সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বারো ভূঁইয়া কারা তাদের বিদ্রোহের কারণ কি

 


বাংলার ইতিহাসে বারো ভূঁইয়া নামটি দেশপ্রেম, বীরত্ব ও ত্যাগের প্রতীক হিসেবে স্মরণ করা হয়ে থাকে বারো ভূঁইয়া কথার অর্থ হল বারো জন ভূম্যধিকারি বা জমিদার। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে বাংলায় বেশ কয়েকজন স্বাধীনচেতা জমিদারের উত্থান ঘটেছিল যারা মুঘলদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম চালিয়ে ছিল বাংলার সুলতানদের দুর্বলতার সুযোগে বেশ কিছু বড় জমিদার স্বাধীন হয়ে ওঠে, এদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান উভয় ছিল এদের দমন করার ইচ্ছা বা শক্তি কোনোটাই বাংলার সুলতানদের ছিল না বাংলায় করনারী বংশের শাসক সুলেমান করনারী পর পুত্র দাউদ করোনারী বাংলার শাসক হন তার রাজনৈতিক অক্ষমতা, নির্বুদ্ধিতার ফলে মুঘল শক্তি বাংলায় আইন-শৃঙ্খলা দখল করে তবে বাংলাকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে অনেক সময় লেগেছিল। এক্ষেত্রে প্রধান বাধা ছিল এইসব স্বাধীনচেতা ভূম্যধিকারি জমিদারেরা আকবরের শাসনকালে বাংলায় বারো ভূঁইয়াদের আধিপত্যের অবসান ঘটেছিল কিন্তু পরবর্তী মুঘল শাসক জাহাঙ্গীরের সময় তাদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায় মোগলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা করে

 মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে আরোহনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিংহকে বাংলায় সুবেদারির দায়িত্ব পালনের জন্য প্রেরণ করেন কিন্তু মানসিংহ বেশিদিন বাংলার সুবেদার ছিলেন না কারণ জাহাঙ্গীরের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কুতুবউদ্দিনকে বাংলার সুবেদার হিসেবে প্রেরণ করে শের আফগানের হাত থেকে মেহেরুন্নেসাকে উদ্ধারের জন্য ব্যস্ত হন কুতুবউদ্দিন বাংলায় শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে শের আফগানের হাতে নিহত হলে ইসলাম খাঁ বাংলার সিপাহশালার নিযুক্ত হন ইসলাম খাঁ ছিলেন প্রভাবশালী অভিজাত তিনি বাংলার স্বাধীনচেতা জমিদার বা বারো ভূঁইয়াদের দমন করে বাংলায় প্রকৃত মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন শেরশাহের পর বাংলায় যে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল তার সুযোগ নিয়ে বাংলার জমিদার ও জায়গীরদার শ্রেণী এক একটি অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপন করেন এরা নিজেদের দুর্গ ও সেনা দল তৈরি করে স্বাধীনভাবে শাসন করতে থাকে বারো ভূঁইয়া নামকরণ করা হলেও এদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল

 এই বারো ভূঁইয়ার মধ্যে বিশেষ শক্তিশালী কয়েকজন ছিলেন, যেমন - ঈশা খাঁ, তার পুত্র মুগা খাঁ, উসমান খাঁ, রামচন্দ্র, কেদার রায়,ত্রাজিৎ, রঘুনাথ, রাজা প্রতাপাদিত্য প্রমূখ রংপুর, বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ জেলা নিয়ে মুগা খাঁর রাজত্ব ছিল কেদার রায়ের মৃত্যুর পর তিনি তার জমিদারি দখল করে নেয় রাজা প্রতাপাদিত্য ছিলেন যশোর, খুলনা ও বাঘেরগঞ্জের অধিপতি এর পিতা শ্রীহরি ঈশা খাঁর কর্মচারী ছিলেন মুঘলদের আক্রমণের সময় তিনি ঈশা খাঁর ধনরত্ন নিয়ে পালান এবং ধুমঘাটে তার রাজধানী স্থাপন করেন ভূষণার জমিদার কেদার রায় মানসিংহের কাছে পরাজিত হয় তারপর সত্রাজিৎ ভূষণার জমিদার হন। সুসঙ্গের জমিদার ছিলেন রঘুনাথ,কলার জমিদার রামচন্দ্র, শ্রীহট্টের জমিদার ছিলেন উসমান খাঁ তিনি ছিলেন উড়িষ্যার বিদ্রোহী আফগান কতলু খাঁর পুত্র। বাহারিস্তান নামক গ্রন্থ থেকে বারো ভূঁইয়াদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় রাজমহল থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে যে সকল স্থানীয় জমিদার বা সামন্ত রাজা ছিলেন তারা সকলেই মুঘলদের বিরোধী ছিলেন পশ্চিমবাংলাতে যে কয়েকজন শক্তিশালী জমিদার ছিলেন তাদের মধ্যে মল্লভূমি ও বাঁকুড়ার রাজা বীর হাম্বীর, পাঁচেতের জমিদার শামস খাঁন ও হিজলির জমিদার সেলিম খাঁনের নাম করা যায়

বাংলায় বারো ভূঁইয়াদের প্রতিরোধকে কোন কোন ঐতিহাসিক বৈদেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলায় স্বাধীনতার যুদ্ধ রূপে বর্ণনা করেছেন আবার অনেকে মেবারের রানা প্রতাপ সিংহের সঙ্গে যশোরের প্রতাপাদিত্যের তুলনা করেছেন তবে প্রকৃতপক্ষে উভয়ের মধ্যে নামের সাদৃশ্য ছাড়া অন্য কোন সাদৃশ্য এক্ষেত্রে নেই উগ্র বাঙালি পন্থীদের প্রভাবে কিছুদিন মহারাষ্ট্রের শিবাজী জয়ন্তীর মত প্রতাপাদিত্য জয়ন্তী চলন হয় বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে দেশপ্রেম ও বাংলার স্বাধীনতার আবেগ খোঁজার চেষ্টা নিরর্থক এরা প্রত্যেকে ছিলেন শের শাহের মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে বাংলায় যে অরাজগতা সৃষ্টি হয়েছিল তার সুযোগের ফসল হিসেবে এরা ক্ষমতা লাভ করেন এরা নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে মাথা ঘামাতে না শিবাজীর মধ্যে যে গঠনমূলক নেতৃত্ব ও জাতীয়তাবাদ দেখা যায় বা রানা প্রতাপের মধ্যে যে আত্মসম্মানবোধ ও মেবারের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়ার মনোভাব দেখা যায় এরকম কিছু গুণাবলী বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে দেখা যায় না বারো ভূঁইয়ারা বা জমিদাররা প্রজাহিতৈষী ও ন্যায় পরায়ন বিচারক ছিলেন না এরা ছিলেন রাষ্ট্রের ও জাতির ঐক্য বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি 

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

       ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাই মুঘলদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বলে মনে করেন শিরিন মুসবি । শিল্প বাণিজ্য থেকে আয়ের পরিমাণ সামান্য । ভূমি রাজস্ব হল ‘ মাল ’ বা ‘ খারাজ ’ । মুঘলরাষ্ট্র সামন্তরাজাদের কাছ থেকে কর পেত । তাছাড়া রাষ্ট্র পেত যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ ( খামস ); স্থানীয় আবওয়াব জিহত , শয়ের - ই - জিহত , ফুরুয়াত , অমুসলমানদের উপর স্থাপিত কর জিজিয়া এবং মুসলমানদের দেয় কর জাকাত ।         আকবরের আমলে সরকারের মোট রাজস্ব পরিমাণ ছিল ১২ , ৮২ , ৮৩ , ৮২৫ টাকা , সুজন রায়ের মতে , ঔরঙ্গজেবের আমলে ৩২ , ৬৮ , ১৬ , ৫৮৪ টাকা , এই রাজস্বের ৬ % ভাগ বাণিজ্য শুল্ক থেকে এবং ৪ % ঔরঙ্গজেব জিজিয়া থেকে পেতেন । বাকি সব রাজস্ব কৃষি খাতে আদায় হত ।       বাবর ভারতবর্ষ জয় করে অধিকৃত অঞ্চলের সমস্ত জমি ইক্তা হিসেবে অভিজাতদের মধ্যে বন্টন করে দেন । দেশের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য ও সংগৃহীত হত । হুমায়ুন এ ব্যাপারে কোন পরিবর্তন ঘটাননি । মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা গঠন করেন আকবর । আকবরের আগ...