মদদ -ই -মাশ্ হল এক ধরনের অনুদান, রাজা কোন নির্দিষ্ট এলাকার জমি থেকে তাঁর ভূমি রাজস্ব ও
অন্যান্য কর আদায়ের অধিকার হস্তান্তর করতেন। এই হস্তান্তর করা অনুদান প্রাপককে
আজীবন বা চিরদিনের জন্য দেওয়া হত। মুঘল আমলে এই অনুদানকে বলা হত মিল্ক বা অম্লাক (দিল্লির সুলতানদের থেকে পাওয়া
শব্দ)। কিন্তু সরকারী দলিল ও অন্যান্য নথিপত্রে এই অনুদানকে সাধারণভাবে ব্যবহার
করা হত মদদ –ই- মাশ্। আক্ষরিক অর্থে যাকে বলা হয় 'জীবনধারণের জন্য সাহায্য'। এই ধরনের অনুদান তদারক করার জন্য একটি আলাদা বাদশাহী
দপ্তরের দায়িত্ব ছিল। দরবারে এই দপ্তরের কাজ দেখতেন 'সদর' বা 'সদরু সুদূর'। তার অধীনে থাকতেন
প্রাদেশিক 'সদর' এবং এর আরও নিচের তলায় ছিলেন 'মুতাওয়াল্লী' নামের কর্মচারীরা।
সাধারণত মদদ -ই –মাশ্ হল অনুদানের অধিকারীদের উদ্দেশ্যে জারি করা ফরমানের একটি অংশ। এই ফরমানে অধিকার ও
অনুগ্রহের বিষয়ে লেখা থাকত। আকবরের শাসনকালের গোড়ার দিকে এই অনুদানের বিষয়টি চালু হয় এবং
তা বাঁধা একটা নিয়মে পরিণত হয়। এই অনুদানে প্রাপকরা জমি থেকে সব রাজস্ব (ওয়াসিলাৎ) পাবে। তাদের ভূমি রাজস্ব (মাল ও জিহাৎ) এবং 'ইখরাজাৎ' দিতে হবে না। সুতরাং সব আর্থিক বাধ্যবাধকতা
এবং বাদশাহের দাবী (হুকুক এ দিওয়ানী ও মুতালিবাৎ -এ সুলতানী) থেকেই তাদের রেহাই দেওয়া হয়। ভূমিরাজস্ব আদায় করা ও তা
নিজেদের কাছে রাখার অধিকার দেওয়া হয়।
আসলে খাতায়-কলমে মদদ –ই- মাশ অনুদান ছিল "আল্লার দরিদ্র ও
নিঃস্ব জীবদের" ভরণপোষণের জন্য বদান্যতা। আবুল ফজলের মতে মদদ-ই-মাশ্ ছিল বিশেষ করে
সমাজে চার শ্রেণীর লোকদের জন্য, যথা- জ্ঞানী, ধার্মিক, জীবিকার উপায়হীন অসহায় লোক এবং যে অভিজাত বংশীয়রা অজ্ঞতার ধরুন কোন
চাকরি নেবেন না। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়েরা প্রায় এই অনুদান পেতেন। অনুদানের ফলে উপকৃত হয়েছিলেন কয়েকজন
চিকিৎসক যাঁরা ওই অঞ্চলের গরিবদের চিকিৎসা করতেন। বাধ্যক্য বা অন্য কোনো কারণে মোঘল কর্মচারীরা চাকুরী করতে পারতেন না
তাদেরকেও মদদ -ই –মাশ্ অনুদান মারফৎ অবসরবৃত্তি দেওয়া হত।
মদদ ই মাশ্ অনুদান প্রাপককে এমন কোনো অধিকার দেওয়া হত না যার উপর
প্রশাসনের কোন অধিকার থাকবে না। অনুদান প্রাপকরা অনুমোদিত ভূমিরাজস্বের বাইরে বেশি দাবী করতে পারত না। আকবরের শাসনের গোড়ার দিকে একটি ফরমান চাষীদের "জরিপের ভিত্তিতে
ভূমি রাজস্ব নির্দিষ্ট পরিমাণের দিতে বলা হয়েছিল।" চাষীদের দখলীকৃত স্বত্বের ওপরও মদদ- ই -মাশ্ অনুদান প্রাপকরা
হস্তক্ষেপ করতে পারত না। আকবর একটি ফরমানে বলেন যে, প্রাপকরা যদি 'রাইয়তী' জমিকে 'খুদ কাস্তা' জমিতে পরিণত করতে যায় তাহলে রাজস্ব আদায়কারী তাতে বাধা দান করবে।
মদদ ই মাশ্ অনুদান কোনোভাবেই জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত মিলকিয়াৎ বা জমিদারী স্বত্বে হস্তক্ষেপ
করতে পারবে না। সরকারী আদেশ নামায় বলা হয়েছে যে, অনুদান প্রাপকরা অবশ্যই স্বত্বাধিকারীদের হক এ মিলকিয়াৎ
দেবে। স্বত্বাধিকারীদের উৎপন্ন দ্রব্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ভাগ বোঝায়, স্বত্বাধিকারীদের
শত্রুতার দরুন অনেক সময় প্রাপক তার অনুদান অন্য কোথাও বদল করিয়ে নিতে বাধ্য হতেন। মদদ- ই –মাশ্ অনুদান সাধারণ নির্দিষ্ট এলাকায় বিঘার অঙ্কে দেওয়া হত। আকবরের আমলে যখন এই অনুদান
দেওয়া শুরু হয় তখন থেকে বিঘা মাপার জন্য গজ –ই- ইলাহী ব্যবহার শুরু হয়। প্রাপক যাতে শুধু তার অনুদানের এলাকাতে অধিকার
সীমাবদ্ধ রাখে আর কোনো বাড়তি এলাকা দখল না করে সে ব্যাপারে জায়গীরদার ও রাজস্ব
কর্মচারীরা স্বভাবতই উদ্বিগ্ন থাকতেন।
আকবর অনুভব করেছিলেন যে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামগুলোতে মদদ -ই –মাশ্ বরাত দিলে তার অপব্যবহার হতে পারে। অনুদান প্রাপকরা কখনও কখনও প্রতারণা করে একই
অনুদানের ভিত্তিতে দুই বা ততোধিক জায়গায় জমি পেয়ে যেতে পারে। কোনো গ্রামের ছোট
প্রাপকের ওপর 'খালিসা' ও জায়গীরদার এর কর্মচারীরা পীড়ন করতে পারে। ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে আকবর স্থির করেন যে মদদ -ই –মাশ্ প্রাপকদের কয়েকটি
গ্রামে কেন্দ্রীভূত করতে। এর জন্য মদদ -ই –মাশ্ অনুদানের জন্য কয়েকটি গ্রামকে চিহ্নিত করে রাখার একটা
প্রতিস্থিত রীতিতে পরিণত হয়েছিল। আবুল ফজল বলেছেন যে, মদদ -ই -মাশ অনুদান দানের একটি বাঁধা নিয়ম হিসাবে অনুদানের অর্ধেক
এলাকা দেওয়া হয় ইতিমধ্যেই আবাদ হয়েছে এমন জমি এবং বাকি অর্ধেক আবাদযোগ্য জমি। তবে আবাদযোগ্য জমি পাওয়া না
গেলে অনুদানের এলাকা একের চার ভাগ কমিয়ে দেওয়া হবে।
ঔরঙ্গজেব একটি ফরমানে মদদ- ই –মাশ এর অনুদানের ধারণাকে
পরিবর্তন করে বলেন যে এটি হল ঋণ হিসেবে। অর্থাৎ পুরো স্বত্বাধিকারের দখল দিয়ে প্রাপককে এটি
হস্তান্তর করা হত না, শুধুমাত্র বাদশাহের খুশিমতো তার অধিকার থাকত। এই ফরমানে কোন বছরের মেয়াদ না থাকার ফলে প্রাপক
তার জীবদ্দশায় অবাধে এই অনুদান ভোগ করতেন। আকবরের আমলে পাইকারী হারে অনুদান
ফিরিয়ে নেওয়া বা কমিয়ে দেওয়ার ঘটনা দেখা যায়। তার আমলে প্রদত্ত অনুদান জাহাঙ্গীরের সময় ও
বহাল ছিল। শাহজাহানের আমল পর্যন্ত প্রদত্ত সমস্ত অনুদান পরীক্ষা করে অযোগ্য লোকেদের হাত থেকে
ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা গ্রহণ করা হয়। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেব আরেকটি ফরমান জারি করেন মদদ –ই- মাশ্কে বংশানুক্রমিক
করে দেন। তিনি ঘোষণা করেন যে এখন থেকে মৃত প্রাপকদের উত্তরাধিকারীরা পুরনো ও নতুন বৈধ
ফরমান মারফত দেওয়া প্রাপকদের জমি অখন্ড ও সম্পূর্ণভাবে বিনা ক্ষয়ক্ষতিতে
পুরুষানুক্রমে রক্ষা করতে পারবে। অর্থাৎ ঠাকুরদার মৃত্যুর আগে বাবার মৃত্যু হলে নাতিকে
সরাসরি উত্তরাধিকারী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। তবে মেয়েকে তার ভাগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই ফরমানে বলা হয়েছে যে, বিধবা তার স্বামীর
অনুদান আজীবন রেখে দিতে পারবে। পরে স্বামীর উত্তরাধিকারীর হাতে হস্তান্তর করবে।
মদদ-ই- মাশ্ অনুদানের বেশির ভাগটাই ভোগ করত জ্ঞানী ও
ধার্মিক শ্রেণীর লোকেরা। মদদ-ই-মাশ্
এর জন্য যোগ্য প্রমাণ করার শ্রেষ্ঠ
উপায়টি ফৈজী, সিরহিন্দীর লেখায় সংরক্ষিত আছে। মদদ-ই-মাশ্ অনুদান প্রদান করা হত কোন প্রকার দায়িত্ব না চাপিয়ে। কিছু কিছু অনুদান ছিল
শর্তসাপেক্ষে। বদাউনী যখন একটি অনুদান পেয়েছিলেন তখন এর শর্তানুযায়ী তিনি একদল সৈন্য যোগান দিতে
বাধ্য ছিলেন।
Good
উত্তরমুছুন