রেনেসাঁস
রিফর্মেশন পটভূমিতে নব্য বিজ্ঞান কিভাবে
মননগত পরিপক্কতা অর্জন করে যুদ্ধের রাজনীতির
এবং ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অভাবিত পরিবর্তনের চেয়ে অনেক
বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, তা আলোচনা
সাপেক্ষে একটা বিষয়। বিজ্ঞান চেতনার
এই অসামান্য বিকাশকে প্রকৃত অর্থে বৈপ্লবিক বলে মনে করেন জে. ডি. বর্নাল।
বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে বিপ্লব বলে অভিহিত করার প্রথম যুক্তি হ'ল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি বস্তু বিশ্বের বহু ধারণাকে
পাল্টে দিয়েছিল এবং মানুষকে শিখিয়েছিল যুক্তিবাদী হতে।
বৈজ্ঞানিক বিপ্লব জ্ঞানের জগতে দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। পাশাপাশি
প্রমাণ করতে পেরেছিল জ্ঞান ও বিবর্তিত হয়,
বিবর্তনের পথ ধরে নবচিন্তা ধারণা ও নব আবিষ্কারের অভ্যুদয় ঘটে। যুক্তিবাদ ও বিশ্ব রহস্যের প্রতি
আগ্রহ কোপার্নিকাসের মত বিজ্ঞানীকে
প্রভাবিত করেছিল। তিনি লিখেছিলেন
'on the revolution of the celestial bodies' আর ১৬৮৭ সালে
নিউটন লিখেছিলেন 'principia' কোপার্নিকাস
বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণ করেছিলেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। এই মত
এতদিনের খ্রিস্টান মতবাদকে উল্টে গিয়েছিল। আইজাক নিউটন 'প্রিন্সিপিয়া' প্রচার করেছিলেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তত্ত্ব।
প্রাচীন
গ্রীকদের কাছ থেকে আহরিত মননগত অনুমানের
ভিত্তিতে বিজ্ঞানচর্চার যে ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছিল তা ইসলামিক এবং খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিকদের
প্রতিরোধের ফলে নিস্তেজ ও বিকাশের সম্ভাবনা রহিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু রেনেসাঁসের সময়ে বিজ্ঞানচর্চা
এই মানসিক স্থবিরতার অবসান ঘটায়। শুরু
হয় বিজ্ঞানমনস্কতা যার প্রভাব ইউরোপীয়দের ভাবনা ও কর্মের প্রতিটি ক্ষেত্রে
অনুভূত হতে থাকে। মধ্যযুগের
খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকরা গ্রীকদের কাছ থেকে যে বিশ্ব ছবিটি আহরণ
করেছিলেন তা ছিল সীমিত এবং প্রবলভাবে ধর্মাশ্রয়ী। তার বদলে রেনেসাঁসে যে নতুন বিশ্ব দৃষ্টিটি
রচিত হলো তা পরিমাণাত্মক, বিচ্ছিন্ন কনিকাবাদী, অসীম বিস্তৃতির সম্ভাবনাপূর্ণ এবং
ধর্মনিরপেক্ষ। অ্যারিস্টোটলের
ক্রমোচ্চস্তরে বিন্যস্ত ব্রম্ভান্ডের স্থলাভিষিক্ত
হল নিউটনের টাইমমেশিন।
পশ্চিম
ইউরোপের মনোজগতের এই পরিবর্তন জ্ঞান সম্পর্কে নতুন ধারণার একটি লক্ষণ মাত্র। আগে মনে করা হত যে জ্ঞান চির
অপরিবর্তনশীল অটল, তাই
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে মানুষ একটা আপোষমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলে। পরম্পরাগত কিছু ধ্যানধারণাকে নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়াটাই ছিল রেওয়াজ। কিন্তু রেনেসাঁসের পরিবর্তিত
পরিস্থিতিতে জ্ঞানের নতুন অভিজ্ঞান হল এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি যার সাহায্যে
বিশ্বপ্রকৃতির শাশ্বত নিয়মগুলিকে জেনে নিয়ে মানুষটাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। বস্তুগত সম্পদ নিয়ে এই সময়ে
মানুষের যে নতুন আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তারই ফসল। রেনেসাঁসের কল্যাণেই অভিজাত
ও পন্ডিতিতত্ত্ব এবং অনভিজাত প্রয়োগ দক্ষতা ও
কর্মের মধ্যে বিচ্ছেদ বা দূরত্ব অনেকাংশে কমে যায়।
আগ্রহী, অনুসন্ধিৎসু পণ্ডিতরা
কারিগরদের বিভিন্ন পেশা নিয়েও চর্চায় আগ্রহী হতে শুরু করেন।
বিজ্ঞানীদের
আগ্রহ শুধু resolution এবং composition
প্রযুক্তিগত স্তরেই আবদ্ধ থাকেনি। মধ্যযুগের
জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা আবর্তিত হয় একটা কাঠামোর মধ্যে। শুধু বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে নয়, এটি
সামগ্রিক চিন্তাজগতেই বিপ্লব আনে। রেনেসাঁসের সময়ই বিজ্ঞান অনুশীলন কিন্তু এক ধরনের
সংস্কৃতি থেকে অন্য এক ধরনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছিল। ভাবজগতের ক্ষেত্রে যে বিপ্লব আধুনিক বিজ্ঞানের জননী স্বরূপ ছিল, সেখানে
কোন ছেদ পড়েনি, তা ছিল নির্বোধ, অসীম
সম্ভাবনার উদ্বেল। তবে যে
সমস্ত বিজ্ঞানী এই বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন তাঁদের
ভাবনা চিন্তা ও কর্মের সূত্রগুলি ঐতিহ্য থেকে আহরিত হয়েছিল। যদিও তাঁরা তার বিস্ময়াবহ রূপান্তর ঘটাতে পেরেছিলেন।
এদিক থেকে বলা যায় যে, নব্য
বিজ্ঞান চর্চাকে ঐতিহ্যের প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকার বলেও মনে করা সমীচীন।
অ্যারিস্টোটল, অ্যাপোলোনিয়াস, আর্কিমিডিসের শ্রেষ্ঠ গাণিতিক ঐতিহ্য,
ভাবজগতের প্লেটোর অবদান এদের প্রেরণা যুগিয়েছিল এবং প্রাচীন পণ্ডিতদের দ্বারা
অনুসৃত পদ্ধতিগুলির মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়ে রেনেসাঁসের সময়ে বিজ্ঞানীরা শ্রেষ্ঠতম কীর্তি রাখতে পেরেছিলেন যদিও সতেরো শতকের আগে তার পূর্ণ
রূপ দেখা যায়নি। বৈজ্ঞানিক
চিন্তাধারার মধ্যে আমুল বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন এনেছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন