১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জুলাই বিপ্লব ফ্রান্সে বুর্জোয়া শ্রেণীকে
বিজয়ী করে, পরাজিত হয় অভিজাত শ্রেণী। এই শ্রেণী শেষ পর্যন্ত দশম চার্লসের প্রতি
আনুগত্য ছিল। এই বিপ্লবের
চরিত্র সম্পর্কে দ্য তকভিল বলেছেন যে, “মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিশেষ মানসিকতা সরকারের সাধারণ মানসিকতা
হয়ে দাঁড়ায়”। বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ সরকারকে পীড়নমূলক নীতি
গ্রহণে বাধ্য করে এবং প্রতিরোধের দলের দিকে ঠেলে দেয়।
কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন যে ১৮৪৬-১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে খাদ্য
সংকট জুলাই রাজতন্ত্রের পতনের প্রধান কারণ ছিল। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে আলুতে পোকা লাগলে আলুর ফসল
বিনষ্ট হয়, এরপর বছর অনাবৃষ্টির ফলে গমের ফসল বিনষ্ট হয়, ময়দা ও রুটির দাম বৃদ্ধি পায়, খাদ্য সংকট ফ্রান্সের বৃহত্তম
জনসাধারণকে হতাশাগ্রস্ত করে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে শহুরে খেটে খাওয়া লোকেদের দুর্দশার অবশেষে থাকে না। এই কারণে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে লুই ফিলিপের পতন ঘটে।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ হিসেবে জ্যাক ড্রুজ (Jack Droz) বলেছেন যে, সমাজের একশ্রেণীর লোকের অপর
শ্রেণীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ। তাঁর মতে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ছিল ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে নিম্ন
বা পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর বিদ্রোহ। ধনী বুর্জোয়া ছিল একচেটিয়া মুনাফা ভোগী শ্রেণী। ঐতিহাসিক তকভিল বলেন যে “ধনী বুর্জোয়া শ্রেণী লুই ফিলিপের সরকারকে একটি
শিল্প উদ্যোগ হিসেবে গণ্য করে। বুর্জোয়া মানসিকতা গোটা সরকারকে আচ্ছন্ন করে। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের ধনী বুর্জোয়ারা
পাতি বুর্জোয়াদের চোখে সন্দেহভাজন শ্রেণীতে পরিণত হয়।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ হিসেবে বলা হয় যে লুই ফিলিপের
সহায়তায় উচ্চ বুর্জোয়া শ্রেণী ফ্রান্সে একটি অর্থনৈতিক অভিজাতক শ্রেণীতে পরিণত
হয়। লুই ফিলিপের শুল্ক সংরক্ষণ
নীতি এদের মুনাফা লাভের সুযোগ করে দেয় এবং আইন প্রণয়ন করে মিল মালিক ও মূলধনীদের
সুবিধা করে দেয়, যার ফলে কলকারখানায় কম মজুরীতে শ্রমিকদের অধিক সময় খাটানোর সুযোগ পায়। অল্প মজুরী শ্রমিকদের জীবনযাত্রাকে করুন করে
তোলে। শ্রমিকেরা শহরের বস্তি এলাকায়
এক অস্বাস্থ্যকর পঙ্কিল জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। চিন্তাবিদ সেন্ট সাইমন যাকে সমাজতন্ত্রবাদের
আদিগুরু বলা হয় তিনি প্রথম উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকদের নব মূল্যায়ন করেন। সমাজতান্ত্রীক দল তার নিকট শ্রমিকদের স্বার্থ
রক্ষার জন্য আইন প্রণয়নের দাবি জানালে লুই ফিলিপ শিল্পে হস্তক্ষেপ না করার নীতি
ঘোষণা করেন। নন্টস লায়নস ও বোর্দো শহরে শ্রমিকদের দাঙ্গা হাঙ্গামা
বাঁধলে লুই ফিলিপ তা দমন করে ধনী বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করেন।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ হিসেবে আরও বলা হয় যে, লুই ফিলিপ যদি ভোটাধিকার আইন
সংস্কার করে সর্বসাধারণের ভোটাধিকার দিতেন তবে তাঁর সিংহাসনের বুনিয়াদ মজবুত হতো। কিন্তু লুই ফিলিপ পাতি বুর্জোয়াদের বা নিম্ন
বুর্জোয়াদের উপর আস্থা রাখতে পারেননি। তিনি ভোটাধিকার আইন চালু করেন, যার মাধ্যমে ১৫০ জন পুরুষের মধ্যে ১ জন ভোটাধিকার পেত।
নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোটাধিকার না থাকায় জুলাই রাজতন্ত্রকে উচ্চ বুর্জোয়া শ্রেণী
পুঁজিবাদী সরকার বলে অভিহিত করে। এঁরা বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক আধিপত্য নাসের
জন্য ভোটাধিকার সম্প্রসারণের দাবি করে।
লুই ফিলিপের ধনী বুর্জোয়া তোষণ নীতি ও বন্ধ্যা বৈদেশিক
নীতিকে প্রজাতন্ত্রীরা সহ্য করতে প্রস্তুত ছিল না। প্যারিসের জনতার মধ্যে প্রজাতন্ত্রী মনোভাব
দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে লুই ফিলিপের সিংহাসনের সামাজিক ভিত্তিভূমি টলে যায়। লুই
ব্ল্যাঙ্ক পুঁজিবাদের এবং একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান দাবি করেন এবং জীবিকার
সংস্থান ও বেকারদের কাজের ব্যবস্থা করার দাবিও তুলেন। তাঁর এই ভাবধারা চিন্তাশীল লোকদের নাড়া দেয়। নিম্ন মধ্যবিত্ত সমর্থিত প্রজাতন্ত্রী দল “মানব অধিকার রক্ষার সমিতি” নামে সমিতি স্থাপন করে
ভোটাধিকার বাড়াবার জন্য তীব্র প্রচার চালায়, সমাজতন্ত্রীরা ও এতে সামিল হয়। ফলে ভোটাধিকারের
দাবি প্রবল হয়ে ওঠে। ১৮৪৮
খ্রিস্টাব্দের ২২ শে ফেব্রুয়ারি প্যারিসের ময়দানে ভোটাধিকার সম্প্রসারণের দাবিতে
এক কেন্দ্রীয় জমায়েত আহ্বান করা হয়। লুই ফিলিপের মুখ্যমন্ত্রী গুইজো এই সভা নিষিদ্ধ করেন। এই নিষেধের ফলে ক্ষিপ্ত জনতা গুইজো বাসভবন
আক্রমণ করলে রক্ষী দল গুলি চালায় এবং কিছু লোক নিহত হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে প্যারিসের বাম উদারতন্ত্রী
দল, প্রজাতন্ত্রী দল
এবং সমাজতন্ত্রী দল বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ফলে লুই ফিলিপ ২৪ শে ফেব্রুয়ারি তার পৌত্রের অনুকূলে সিংহাসন থেকে পদত্যাগ
করেন। লুই ফিলিপের পতনের ফলে ধনী বুর্জোয়া শ্রেণীর আধিপত্য ধ্বংস
হয়। সর্বসাধারণের ভোটাধিকারের
ভিত্তিতে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়।
ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন