উত্তর-পশ্চিম
সীমান্ত নীতিকে কান্দাহার অঞ্চলের প্রতি অনুষ্ঠিত নীতি ও বলা যেতে পারে। সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে
অবস্থিত আর্থ-সামরিক
দিক থেকে
গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল কান্দাহারকে কেন্দ্র করে এই নীতি আবর্তিত হয়েছিল। উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও
উত্তর-পশ্চিমে দূরতিক্রম্য হিমালয় ও তার
শাখা-প্রশাখা এবং পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব
দিকে সাগরমালা বহিরাক্রমণ থেকে ভারতবর্ষকে প্রাকৃতিক নিরাপত্তা দান করেছে। কিন্তু হিমালয়ের খাইবার, গোলাম ও বোলান ইত্যাদি গিরিপথ দিয়ে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে বিদেশীরা
ভারতবর্ষকে আক্রমণ করে এসেছে। এই
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পথেই আক্রমণকারীর বেশে এসেছিল পারসিক, গ্রীক, কুষাণ, শক, হুন, পাঠান ও মুঘল। কান্দাহারের গুরুত্ব উপলব্ধি করে মুসলিম শাসকদের মধ্যে বলবন ও আলাউদ্দিনই প্রথম
উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে নিরাপত্তার জন্য সামরিক
ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
পরবর্তীকালে মুঘলরাও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের গুরুত্ব উপলব্ধি করে কান্দাহারকে করায়ত্ত
করার চেষ্টা চালিয়েছেন, এই কাজে প্রথম
সক্রিয় পদক্ষেপ নেন সম্রাট শাহজাহান।
সমকালীন লেখক ইতিহাসবিদ্ আব্দুল হামিদ
লাহোরী উল্লেখ করেছেন যে “শাসনক্ষমতা লাভের
সূচনা থেকেই সম্রাটের হৃদয়ে বাল্ক ও
বাদাখশান দখলের ইচ্ছা স্থান নিয়েছিল।”
দক্ষিণ ভারত অভিযানের সাফল্যের পর
শাহজাহান মধ্য-এশিয়া অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। মধ্য এশিয়া অভিযানের অজুহাত হিসেবে তিনি উজবেগ উপজাতির আক্রমণ ও সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার কথা বলেন। উজবেকদের আক্রমণের ফলে একদা বাবর এই অঞ্চল ত্যাগ করে
সরে আসতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু
উজবেক দলপতিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা
মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। আবদুল্লাহ খাঁ উজবেগ এর মৃত্যুর পর
মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক সংকট চরমে উঠেছিল। শেষ
পর্যন্ত ইমাম কুলি খাঁ নামে জনৈক উজবেক নেতা বোখারা ও বাল্খ দখল করে স্বাধীনভাবে শাসন করতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যেই ইমাম কুলিকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার ভ্রাতা
নজর মহম্মদ বোখারা ও বাল্খ দখল করে নেন।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী নজর মহম্মদ ক্ষমতা দখল করার পর কাবুলের উপর আক্রমণ চালাতে থাকেন। উজবেকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আক্রমণের ফলে ভারতের
উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
উত্তর-পশ্চিম
সীমান্তে কান্দাহারের উপর অধিকার নিয়ে মুঘল সম্রাট ও পারস্যের শাহের মধ্যে সংঘর্ষ
অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। প্রাথমিক পর্বে
শাহজাহানের ইচ্ছা ছিল পারস্যের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে কান্দাহার ফিরে
পাওয়া এবং সম্ভব হলে পারস্যের সহযোগিতায় ট্রান্স অক্সিয়ানা অধিকার করা। এই উদ্দেশ্যে পারস্যের শাসক শাহ আব্বাসেরর মৃত্যুর পর শাহজাহান নতুন শাসক সফির কাছে দূত প্রেরণ করে উভয় বংশের মধ্যে অতীত সম্পর্ক
স্থাপনের প্রস্তাব করেন। একই সঙ্গে
শাহ আব্বাসের মৃত্যু এবং সাফির অনভিজ্ঞতার
ফলে পারস্যের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির প্রতি
শাহজাহান সতর্ক দৃষ্টি দেন। এই সময়
শাহ আব্বাসের বিরোধী রাষ্ট্রবর্গ একটি পারস্য
বিরোধী সংঘ গঠনের উদ্যোগ নেয়। আকবরের
মত শাহজাহানও কোন নির্দিষ্ট পথ গ্রহণের
পরিবর্তে একইসঙ্গে পারস্য ও তার শত্রু দেশগুলির সাথে যোগাযোগ রেখে চলেন। কিন্তু পারস্যের শাহর মুঘল মৈত্রী সম্পর্কে উদাসীনতা শাজাহানকে পারস্যের সাথে
ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে বাধ্য করে।
শাহজাহান আকবরের দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করে কাবুলে একটি বিশেষ
গোয়েন্দা দপ্তর খোলেন এবং তার তত্ত্বাবধক হিসেবে নিয়োগ
করা হয় কাবুলের মুঘল গভর্নর সৈয়দ খাঁকে। তার প্রতি সম্রাটের নির্দেশ ছিল গোপনে কান্দাহারের
শাসক আলিমর্দানের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলা এবং
পারসিক শাসককে মুঘলদের স্বপক্ষে আনার চেষ্টা চালানো। এই প্রচেষ্টাকে বাস্তব রূপ দিতে আলিমর্দানকে গুরুত্বপূর্ণ
ও সম্মানজনক সরকারি-পদ দানেরও লোক দেখানো হয়। কিন্তু
পারস্যের শাহর প্রতি বিশ্বস্ত আলিমর্দান মুঘলদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং সম্ভাব্য মুঘল আক্রমণ
প্রতিহত করার জন্য কান্দাহারের প্রবেশ পথে
পাহাড়ের উপর নতুন দুর্গ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পারস্যের দরবারে আলিমর্দানের বিরোধী অভিজাতগন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সন্দেহ প্রকাশ
করলে অবিবেচক শাহ আলিমর্দামকে রাজধানীতে
প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন এবং তাঁকে বন্দি করা হয়। এইরূপ
পরিস্থিতিতে আলিমর্দান মুঘল দূত সৈয়ত খাঁর মারফত
শাহজাহানকে কান্দাহার দখলের প্রস্তাব দেন। ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে কান্দাহার
মুঘলদের হাতে হস্তান্তরিত হয়। এই
ঘটনার নায়ক অথবা খলনায়ক হিসাবে আলিমর্দান
শাহজাহানের থেকে পুরস্কার লাভ করে এবং কাশ্মীর ও
কাবুলের গভর্নর নিযুক্ত হন। অতঃপর শাহজাহান কান্দাহারকে পারস্যের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করার
জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা নেন।
স্থানীয় সর্দার ও জমিদাররা মুঘল আনুগত্য স্বীকার করে নেয়। শাজাহান কূটনৈতিক পথে মুঘল পারস্য বিরোধ মিটিয়ে
নিতে প্রয়াসী হন।
১৬৪২
খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় আব্বাস পারস্যের সিংহাসনে বসার পর কান্দাহার পুনর্দখলের
বিষয়ে উৎসাহী হয়। ইতিমধ্যে
মধ্য এশিয়ায় মুঘলদের বিপর্যয় এবং বুখারার
শাসনকর্তা নজর মহম্মদের সঙ্গে পারস্যের সমঝোতায় শাহ আব্বাস কান্দাহার পুনর্দখলে অনুপ্রাণিত
হয়ে ওঠেন। কান্দাহার দখলের পর
পারস্যের সঙ্গে সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছিল তা অনেকটা জোড়া দেওয়ার জন্য এবং অস্ট্রাখান পরিবারের ব্যাপারে নিরপেক্ষ রাখার জন্য শাহজাহান মৈত্রীর আহ্বান
জানিয়ে ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ পত্রবাহী দূত জান
নিসার খানকে পারস্যে পাঠান। কিন্তু
শাহ আব্বাস পারস্যের দরবারে অবস্থানরত দুই মুঘল দূতকে
ফিরিয়ে দেন। ১৬৪৬
খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর পারসিকরা
কান্দাহার অবরোধ করে এবং কান্দাহারের মুঘল শাসন কর্তা দৌলত খান খাদ্যাভাব, শাদি খানের সঙ্গে আক্রমণকারীদের গোপন যোগাযোগ ইত্যাদি
নানা কারণে উপায়ন্তর না দেখে ১৫৭ দিন প্রতিরোধের পর ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১১
ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণ করে। শাহ
আব্বাস মীহ্রাব খাঁনকে কান্দাহার দুর্গের
দায়িত্ব দেন এবং ক্ষমা চেয়ে চিঠি দিয়ে শাহ কুলি খানকে শাহজাহানের
কাছে পাঠান।
শাহজাহান উপায়ন্তর না দেখে শাহজাদা ঔরঙ্গজেব ও প্রধানমন্ত্রী
শাদুল্লা খাঁনের
নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী কান্দাহার পুনরুদ্ধারে প্রেরণ করেন। ঔরঙ্গজেব
চার মাস অবরোধ করেও জয় লাভে ব্যর্থ হয়। পারসিকবাহিনী
কামান যুদ্ধে প্রভুত্ব নৈপুন্যতা দেখায়। তিন
বছর পর (১৬৫২) শাহজাহান আবার কান্দাহার পুনর্দখলের চেষ্টা করেন। ঔরঙ্গজেব, শাদুল্লা খাঁ এবং রুস্তম খাঁর নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী কান্দাহার আক্রমণ
করে। কিন্তু পারসিকদের শৌর্যবীর্য এবং কামান
ব্যবহারের অপূর্ব দক্ষতার দ্বারা মুঘল বাহিনীকে এক ইঞ্চি
জমি দখল করতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত
বৃহত্তর বিপর্যয়ের আগেই শাহজাহান অভিযান
প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন। ঔরঙ্গজেব অবশ্য নিজের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করার আশায়
অভিযান চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি চান কিন্তু শাহজাহান নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। আস্থাহীন সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে জানায় "আমি যদি বিশ্বাস করতে পারতাম যে তুমি কান্দাহার দখল করতে
সক্ষম, তবে তোমাকে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দিতাম
না। প্রত্যেক মানুষই কিছু কাজ করতে পারে।
এটা বলাই যথেষ্ট যে যারা জ্ঞানী তারা কারও পরামর্শের অপেক্ষা করে না।"
কান্দাহারে
ঔরঙ্গজেবের
ব্যর্থতা শাহজাদা দারাসুকোকে আনন্দিত
করেছিল। ঔরঙ্গজেবের
ব্যর্থতার গ্লানিকে আরো উস্কে দেওয়ার জন্য দারাসুকো
স্বয়ং কান্দাহার পুনরুদ্ধারে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সম্রাটকে রাজি করান। এনায়েত খাঁ'নের 'শাহজাহাননামা'
গ্রন্থে এই সমস্যার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। দারাসুকো পাঁচবার
কান্দাহার দুর্গ আক্রমণ করেন এবং পারসিক বাহিনীর গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে পিছু
হটতে বাধ্য হয়।
কান্দাহার
দখলের জন্য তিনটি অভিযানের ব্যর্থতা ব্যক্তিগতভাবে শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের মর্যাদা ধুলুণ্ঠিত করে। মুঘল
বাহিনী যে 'কাগুজে বাঘ মাত্র' এই সত্য পরিষ্কার হয়ে যায় সমগ্র এশিয়াবাসীর কাছে। পারস্যের শাহ দম্ভভরে বললেন দিল্লির শাসকরা সোনার
বিনিময়ের দুর্গ চুরি করতে পারে, কিন্তু অস্ত্রের জোরে দুর্গ
বিজয় করতে পারে না। কান্দাহার
অভিযানে মুঘল বাহিনীর ব্যর্থতা দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের শক্তিশালী হয়ে উঠছে
সাহায্য করে। সুতরাং
কান্দাহার হারিয়ে মুঘলদের যে ক্ষতি হয়েছিল তার চেয়ে সহস্রগুণ ক্ষতি হয়েছিল কান্দাহার অভিযানের
ব্যর্থতার জন্য। আর কান্দাহার
অভিযানের এই আর্থ-সামরিক
ক্ষয়ক্ষতি মুঘল সাম্রাজ্যের উপর যে চাপ সৃষ্টি করেছিল তা আর মুঘলরা কাটিয়ে উঠতে
পারেনি। অপরিমিত রাজ্যলিপ্সার মূল্য মুঘল শাসককে দিতে হয়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে ভারতবর্ষকে বারবার বিড়ম্বিত
হতে হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন