গ্রিক মহাকাব্যের হেলেন, রামায়ণের সীতা ও মহাভারতের দ্রৌপদীর সৌন্দর্য যেমন
তদানীন্তন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছিল, তেমনি
মুঘল আমলে অসামান্য রূপসী নূরজাহান তাঁর রূপের জালে সম্রাট জাহাঙ্গীর ও তাঁর রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। মধ্য যুগে ভারতীয় ইতিহাসে যে কজন নারী রাজনীতির আঙিনায় পদসঞ্চারণ করেছিল তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব হলেন নূরজাহান। ড. বেণীপ্রসাদ যাঁকে মধ্যযুগের ভারত ইতিহাসে সবচেয়ে রোমান্টিক ব্যক্তিত্ব
বলেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনা ও নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে নূরজাহানের সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। জাহাঙ্গীরের উপরে তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব কীভাবে
রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং কর্তৃত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত হয় তা নিয়ে। এই স্বভাবের আশু ফল হিসাবে যা বলা যায় বা দেখা যায়
তা হল তাঁর নিকট
আত্মীয় স্বজনকে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব এক
গোষ্ঠীর হাতে আনা। ইতিহাসে যা নূরজাহান জুন্টা বা নূরজাহান চক্র
নামে
প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
মুঘল ভারতের ইতিহাসে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে নূরজাহানের বিবাহ
একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কেননা
এই বিয়ের সূত্রেই এক সামান্য রমণী থেকে নূরজাহান
ভারত সম্রাজ্ঞী হয়েছিলেন এবং অন্তত সতের বছর
সম্রাট ও দরবারী রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাই ড. স্মিথ বলেছেন যে নূরজাহান
ছিলেন সিংহাসনের অন্তরালবর্তী ক্ষমতা। সম্রাট
ও সাম্রাজ্যের উপর নূরজাহানের প্রভাব নিয়ে পন্ডিত মহলে বিতর্ক রয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে নূরজাহানের
সর্বগ্রাসী প্রভাব সম্পর্কে ইন্তেখাব -ই – জাহাঙ্গীরশাহী -র লেখক "At this
time influence of Nurjahan had attained sucha height that the entire management
of the empire was entrusted to her hands." মহাবৎ খাঁ যখন
জাহাঙ্গীরকে বলেন 'সম্রাট কি
ইতিহাসে এমন কোন নজির দেখাতে পারবেন যিনি স্ত্রীর পরামর্শে রাজকার্য পরিচালনা
করতেন?' তখন সাম্রাজ্যের উপর নূরজাহানের অপরিসীম প্রভাব কি নির্দেশ করে। ইন্তিখাব –ই-
জাহাঙ্গীরশাহী –র লেখক
এ প্রসঙ্গে বলেন যে, জাহাঙ্গীরের
উপর নূরজাহানের প্রভাব এতই গভীর ছিল যে মহাবৎ খঁর মত দুশোজন আমীরের বক্তব্যও
জাহাঙ্গীরের উপর বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি। ড. বেণীপ্রসাদ তাঁর 'History of Jhangir' গ্রন্থে
বলেছেন যে ১৬১১ -২২ খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত নূরজাহানের প্রভাব তত প্রখর ছিলনা। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেছেন যে, জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব রাষ্ট্রের পক্ষে
মঙ্গলজনক হয়নি। অন্যদিকে ড. আর। পি। ত্রিপাঠী বলেন "জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব ছিল নৈতিক আবেগসঞ্জাত মনস্তাত্ত্বিক এবং সম্ভবত বৌদ্ধিক।" তিনি জাহাঙ্গীরের ক্ষেত্রে নূরজাহানকে 'সৌভাগ্যসূচক
শক্তি' বলেছেন।
১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে সেলিমা বেগমের মৃত্যুর পর নূরজাহান 'বাদশা বেগম' অর্থাৎ
প্রথম মহিষী রূপে প্রাসাদ ও হারেমের সর্বময়ী কর্ত্রী হন।
'ওয়াকিয়াৎ- ই- জাহাঙ্গীরী'তে বলা
হয়েছে যে নূরজাহান ক্রমশ সম্রাটের উপর এতই
প্রভুত্ব বিস্তার করেন যে, পারস্য থেকে
আগত সম্রাজ্ঞীর আত্মীয়স্বজনকে তিনি উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত করেন। নূরজাহানের
কারণে তাঁর পিতা গিয়াস বেগ 'ইতিমদ্ উদ্-দৌলা উপাধি পেয়েছিল,
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আসফ খাঁ
প্রধানমন্ত্রিত্ব পেয়েছিল, দ্বিতীয় ভ্রাতা মির্জা আবুল
হাসান 'আসফ খাঁ (৪র্থ) উপাধি পান এবং পাঁছাজারী
মনসবদার নিযুক্ত হয়। তৃতীয় ভ্রাতা ইব্রাহিম খাঁ 'ফতে জঙ্গ' উপাধি লাভ
করে বাংলার সুবাদার হন। আর তার কনিষ্ঠ ভগ্নীপতি হাকিম বেগকে দরবারে একজন বিশিষ্ট আমীর পদে অধিষ্ঠিত
করেন। নূরজাহানের ধাত্রী দিলারানী রাজ
অন্তঃপুরে কর্তৃত্ব লাভ করে 'সদ্বী- অনাস্' উপাধি পান। একের পর এক আত্মীয়স্বজনদের সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে পরিবৃত্ত করে যে চক্র গড়ে তোলেন ১৬১২
খ্রিস্টাব্দে আসফ খাঁর কন্যা আরজুমন্দ বানু বেগমের (মমতাজ
মহল) সঙ্গে খুররমের বিবাহ দিয়ে ঐ চক্রকে আরও শক্তিশালী করেন।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নূরজাহান উপলব্ধি করেন যে,
উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাহজাহান তার কর্তৃত্বকে মেনে নেবে না,
সিংহাসনের দিকে হাত বাড়াবে। এই
আশঙ্কা থেকে নিজ কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখার জন্য শাহজাদা শাহরিয়ারের সঙ্গে তার প্রথম
কন্যা লাডলী বেগমের বিবাহ দেন।
শাহজাহানের বিরুদ্ধে সিংহাসন লাভের আর একজন দাবিদার সৃষ্টি করেন। নূরজাহানের
অভিসন্ধির কথা বুঝতে পেরে শাহজাহান ১৬২৪ খ্রিস্টাব্দে আজমীরের
পূর্ব-দক্ষিণে রামশিবের কাছে নূরজাহানের যে
জায়গীর ছিল তা এবং শাহরিয়ারের জায়গীর অধিকাংশ দখল করেন। জাহাঙ্গীর শাহজাহানকে তাঁর
অধিনস্ত সেনা দিল্লিতে পাঠিয়ে দিতে এবং নিজ জায়গীর নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে নির্দেশ
দিলে শাহজাহান তা অস্বীকার করেন। মহাবৎ খাঁ জাহাঙ্গীরকে
নূরজাহানের প্রভাব থেকে বের করে আনার এবং খুররম বা শাহজাহানকে
সিংহাসন দেওয়ার ব্যাপারে উপদেশ দিয়ে ব্যর্থ হন। নূরজাহান স্বীয় জামাতা শাহরিয়ারের জন্য ভবিষ্যতে দিল্লীর সিংহাসন
প্রতিদ্বন্দী শূন্য করতে উদ্যোগী হন। এই সময় ১৬২১ খ্রিষ্টাব্দে নূরজাহানের পিতা ইতিমদ উদ্-দৌলার মৃত্যু
এবং মায়ের মৃত্যু ও শাহজাহানের
সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত নূরজাহান চক্রের পতন
ঘটে।
নূরজাহান
ক্রমশ স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল।
জাহাঙ্গীরের অসুস্থতার ক্রমেই বৃদ্ধি পেলে নূরজাহানই
সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন।
সম্রাটের অসুস্থতার জন্য তিনি মাঝে মাঝে ঝারোখা দর্শনে উপস্থিত হয়ে রাজকার্যে
আমীরদের পরামর্শ দিতেন এবং উপাধি প্রদান করতেন। রাজকীয় ফরমানে সম্রাটের স্বাক্ষরের
সঙ্গে নূরজাহানের নামও মুদ্রিত হত।
রাষ্ট্রদ্রোহীদের ক্ষমা পেতে গেলে নূরজাহানের ওপর নির্ভর করতে হত। জাহাঙ্গীরের উনিশতম
রাজত্ববর্ষে নূরজাহানের
নামে স্বর্ণ মুদ্রা মুদ্রিত হয় তখন থেকে বুঝতে বাকি
থাকেনা যে তিনিই ভারতবর্ষের প্রকৃত নিয়ন্তা। শুধুমাত্র নিজের নামে 'খুৎবা' পাঠ ছাড়া আর
সবই নূরজাহান করায়ত্ত করে নিয়েছিলেন। মহাবৎ খাঁন বিদ্রোহ,
শাহজাহানের বিদ্রোহ অনেকাংশে নূরজাহানের
স্বৈরাচারিতা, ক্ষমতা
আঁকড়ে থাকার লোভ এবং সন্দেহ পরায়নতা নিঃসন্দেহে দায়ী ছিল।
পরিশেষে বলা যায় যে সম্রাট ও
সাম্রাজ্যের উপর নূরজাহানের প্রভাব রাষ্ট্রের পক্ষে কল্যাণকর হয়নি। শাহজাহানকে বঞ্চিত করে
শাহরিয়ারকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করার নূরজাহানের
মতলবকে জাহাঙ্গীর সম্মতি দেননি। এই দিক
থেকে ড. বেণীপ্রসাদ
মনে করেন নূরজাহানের প্রভাব ছিল সীমিত। ড. আর পি ত্রিপাঠীর মতে জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব ছিল 'Moral, emotional, spiritual and possibly intellectual' দরবারে
যখন বহু আমির-ওমরাহ চক্রান্তে লিপ্ত,
খুররমের শ্যেণদৃষ্টি যখন সিংহাসনের দিকে, তখন
সম্রাটের অসুস্থতাজনিত পরিস্থিতিতে নূরজাহান
দরবারের হাল ধরে ছিল। নূরজাহান খুররমের বিদ্রোহ দমন করেছিল, মহবৎ খাঁর বন্দীদশা থেকে তিনি অপূর্ব বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সম্রাটকে
মুক্ত করেছিল। ড. নুরুল হাসানও নূরজাহানের
অতিরিক্ত প্রভাবের কথা অস্বীকার করেন। তবে
টমাস রো ও টেরি প্রমূখ নূরজাহানের অতিরিক্ত প্রভাবের কথা বলেছেন। শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, সাম্রাজ্যের আর্থ-সামাজিক
ও সাংস্কৃতিক জীবনেও নূরজাহানের প্রভাব দারুণভাবে অনুভূত হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন