সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সমরনায়কতন্ত্রের উদ্ভবের কারণ

 


 

চীনের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯১৬ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিল ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র রূপে চীনের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার ইতিহাস শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শক্তির অভাবের ফলে কেন্দ্রাতিক বা বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির উত্থান ঘটে এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এইরূপ অবস্থায় দেশের বিভিন্ন প্রদেশে সমরপ্রভুদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয় সমর প্রভুরা নিজেদের ক্ষমতা ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় যার পরিণতি রূপে প্রজাতান্ত্রিক চীনের ইতিহাসে অন্ধকার যুগের সূচনা হয়। কেন্দ্রীয় পিকিং শক্তির দুর্বলতা এবং আর্থিক ও সামরিক দিক থেকে প্রদেশ গুলির উপর অধিক নির্ভরতা সমনায়কতন্ত্রের উদ্ভবের পথ প্রস্তুত করে একটু পিছনে গিয়ে দেখলে দেখা যায় যে ১৯১১-১২ খ্রিস্টাব্দে চীনে প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই চীনের প্রদেশগুলিতে সামরিকিকীকরণ ঘটতে থাকে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের পিছনে সাফল্যের ক্ষেত্রে বিদ্রোহী সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল, তারাই ছিল প্রকৃত সাফল্যের কারিগর প্রজাতান্ত্রিক সরকার সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রদানে অক্ষম হলে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এই আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় উদ্যোগের অভাবের ফলে সামরিক গভর্নরূপে সমর প্রভুরাই এগিয়ে এসেছিল

প্রজাতান্ত্রিক কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার ফলে সমরনায়কতন্ত্রের উদ্ভবের পথ প্রস্তুত হয় তাইপিং বিদ্রোহের সময় থেকে চীনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একটি দুষ্টচক্রের সৃষ্টি হয় যার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষকে রাজস্ব আদায় ও ব্যবহারের অধিকার অর্পণ করেন কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক দুর্বলতার কারণে প্রাদেশিক সেনাবাহিনীর খরচ যোগান দিতে পারেনি ফলে প্রাদেশিক সরকারকে সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ যোগাতে হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে সামরিক গভর্নর ও তাদের অধস্তনদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে রাজনৈতিক সুস্থিতির জন্য রাজস্ব উৎপাদনকারী প্রতিটি ভূমির উপরেই সেনাপতিরা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে যার ফলশ্রুতি হিসেবে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল সরকারের সামন্তিকরণ এই সামন্তিকরণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ রূপে চিনে সামরিকীকরণ ঘটে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে চীনে আধুনিক সেনাবাহিনী তৈরির ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট শিক্ষার প্রয়োজন হতো না, সাহস উপস্থিত বুদ্ধি এবং জনগণকে চালনা করার ক্ষমতা থাকলেই হতো নতুন পরিস্থিতিতে সেনার চাহিদা বৃদ্ধি পেলে চীনের দরিদ্রতম ব্যক্তিরা ও সেনা অফিসার হিসেবে কাজ করার সুযোগ লাভ করে আর এই ধরনের লোকেরাই চীনের শাসন ক্ষমতা কায়েম করে

চীনের সমন্বয়ক তন্ত্রের উত্থানের বীজ লুকিয়ে ছিল ইউয়ান শি কাইয়ের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতির মধ্যে তাই তাকে সমরপ্রভুদের জনক আখ্যা দেওয়া হয় তার কাছ থেকে সমর নায়করা প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতির অভিজ্ঞতাই শুধুমাত্র অর্জন করেননি, তারা শিখেছিলেন কিভাবে সন্ত্রাস ও উৎকোচের মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়

 প্রাচীন কনফুসিয় বাদের ঐতিহ্য উয়ানের কাছে অকেজো মনে হয়েছিল। একদিকে প্রাচীন কনফুসীয় নৈতিক বিধি এবং চীনা রাজতন্ত্রের আচার ভিত্তিক শাসন পূর্বের তেজ হারিয়েছিল। অন্যদিকে জনঘনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আধুনিক বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানসমূহ তখন ও চীনা জনমানুষে প্রতিষ্ঠিত হয়নি

ইউয়ান এবং তার অনুচর সমরপ্রভুগণ কনফিউশন বিধি প্রয়োগের পরিবর্তে বলপূর্বক ও কৌশলে অনেকটা আইনি শাসন কায়েম করেন যদিও কোন ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা ছিল না। তিনি মনে করতেন রাজকীয় ক্ষমতার অনুমোদন তখন আর দৈব দ্বারা নির্দিষ্ট হয় না, বরং জনগণের ইচ্ছার মাধ্যমেই এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে নিজের ক্ষমতার প্রতি আস্থাশীল ইউয়ান আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার প্রতি যেমন ঘৃণা প্রদর্শন করতেন তেমনি ভাবে ঐতিহ্যগত ব্যবস্থার প্রতিও তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেন

ইউয়ানের মৃত্যুর পর ১৯১৬ বৈদেশিক শক্তির প্রভাব ও চীনের ঐক্যের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তার উত্তরসূরীদেরও ব্যর্থ করেছিল কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে সন্ধি বন্দরগুলিতে স্থানীয় শক্তি বিন্দের যেমন আশ্রয়স্থল গড়ে উঠেছিল তেমনি রণনীতিগত সম্পদের সহজ প্রাপ্য তাও ছিল প্রভাবের ক্ষেত্রগুলিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থ ও ক্ষমতাবৃদ্ধির ফলে প্রদেশ গুলিতে তাদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায় ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহায় সংঘের ভিতর এবং বাইরে বিদেশি ব্যাংক গুলির প্রবল প্রভাব চীনকে কখনোই আত্মনির্ভরশীল হতে দেয়নি ইউয়ান শি কাইয়ের মৃত্যুর পর সমর প্রভুদের নিজেদের মধ্যে বিবাদ পার্লামেন্টের সদস্যদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ এবং সমর প্রভু ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিবাদ চীনের রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল

 

 

 

 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস

    মার্টিন লুথার ছিলেন লুথা রিয়ান মতবাদের প্রবক্তা । জার্মানির স্যাক্সসনিতে ইসলিবেন নামে একটি গ্রামে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের জন্ম হয় । ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ইউটে ম বা র্গ চা র্চে র দরজায় তিনি তাঁ র ৯৫ তত্ত্ব ঝু লিয়ে দেন । এটি ছিল পোপের স্বর্গীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ । সমস্ত জার্মানির শিক্ষিত মানুষেরা লুথারের তত্ত্বে র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । এই ৯৫টি ছিল তাত্ত্বিক প্রশ্ন , এতে বাইবেল ও খ্রিস্টান দর্শন সম্বন্ধে তাত্ত্বিক গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রশ্ন ছিল । উইলিয়াম ওকামের চিন্তাভাবনা দ্বারা মার্টিন লুথার প্রভাবিত হয়েছিলেন । ইউরোপের এই চিন্তা ধারা পরিণত ছিল nominalism নামে । নমিনালিস্ট চিন্তাধারায় উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্বাস ও নিবেদিতপ্রাণতা । নমিনালিস্টরা মনে করত বিশ্বাসই মুক্তি আনবে , তবে এই বিশ্বাস অর্জনের জন্য শাস্ত্র পড়তে হবে এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের বোধগম্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করতে হবে । লুথার এইমতে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হওয়া উচিত এবং আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল রচনা করা একান্ত দরকার । তিনি খ্...