ট্রুয়ার্ট মিল তাঁর ১৮১৮ সালের প্রকাশিত 'History of India' নামক গ্রন্থে ভারতবর্ষের ইতিহাসকে
তিনটি ভাগ করেন – হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ এবং ব্রিটিশ যুগ। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মধ্যে অবশ্য অনেকেই বলেন যে ব্রিটিশ
ভারতের আগে ভারতের ইতিহাসে কোন পরিবর্তনই ঘটেনি তা ছিল গতানুগতিক।
বিভাজনের উপর ভিত্তি করে ই পরবর্তী ঐতিহাসিকরা ভারতবর্ষের
ইতিহাস কে তিনটি পৃথক যুগে ভাগ করেন। যথা প্রাচীন যুগ (শুরু থেকে ১২০৩ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ হিন্দু রাজাদের দ্বারা
শাসিত ভারত), মধ্যযুগ (১২০৩ থেকে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ অর্থাৎ মুসলিম শাসিত ভারত) এবং আধুনিক যুগ (১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসিত
ভারত)। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, রামশরণ ত্রিপাঠী, অশোক কুমার
মজুমদার, কালীকিঙ্কর দত্ত প্রমূখ জাতীয়তাবাদী অন্যান্য ঘরানার ঐতিহাসিকরা ও এই যুগ বিভাজনকে
মোটের উপর তাঁদের রচনায় রেখেছিলেন।
রামশরণ শর্মা, ইরফান হাবিব, নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখ মার্কসবাদী এবং অন্যান্য
ধারার ঐতিহাসিকরা বিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে এই যুগ বিভাজন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের সার কথা যে সকল দেশে কোনদিন
মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বা যে সকল দেশে নিরবিচ্ছিন্নভাবে মুসলিম শাসন চলছে সেই সকল
দেশের তাহলে কিভাবে মধ্যযুগকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যাবে?
৩০০/৩৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন যুগকে শেষ করে পরবর্তী ৬০০ বছরের
সময়কালকে রামশরণ শর্মা, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ ঝা, নিহাররঞ্জন রায়, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়
প্রমুখরা নাম দিলেন আদি মধ্যযুগ। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ৩০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের
মধ্যবর্তী সময় কালকে বিকাশোন্মুখ মধ্যযুগ বা প্রায় মধ্যযুগ (Proto Medieval) নামে
চিহ্নিত করলেন। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ৭৫০ - ১০০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালকে বললেন আদি
মধ্যযুগাভিমুখী ১০০০-১৩০০ খ্রিষ্টাব্দকে বললেন আদি মধ্যযুগ।
ঐতিহাসিক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় তাঁর the making of early medieval India গ্রন্থে বলেছেন যে প্রাচ্য লেখকদের ভারতীয় সমাজ সম্বন্ধে পরিবর্তনহীনতার
ভ্রান্ত ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করার জন্যই আদি মধ্যযুগ ধারণার উদ্ভব। তাঁর মতে ৬০০-১২০০/১৩০০ পর্যন্ত সময়কালে যে ঐতিহাসিক প্রবণতাগত পরিবর্তন ঘটেছিল তা এই সময়কালকে
আগের এবং পরের যুগ থেকে প্রকৃতিগত/ চরিত্রগত/ বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে আলাদা করে। এখানে ঐতিহাসিকদের দুটি দিকে নজর দিতে হবে (ক) সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে
আদৌ কোন পরিবর্তন ঘটেছিল কিনা এবং (খ) পরিবর্তন ঘটে থাকলে তার প্রকৃত চরিত্র কি ছিল।
এখানে দেখতে হবে কুখ্যাত ঐতিহাসিক নিহাররঞ্জন রায়, রামশরণ
শর্মা, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় -রা early
historical বা আদি ঐতিহাসিক যুগ (বৈদিক থেকে
গুপ্তদের অবসান পর্যন্ত) এর চরিত্র সম্পর্কে কি বলেছেন -ছোট ছোট রাজ্য থেকে
কেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা যা আমলাতান্ত্রিক আমলাদের নগদ অর্থে মাইনে প্রদান, মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন, দূরপাল্লার বাণিজ্য, নগরায়ন, কারিগরি শিল্প উৎপাদনের ব্যাপক
বিকাশ, জমিতে অধিকার স্থাপনকারী মধ্যবর্তী শ্রেণীর অনুপস্থিতি, চতুরবর্ণ প্রথা -ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়
কর্তৃক সামাজিক উদ্বৃত্ত ভোগ, বৈশ্য ও শূদ্র দ্বারা উৎপাদন, দাস প্রথার উপস্থিতি, ভূমি দাসের বা এই প্রথার অনুপস্থিতি।
৬০০ – ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের পর তাহলে আর্থসামাজিক রাষ্ট্রীয়
পরিকাঠামো ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কি এমন পরিবর্তন ঘটল? Herman kulke এবং Dietmar Rothermund a lustory of India হর্ষর সাম্রাজ্যিক পরিকাঠামোকে পুরাতন মগধের সাম্রাজ্যের থেকে আলাদা বলে
বিশ্লেষণ করেছেন। ৬৩২ র মধুবন তাম্রশাসনে ব্রাহ্মণদের জমিদান প্রসঙ্গে মহাসামন্ত স্কন্দগুপ্ত
এবং সামন্ত ঈশ্বর গুপ্তর অধিকার ও কর্তব্যকে উল্লেখ করা হয়েছে। গুপ্ত বা তার আগেকার সময়কালে
সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে যে প্রাদেশিক শাসনকর্তা বা রাজ প্রতিনিধি বা যুবরাজের
উপস্থিতি থাকতো এবং তারা যে রাজকীয় নির্দেশকে বলবৎ করত তারা তাহলে কোথায় গেল? অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর
প্রশ্নে হর্ষের সময় একটি তাৎপর্যপূর্ণ
পরিবর্তন এসেছিল; লেখকদের ভাষায় “Harsha & the
samants: a new pattern of feudalism.”
সামন্ততন্ত্র সংক্রান্ত বিতর্কে খুব সংক্ষেপে আদি মধ্যযুগের
ঐতিহাসিক প্রবণতা বা লক্ষণগুলিকে অতি সংক্ষেপে দেখা যেতে পারে –
নীহার রঞ্জন রায়ের মতে আঞ্চলিক রাজতন্ত্র (রাজ্যের উদ্ভব, ইউরোপের জাতি
রাষ্ট্রের মত) মুদ্রা অর্থনীতির বদলে স্বাভাবিক অর্থনীতি, লিপি, ভাষা, সাহিত্য, শিল্পের ক্ষেত্রেও
আঞ্চলিকতার উদ্ভব, অসংখ্য সম্প্রদায়, উপসম্প্রদায়, জাতিভিত্তিক ধর্ম ইত্যাদি।
রামশরণ শর্মা, বি এন এস যাদব, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ ঝা – কৃষকদের অবস্থার
ব্যাপক অবনতি, কৃষির প্রসার, বাণিজ্যিক অবক্ষয়, মুদ্রার অভাব, নগরের অবক্ষয়, ভূম্যধিকারী শ্রেণীর আগমন এবং ক্রমিক শক্তি বৃদ্ধি, কেন্দ্রীয় শক্তির ক্রমিক
দুর্বল হয়ে যাওয়া।
ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় স্থানীয় ভিত্তিতে সামাজিক গোষ্ঠীর
উদ্ভব- এদের মধ্যে কতকগুলির বৃহত্তর আঞ্চলিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর রূপ ধারণ (রাজপুত গুর্জর), আঞ্চলিক স্তরের সমাজ সংস্কৃতি
অর্থনীতি ধর্ম ও জীবনযাত্রার পরিপেক্ষিতে এক একটি রাষ্ট্রীয় এককের আবির্ভাব। তিনি লিখেছেন our period marked in a perceptible way the coming
together of ingredients which go into the making of regions. State formation
was a crucial agent of change in this respect in the sense that it brought a
measure of cohesion among local elements of culture by providing them a focus.
At the same time it medieval in assimilation of ideas, symbols,& rituals
which had a much wider territorial spread & acceptability.
Reference
ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রাচীন ও মধ্যযুগ (দ্বিতীয় খন্ড): গোপাল চন্দ্র সিনহা
মধ্যকালীন ভারত : গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী
The making of early medieval India – Brajadulal chattopadhyay
A history of India – Herman kulke & Dietmar Rothermund
The medieval factors in Indian civilization : edited by
Niharranjan Roy & others
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন