সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুঘল চিত্রকলা

 




ভারতীয় শিল্পকলা মুঘল শাসকরা এক গুরুত্বপূর্ণ নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। মুঘল শাসকরাই প্রথম ভারতবর্ষে তরবারি, কলম ছবি অঙ্কনেতুলিকে সমান মর্যাদা দিয়েছিলেন তাদের সৃষ্ট কালজয়ী অভূতপূর্ব স্থাপত্য শিল্পের পাশাপাশি চিত্রশিল্প এক অভাবনীয় মর্যাদার স্থান অধিকার করেছিল সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় মুঘল যুগে যেমন অসাধারণ অগ্রগতি দেখা যায়, চিত্রশিল্পের মধ্যেও মুঘল যুগের শিল্প ভাবনা ও মননশীলতার উৎকর্ষ লক্ষ্য করা যায় প্রাচীন ভারতের চিত্রকলার ঐতিহ্য সংস্কৃত সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়েছে কালিদাসের রঘুবংশে প্রতিমা গৃহ, অজন্তার গুহাচিত্রে চিত্রকলার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। অষ্টম শতক থেকে ভারতীয় চিত্রশিল্পের অবনতি ঘটলে ও জৈন সন্তরা তাদের পুঁথিতে ভারতীয় চিত্রকলার ঐতিহ্য বহন করে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের জয়লাভের বহু পূর্বেই ভারতবর্ষ জৌনপুর, মান্ডু আহমেদাবাদ প্রভৃতি স্থানে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় 'মিনিয়েচার' চিত্রের বিকাশ ঘটেছিল ভারতীয় এই 'মিনিয়েচার' চিত্রশৈলী মুঘলদের সংস্পর্শে পারসিক চিত্ররসে সিক্ত হয়ে এক নব জীবন লাভ করে মহান মুঘলরা ভারতবর্ষ থেকে বিলুপ্ত হলেও তাঁদের সৃষ্ট চিত্রশিল্পের প্রভাব দাক্ষিণাত্যে, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতের চিত্রশিল্পে দীর্ঘদিন স্থায়িত্ব লাভ করে

সুলতানি যুগে চিত্রশিল্পের তেমন কদর ছিল না তবে আমির খসরু, সামসি সিরাজ আফিফ ও মৌলানা দাউদ প্রভৃতি সমসাময়িক লেখকদের লেখা গ্রন্থে দেওয়াল চিত্র ও চিত্রকরদের পরিচয় পাওয়া যায় মুঘলরা প্রথম চিত্রশিল্পের মত ভারতীয় সংস্কৃতির চরম বিকাশে আত্মনিয়োগ করেনমুঘল যুগের চিত্রকলা বৈশিষ্ট্য ছিল i) এই চিত্রকলা যেমন একদিকে মুঘল দরবারে পৃষ্ঠপোষকতায় বিকাশ লাভ করে তেমনি দরবারের বাইরে রাজস্থান ও কাংডায় লোকশিল্প হিসেবে বিকাশ পায় ii) মুঘল চিত্রকলা ইন্দো পারসিক রীতির অসাধারণ মিশ্রন দেখা যায় আকবরের আমল থেকে এই সমন্বয়ধর্মী শৈলী গড়ে ওঠে iii) মুঘল চিত্রকলা প্রাকৃতিক দৃশ্য, গাছ, পশু, পাখির চিত্র বিষয়বস্তু হিসেবে স্থান পায় চিত্র রচনায় স্বাভাবিকতার পর গুরুত্ব দেওয়া হয় iv) জাহাঙ্গীরের আমল থেকে মুঘল চিত্রকলায় আঙ্গিক অপেক্ষা বক্তব্য প্রধান্য পায় এবং বিষয়টির অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য প্রকাশের ওপর জোর দেওয়া হয় v) শাহজাহানের আমল থেকে ছবির বক্তব্য অপেক্ষা বিষয়বস্তুর সঙ্গে সাদৃশ্য স্থাপনের ওপর জোর দেওয়া হয় vi) মুঘল দরবারী চিত্রগুলির বিষয়বস্তু ছিল বিচিত্র দরবারে সম্রাটকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দৃশ্যের চিত্র আঁকা হত এবং সম্রাটের শিকার দৃশ্য আঁকা হত চিত্রগুলি ছিল দীর্ঘ এবং খুঁটিনাটি কাজ ছিল অসাধারণ vii) কোন কোন আধুনিক সমালোচকের (Percy Brown) মতে কোন কোন মুঘল চিত্রকলা ইউরোপীয় প্রভাব দেখা যায় দরবারে টমাস রো প্রভৃতি ইউরোপীয়দের উপস্থিতি ছিল এর কারণ মুঘল চিত্রকলার বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয় পুরাণ, মহাভারত, রামায়ণের কাহিনী অথবা প্রাকৃতিক দৃশ্য এই চিত্রকলার শৈলী ছিল মূলত ভারতীয় পারসিক মিশ্রণে রচিত।

পারসিক চিত্রধারা অনুসারে মুঘল ভারতীয় চিত্রধারার বিকাশে স্মরণীয় দুটি নাম হল - বায়াজিদ এবং তাঁর শিষ্য আগামারিক পারস্যের সাফাভি বংশীয় সুলতান শাহ্‌ ইসমাইলের পৃষ্ঠপোষকতায় বায়াজিদ মোঙ্গলীয় চিত্রকলাকে পরিবর্তিত করে পারস্যের চিত্রধারার সৃষ্টি করেন 'প্রাচ্যের রাফায়েল' নামে বন্দিত বায়াজিদই প্রথম প্রকৃত অর্থে প্রতিকৃতি অঙ্কনের রীতি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন জনৈক চিত্র সমালোচকের মতে চীন ও জাপানের চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য হল তার রেখাঙ্কন, পারসিক চিত্রের বৈশিষ্ট্য হল তার রেখা ও রং এবং ভারতের বৈশিষ্ট্য হল রঙের সুষম প্রয়োগ এডওয়ার্ডস ও গ্যারেটের মতে মুঘল যুগের চিত্রকলায় রেখ, রং, রঙের সুষম বিন্যাস- এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের অপূর্ব অঙ্গীভূতকরণ এবং সমন্বয় সাধন করা সম্ভব হয়েছে 'তারিখ--খান্দান -তৈমুর' এবং 'বাদশাহ নামা' গ্রন্থে এই ক্রমপরিবর্তনশীল লক্ষ্য করা যায় আচার্য যদুনাথ সরকার লিখেছেন "প্রথম গ্রন্থের ক্ষেত্রে চৈনিক রেখাঙ্কন পদ্ধতি কিছুটা নমনীয় রূপে গৃহীত হয়েছে এবং দৃশ্যাবলীতে ভারতীয় প্রকৃতির আভাস পরিস্ফুট হয়েছে দ্বিতীয়টিতে চৈনিক প্রভাব সম্পূর্ণভাবে তিরোহিত এবং ভারতীয় ধারার প্রভাত স্পষ্ট" কয়েকটি বিখ্যাত মুঘল চিত্র হল – i) দশরথের পুত্রেষ্ঠিঞ্জ ii) রাবনের সীতা হরণ ও জটায়ুবধ - বিষেন দাসের আঁকা iii) আকবরের বাল্যকালের ছবি - হামজা নামা; iv) 'বাদশাহ নামা'র পাতা পাশে আঁকা ছবিগুলি ইংল্যান্ডের প্রাসাদে সংরক্ষিত সংস্করণ, v) দারাশিকোর ছবির অ্যালবাম - ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত প্রভৃতি

ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ছিলেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পূজারী প্রকৃতির ঋতুবৈচিত্র্য, তার রূপ পরিবর্তন প্রভৃতি তিনি পরিদর্শন করতেন একাত্মমনে প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতি প্রেমিক হওয়া সত্ত্বেও বাবর কোন চিত্র অঙ্কন করেন নিন এল. বিনিয়ন মনে করেন যে, বাবর চিত্রশিল্পকে উন্নত করার জন্য কোন উদ্যোগ না নিলেও তাঁর দরবারে চিত্রশিল্পীরা পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন ফার্সী ভাষায় রচিত তাঁর আত্মজীবনীর রূপায়ণ থেকে অনুমান করা যায় যে, চিত্রশিল্প তখন সম্পূর্ণ অবহেলিত ছিল না তারমধ্যে তৈমুর বংশের সহজাত শিল্পবোধ ও শিল্পপ্রীতি আভাস ছিল না বলে তিনি এদেশে চিত্রকলার ক্ষেত্রে নবজীবনের প্রবর্তক হিসেবে কৃতিত্বের অধিকারী হয়ে আছেন

হুমায়ুনের ভাগ্যবিপর্যয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা –এরূপ অবস্থায় সিংহাসনচ্যুত হয়ে যাযাবর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয় তাঁর মত সৌন্দর্যপ্রিয় শিল্পের পূজারী মুঘল শিল্প রীতিতে কোন স্থায়ী ছাপ রেখে যেতে সমর্থ হয়নি কাকতালীয়ভাবে ধর্মীয় গোঁড়ামির জন্য পারস্যের শাহ তহমাস্প এর চিত্রকলার প্রতি অনীহা এবং একই সময়ে রাজনৈতিক প্রয়োজনে হুমায়ুনের পারস্যের অবস্থান, ভারতবর্ষে পারসিক চিত্রশিল্পীদের আগমনের পথ প্রস্তুত করে দেয় পারস্যের দুই বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী মির সৈয়দ আলী এবং আব্দুস সামাদের সাথে হুমায়ুনের পরিচয় হয় এবং কাবুলে তাঁর অস্থায়ী রাজধানীতে তাঁদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন সেখান থেকে হুমায়ু তাদের সঙ্গে করে দিল্লিতে নিয়ে আসেন এবং চিত্র সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করেন দিল্লীর সিংহাসন পুনর্দখল করার পর হুমায়ু পুত্র আকবরের চিত্রাঙ্কন শিক্ষা ও চিত্রকলা চর্চার জন্য এই দুই প্রথিতযশা শিল্পীকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র দপ্তর গড়ে তোলেন

স্থাপত্যের মতই মমতা ও একাগ্রতা দিয়ে সম্রাট আকবর চিত্রশিল্পকে লালন পালন করেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা এবং ভারত ভারতীয় চিত্রকলাকে পারসিক বা চৈনিক প্রভাবের দ্বারা উদ্বুদ্ধ করলেও তাকে বিশিষ্ট ভারতীয় চরিত্র দিতে সক্ষম হয় এস. এম. জাফর লিখেছেন "আকবর ভারতীয় চিত্রকলাকে পরানুকর -এর কলঙ্ক থেকে মুক্ত করে একে একটি নিরাপদ এবং দৃঢ় ভিত্তি দেন (Put on a safe and strong holding by removing the stigma of sacrilege attached is it)।" সমকালীন মুসলিম বিশ্বের দুই চিত্রকর খাজা আব্দু সামাদ, মির সৈয়দ আলী সহ বহু চিত্রশিল্পী তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় অমর শিল্পসৃষ্টি দ্বারা মুঘল চিত্রকলাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন বিনায়কের মতে প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্যের প্রতি আকবরের গভীর অনুরাগ ছিল প্রকৃতির বৈচিত্র এবং সৃষ্টিকর্তার উদ্ভাবনী শক্তির প্রতি ছিল তাঁর সীমাহীন আস্থা তাই ব্যক্তিগত গৌরব বৃদ্ধি বা কৃতিত্ব প্রদর্শন নয়, প্রকৃতির সহজাত সৌন্দর্যের প্রকাশ এবং সৃষ্টিকর্তার গৌরব বৃদ্ধির জন্যই আকবর চিত্রকলার প্রতি অনুরাগ দেখান ইসলাম নিয়মানুযায়ী মানুষের প্রতিকৃতি আঁকা নিষিদ্ধ ছিল সম্রাট আকবর এই নিষেধাজ্ঞার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রচারের ওপর জোর দেন চিত্রাঙ্কনের সমর্থনে নিজ যুক্তি প্রদর্শনের পর তিনি সরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় চিত্রকলা চর্চা শুরু করেন 'আইন--আকবরী' গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, 'আকবর চিত্ত্রাঙ্কনকে একাধারে শিক্ষা ও মনোরঞ্জনের মাধ্যম বলে বিবেচনা করতেন। যার কারণে চিত্রকলা চর্চায় সমস্ত ধরনের সাহায্য ও উৎসাহ দানে দ্বিধা করতেন না'

ফতেপুর সিক্রির নতুন রাজধানীতে বই লেখা, অনুবাদ করা, ছবি আঁকা ইত্যাদি উপর বিশেষ নজর দেন কুতব খানায় গুণি কাগজী লিপিশিল্পী দপ্তরীদের সঙ্গে তসবির খানার মোসাব্বির, মোঝাহেবদের কাজের চাপ বহুগুণ বেড়ে যায় আকবরের রাজত্বের প্রথমার্ধে মাত্র আট নয়টি চিত্রিত গ্রন্থ তৈরি হয়েছিল কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে তার সংখ্যা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৫৭০-৮৫ খ্রিস্টাব্দে মধ্যবর্তীকালে ফতেপুর সিক্রির দেওয়াl চিত্র অঙ্কনে ইন্দো-পারসিক চিত্রকলার সমন্বয় আরো স্পষ্ট রূপ লাভ করে। সামা ও মিরা  লি ছাড়া বহিরাগত খ্যাতিমান চিত্রকর হিসেবে ফারুক বেগ, খসরু কুলি প্রমুখের নাম স্মরণীয় হিন্দু চিত্রশিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শবন্ত, সা, কেশব, মুকুন্দ,‌ মিস্কি, জগন, মহেশ প্রমু আবুল ফজল তৎকালীন যে সতের জন অগ্রণী চিত্রকরের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে অন্ততঃ তের জন ছিলেন হিন্দু তাঁর মতে দশবন্তের প্রতিভা বায়াজিদ কিংবা চৈনিক চিত্রকরদের তুলনায় কোন কিছুতে কম ছিল না দৈবক্রমে একদিন আকবর এই আত্মনিমগ্ন শিল্পীর কাজ দেখতে পান, অল্পসময়ের মধ্যে দবন্ত তসবির খানার সেরা চিত্রকরদের মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠেন 'রজমনামা' গ্রন্থের অলঙ্করণে দশবন্তের প্রতিভার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। 'রজমনামা' ছাড়া আকবরের আমলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রাঙ্কিত পুস্তক হল- রামায়ণ, দিওয়ান, তারিখ-ই-কান্দাহারি, আকবরনামা, বাহারিস্তান, বাবরনামা ইত্যাদি আকবরের রাজত্বের শেষ পর্বের কিছু চিত্র নিদর্শন পাওয়া যায় – যোগবশিষ্ট, নাফাহাৎ -উল-উন্স এবং ইয়ার--দানিশ গ্রন্থের চিত্র বিবরণীর মধ্যে

 আকবরের মত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী না হলেও চিত্রকলা চর্চার ক্ষেত্রে আকবর যে ধারার সূচনা করেছিলেন জাহাঙ্গীর তাকে রঙে রূপে সুসজ্জিত ও সমৃদ্ধ করার কাজে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখান প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন চিত্রকলার সমঝোদার অনুরাগী নিজের আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন একাধিক চিত্রকরের আঁকা একই ধরনের বহু ছবি সামনে রাখলে আমি নিমেষে বলতে পারি কোনটি কোন চিত্রকরের আঁকা এমনকি একাধিক শিল্পী দ্বারা একটি মাত্র ছবি অঙ্কন করলে আমি বলতে পারি ছবির কোন অংশ কোন চিত্রকর এঁকেছেন ইংরেজ পর্যটক স্যার টমাস রো লিখেছেন যে, জাহাঙ্গীর ছিলেন উন্নতমনা চিত্রসংগ্রাহকবহু বিদেশী চিত্র তাঁর সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছিল তিনি বহু প্রখ্যাত চিত্রকে অবিকল নকল করিয়ে ও নিজ সংগ্রহে রেখেছিলেন আকবরের রাজত্বের শেষ পর্বে সম্রাটের উদ্যোগের বাইরে শাহজাদা সেলিম ও (জাহাঙ্গীর এর পূর্ব নাম) চিত্র চর্চার ক্ষেত্রে কিছু সফল উদ্যোগ নেন হীরাটি চিত্রকর আকারিজার তত্ত্বাবধানে সেলিম একটি চিত্রশালা গঠন করেন এবং অনন্ত, আবুল হাসান, বিষণ দাস প্রমূখ সহ চিত্রকরের সহযোগিতায় বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অলঙ্কনের কাজ সম্পন্ন করেন রাজকুমার এবং নিজামউদ্দিন ভির 'গজল ও রুবাইৎ' সংকলন গ্রন্থ দুটির চিত্র অলঙ্ক বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে 



চিত্রকলা নির্মাণে জাহাঙ্গীরের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন ফারুক বেগ, দৌলত, ওস্তাদ মনসুর, বিষণ দাস, আবুল হাসান, মহম্মনাদীর, মহম্মদ মুরাদ প্রমুখ সম্ভবত - নাদির ও মুরাদ ছিলেন মুঘল দরবারে শেষ দুই বিদেশী চিত্রকর দের মধ্যে সর্বাধিক অগ্রণী দুই শিল্পী ছিলেন ওস্তাদ মনসুর ও আবুল হাসান, যাদের কৃতিত্বের পুরস্কার স্বরূপ জাহাঙ্গীর যথাক্রমে 'নাদির ল আসর' এবং নাদির উল জামান অভিধায় ভূষিত করেছিলেন বিরল প্রজাতির পশু অসাধারণ পাখী কিংবা সচরাচর দেখা যায় না এমন ফুলের চিত্র অঙ্কনে মনসুর ছিলেন সিদ্ধহস্ত, কলকাতা যাদুঘরে সংরক্ষিত সাইবেরীয় সারস এবং বাংলার ফ্লোরিকানের ছবি দুটি তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ও অঙ্কন প্রতিভার অনন্য নিদর্শন আবুল হাসান ছিলেন অনেক বেশি অভিজাত শিল্পী, রূপকধর্মী চিত্রকলার বিকাশে তাঁর অবদান ছিল সর্বাধিক রঙ-এর সুষম ব্যবহার যে সামান্য চিত্রকে অসামান্য করে তুলতে পারে তা প্রমাণ করেছেন আকারিজার এই স্বনামধন্য পূত্র

 জাহাঙ্গীরের চিত্রকলায় পারসিক প্রভাব প্রায় লোপ পেয়ে খাঁটি ভারতীয় চরিত্র বিকাশ লাভ করে তাঁর আমলে চিত্রকলার পান্ডুলিপির প্রসঙ্গ চিত্রের পাশাপাশি বিশিষ্ট ব্যক্তি, গায়ক ও সাধারণ মানুষের প্রতিকৃতি অঙ্কিত চিত্রকরদের বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয় প্রকাশ বর্মা তাঁর 'ইন্ট্রোডাকশন অফ সেফ পোর্ট্রেট পেইন্টিং ইন ইন্ডিয়া' গ্রন্থের মুঘল আমলে প্রতিকৃতি অঙ্কন পারসিক ও প্রাক মুঘল ভারতীয় চিত্রকলা দ্বারা প্রভাবিত প্রাথমিক মুঘল রীতি তিন চতুর্থাংশ মুঘলচিত্রন জাহাঙ্গীরের আমলে লো পেয়ে যায় এবং তার স্থান দখল করে অর্ধ মুখচিত্র জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মজীবনীতে দক্ষ প্রতিকৃতি চিত্রবিদ হিসেবে বিষণ দাস ও আবুল হাসানের নাম উল্লেখ করেছেন মুখাবয়বের সজীবতা ও লক্ষণগত প্রবৃত্তির অভিব্যক্তিকে তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দেন তাঁ'গায়ক-বাদক ও অন্য' চিত্রটিতে এই সজীবতা স্পষ্ট ভাবে লক্ষ্য করা যায় সমসাময়িক উৎসব বা ঘটনাবলীর সাথে প্রতিকৃতি অঙ্কনের বহু নিদর্শন জাহাঙ্গীরের আমলে পাওয়া যায়জাহাঙ্গীরের রাজ্যাভিষেক, হোলি, দেওয়ালি, তুলাদান প্রভৃতি উৎসবে জনসমাবেশ ও শিকার দৃশ্য প্রভৃতি চিত্র নানা সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে শ্রী বর্মা লিখেছেন যে, সাধারণ মানুষের যথাযথ চিত্রণ ভারতীয় কলায় মুঘল চিত্রকরদের বিশেষ অবদান

 জাহাঙ্গীরের সময়েই মুঘল চিত্রকলা ইউরোপীয় চিত্র শিল্পের প্রভাব পড়ে তাঁর আমলে মুঘল চিত্রাঙ্কন পদ্ধতির আরেকটি অভিনবত্ব হল পাড় চিত্র। মুল ছবির সঙ্গে মিল রেখে পাড় চিত্রণের রেওয়াজ আকবরের আমলের ও ছিলদেওয়ান--হাফিজ পান্ডুলিপির অলঙ্কিত পাড়টি পাড় চিত্রণের প্রথম দৃষ্টান্ত। পরবর্তীকালে 'বাবরনামা' 'খামসা' ইত্যাদি পান্ডুলিপিতে পাড় চিত্রণের ক্রমবিকাশ ঘটে। জাহাঙ্গীরের আমলে চিত্রকলার এই স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে পাড় চিত্রণ বিকাশ লাভ করে

জাহাঙ্গীরের রাজত্বের শেষদিকে নূরজাহান বেগমের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় এবং এই পর্বে জাহাঙ্গীরের চিত্রকলা সম্রাটের গুরুত্ব ও কর্তৃত্বব্যঞ্জক এমন কিছু চিত্র অঙ্কন করেন যার সাথে বাস্তব ইতিহাসের মিল পাওয়া যায় না ওয়াশিংটনের আর্ট গ্যালারি, ডাবলিনের চেস্টাবেটি লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত কিছু চিত্রে দেখা যায় জাহাঙ্গীর ইরানের আব্বাসকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন কিংবা তার চিরশত্রু মালিক অম্বরের ছিন্ন মস্তকে আঘাত করছেন কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো পারস্যের শাহ্‌র সাথে তাঁর কখনো সাক্ষাৎ হয়নি, কিংবা মালিক অম্বর কখনোই জাহাঙ্গীরের প্রদানত হয়নি চিত্রায়নের এই ধারাটি ও অভিনবত্বের দাবি রাখে অধ্যাপক এ. কে. দাসের ভাষায় 'this feature of presenting the patron-emperor as an all powerful entity pampered by the gods, respected by the kings and loved and feared by the subjects was a new feature in the development of Mughal painting'.

প্রাক মুঘল ভারতীয় চিত্রকলার সঙ্গে চিত্রকরের নামাঙ্কন বা সাক্ষারদানের রীতি ছিল না এমনকি মুঘল যুগের প্রাথমিক পর্বে চিত্রগুলিতে যেমন 'হামজানামা' 'আনোয়ার--সুহেলী প্রভৃতিতে এই রীতির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় আকবরের আমলে চিত্রের সাথে তাঁর রূপকারের নাম বিশেষ গুরুত্ব পায় আকবর ও জাহাঙ্গীর চিত্রকলার উন্নয়নের জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রকরদের সম্মান প্রদান, পদোন্নতি বিধান বা আর্থিক পুরস্কার প্রদান দ্বারা উৎসাহিত করার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তাতে ছবির গুনাগুন বিচারের প্রয়োজনে চিত্রকরের নামাঙ্কন জরুরি হয়ে পড়েছিল এবং তা অনুসৃত হয়েছিল

 মুঘল স্থাপত্যের চরম উন্নতির কাল যেমন ছিল শাহজাহানের আমলে, তেমনি মুঘল চিত্রকলার চরম উৎকর্ষের কাল হিসেবে জাহাঙ্গীরের আমলকে স্মরণ করা যেতে পারে চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি, চিত্ররং ও রুপের বৈচিত্র সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মুঘল চিত্র রীতিকে পারসিক প্রভাব মুক্ত করে ভারতীয় করনের কাজেও তিনি ছিলেন সফল পার্সী ব্রাউন চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জাহাঙ্গীরের আন্তরিকতা ও অবদানের প্রশংসা করে লিখেছেন যে, 'জাহাঙ্গীরের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল কিন্তু তার ছিল শিল্পীর দৃষ্টি, যতদিন জীবিত ছিলেন তিনি ছিলেন মুঘল চিত্রকলার প্রাণস্বরূপ

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মুঘল চিত্রকলার গৌরব রশ্মি ও অস্তমিত হয় পার্সী বরাউল এর ভাষায় 'the real spirit of Mughal painting departed with the death of Jahangir'. শাহজাহান চিত্রকলার তুলনায় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের প্রতি ছিলেন বেশি আগ্রহী শাসনকালের সূচনাপর্বে চিত্রকলার প্রতি তাঁর যেটুকু অবদান ছিল পরবর্তীকালে তাও ফিকে হয়ে যায় শাহজাহানের আমলে মুঘল চিত্রকলার যে অবক্ষয়ের সূচনা হয় ঔরঙ্গজেবের আমলে তা পূর্ণতা পায় ফলে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভের জন্য শিল্পীদের মধ্যে অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয় অন্যদিকে বহু শিল্পী ধনী ও অভিজাত ব্যাক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় চিত্রাঙ্কন এর কাজ শুরু করেন জাহাঙ্গীর পর্যন্ত সময়কালে বাদশাহী আনুকূল্যে চিত্রকলার যে স্বাভাবিক ও বর্ণময় বিকাশ ঘটেছিল আলোচ্যপর্বে তা অসম্ভব হয়ে পড়ে ফলে বহু চিত্রকর ব্যক্তিগত উদ্যোগে চিত্রশালা চালিয়ে যান মুঘল ধারা থেকে স্বতন্ত্র হলেও দেশের দক্ষিণ সীমান্তে দুই মুসলিম রাজ্য বিজাপুর গোলকুণ্ডা চিত্র চর্চার ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিল

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস

    মার্টিন লুথার ছিলেন লুথা রিয়ান মতবাদের প্রবক্তা । জার্মানির স্যাক্সসনিতে ইসলিবেন নামে একটি গ্রামে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের জন্ম হয় । ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ইউটে ম বা র্গ চা র্চে র দরজায় তিনি তাঁ র ৯৫ তত্ত্ব ঝু লিয়ে দেন । এটি ছিল পোপের স্বর্গীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ । সমস্ত জার্মানির শিক্ষিত মানুষেরা লুথারের তত্ত্বে র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । এই ৯৫টি ছিল তাত্ত্বিক প্রশ্ন , এতে বাইবেল ও খ্রিস্টান দর্শন সম্বন্ধে তাত্ত্বিক গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রশ্ন ছিল । উইলিয়াম ওকামের চিন্তাভাবনা দ্বারা মার্টিন লুথার প্রভাবিত হয়েছিলেন । ইউরোপের এই চিন্তা ধারা পরিণত ছিল nominalism নামে । নমিনালিস্ট চিন্তাধারায় উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্বাস ও নিবেদিতপ্রাণতা । নমিনালিস্টরা মনে করত বিশ্বাসই মুক্তি আনবে , তবে এই বিশ্বাস অর্জনের জন্য শাস্ত্র পড়তে হবে এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের বোধগম্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করতে হবে । লুথার এইমতে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হওয়া উচিত এবং আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল রচনা করা একান্ত দরকার । তিনি খ্...