মধ্যযুগের
ইউরোপের অবসানের পথ ধরেই একটু একটু করে নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করেছিল এক নতুন
ইউরোপ, আর তার লক্ষনীয় প্রকাশ ঘটে ছিল বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তির বিকাশ ও বিস্তারে। রেনেসাঁস
ও রিফর্মেশন নিঃসন্দেহে ইউরোপীয়দের মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং
সংস্কারের সম্মোহ থেকে মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু
তাদের মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটিয়ে আধুনিক মনস্ক করে তোলার সবচেয়ে বেশি
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল বিজ্ঞান বিপ্লব। 'দ্য অরিজিনস্ অফ মডার্ন সাইন্স' এ অধ্যাপক
বাটারফিল্ড দেখিয়েছেন যে, 'খ্রিস্টধর্মের অভ্যুদয়ের পর যা কিছু ঘটেছে তাকে নিষ্প্রভ
করে নিয়েছে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব'। এই বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে নিত্যনতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কার জড়জগৎকে বিধিসম্মত
পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় আনে, গাণিতিক
বিশ্লেষণের সাহায্যে প্রকৃতি ও পৃথিবীকে বুঝতে
সাহায্য করেছে, মানুষকে রক্ষণশীল দুর্জ্ঞেয়কে বিচার
বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে সক্ষম করেছে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ
শতকে রেনেসাঁসের সময় মানবতাবাদী লেখক গবেষকরা ধ্রুপদী
সাহিত্যের প্রতি পুনরায় আগ্রহ দেখাবার
ফলেই প্রাচীন গ্রীক বিজ্ঞানের পুনরুত্থান ঘটে। এর ফলে বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে অভাবনীয়
পরিবর্তন নতুন একটা বিজ্ঞান ভিত্তিক পদ্ধতি (scientific
methodology) এর উদ্ভব হয়। যাতে
করে গ্যালিলিও, উইলিয়াম হার্ভে, রবার্ট বয়েল, কেপলার
এবং আইজাক নিউটনের মতো বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকদের পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা
বিজ্ঞানকে বৈপ্লবিক করে তুলেছিল।
অনেক লেখকের মধ্যেই মধ্যযুগের বিজ্ঞান
চর্চাকে এভাবে বাতিল করা ঠিক হবে না রেনেসাঁস সম্পর্কে গবেষণা করার সময় অনেক
আধুনিক লেখক বলেছেন রেনেসাঁসের সময় মানবতাবাদী লেখকদের দ্বারা বৈজ্ঞানিক কৌতুহল
কোনভাবে বৃদ্ধি পায়নি।
মানবতাবাদী লেখকরা ধ্রুপদী সাহিত্য আবিষ্কারের নেশায়
মত্ত হয়ে তাঁরা প্রকৃতি সম্পর্কে মধ্যযুগের ও
পর্যবেক্ষণকে গ্রাহ্য করেননি। তাঁরা যাদুবিদ্যা ও
বিজ্ঞানকে একই দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন। গাছপালা জীবজন্তু এমনকি ধাতু পদার্থকেও তারা
প্রতীকী অর্থে অবলোকন করেছেন। ষোড়শ
শতকের মধ্যবর্তী সময়ে প্রাকৃতিক জগত সম্পর্কিত অনেকগুলি বই প্রকাশিত হয়েছিল। যে বইগুলিতে পশুপাখি উদ্ভিদজগৎ
এবং বিভিন্ন ধাতুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা ও চিত্র অঙ্কিত ছিল। সপ্তদশ শতকেই এই প্রকৃতিবিদ্যা থেকে প্রতীকী ব্যবহারকে পৃথক করা হয়, বিভিন্ন
প্রাণী ও উদ্ভিদের নিখুঁত অঙ্কনের জন্য চিত্রশিল্পী নিয়োগ করা হয়। আবার ভৌগোলিক
আবিষ্কারের জন্য সামুদ্রিক অভিযানের
নিত্য নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের প্রয়োজন হয়েছিল। এর জন্য
মানচিত্র প্রস্তুতকারী ও গণিতজ্ঞের চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে
শিল্পীরা প্রধানত প্রকৃতি সম্পর্কে বিশেষত মানুষের শরীরস্থান সম্পর্কে আগ্রহ
জাগিয়ে তুলেছিল। যুদ্ধের
প্রয়োজনে সামরিক ক্ষেত্রে সাজসরঞ্জাম তৈরিতে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর এবং প্রাত্যহিক
জীবনের নানান দ্রব্য উৎপাদনের
ক্ষেত্রে প্রয়োগ ঘটিয়ে শিল্পীরা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে সাহায্য করেছিল। এইসব ক্ষেত্রে মহোত্তম প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মিকেলাঞ্জেলো, লিওঁ বাতিস্তা আলবার্তি প্রমুখ। এই
যুগের শিল্প মূলত ছিল আকার নির্ভর ও রুপভাস নির্ভর। আলবার্তি বলেছেন যে, তারা যেন সবার আগে অস্তি - তারপরে
যে মাংস অস্তিকে বেঁধে রেখেছে তাকে এবং সবশেষে দেহের আবরণকে গুরুত্বদান করেন।
প্রাক
রেনেসাঁস অধ্যায়ে ইউরোপীয়রা বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার প্রতি উদাসীন ছিলেন না, তবে তারা এ বিষয়ে ইসলামিক জগতের কাছে ঋণী ছিল। আরবীয় পণ্ডিতরা গ্রিক
জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটিয়েছিলেন অনুবাদের মাধ্যমে। যার মাধ্যমে ইউরোপীয়রা পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান চর্চায়
আগ্রহী হয়ে ওঠে। ইউরোপীয়দের
অনুসন্ধিত্সু জ্ঞানের পিপাসাকে পরিতৃপ্ত করার ব্রত পালনে সাহায্য করে অ্যারিস্টোটল, ইউক্লিড, আর্কিমিডিস
প্রমুখের আরবী থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত
বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা। মানুষের সহজাত
জ্ঞানপিপাসার উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞান চেতনার উন্মেষ
শুরু হয়। জার্মান
পন্ডিত আলবার্টস ম্যাগনাস (১১৯৩-১২৮০)
অ্যারিস্টোটলের রচনার উপর ভাষ্য রচনা ছাড়াও ভূগোল,
জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদ ও চিকিৎসা এবং পদার্থবিদ্যা
বিষয়ে লেখার সময় অধিবিদ্যা পর্যবেক্ষণের সময় যাচাই
করে নিয়েছিলেন। অক্সফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রান্সিসকান ভিক্ষুকরা
বিজ্ঞানচর্চার সময় পরীক্ষালব্ধ তথ্যের উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আবার রজার বেকনের (১২১৪-১২৯৪) শিক্ষক
রবার্ট গ্রসটেস্ট (১১৭৫-১২৫৩) পদার্থবিদ্যা
এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান চর্চার প্রাথমিক সূত্রগুলির অনুসন্ধান করেছিলেন। বিজ্ঞানী রজার বেকন আলোকবিদ্যা (অপটিকস) শব্দ
তাপ বিষয়ক বিদ্যা, বর্ণতত্ত্ব, দর্শনানুগত বিদ্যা (perspective), বারুদের
ব্যবহার বিষয়ে মৌলিক রচনা করে পরীক্ষা নির্ভর বিজ্ঞানচর্চা এবং অস্পর্শিত বহু বিষয়ে বিস্ময়াবহ অনুসন্ধিৎসা প্রমান দেন। ম্যাগনাস, গ্রসটেস্ট,
বেকনের সঙ্গে আরও কয়েকজন সুখ্যাত বিজ্ঞান সাধকরা বহুবিচিত্র বিষয়ের উপর
আলোকপাত করে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সূত্রপাত ঘটিয়ে
রেনেসাঁসের সময়ে বিজ্ঞান চর্চার ভিত্তি প্রস্তুত করেন।
পঞ্চদশ
শতকের শেষের দিকে রেনেসাঁস আন্দোলন যখন তুঙ্গে ছিল তখনই বাণিজ্যের প্রচলিত
ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। নৌ
চলাচলের উন্নতি ঘটার ফলে ব্যয়বহুল
স্থলপথ ভিত্তিক বাণিজ্য সড়কগুলির তুলনায় যাতাযাত দ্রুত হয়। অল্প খরচে নতুন নতুন বাজারের
রাস্তা খুলে যায়। এই নৌ চলাচলের উন্নতির সবচেয়ে চমকপ্রদ ফল ছিল ইউরোপীয়দের
আমেরিকায় পদার্পণ। পঞ্চদশ শতকের
শেষে প্রাচ্য বাণিজ্যে একচেটিয়া অধিকার ছিল তুর্কিদের হাতে। কাজেই লোহিত সাগরকে এড়িয়ে অন্য
কোন নতুন সমুদ্র পথ বেয়ে ভারত মহাসাগরে পৌঁছানোর জন্য ইউরোপীয়রা উদগ্রীব হয়ে
উঠেছিল। ক্রিস্টোফার
কলম্বাস আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারের ফলে নতুন পথের
সূচনা হয় এবং কম্পাস প্রভৃতি যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় বৈজ্ঞানিক
জ্ঞানের প্রসার ঘটে।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে রেনেসাঁস পর্বে
বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসার নবযুগ শুরু হয়। গণিত হয়ে ওঠে নব বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রীয়
প্রেরণা। অবশ্য অনেক আগে
থেকেই ইউরোপীয় বিজ্ঞান সাধকরা জ্যামিতিক ও
বীজগণিতের সাহায্যে বহু physical phenomena -র রহস্য
উদঘাটন করে চলেছিল, পরে তার সঙ্গে যুক্ত হয় ক্যালকুলাস। আইজ্যাক নিউটনের 'principia' গণিত শাস্ত্রের পরিধির এবং সম্ভাবনার অসামান্য বিস্তারের দৃষ্টান্ত হিসেবে
সম্মানিত হয়ে থাকে। মধ্যযুগের 'কসমোলজি' বা 'সৃষ্টিরহস্য'
সংক্রান্ত ধারণা অ্যারিস্টোটল এবং টলেমির চিন্তাধারার কাছে ঋণী ছিল। অ্যারিস্টোটলই পদার্থবিদ্যা এবং সৃষ্টিরহস্যকে সম্মিলিত করে প্রমাণ করার
চেষ্টা করেছিলেন যে বিশ্বের কেন্দ্রে পৃথিবীর অবস্থান এবং তা স্থির ও অনড়। ত্রয়োদশ
শতকে টমাস একুইনাস তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থদ্বয় Summa
Theologica ও Summa philosophica Contragentiles এ গ্রিক
পন্ডিত অ্যারিস্টোটলীর জ্ঞানের সঙ্গে খ্রিস্টিয়
ধর্মতত্ত্বের সমন্বয় সাধনের প্রয়াস করেন। কিন্তু গ্যালিলিও, বয়েল এবং নিউটন 'ফরম' এর অস্তিত্ব অস্বীকার করে ঘোষণা করেন যে, বস্তু, অণু বা সূক্ষ্ম
কণিকার সমাহার মাত্র এবং সেগুলি কঠিন ও অভেদ্য এবং তারা অভিঘাত ও শক্তির দ্বারা
নিয়ন্ত্রিত হয়। এই বৈজ্ঞানিক
বিপ্লব একই সঙ্গে প্রাচীন
যুগ থেকে চলে আসা ইন্দ্রজাল বা যাদুবিদ্যার অন্তঃসারশূন্যতা ও প্রমাণ করে দেয়।
রেনেসাঁসের
বৈজ্ঞানিক প্রতিভার স্ফুরণ নানান দিকে ঘটলেও এযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক
উৎকর্ষের নিদর্শন পাওয়া যায় জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে। পোলিশ বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস এর
প্রধান আকর্ষণের বিষয় ছিল গণিত এবং জ্যোতি
বিজ্ঞান। যদিও
তিনি চিকিৎসা ও আইনশাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। কোপার্নিকাসের বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে
প্রধান অবদান কেবল মাত্র কয়েকটি মূল্যবান বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রতিষ্ঠা নয়, পরস্পরাগত প্রায় সর্বজনীন কিন্তু বিশ্বাসের ভ্রান্তি প্রমাণ করার জন্য। তাঁর
মৃত্যুর আগে প্রকাশিত 'on
the revolution of the heavenly spheres' (১৪৭৩ জ্যোতিষ্ক সমূহের কক্ষপথে
আবর্তন) এ তিনি এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেন যে
বিশ্বজগতের কেন্দ্রে অবস্থান সূর্যের,
জ্যোতিষ্ক গোলকসমূহ পৃথিবীকে নয়, সূর্যকে কেন্দ্র করেই
আবর্তন করে, এমনকি পৃথিবী ও
নিজে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। তাঁর আবিষ্কৃত এই সত্যের স্বীকৃতি সহজে হয়নি, কেননা মানুষের প্রতিদিনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল তার
একেবারেই বিপরীতে। তাঁর
সৌরকেন্দ্রিক জগতের তত্ত্ব পর্যবেক্ষণমূলক ও নিরীক্ষণ
নির্ভর বিজ্ঞান চর্চার পথ দেখিয়েছিল।
চার্চের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও গ্যালিলিওর মাধ্যমে কোপার্নিকাসের তত্ত্বের পূর্ণ
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ডেনিস
জ্যোতির্বিজ্ঞানী ট্রাইকো ব্রাহে কোপার্নিকাসের তত্ত্বকে স্বীকার করেননি। জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস
কেপলার গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি বিষয়ে মূল্যবান তথ্যের সন্ধান দেন। তিনি গাণিতিক প্রমাণের উপর
পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করেন যে টলেমির তত্ত্ব ভুল ছিল এবং কোপার্নিকাসের
তত্ত্ব ঠিক ছিল।
ষোলশ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে একটা নতুন
দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করেছিল ফ্লোরেন্সবাসী গ্যালিলিও গ্যালিলি। ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিলিও শুনেছিলেন
যে একজন ওলন্দাজ একটি কাঁচ আবিষ্কার
করেছেন যার সাহায্যে দূরের বস্তুকে কাছে দেখা যায়। এরপরে পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি ও পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক
গ্যালিলিও গ্যালিলি একক চেষ্টায় একটি দূরবীন যন্ত্র আবিষ্কার করেন। কোপার্নিকাসের ভক্ত এই বিজ্ঞানী দূরবীনের সাহায্যে দূর আকাশকে আরও
স্পষ্ট করে পর্যবেক্ষণ সম্ভব করে তোলেন। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে
তাঁর পর্যবেক্ষণ প্রসূত জ্ঞান লিপিবদ্ধ করেন 'তারকা জগতের দুত' নামক
গ্রন্থটিতে। গ্যালিলিও
জুপিটারের চারটি উপগ্রহের আবিষ্কার ও শনিগ্রহের বলয় লক্ষ করেন। চার্চ, সরকার
এবং রক্ষণশীল মানুষ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে যুগপোষিত ধারণাগুলি
এমন আকস্মিকভাবে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হওয়ায় ক্ষিপ্ত
হয়ে গ্যালিলিওর বিচার ও শাস্তিদানের উদ্যোগী হয়। ইতিপূর্বে জিওরদানো ব্রুনোকে এই ধরনের অপরাধের জন্য পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। কাম্পানেলাকে দীর্ঘকাল থাকতে হয়েছিল অন্ধকার কারাগারে। গ্যালিলিওর সৌভাগ্য যে তিনি
ক্যাথলিক ছিলেন বিপ্লবী ছিলেন। সুতরাং
নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করার প্রাণে বেঁচে ছিলেন তিনি। তবে সত্য ও সংস্কারের মধ্যে বিরোধ বাধলে সত্যকে পরাজয়ের অবমাননা থেকে
বাঁচাতে পারেননি রেনেসাঁস।
বৈজ্ঞানিক
বিপ্লবের যুগে সবচেয়ে প্রতিভাবান বলা হয়
আইজ্যাক নিউটনকে। পদার্থবিদ্যা
ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের একমাত্র গ্যালিলিওকে তার সমকক্ষ বলা যায়। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে নিউটন
মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কিত বৈশ্বিক নিয়মকে গণিতের অভ্রান্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত
করে গোটা পৃথিবীকে উচ্চকিত করেছিলেন। এরপর
আলোর গতি প্রকৃতি, পদার্থবিদ্যা
এবং দৃষ্টি ও আলোক সংক্রান্ত বিষয়ে যে গবেষণা করেন সেগুলি সুহৃদয় এডমন্ড হ্যালি
উৎসাহে এবং উদ্যোগে রয়েল সোসাইটির
পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয় ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে the
mathematical principalies of natural philosophy এবং opticks
নামক
মাধ্যাকর্ষণ সংক্রান্ত মৌলিক রচনার দুটি অসামান্য কৃতিত্বের অভিজ্ঞান হিসেবে
চিহ্নিত হয়ে আছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের
বহু অতি জটিল বিষয়কে একটা শৃঙ্খলা বা পদ্ধতির মধ্যে সুবদ্ধ করে দিয়েছেন। রেনেসাঁসের সময় থেকে যে বিজ্ঞান
অনুশীলনের ধারা প্রবাহিত হচ্ছিল নিউটন তার
একটা পর্বকে পূর্ণতা দেয়।
মধ্যযুগের যাজকেরা চিকিৎসাশাস্ত্রকে
কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে তুলেছিলেন।
পরবর্তীকালে রেনেসাঁসের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও যথেষ্ট উন্নতি
লাভ করে। চিকিৎসা
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটান সুইস জার্মান বৈজ্ঞানিক প্যারাসেলসাস (১৪৯৩-১৫৪১)। রোগের লক্ষণ দেখে চিকিৎসা ও নিদান
সম্পর্কিত ধারণা তিনি পাল্টে দিয়েছিলেন। কেমোথেরাপি
বা রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে চিকিৎসা তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এবং সালফার লেড, আর্সেনিক, পারা, তুঁতে, আফিম ও অ্যালকোহলের
ব্যবহার তিনি চালু করেন। রসায়নের
ক্ষেত্রে তাঁকে দস্তা ধাতুর আবিষ্কর্তা বলা
হয়। ইরাত্রো-
রসায়নে প্যারাসেলসাসের পরেই
উল্লেখযোগ্য জার্মানির লিবাভিয়াস (Libavius ১৫৪০-১৬১৬) এবং
হল্যান্ডের ভ্যান হেলমন্ট (Van Helmont ১৫৭৭-১৬৪৪) চিকিৎসাশাস্ত্র
ছাড়াও গ্যাস নিয়ে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। শরীর তত্ত্ব
সম্পর্কে ইংল্যান্ডজাত পাদুয়ায় শিক্ষিত উয়িলিয়াম
হার্ভের (১৫৮৭-১৬৫৭) গবেষণাই যুগান্তরকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে। শরীরস্থান শাস্ত্রে ইতালির পরস্পরাগত বিদ্যার সঙ্গে তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণার সমন্বয় ঘটিয়ে
ছিলেন। মানবদেহে
রক্ত যে চলাচল
করে তা প্রমাণ করলেও অতি সূক্ষ্ম যেসব কৌষিক
রক্তবাহ বেয়ে রক্ত প্রবাহিত হয় তা উপযুক্ত যন্ত্রের
অভাবে বিশদ করা হার্ভের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৬২৪ খ্রিস্টাব্দে অণুবীক্ষণ
যন্ত্রের সাহায্যে তা দেখান মালাপিগি। অবশ্য
হার্ভের কিছু ঋণ ছিল বেলজীয় শল্যচিকিৎসক ভেসালিয়াসের (১৫১৪-৬৪) কাছে। ভেসালিয়াসের লেখা 'The
structure of human body' ছিল শরীরতত্ত্ব বিষয়ে আকর গ্রন্থ।
ভেসালিয়াসের সমসাময়িক ফরাসী
চিকিৎসক আঁব্রোয়াজ পারে (১৫১০-৯০)
শল্যবিদ হিসাবে সুখ্যাত ছিলেন। পুঁথিগত
বিদ্যায় শিক্ষিত না হলেও পারে ছিলেন শরীরতত্ত্ব
শাস্ত্রে স্বশিক্ষিত এবং শল্যবিদ্যায় অসামান্য পারদর্শী। তাঁর পুস্তিকা 'De
Motu Cordis et Sanguinis' শরীরতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রে যুগান্তর
এনেছিল।
বিজ্ঞান ও যাদুবিদ্যা ভিন্ন জগতের হলেও আধুনিক কাল পর্যন্ত তাদের ছিল
সহাবস্থান। এমনকি
ফলিত বিজ্ঞান ও যাদুবিদ্যার মৌলিক পার্থক্য সম্পর্কেও মানুষের সচেতনতা ছিল কম। যাদুবিদ্যা যে যুক্তি সম্মত নয়
তাও সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। ১৬০৫
খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত advancement of learning গ্রন্থে রজার বেকন যাদুবিদ্যা সম্পর্কে তাঁর গভীর
অনাস্থার কথা লেখেন। তিনি বলেন
বিজ্ঞান চর্চার মধ্যে কোনও রহস্যজনক
গোপনীয়তা থাকবে না, তাহলে প্রকাশ্য ও অবাধ সব ধরনের
দৃষ্টিভঙ্গি সম্মানিত হবে। বেকন আরও বলেন যে, অবরোহী
পদ্ধতিতে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তথ্য ও উপাত্তের উপর নির্ভর করে বিজ্ঞানের
বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গবেষণা পরিচালিত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তিনি এভাবেই বিজ্ঞানকে বস্তুগত
উৎপাদনের অগ্রগতির সঙ্গে যুক্ত করে দেন। সপ্তদশ
শতকে ও যাদুবিদ্যার প্রভাব অনেকটাই ছিল বিজ্ঞানের বিখ্যাত ঐতিহাসিক জে. ডি. বার্ণাল এর
ভাষায় “science is not only ordered technique, it is also
rationalised mythology”. ফলিত বিজ্ঞানকে কৃত্রিম যাদুবিদ্যা
হিসাবে দেখলেই রেনেসাঁস যুগের বিজ্ঞান ও যাদুবিদ্যার সম্পর্ক বোঝা যাবে।
বৈজ্ঞানিক বিপ্লব সামাজিক বিন্যাসও
পাল্টে দিয়েছিল। মধ্যযুগে এমনকি
ধ্রুপদী
অধ্যায়েও শিল্পী, স্থপতি, ভাস্কর সাধারণভাবে কারিগররা, দু'একটি ব্যতিক্রম
ছাড়া সমাজের বিশেষ মর্যাদা পেতেন না।
রেনেসাঁসের সময়ে বিজ্ঞানচর্চার ফলে উপকৃত প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবিত উন্নতির কারণে কারিগরি
শিল্পেও নতুন মাত্রা সংযোজন ঘটে। মধ্যযুগে পরম্পরাগত বিদ্যা এবং পণ্ডিতদের পুঁথিগত জ্ঞানের মধ্যে সুস্পষ্ট
বিভাজন রেখা তাদের সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যের দ্যোতক হয়ে
উঠেছিল। কিন্তু
রেনেসাঁস বিজ্ঞানচর্চার ব্যবহারিক দিকের অভাবিত উন্নতি ও প্রসারের ফলে সমাজ নিজপ্রয়োজনেই কারুশিল্পীদের সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে তৎপর হয়ে ওঠে। সপ্তদশ শতকের শেষ ও অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় রূপকথা, যাদুবিদ্যা প্রভৃতির অস্তিত্ব হীনবল হয়ে পড়ল। এই নতুন
বৈজ্ঞানিক দর্শনের ফলে মানুষ তার ধর্মীয়
বিশ্বাসকে ও নতুন আকার দিতে বাধ্য হয়েছিল। নিউটন কোপার্নিকাসের মত প্রোটেস্ট্যান্ট
বৈজ্ঞানিকরা ও অন্যদিকে গ্যালিলিও ও ডেকার্ত এর মত
ক্যাথলিক বিজ্ঞানীরাও খ্রিস্টীয় সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে আবিষ্কৃত পদ্ধতিগুলির
সমন্বয় ঘটাতে চেয়ে ছিলেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন