সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তুং চি পুন:স্থাপন কি যথার্থ পুন:স্থাপন

 

 অরুণ কুমার গিরি

তুং চি পুন:স্থাপন কথাটি এসেছে চীনা সম্রাট তুংচি এর নাম থেকে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে চীন যখন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে পিকিং কনভেনশন স্বাক্ষর করে তখন মাঞ্চু রাজতন্ত্রের ভগ্নদশা ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী বছরগুলিতে বিলুপ্ত প্রায় রাজশক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটা আন্তরিক প্রয়াস চালানো হয়েছিলসমসাময়িক চীনা পন্ডিতেরা এই প্রক্রিয়াকে তুং চি পুন:প্রতিষ্ঠা নামে আখ্যায়িত করেছেনসপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডের বিপ্লবের পর সেদেশের স্টুয়ার্ট রাজা দ্বিতীয় চার্লসের প্রত্যাবর্তন ঘটে, ফ্রান্সে নেপোলিয়নের পতনের পর বুরবোঁ রাজা অষ্টাদশ লুই ক্ষমতা ফিরে পান কিন্তু চীনের ইতিহাসে প্রত্যাবর্তনের ঘটনা ছিল আলাদা, ইমানুয়েল সু জাপানের মেইজি পুন:প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তুং চির তুলনার বিরোধিতা করে বলেছেন যে, তুং চি শাসনের লক্ষ্য ছিল কৃষক বিদ্রোহ বিধ্বস্ত চীনের শাসক শ্রেণী ও গ্রামাঞ্চলকে নতুন করে পুন:গঠন করা এবং রাজতন্ত্রের দ্রুত অবক্ষয়ের প্রক্রিয়াকে সাময়িকভাবে স্তব্ধ করা

তুং চি পুন:প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চীনের রাজশক্তির পুন:প্রতিষ্ঠার প্রয়াস সম্রাট তুং চির রাজত্বকালে চালানো হলেও এ ব্যাপারে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না কারণ তিনি যখন সম্রাট পদে অধিষ্ঠিত হন তখন তার বয়স ছিল অত্যন্ত কম তার ফলে বিধবা মাতা জু-সি তাঁর অভিভাবক হিসাবে রাজকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এর সাথে একদল অত্যন্ত যোগ্য রাজপুরুষ ও আমলা সহযোগিতা দান করেছিলেন শাসন কার্য পরিচালনায় কেন্দ্রীয় স্তরে এইসব দক্ষ রাজপুরুষদের কৃতিত্বের ফলে চীনের পতনোন্মুখ রাজতান্ত্রিক কর্তৃত্বকে সাময়িকভাবে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। জাঁ শ্যেনোর মতে পুন:প্রতিষ্ঠার প্রকৃত কারিগর ছিলেন রাজধানীর এবং বিভিন্ন প্রদেশের কিছু উচ্চপদস্থ কর্মচারী রাজধানী পিকিং এর রাজ শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠার মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন কু, ওয়েন সিয়াং, শেন কুই ফেন, লি তাং সি প্রমূখ

নব কনফুসীয় মতবাদের প্রবক্তারা হলেন তুং চি পুনরুদ্ধার আন্দোলনের নেতা কনফুসীয়াসের লি দর্শনের ভিত্তিতে তাঁরা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন নৈতিকতা, সৎ আচরণ ও আদর্শ হবে রাষ্ট্র গঠনের মূল নীতি বিধ্বস্ত প্রায় আবাদী অঞ্চল সমূহ পুনরায় আবাদের যোগ্য অঞ্চলে পরিণত করে কৃষির উন্নতি সাধন ঘটায় সরকারি দায়িত্ব পালনের জন্য সম্পন্ন ব্যক্তিগণ নিযুক্ত হন ব্যক্তিগত জীবনে সংযম অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করা হয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পাঠাগারগুলির দরজা পুনরায় উন্মুক্ত হয় প্রশাসনিক কঠোরতর নিয়মানুবর্তিতা প্রবর্তিত হয় এবং বৈদেশিক শক্তিবর্গের সঙ্গে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়

তুং চি পুনঃস্থাপনের যুগে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বিদ্রোহ দমন করে রাজ শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তাইপিং বিদ্রোহ দমন করা হলেও উত্তরাঞ্চলে চলেছিল নিয়েন বিদ্রোহ। সেং কুয়ো ফ্যাং ও পরে লি হুং চাং ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নিয়েন বিদ্রোহ দমন করে শান্তি স্থাপন করেন চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমে ও উত্তর-পশ্চিমে মুসলিম বিদ্রোহ ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন তু ওয়েন শিউ, তালি ছিল তার বিদ্রোহের ঘাঁটি চীনের উত্তর পশ্চিম মুসলিম মুসলিম বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন মা জুয়া লুং ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ উত্তর-পশ্চিমে সর্বত্র শান্তি স্থাপিত হয় অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য তুং চি সরকার প্রধান তিনটি পন্থা অবলম্বন করেন যথা- প্রথমত, প্রাচীন ঐতিহ্যগত ভিত্তির উপর চীনা সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং কনফুসীয় বেসামরিক শাসনের পুনরায় প্রচলন দ্বিতীয়ত, বজ্রমুষ্টিতে কেন্দ্রীয় শাসনভার গ্রহণ এবং তৃতীয়ত, বিদ্রোহ দমনের সকল প্রকার সার্থক ব্যবস্থা অবলম্বন

বিভিন্ন গণঅভ্যুত্থান এবং যুদ্ধ, চীনের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এক গভীর সংকট নিয়ে এসেছিল বিদ্রোহ কবলিত অঞ্চলগুলি থেকে গ্রামীণ জনসাধারণ এলাকা ত্যাগ করে চলে যেতে শুরু করেছিল ফলে চীনের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে কৃষির ব্যাপক অবনতি ঘটে চীন সরকারের তরফ থেকে কৃষির উন্নতি কল্পে বিভিন্ন এলাকায় সেচ প্রকল্প গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এইভাবে চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের সক্রিয় উদ্যোগে নতুন নতুন এলাকায় পলাতক কৃষকদের পুনর্বাসন আরম্ভ হয় জনবসতি বৃদ্ধি নতুন এলাকা গুলিতে কৃষির সম্প্রসারণের সহায়ক হয়েছিল।। চেং কুয়ে ফ্যান বেশ কিছু কর্মচ্যুত সৈনিককে হুনানে বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করেছিলেন এবং তাদের প্রত্যেককে একখণ্ড করে জমি দেওয়া হয়েছিল সরকারি কর্মচারীরা পরিত্যক্ত জমি বাজেয়াপ্ত করে এবং অত্যন্ত সস্তা দরে নতুন বসতি স্থাপনকারীদের কাছে বিক্রি করে কৃষি সরঞ্জাম ও বীজ কেনার জন্য কৃষকদের সরকারি ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় বেশ কিছু জেলায় খাজনার হার কমিয়ে উৎপাদিত পণ্যের দশ ভাগের তিন ভাগ করা হয় তুং চি পুনঃ প্রতিষ্ঠাকালে এই নতুন ভারসাম্য সমগ্র চীনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছিল

তুং চি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল কনফুসীয় ভাবাদর্শনফুসীয় ভাবাদর্শের মূল কথা ছিল অধিকাংশ জমিতেই কৃষক মালিকানা প্রতিষ্ঠা হবে কিন্তু তুং চি সরকারের কৃষি নীতিতে এই নীতি সর্বক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়নি এ ব্যাপারে জেলার জেলায় এমনকি গ্রামে গ্রামে তারতম্য পরিলক্ষিত হয়েছিল কিয়াংসু অঞ্চলে তাইপিং বিদ্রোহের দাপটে বৃহৎ ভূস্বামীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল, ফলে সেখানে কৃষক মালিকানা গড়ে ওঠে বিদ্রোহজনিত অভ্যন্তরীণ সংকটের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে জমির মূল্য হ্রাস পেয়েছিল ফলে গ্রামাঞ্চলে কৃষি ক্ষেত্রগুলি ধনী ব্যক্তিরা প্রচুর পরিমাণে কিনে নিতে শুরু করে তুং চি পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময় জমির মালিকানার ক্ষেত্রে যে নতুন ধারার সূচনা হয়েছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই

তুং চি সরকার পুননির্মাণ সংক্রান্ত কার্যালয় গড়ে তোলেন তাইপিং বিদ্রোহীদের কবর থেকে কেড়ে নেওয়া এলাকায়এই কার্যালয়গুলির প্রাথমিক কাজ ছিল শহরের ধ্বংসপ্রাপ্ত পাঁচিল ও মন্দিরগুলিকে পুনর্নির্মাণ করা স্থানীয় জেন্ট্রিদের সহায়তায় শস্য ভান্ডারগুলি পুনঃগঠন করার কাজ শুরু হয় তুং চি পুনরুদ্ধারে প্রাথমিক পর্বে ইয়েলো নদীর বাঁধগুলিকে পুননির্মিত করা হয়ে ছিল এছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলি রূপায়ণের জন্য একটি আন্ত:প্রাদেশিক দপ্তর খোলা হয় কিন্তু বন্যা চিরতরে রোধ করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কোন পরিকল্পনা কার্যকর করা হয়নি।

 ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় একাধিক গণ বিদ্রোহ চীনের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল তুং চি পুনঃপ্রতিষ্ঠার রূপকাররা দেশের কর ব্যবস্থার পুন:গঠনের কথা ভেবেছিলেন। জনগণের মধ্যে ভূমিকরের হার নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ ছিল সংস্কারকরা মনে করেন ভূমিকর হ্রাস করা হলে কৃষি সম্প্রসারণ ঘটবে এবং দেশের সমৃদ্ধি আসবে এজন্য কোন কোন অঞ্চলে ভূমিকর ৫০ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছিল ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্রকাশিত একটি রাজকীয় নির্দেশের মাধ্যমে জনসাধারণের দেয় করের মৌলিক হার দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস করা হয়েছিল কিন্তু তুং চি পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুগে কর সংস্কার ছিল ক্রুটিপূর্ণ হ্রাসপ্রাপ্ত করে তালিকা নথিভুক্ত করা হয়নি, তাই ম্যাজিস্ট্রেট এবং স্থানীয় জেন্ট্রিরা এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে পুরাতন বর্ধিত হারেই কর আদায় করতেন ফেং কুই ফেং এর নির্দেশ সত্ত্বেও ভূমিকরের হার হ্রাস করার সঙ্গে কিন্তু উৎপাদনের উপর খাজনার হার কমানো হয়নি উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলির প্রতি ছিলেন চরম উদাসীন বৃহৎ জমিদার কর্তৃক সাধারণ চাষীদের শোষণ ও উৎপীড়ন অব্যাহত ছিল

তুং চি সংস্কারকরা জনগণের জীবিকা সংক্রান্ত সমস্যার কথা বললেও তার সমাধানের জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি তারা কৃষিভিত্তিক সমাজের পক্ষপাতী ছিলেন এজন্য শিল্প-বাণিজ্যের সম্প্রসারণের বিষয়ে বড়ো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি উপরন্তু বণিকদের ওপর ধার্যকরের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছিললিজিন নামক বাণিজ্য শুল্কের অস্তিত্ব থেকে গিয়েছিল লিজিন বাব রাষ্ট্র যে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করত, তার একটা বড় অংশ যেত প্রদেশগুলিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুগে লিজিন এর প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নতি করা হয়েছিল লিজিন আদায়ের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হলে, সংশ্লিষ্ট আদায়কারীর বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নিয়ম চালু করা হয়। পুনঃপ্রতিষ্ঠার রূপকারদের শিল্পোন্নতির প্রতি চরম ও উদাসীনতার ফলে বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ বিঘ্নিত হয়েছিল উদ্যোগী বণিক শ্রেণীর অভাবই উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চীনে শিল্পের উন্নতি ও পুঁজিবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল

 পুনঃপ্রতিষ্ঠার সাথে যুক্ত রাজপুরুষেরা জনগণের জীবিকা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে উৎসাহী ছিলেন কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতি রাষ্ট্রের অনীহা এই সমস্যার সমাধান করতে পারেনি কেবলমাত্র কর দপ্তরে কিছু সৎকর্মচারী নিয়োগ করা হয় এবং কর আদায় সংক্রান্ত বিষয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন দিতে বলা হয় কর আদায়ের পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল বটে কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না তুং চি পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঠিক প্রাক্কালে তামার মূল্য হ্রাস পাওয়া এবং লৌহ মুদ্রা ও অপরিবর্তনীয় কাগজী নোটের প্রচলনের ফলে চীনের অর্থ ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছিল এই সমস্যা সমাধানের জন্য মুদ্রা ব্যবস্থার আমুল সংস্কারের প্রয়োজন ছিল কিন্তু সেই সংস্কার পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুগে সাধিত হয়নি জাঁ শ্যেনো বলেছেন তুং চি-র অর্থনৈতিক নীতি ছিল মূলত রক্ষণশীল এই অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল চীনের সনাতনী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কৃষিভিত্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা

বিদেশী শক্তি বর্গের সঙ্গে যাতে চীনের কোন প্রকার সংঘর্ষ না বাঁধে তা সুনিশ্চিত করার জন্য তুং চি সরকার তাদের সম্পর্কে একটি উদার প্রকৃতির বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেন তুং চি সরকার পাশ্চাত্য শক্তিবর্গকে চীনের পক্ষে মূলত ক্ষতিকারক বিবেচনা না করে তাদের সম্পর্কে সহিষ্ণু মনোভাব পোষনের নীতি গ্রহণ করেন প্রিন্স কুং স্বদেশবাসীকে এই উপদেশ দেন যে বিদেশীকে উপেক্ষা না করে বিদেশী কৃত দেশের পক্ষে ক্ষতিকর বা অনিষ্টকর কার্যকেই উপেক্ষনীয় বলে গণ্য করা উচিত তুং চি সরকার বল প্রয়োগে বিদেশীদের স্বার্থসিদ্ধির প্রয়াস সহ্য করা হবে না এরূপ নীতি গ্রহণ করেন চীনের নীতি হবে - আজ্ঞাবহের সঙ্গে সদর আচরণ, আর বিদ্রোহীদের প্রতি শাস্তির বিধান বিদেশীকে স্বনিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে বিদেশ নীতি ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে

বৈদেশিক আক্রমণ এবং তাইপিং বিদ্রোহ বিভিন্ন গণঅভ্যুত্থান মাঞ্চু সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের দুর্বলতার স্বরূপ উদঘাটিত করেছিল এই পটভূমিকায় চীনের রক্ষণশীল রাষ্ট্র নেতারা রাষ্ট্র ও সমাজকে রক্ষার জন্য সীমিত সংস্কারের পরিকল্পনা নিয়েছিল তাদের লক্ষ্য ছিল রাজস্ব শক্তির পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে জনমানসে তার ভাবমূর্তিকে পুন:প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করাজাঁ শ্যেনো বলেছেন যে পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যম ছিল জেন্ট্রি শ্রেণী সংস্কারের ফলে এই শ্রেণী লাভবান হয়েছিল তাই প্রত্যাবর্তন রাজনৈতিক ও আর্থ্ সামাজিক ক্ষেত্রে জেন্ট্রি শ্রেণীকে শক্তিশালী করেছিল

সংস্কারকরা কনফুসীয় নৈতিকতা ও আদর্শের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেন সমাজের বাস্তব পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে তারা সংস্কারের কথা ভাবেননি চীনের প্রয়োজন ছিল আধুনিক শিক্ষা, কিন্তু তুং চি যুগের পণ্ডিতরা পুরোনো ধরনের শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরেছিলনতুন শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি তারা দেশের প্রয়োজনে তারা জাহাজ নির্মাণ, অস্ত্র কারখানা, সামরিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা গড়ে তোলেন নি পশ্চিমী জ্ঞান বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতিকে আয়ত্ত না করে পশ্চিমী প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব হয়নি এই সত্য সংস্কারকরা উপলব্ধি করতে পারেননি রক্ষণশীলতার মধ্যে সংস্কারকরা রাজতন্ত্র ও কেন্দ্রীয় শাসনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, তবে রাজতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি আর্থ সামাজিক সমস্যার সমাধান ঘটাতে পারেনি, কৃষি ও কৃষকের উন্নতি সম্ভব হয়নি, জেন্ট্রি শ্রেণী মূলধন শিল্পে লগ্নী করেননি, বিক্ষিপ্তভাবে কিছু শিল্পায়ন হয়েছিল মাত্র নতুন শিল্প প্রকল্পগুলি বিদেশী প্রযুক্তিবিদ ও কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল ছিল, ফলে এগুলিও জাতির প্রয়োজন মেটাতে পারেনি তুংচি পুন:প্রতিষ্ঠা দেশকে মুক্তির পথ দেখাতে পারেননি, রাজতন্ত্র দেশ ও জাতি শক্তিশালী হয়নি

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস

    মার্টিন লুথার ছিলেন লুথা রিয়ান মতবাদের প্রবক্তা । জার্মানির স্যাক্সসনিতে ইসলিবেন নামে একটি গ্রামে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের জন্ম হয় । ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ইউটে ম বা র্গ চা র্চে র দরজায় তিনি তাঁ র ৯৫ তত্ত্ব ঝু লিয়ে দেন । এটি ছিল পোপের স্বর্গীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ । সমস্ত জার্মানির শিক্ষিত মানুষেরা লুথারের তত্ত্বে র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । এই ৯৫টি ছিল তাত্ত্বিক প্রশ্ন , এতে বাইবেল ও খ্রিস্টান দর্শন সম্বন্ধে তাত্ত্বিক গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রশ্ন ছিল । উইলিয়াম ওকামের চিন্তাভাবনা দ্বারা মার্টিন লুথার প্রভাবিত হয়েছিলেন । ইউরোপের এই চিন্তা ধারা পরিণত ছিল nominalism নামে । নমিনালিস্ট চিন্তাধারায় উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্বাস ও নিবেদিতপ্রাণতা । নমিনালিস্টরা মনে করত বিশ্বাসই মুক্তি আনবে , তবে এই বিশ্বাস অর্জনের জন্য শাস্ত্র পড়তে হবে এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের বোধগম্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করতে হবে । লুথার এইমতে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হওয়া উচিত এবং আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল রচনা করা একান্ত দরকার । তিনি খ্...