সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জাপানে সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়ের কারণ

 

জাপানকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রথম প্রয়োজনীয় বিষয় ছিল মধ্যযুগীয় সামন্ত প্রথার অবসান কারণ সামন্ত প্রভুরা যতদিন রাজশক্তি ও সাধারণ নাগরিকদের মাঝে অবস্থান করবে ততদিন সমগ্র দেশ জুড়ে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না টোকুগাওয়া শোগুনদের পরাজিত করে তাদের ভুসম্পত্তি সরাসরি অধিগ্রহণ করে কেন্দ্রীয় সরকার সামন্ত প্রথা উচ্ছেদের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রত্যেক সামন্ত ক্ষেত্রে বা জমিদারীতে একজন করে রাজকর্মচারী নিয়োগ করা হয় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে সামন্ততন্ত্রের বিলোপ সাধনের উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নতুন সরকারকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে কিডো সাইগো এবং অন্যান্য পশ্চিমী গোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দ তাদের সামন্ত প্রভুদের ও জনগণের ভূমি সংক্রান্ত দলিল সম্রাটের কাছে অর্পণ করতে বাধ্য করেন এইভাবে সামন্ত প্রভুদের জমিদারীতে সম্রাটের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়

সামন্ত প্রথার অবসানের ফলে ডাইম্যো শ্রেণীর তুলনায় সামুরাই শ্রেণী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ডাইম্যো শ্রেণীর এই পরিবর্তনকে মেনে নিয়েছিল কারণ জমিদারী অর্পনের বদলে তারা তাদের জমিদারী আয়ের এক দশমাংশ মাসিক ভাতা হিসেবে পাবে বলে স্থির হয় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ডাইম্যোদের মাসিক প্রাপ্য ভাতা এককালীন মিটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয় এবং ঋণ পরিশোধের দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় সামুরাই শ্রেণীর ভরণপোষণের দায়িত্ব থেকে ডাইম্যোদের মুক্তি দেওয়া হয় পশ্চিমী গোষ্ঠীর সামন্ত নেতাদের স্বেচ্ছায় জমিদারী অর্পনের মধ্যে স্বাদেশিকতার প্রমাণ পাওয়া গেলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের নেতৃত্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার সুযোগ ও তাঁদের ছিল বৈদেশিক প্রভাবের সম্মুখে জাপানের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখার প্রশ্নই তাঁদের সামন্ত প্রথা বিলোপকে প্রণোদিত করে ডাইম্যোদের নামে ধার্য রাজস্ব তাঁদের প্রকৃত আয়ের চেয়ে বেশি থাকায় ডাইম্যোদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হয়নি।

সামুরাই শ্রেণী সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলোপে ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিল শোগুনতন্ত্রের শেষদিকে সামুরাই শ্রেণীর ভাতা হ্রাস পেতে আরম্ভ করে মেইজি সরকার সামুরাইদের বংশানুক্রমিক ভাতা দানের পদ্ধতি একেবারেই বন্ধ করেদে তাছাড়া সামুরাইদের দেওয়া ক্ষতিপূরণের পরিমাণও যথেষ্ট পরিমাণে ছিল না তাকাহাসি দেখিয়েছেন যে সামুরাই শ্রেণী দীর্ঘদিন ধরে যে সমস্ত অধিকারগুলি ভোগ করে আসছিল নতুন সরকার ১৮৭০-৭৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গৃহীত কতগুলি পদক্ষেপের মাধ্যমে এই অধিকারগুলি কেড়ে নিয়েছিল। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারীতে মেইজি সরকার সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বাধ্যতামূলক ও সকল শ্রেণীর জন্য উন্মুক্ত করার ফলে সামুরাই শ্রেণী তাদের যুদ্ধ করার একচেটিয়া অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় সর্বজনীন সামরিক পরিষেবা সামন্ততন্ত্রের মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছিল

মেইজী সরকারের নীতি নির্ধারণ নিয়ে আমলা গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হয় একদল যুদ্ধবাদী গোষ্ঠী মনে করেন ক্ষুব্ধ সামুরাই শ্রেণীকে সন্তুষ্ট করার জন্য সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন তাঁরা সামুরাইদের কোরিয়াতে যুদ্ধে পাঠাবার পক্ষে ছিলেন, কারণ কোরিয়া চীনের মদপুষ্ট হয়ে জাপানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে অস্বীকৃত হয় তাই কোরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পাঠানোর উদ্যোগ নেয় সাতসুমা নেতা সাইগো তাকামোরি এবং তোসা নেতা ইতাগাকি তাইসুকে এই সময় শান্তিবাদী নেতা ইয়াকুরা, কিডো ও ওকুবো বিদেশে থাকায় যুদ্ধবাদীরা সম্রাটের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং তারা ফিরে এলে দুই গোষ্ঠী বিরোধে শান্তিবাদীদের জয় হয় ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে কোরিয়া অভিযানের পরিকল্পনা বাতিল করা হয় কোরি সরকার জাপানের সঙ্গে মৈত্রী ও বাণিজ্যের চুক্তি স্বাক্ষর করতে সম্মত হলে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয় ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সাতসুমা সামরিক গোষ্ঠীর নেতা সাইগো ইয়ামাগাতা আরিটোমো এই সামুরাই বিদ্রোহ দমন করেন, সাময়িক বাহিনীর এই জয় সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত পতন সুনিশ্চিত করে

উনবিংশ শতকের অন্তিমলগ্ন থেকে জাপানে বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে যে উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটতে আরম্ভ করেছিল, তার ভ্রূনাবস্থা সম্ভবত দেখা গিয়েছিল সাতসুমা বিদ্রোহের মধ্যে সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি সাধনের জন্য কৃষি ও ভূমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের প্রয়োজন দেখা দেয়

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

       ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাই মুঘলদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বলে মনে করেন শিরিন মুসবি । শিল্প বাণিজ্য থেকে আয়ের পরিমাণ সামান্য । ভূমি রাজস্ব হল ‘ মাল ’ বা ‘ খারাজ ’ । মুঘলরাষ্ট্র সামন্তরাজাদের কাছ থেকে কর পেত । তাছাড়া রাষ্ট্র পেত যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ ( খামস ); স্থানীয় আবওয়াব জিহত , শয়ের - ই - জিহত , ফুরুয়াত , অমুসলমানদের উপর স্থাপিত কর জিজিয়া এবং মুসলমানদের দেয় কর জাকাত ।         আকবরের আমলে সরকারের মোট রাজস্ব পরিমাণ ছিল ১২ , ৮২ , ৮৩ , ৮২৫ টাকা , সুজন রায়ের মতে , ঔরঙ্গজেবের আমলে ৩২ , ৬৮ , ১৬ , ৫৮৪ টাকা , এই রাজস্বের ৬ % ভাগ বাণিজ্য শুল্ক থেকে এবং ৪ % ঔরঙ্গজেব জিজিয়া থেকে পেতেন । বাকি সব রাজস্ব কৃষি খাতে আদায় হত ।       বাবর ভারতবর্ষ জয় করে অধিকৃত অঞ্চলের সমস্ত জমি ইক্তা হিসেবে অভিজাতদের মধ্যে বন্টন করে দেন । দেশের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য ও সংগৃহীত হত । হুমায়ুন এ ব্যাপারে কোন পরিবর্তন ঘটাননি । মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা গঠন করেন আকবর । আকবরের আগ...