তাইপিং
ও বক্সার বিদ্রোহের তুলনামূলক আলোচনা কর। তাইপিং বিদ্রোহ থেকে বক্সার আন্দোলন কতখানি পৃথক ছিল?
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চীনের ইতিহাসে দুটি বড় বিদ্রোহ ঘটেছিল তাইপিং
(১৮৫০ – ৬৪) এবং বক্সার বিদ্রোহ (১৮৯৯
- ১৯০২)। এই
দুই বিদ্রোহ একই ঐতিহাসিক যুগে অর্থাৎ উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঘটেছিল। উভয় বিদ্রোহের
ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশের নির্ধারক ভূমিকা ছিল। উভয় বিদ্রোহের মধ্যে কিছু মিল থাকলেও
অমিলের দিক ছিল অনেক বেশি। এই বৈষম্যের দিক প্রতিফলিত হয়েছিল বিদ্রোহের মধ্যে। উভয় বিদ্রোহের
পরিপেক্ষিতের মধ্যেই নেতৃত্ব, অনুগামীদের মতাদর্শগত ও চরিত্রগত ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত
হয়েছিল।
আফিম
যুদ্ধের পর পশ্চিমী দেশগুলি চীনের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তার কাছ থেকে অতি রাষ্ট্রিক অধিকার, সর্বাধিক
অনুগৃহীত দেশের মর্যাদা ও শুল্ক ছাড় আদায় করে নিয়েছিল। চীনের অভ্যন্তরে বিদেশীদের উপনিবেশের প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি চীন
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারিয়ে এক আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা উপনিবেশিক দেশে পরিণত হয়। চীনের বিদেশী মাঞ্চু রাজবংশ দেশকে বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারেনি। দেশের শাসকগোষ্ঠী সামন্ততান্ত্রিক শোষণ থেকে কৃষক ও
দরিদ্র মানুষদের রক্ষা করতে পারেনি। এই
পটভূমিকায় উনিশ শতকের মধ্যভাগে চীনে তাইপিং বিদ্রোহ হয়। চীনের পূর্ব ও দক্ষিণ উপকূলে অনেকগুলি গুপ্ত সমিতিকে নিয়ে হুং শিউ চুয়ান
তাঁর তাইপিং 'তিয়েন কুয়ো' বা 'মহাশক্তিময়' ঈশ্বরের রাজত্ব স্থাপন করেন। প্রাচীন চীনের ঐতিহ্যে কৃষকের
কল্পরাজ্যের ধারণা ছিল, সেই প্রাচীন
ঐতিহ্যকে হুং বাস্তবে রূপায়িত করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। তাঁর সমর্থকদের
বেশিরভাগ ছিল কৃষক, নিম্নবর্ণের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষেরাও তাঁর আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। তিনি বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, বিধবা, অনাথ শিশুদের
আশ্রয় ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন। সৈন্যবাহিনী
ও সরকারি চাকুরীতে তিনি মহিলাদের প্রবেশের অধিকার দিয়েছিলেন। তাইপিং বিদ্রোহ শুধু কৃষকদের অভিযোগ নিয়ে গড়ে
ওঠেনি, এর মধ্যে সনাতন সমাজ ব্যবস্থার বিরোধিতা
ছিল কনফুসিও সমাজকে আক্রমণ করা।
বক্সার
বিদ্রোহ ছিল একটি স্বল্পকায় স্থায়ী ঘটনা। পশ্চিমী ঐতিহাসিকরা একে 'গ্রীষ্মকালের
পাগলামি' বলে উল্লেখ করেছেন। তাইপিং বিদ্রোহের প্রতি বিদেশীরা
গোড়ার দিকে সহানুভূতি সম্পন্ন হলেও শেষ দিকে এই বিদ্রোহ দমনে সরকারের সঙ্গে
সহযোগিতা করেছিল। বক্সার বিদ্রোহ
ছিল প্রধানত বিদেশী খ্রিস্টান মিশনারী বিরোধী। মাঞ্চু শাসকগোষ্ঠী খ্রিস্টান মিশনারীদের বিরাগভাজন হতে চাইছিল না, কারণ
পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই গোড়ার দিকে বক্সার আন্দোলন মাঞ্চু বিরোধী হলেও আন্দোলনের একটি পর্যায়ে
রাজদরবারের গোপন সমর্থন পেয়ে তারা মাঞ্চু বিরোধীতা ত্যাগ করে বিদেশী বিরোধিতাকে প্রধান লক্ষ্য করেছিল। আই হো চুয়ান নামক মুষ্ঠি যোদ্ধাদের
ন্যায়পরায়ণ সমিতি এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের এই দুই বিদ্রোহের মধ্যে সাদৃশ্যের
চেয়ে বৈসাদৃশ্যই বেশি
পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। উভয় আন্দোলন গোড়ার দিকে গুপ্ত সমিতির সমর্থনের উপর নির্ভর করে মাঞ্চু রাজবংশের উচ্ছেদ
সাধনে সচেষ্ট হয়েছিল। উভয়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিল। প্রধানত কৃষক আর
নিম্নবর্গের দরিদ্র মানুষ শোষিত নিপীড়িত দরিদ্ররা এই দুই আন্দোলনের শক্তি যুগিয়ে
ছিল।
তাইপিংরা বিদেশী
বিরোধিতায় সামিল না হয়ে বরং বিদেশীদের সহযোগিতা
লাভে চেষ্টা করেছিল। অন্যদিকে বক্সাররা বিদেশী মিশনারীদের তাড়িয়ে চীনকে সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত করতে চেয়েছিল।
তাইপিং বিদ্রোহ চোদ্দ বছর চীনের বেশিরভাগ অঞ্চল জুড়ে চলেছিল। অন্যদিকে বক্সার বিদ্রোহ
ছিল প্রধানত শহরকেন্দ্রিক এবং মিশনারি অধ্যুষিত অঞ্চলে দু’বছর ধরে চলেছিল। বক্সার আন্দোলন ছিল রক্ষণশীল, প্রগতিবিরোধী, এবং
এরা তন্ত্র মন্ত্রে বিশ্বাস করত, অতীন্দ্রিয় শক্তির প্রয়োগ করে এরা বিদেশিদের পরাস্ত করার
পরিকল্পনা করেছিল। অপরদিকে তাইপিং বিদ্রোহীরা ছিল প্রগতিশীল, প্রথাগত সমাজ ব্যবস্থার বিরোধী, অত্যাধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গ্রহণের
মানসিকতা তাদের মধ্যে ছিল।
উভয় বিদ্রোহ চীনদেশে সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটলেও
তাইপিং বিদ্রোহীরা প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। বক্সার বিদ্রোহীদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারিত করেছিল মিশনারীরাই। উভয় বিদ্রোহীদের এই নতুন ধরনের মনোভাবের কারণ সম্ভবত ছিল যে, বহু মিশনারীদের ধর্মের আড়ালে বিদেশী
সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশকেই সহায়তা করা। তা পরবর্তী বক্সার আন্দোলনের সময় যতটা স্পষ্ট হয়েছিল
পূর্ববর্তী তাইপিং আন্দোলনে ততটা ছিল না।। তাইপিং আন্দোলনের নেতা হাং শূই
চূয়ান (Hung Shiu Chuan) প্রধানত
খ্রিস্টধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই মাঞ্চু বিরোধী সংগ্রাম সংঘটিত করেছিলেন। এর সাথে তিনি ন্যায়
সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নতুন সমাজ গঠনের কথা বলেছিলেন।
তাইপিং
বিদ্রোহ এক ধরনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দেখতে পাওয়া যায়। হাং শু চুয়ান (Hung Hsiu Chuan) ছিলেন সর্বোচ্চ নেতা, শি - তা - কাই (Shi ta Kai) এবং অন্যরা ছিলেন বিভিন্ন স্তরের নেতৃবর্গ কিন্তু বক্সার বিদ্রোহে
কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না, ছিল আঞ্চলিক
নেতৃত্ব। এই বিদ্রোহে
বক্সারদের প্রধান সংগঠন আই - হো – চুয়ান (I-Ho-Chuan) প্রধান
ভূমিকা নিয়েছিলেন। যেমন
Chesneaux বলেছেন, বক্সার বিদ্রোহ
ছিল গুপ্ত সমিতির নেতৃত্বাধীন একটি কৃষক বিদ্রোহ, কিন্তু
বক্সার বিদ্রোহে তৎকালীন আর্থ-সামাজিক সংকটের ফলে দরিদ্র চীনারা গুপ্ত সমিতির
চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করলেও বিদ্রোহের সূচনার পরেই নেতৃত্বের পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যায়।
চীনের
ভূস্বামী সম্প্রদায় এবং স্থানীয় কর্মচারীরা বক্সারদের বিদেশী বিরোধিতার দ্বারা বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কেননা এসব রক্ষণশীল চীনারা
এটা ভেবে আতঙ্কিত হয়েছিল যে, পাশ্চাত্যে
প্রগতিশীল ভাবধারার অনুপ্রবেশের ফলে গ্রামাঞ্চলে এদের প্রতিপত্তি ক্ষুন্ন হতে পারে, ঠিক একই ভাবে মাঞ্চু
রাজদরবারেও রাজমাতা তুজু শি (Tzu-hsi) ও তাঁর অনুগামীরা বক্সার বিদ্রোহের সমর্থক ছিলেন। এ অবস্থায় বিদ্রোহীরা মাঞ্চু বিরোধিতাকে ত্যাগ করে
বিদেশী বিরোধিতাকে প্রধান লক্ষ্য করে তুলেছিল।
তাইপিং ও বক্সার বিদ্রোহের সংগঠন ও
কর্মসূচীর মধ্যেও বেশ কতগুলি পার্থক্য ছিল। তাইপিং বিদ্রোহীরা একটি বিকল্প রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার কল্পনা
করেছিল এবং এই উদ্দেশ্যে
কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। তবে
কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য তারা দক্ষ সংগঠন গড়ে তুলেছিল। কিন্তু বক্সার বিদ্রোহীদের
দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পুরোপুরি নেতিবাচক।
বিদেশিদের হত্যা ও বিতরণ ছাড়া
তাদের অন্য কোন কর্মসূচী ছিল না। চীনের পুরনো সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল ত্রুটি
দূর করবার জন্য তারা কোন চিন্তা ভাবনা করেনি এবং কোন প্রকার পরিকল্পনাও তাদের ছিল
না। বিদ্রোহের পরিচালনা করবার জন্য বক্সার
বিদ্রোহীরা তাইপিংদের মত কোন সংগঠন গড়ে তুলতে পারেনি। এক কথায় বলা যায় যে,
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জনের জন্য যে ধরনের ঐক্যবদ্ধ সংগঠন ও
দক্ষ নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল তা বক্সার বিদ্রোহীরা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। তাইপিং বিদ্রোহের তুলনায় বক্সার
বিদ্রোহ ছিল স্বল্পস্থায়, তাই তাদের পক্ষে কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ
রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচী গড়ে তোলা বা
কার্যকরী করা সম্ভব হয়নি।
এটা ঠিক
যে, উভয় বিদ্রোহই একটি বিশেষ আর্থ-সামাজিক সংকট থেকে উদ্ভূত হয়েছিল এবং সাম্রাজ্যবাদী
শোষণের বিরুদ্ধে হাতিয়ার ছিল শিল্প পুঁজি। কিন্তু বিংশ শতকের জন্মলগ্নে সংঘটিত বক্সার বিদ্রোহের সময় সাম্রাজ্যবাদী
আগ্রাসনের চরিত্র ছিল লগ্নিপুঁজির এবং
শোষণের মাত্রা ছিল পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি তীব্র।
তাই
দুটি বিদ্রোহের চরিত্রের দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে তাইপিং বিদ্রোহ ছিল মূলত মাঞ্চু বিরোধী সামন্ত বিরোধী
চরিত্রের। অন্যদিকে G. Duntheimer
-এর ভাষায় বলা যায় এক ঐতিহাসিক যুগের সন্ধিক্ষনে সংঘটিত (অর্থাৎ
মধ্যযুগীয় বা প্রাক শিল্প সমাজ ও আধুনিক যুগ) বক্সার
বিদ্রোহ ছিল মূলত মিশনারী বিরোধী
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চরিত্রের। আবার
বক্সার বিদ্রোহের মধ্যেও বিরোধী উপাদান লক্ষ্য করা যায়, কেননা
বিদ্রোহীদের একাংশ প্রধানত মাঞ্চু বিরোধী ছিল। একই সঙ্গে তাইপিংরা ও আফিম
বাণিজ্য নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে বিদেশী আগ্রাসনের
বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিশেষে বলতে পারি যে, সামন্ত বিরোধীতা এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা এই দুটি দিকের অস্তিত্ব
দুটি বিদ্রোহের মধ্যেই ছিল। তাই দুটি বিদ্রোহই শুধুমাত্র কৃষক বিদ্রোহ ছিল না। চীনা সমাজের
নিম্নবর্গের মানুষের একটি স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ উভয় বিদ্রোহের মধ্যেই লক্ষ্য করা
গিয়েছিল। দুটি বিদ্রোহের মধ্যে প্রভেদ এই যে তাইপিং বিদ্রোহের ক্ষেত্রে মাঞ্চু
বিরোধী, সামন্ততন্ত্র
বিরোধী দিক প্রধান হলেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ছিল অপ্রধান। অন্যদিকে বক্সার
বিদ্রোহের ক্ষেত্রে মিশনারী বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিক প্রধান আর অপ্রধান ছিল মাঞ্চু
বিরোধিতা। দুটি বিদ্রোহকে শেষ পর্যন্ত দমন করা হয়েছিল। কিন্তু তাইপিং বিদ্রোহ স্থায়ী
প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় শাসক গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্কারমূলক প্রবর্তনের মধ্যদিয়ে চীনা জনগণের দুর্দশা
লাঘব এর চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে বক্সার বিদ্রোহের ক্ষেত্রে এধরনের কোন দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব
লক্ষ্য করা যায় না। তবে চীনারা বক্সার বিদ্রোহ থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নয়, দেশের আসল শত্রু হলো মাঞ্চু রাজবংশ। আর তাই এ সময় থেকে চিং রাজবংশের উৎখাত পরিকল্পনা
বাস্তব রূপ দিতে থাকে এবং সান ইয়াৎ সেনের নেতৃত্বে এক দশকের মধ্যেই একটি প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের
মধ্য দিয়ে মাঞ্চু রাজবংশের অবসান ঘটে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন