ণো চুক্তি আপাতত ইউরোপের নিরাপত্তার বিধান করতে সক্ষম হয় যুদ্ধের পর এই সর্বপ্রথম ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে এক নিরপেক্ষ সমতাল রক্ষা করা সম্ভব হয় লোকার্ণো চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির ওপর থেকে যুদ্ধ অপরাধীর কলঙ্ক চিহ্ন মুছে ফেলা সম্ভব হয়

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস

    মার্টিন লুথার ছিলেন লুথা রিয়ান মতবাদের প্রবক্তা । জার্মানির স্যাক্সসনিতে ইসলিবেন নামে একটি গ্রামে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের জন্ম হয় । ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ইউটে ম বা র্গ চা র্চে র দরজায় তিনি তাঁ র ৯৫ তত্ত্ব ঝু লিয়ে দেন । এটি ছিল পোপের স্বর্গীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ । সমস্ত জার্মানির শিক্ষিত মানুষেরা লুথারের তত্ত্বে র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । এই ৯৫টি ছিল তাত্ত্বিক প্রশ্ন , এতে বাইবেল ও খ্রিস্টান দর্শন সম্বন্ধে তাত্ত্বিক গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রশ্ন ছিল । উইলিয়াম ওকামের চিন্তাভাবনা দ্বারা মার্টিন লুথার প্রভাবিত হয়েছিলেন । ইউরোপের এই চিন্তা ধারা পরিণত ছিল nominalism নামে । নমিনালিস্ট চিন্তাধারায় উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্বাস ও নিবেদিতপ্রাণতা । নমিনালিস্টরা মনে করত বিশ্বাসই মুক্তি আনবে , তবে এই বিশ্বাস অর্জনের জন্য শাস্ত্র পড়তে হবে এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের বোধগম্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করতে হবে । লুথার এইমতে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হওয়া উচিত এবং আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল রচনা করা একান্ত দরকার । তিনি খ্...