হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসী দলের ক্ষমতাসীন হওয়া আন্তর্জাতিক
রাজনীতিতে জার্মানির সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। তিনি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যেমন একদলীয় একনায়কতন্ত্রী
শাসন বলবৎ করেছিলেন, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সম্প্রসারণশীল নীতির প্রবক্তাও ছিলেন। হিটলারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের পর ইউরোপের কোন দেশেই
তেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। হিটলার কর্তৃক অনুসৃত কঠোর নিয়ন্ত্রণবাদী
তৎপরতা বৈদেশিক নীতিতে কোন ছাপ ফেলবে না এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের
শাসনকূলের মনে কোন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়নি। সোভিয়েত রাশিয়াও নাৎসী শাসন বলবৎ হওয়ায় তেমন শঙ্কিত
হয়নি, বরং স্তালিনের জীবনীকার আইজাক ডয়েশার মনে করেন জাতীয় স্বার্থের প্রতি
অগ্রাধিকার দিয়ে স্তালিন জার্মানি সম্পর্কে উদাসীনতা দেখিয়েছিলেন। এইসব বিষয়গুলি
হিটলারের পররাষ্ট্র নীতি বা বৈদেশিক নীতির উপর প্রভাব ফেলেছিল।
হিটলার জার্মানির ক্ষমতা দখলের পর কোন উগ্র পররাষ্ট্র নীতি
অনুসরণ করেন নি। প্রথমদিকে তিনি
অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে বেশি নজর দিয়েছিলেন। তিনি আর্থিক ও সামরিক দিক দিয়ে জার্মানির উন্নয়ন ঘটাতে
অধিক বেশি জোর দিয়েছিলেন। তিনি বলেন যে, জার্মানি শান্তি নীতি অনুসরণে আগ্রহী। তাঁর বক্তব্য ছিল মীমাংসা ও আলোচনার মাধ্যমেই জার্মান সরকার
ও জনগণ শান্তি ও মিত্রতা স্থাপনের জন্য ঐক্যবদ্ধ। সম্ভবত হিটলারের এইসব বক্তব্য পশ্চিমী
গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে বিভ্রান্তির মধ্যে রেখেছিল।
হিটলারের পররাষ্ট্রনীতির চরিত্র ছিল একাধারে সংশোধনবাদী ও
সম্প্রসারণশীল। প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে জার্মান পররাষ্ট্রনীতির মূল বক্তব্য ছিল ১৯১৯
খ্রিস্টাব্দের অপমানজনক চুক্তির বৈষম্য মূলক ভৌমিক সামরিক ও আর্থিক শর্তগুলিকে
লঙ্ঘন করে জার্মানিকে পুনরায় একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করা। এই সংশোধনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত
হয়েই জার্মানি পুনরায় সমরায়োজনের দাবি জানাতে থাকে এবং অন্যান্য ইউরোপীয়
দেশগুলির বিশেষত ফ্রান্সের সঙ্গে সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে সমকক্ষ হতে চেয়েছিল। অখন্ড জার্মান রাষ্ট্র গঠন হিটলারের মূল
উদ্দেশ্য ছিল না, জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার জন্য ইউরোপীয় বিস্তৃত ভূখণ্ড জুড়ে
এক বিশালাকার জার্মান সাম্রাজ্য স্থাপন করা ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য।
ফ্রান্স তার নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করার জন্য পোল্যান্ডের
সঙ্গে মিত্রতাবদ্ধ হয়েছিল। হিটলারের তাই লক্ষ্য ছিল ঐ মৈত্রীকে ভেঙে দেওয়া। হিটলার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডের সঙ্গে দশ
বছরের এক অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। জার্মানদের বিরুদ্ধে ফ্রান্স ও পোল্যান্ড
যে মৈত্রী গড়ে তুলেছিল এই চুক্তির দ্বারা হিটলার তাকে অকেজো করেন। এর সাথে সাথে হিটলার পোল্যান্ডের সঙ্গে সোভিয়েত
ইউনিয়নের সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করেন।
ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী জার্মানির কাছ থেকে সার অঞ্চল
কেড়ে নিয়ে ফ্রান্সকে দেওয়া হয়েছিল। ঠিক ছিল ১৯৩৫ সালে গণভোটের মাধ্যমে স্থির হবে এই সার অঞ্চলের ওপর ফ্রান্স না
জার্মানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। হিটলার সার অঞ্চলের সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ আরম্ভ করেন এবং ভোটারদের ভীতি
প্রদর্শন করেন। গণভোটের ফলাফল
জার্মানির অনুকূলে আসে। প্রায় ১৫ বছর পর
জার্মানি তার শিল্পসমৃদ্ধ সার অঞ্চল ফিরে পায়।
ভার্সাই সন্ধি জার্মানিকে নিরস্ত্র করে রাখার যে ব্যবস্থা
করেছিল হিটলার তাকে মেনে চলতে রাজি ছিলেন না। তিনি বাধ্যতামূলক সামরিক আইন বলবৎ করে জার্মান
যুবকদের সামাজিক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তিনি যুদ্ধজাহাজ, ট্রাঙ্ক, কামান, সাজোয়া গাড়ি, ডুবোজাহাজ, বোমারু বিমান ইত্যাদি দ্বারা সামরিকীকরণ আরম্ভ করেন। ইউরোপের রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৩৫ সালে ইংল্যান্ডের সঙ্গে জার্মানির নৌ
চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অবশ্যই
হিটলারের কূটনীতির সাফল্যের অন্যতম দিক। ভার্সাই সন্ধি ও লোকার্নো চুক্তিকে অস্বীকার করে জার্মানি
রাইন অঞ্চলে সামরিকীকরণ শুরু করেন। এছাড়া ইংল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পরিণতিতে ফ্রান্সকে যে হিটলার আরও
বিপদে ফেলে দিয়েছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তথ্য ভিত্তিক
উত্তরমুছুন