সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ধর্ম ও রাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে ঔরঙ্গজেবের চিন্তাভাবনা

 

 

 

মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব আলমগীর (১৬৫৮-১৭০৭) ছিলেন একজন গোঁড়া সুন্নী সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমান ইসলামের আদর্শ অনুযায়ী যেকোনো মুসলিম রাষ্ট্র ধর্মাশ্রয়ী, প্রকৃত শাসক হলেন ঈশ্বর এবং সম্রাট বা সুলতান হলেন তার প্রতিনিধি মাত্র যিনি সেইসব শক্তিমান ঈশ্বরের আইন অনুসারে শাসন পরিচালনা করতে দায় বদ্ধ ইসলামের দর্শন অনুযায়ী একজন প্রকৃত ইসলাম বিশ্বাসীর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হল ঈশ্বর নির্দেশিত পথে জিহাদ ঘোষণা করা এবং দার- উল- হার্ব কে  দার –উ- ইসলামে পরিণত করা এই আদর্শেই রঙ্গজেব ভারতবর্ষে তাঁর ধর্মীয় নীতিকে পরিচালিত করেছিলেন

ঔরঙ্গজেবের ধর্ম সম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনা ও কাজকর্মকে দু'ভাগে ভাগ করা যায় যথা - ১৬৫৮-১৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দ এবং ১৬৬৯-১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ ইসলামের রক্ষক রঙ্গজেব ১৬৫৮ -১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে এক নির্দেশনামা জারি করে কোরা বিরোধী বিভিন্ন প্রথা নিষিদ্ধ করেন মুদ্রার ওপর কলিমা খোদাই করা নিষিদ্ধ করেন কারণ বিধর্মীদের হাতে পড়ে তা অপহৃত হবার সম্ভাবনা ছিল পারস্যের রীতি অনুসারে মুঘল দরবারে এতকাল প্রচলিত নওরোজ (নববর্ষ) অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করেন সারাদেশে ভাঙ চাষ নিষিদ্ধ করেন। মুহতাশিব নামক কর্মচারী নিয়োগ করে তাদের ওপর কোরানের আইন যাতে সারা দেশে অনুষ্ঠিত হয় তা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় জুয়া খেলা, মদ্যপান, পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি বন্ধের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় এদের ওপর মুসলমানরা যাতে যথারীতি নামাজ পড়ে বা রমজানের উপোস পালন করে তা দেখা এবং কোরা বিরোধী কর্মে রত মুসলমানদের শাস্তির ব্যবস্থা, সঙ্গীত কারদের ভাতা দানের ব্যবস্থা, অভিজাতদের মধ্যে সাক্ষাতের মুহূর্তে হিন্দু প্রথায় নমস্কারের পরিবর্তে ইসলামীয় প্রথায় 'সালাম আলেকুম' বলা বাধ্যতামূলক করা হয় দোলের সময় রাজপথে হৈ-হুল্লোড়সহ গান এবং মহরমের মিছিল ও বন্ধ করে দেওয়া হয় হিন্দুদের সতীদাহ বন্ধ করার বিষয়ে সরকারি কর্মচারীদের সতর্ক করে দেওয়া হয় কিন্তু সম্রাটের কঠোর নির্দেশ সত্ত্বেও এই সকল আদেশের অনেকগুলি অকার্যকর হয়ে থেকে ছিল

গোঁড়া সুন্নী মুসলমান ঔরঙ্গজেব মোল্লা, মৌলভী অ উলেমাদের উদারভাবে সাহায্য দান করেন। ৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর 'মহজারনামার' দ্বারা উলেমাদের যে ক্ষমতা খর্ব করেছিলেন তিনি তা ফিরিয়ে দেন দের জন্য সম্রাট রাজকোষের প্রচুর অর্থ ব্যয় ও নিষ্কর জমি দান করেন এদের পরামর্শে ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু মন্দির, ধর্মস্থান ও বিদ্যায়তনের জন্য বরাদ্দ অর্থ বা জমি নাকচ করে দেন রঙ্গজেব উলেমাদের খুশি করার জন্য মসজিদ, খানকা, দাতব্য প্রতিষ্ঠান সংস্কার করেন ইরফান হাবিব The Agrarian system in Mughal India (p-311) বইতে বলেছেন সম্রাট ঔরঙ্গজেব মুসলিম ধর্মগুরু অ যাজকদের বংশানুক্রমিকভাবে বহু নিষ্কর জমি দান করেন।" আতাহার আলি তাঁর 'The Mughal Nobility under Aurangazeb' (p-99) গ্রন্থে বলেছেন "রাজনৈতিক বিষয়ে উলেমাদের প্রভাবের বিরুদ্ধে অভিজাত ও মুসলমানদের (মহাব খাঁ, মির্জা প্রমূখ) প্রতিবাদ রঙ্গজেব অগ্রাহ্য করেন  

ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল হিন্দু মন্দির ধ্বংসের প্রচেষ্টা তাঁর পিতার আমলের এক নির্দেশ জারী করে হিন্দুদের নতুন মন্দির নির্মাণ নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং কিছু অসম্পূর্ণ মন্দির ভেঙে দিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেবও তাঁর রাজত্বের প্রথম বছরে বেনারসের জনৈ ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত এক ফরমানে স্বীকার করেছিলেন যে 'পবিত্র ইসলামীয় আইন অনুসারে প্রাচীন মন্দিরের ওপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না, তবে কোনো নতুন মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হবে না" কিন্তু রঙ্গজেবের এই সহনশীলতা ক্রমে হ্রাস পায় এবং ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে এক আদেশ জারী করে পৌত্তলিকদের সমস্ত শিক্ষায়তন ও ধর্ম প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার এবং তাদের ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ ও শিক্ষা বন্ধ করার নির্দেশ দেন প্রাদেশিক শাসকরা সম্রাটের নির্দেশকে কার্যকরী করতে তৎপর হন ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দির এবং পরের বছর মথুরার বিখ্যাত কেশব রায় মন্দির ধ্বংস করা হয় এবং ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে তোলা হয় এক বিশাল মসজিদ Elliot and Dowson তাঁদের গ্রন্থে মন্দিরের মূর্তিগুলির প্রতি ধ্বংসকারীদের আচরণ এবং মূর্তির পরিণতি সম্পর্কে যে বিবরণ দিয়েছেন তা ঔরঙ্গজেবের চূড়ান্ত ধর্মীয় অনুদারতা এবং গোঁড়ামির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা পক্ষে যথেষ্ট ঔরঙ্গজেব তাঁর উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ধর্মান্ধ আব্দুল নবীকে মথুরার ফৌজদার নিয়োগ করে ষোলকলা পূর্ণ করেন।  ১৬৭৯-৮০ খ্রিস্টাব্দে মেবারের ছোট-বড় প্রায় ২৪০ টি মন্দির ধ্বংস করা হয়

 আতাহার আলি (medieval India), ফারুকী (Aurangzeb), পার্সিভাল স্পিয়ার্ (Oxford history of India), সতীশ চন্দ্র (mughal religious policies) প্রমুখের মতে রঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংসের পেছনে ধর্মনৈতিক উদ্দেশ্যের চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল কারণ রাজত্বের শুরুতে রঙ্গজেব নির্বিচারে সব মন্দির ধ্বংস করেন নি পরবর্তীকালে জাট ও মারাঠাদের সঙ্গে বিরোধ শুরু হলে রঙ্গজেব বিরোধীদের পর্যুদস্ত করার জন্য শাস্তি হিসাবে তাদের অঞ্চলের মন্দিরগুলি ধ্বংসের নির্দেশ দেন বি. এন. পান্ডে 'Islam and Indian culture' গ্রন্থে বলেছেন রঙ্গজে রাজনৈতিক কারণে যেমন মন্দির ভেঙেছেন তেমনি মসজিদ ও ভেঙেছিল তাই মন্দির ভাঙার কাজকে ধর্মীয় দিক দিয়ে বিচার না করে রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার করা উচিত।'

ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল 'জিজিয়া' করের পুনঃপ্রবর্তন মুসলমানদের ওপর ঔরঙ্গজেব কর্তৃক 'জিজিয়া' পুনঃপ্রবর্তনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল 'ইসলামের সম্প্রসারণ' এবং 'পৌত্তলিকদের দমন' 'জিজিয়া' নির্ধারণের ক্ষেত্রে অমুসলমান প্রজাদের তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয় ১০ হাজার দিরহাম এবং তদূর্ধে যাদের আয় তারা ছিল প্রথম শ্রেণীভুক্ত এবং তাদের দিতে হত বার্ষিক ৪৮ দিরহাম দ্বিতীয় শ্রেণী ভুক্ত ছিল ২০০ থেকে ১০ হাজার দিরহাম আয়ের ব্যক্তিগণ এবং তাদের দিতে হত ২৪ দিরহাম ২০০ ও তার থেকে কম আয়ের সম্পন্ন ব্যক্তিরা ছিল তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত এবং তাদের প্রদেয় বার্ষিক 'জিজিয়া' কর ছিল ২২ দিরহাম কাফী খাঁ'র মতে এই করের বিরুদ্ধে অ-মুসলমানদের মধ্যে দুঃখ ক্ষোভ সঞ্চারিত হয় প্রথমে তারা ঝারোখা নীচে সম্রাটের কাছে এই কর তুলে নেবার অনুরোধ করে কিন্তু সম্রাট তাদের আবেদনে কর্ণপাত করেননি ধর্মান্ধ সম্রাট মত্ত হস্তী ও যুদ্ধ ঘোড়া চালিয়ে প্রতিবাদী মানুষকে পিষ্ট করেছেন

ঔরঙ্গজেবের 'জিজিয়া' কর পুনঃপ্রবর্তনের উদ্দেশ্য নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে কাফী খাঁ ও মানুচীর মতে ঔরঙ্গজেব ইসলামের প্রসার ও বিধর্মীদেরকে দমন করার উদ্দেশ্যে 'জিজিয়া' কর চাপিয়েছিলেন মানুচী লিখেছেন যে, 'জিজিয়ার চাপ এবং সরকারি কর্মচারীদের নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় বহু হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।' ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার এই বিশ্লেষণ সঠিক বলে মনে করেন না সরকারি নথিপত্র, মিরাত-ই- আহমদী গ্রন্থে ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় উদ্দেশ্যের কথা স্বীকার করা হয়েছে তাছাড়া ইউরোপীয় তুরস্কেও সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির জন্য 'জিজিয়া' করের প্রচলন হয়েছে প্রায় পৌনে দুশো বছর পরে আসলে এর পেছনে ছিল গভীর অর্থনৈতিক কারণ দেশের নানা প্রান্তে নিরন্তন যুদ্ধ-বিগ্রহ ও স্থানীয় বিদ্রোহে রাজকোষ শূন্য হয়ে গিয়েছিল সতীশচন্দ্র বলেছেন ঐতিহাসিক নিরীক্ষণের আলোকে এটি বিশ্বাসযোগ্য নয় যে অমুসলমানদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার জন্যই ঔরঙ্গজেব 'জিজিয়া' কর বলবৎ করেছিলেন

ঔরঙ্গজেব 'জিজিয়া' কর ছাড়াও হিন্দুদের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একাধিক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হল ১৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এক আইন জারি করে হিন্দু ও মুসলমান ব্যবসায়ীদের প্রদত্ত বাণিজ্য শুল্কের মধ্যে তারতম্য ঘটানো মুসলমান বণিকেরা তাদের বাণিজ্য পণ্যের উপর ২% হারে শুল্ক দেবে কিন্তু হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই হার হবে ৫% পরে ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে মুসলমান বণিকদের উপর থেকে শুল্ক তুলে দেওয়া হলেও হিন্দুদের উপর শুল্ক একই ছিল হিন্দু ধর্মে ধর্মোপলক্ষ্যেই মেলার আয়োজন হয় ধর্ম পালন, ভাববিনিময়, আনন্দ উপভোগের সাথে সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য চলে নানা অঞ্চলের মানুষের মিলিত মেলা প্রাঙ্গণে ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে আইন জারী করে সকল মেলার আয়োজন বন্ধ করে দেন ১৬৭১ খ্রিস্টাব্দে আদেশ জারির মাধ্যমে করণিক, হিসাবরক্ষক প্রভৃতি প থেকে হিন্দুদের সরিয়ে মুসলমানদের নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয় ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে এক নির্দেশ দ্বারা সম্রাট রাজপুত ব্যতীত অন্যান্য হিন্দুদের ক্ষেত্রে পালকি চড়া, হাতি বা ঘোড়ায় চড়া এবং প্রকাশ্যে অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করেন 

 ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতি সাম্রাজ্যের পক্ষে ভীষণভাবে ক্ষতিকারক হয়েছিল মূলত দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে ঔরঙ্গজেব তাঁর ধর্মনীতি স্থির করেছিলেন; ইসলামের শুদ্ধিকরণ এবং অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলামের প্রসার হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য শাস্তির ভয় বা সম্পদের লোভ দেখালেও ধর্মান্তরিতদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য মাসির-ই- আলমগীরি'র লেখক বলেছেন যে, সম্রাট কর্তৃক 'প্রকৃত বিশ্বাসে'র প্রতি আস্থা বিদ্রোহী রাজাদের প্রচন্ড ধাক্কা দিয়েছিল এবং সন্ত্রস্ত হয়ে তারা দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল রাজস্থান, মালব, বুন্দেলখন্ড, খান্দেশ প্রভৃতি স্থানে সম্রাটের আদেশে মন্দির ধ্বংসের বিরুদ্ধে জনমত সোচ্চার হয়েছিল সম্রাটের ধর্মীয় অনুদারতা অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ দেশের নানা স্থানে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠেৎনামী, জাঠ, বুন্দেলা, শিখ প্রভৃতি নানা সম্প্রদায় মূলত ধর্মকে সামনে রেখেই স্ব স্ব গোষ্ঠীর মানুষকে বিপ্লব মুখী করে তুলতে সক্ষম হয়

 রঙ্গজেবের ধর্ম ও হিন্দু বিদ্বেষী নীতি তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থে বা সংকীর্ণ ইচ্ছাবোধ দ্বারা চালিত হয়ে গ্রহণ করেননি বলে সম্প্রতি কোন কোন লেখক মনে করেন কোরানের প্রতি তাঁর প্রশ্নহীন আস্থা থেকে আকবরের মত অনুসন্ধিসা তাঁর কাছে কোরানের বাণীর প্রতি 'অনাস্থা নামান্তর' বলে বিবেচিত হয়েছিলতিনি সহজ-সরল, অনাড়ম্বর জীবন যাপনে বেশি সুখ পেতেন টুপি সেলাই করা বা পবিত্র কোরান নকল করার মত কষ্টকর ক্রিয়া তিনি নিয়মিত সম্পাদনা করতেন তাই তাঁকে সমসাময়িকরা 'জিন্দাপীর' বা 'বাদশাহের ছদ্মবেশে দরবেশ' উপাধিতে ভূষিত করেন ১৬৮১ থেকে ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে দুটি বাদশাহী ফরমানে বৈষ্ণবদের ম নির্মাণের জন্য রঙ্গজেব কর্তৃক ভূমিদানের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা থেকে তাঁর পরধর্ম প্রীতির পরিচয় পাওয়া যায় 'জিজিয়া' কর পুনঃপ্রবর্তনের প্রসঙ্গে অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মনে করেন যে, ঐতিহাসিক নিরীক্ষণের আলোকে এটি বিশ্বাসযোগ্য নয় যে অমুসলমানদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার জন্যই ঔরঙ্গজেব 'জিজিয়া' কর বলবৎ করেছিলেন। দেশের বৃহত্তর অংশে ৪০০ বছর ধরে মুসলিম শাসন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও হিন্দুরা দৃঢ়ভাবে তাদের ধর্ম বিশ্বাস আঁকড়ে ছিল কাজটি প্রতিক্রিয়ামূলক হলেও এর পেছনে গভীর অর্থনৈতিক কারণ কাজ করেছিল অর্থাৎ নিছক ধর্মীয় গোঁড়ামীর দ্বারা পরিচালিত হয়ে তিনি জিজিয়া পুনঃস্থাপন করেননি

 আকবরের মত সমন্বয়বাদী চেতনা বা সহিষ্ণুতা হয়তো রঙ্গজেবের ছিল না, কিন্তু তিনি যে পুরোপুরি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই মুঘল সাম্রাজ্যের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করাকেই তিনি সম্রাটের প্রধান কর্তব্য বলে বিবেচনা করতেন তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীকরণ জোরালো করতে আগ্রহী হয়েই বিজাপুর গোলকুণ্ডা গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিলেন, 'শিয়া' বিরূপতার কারণে নয় হিন্দু ও অন্যান্য অ-মুসলমান ধর্ম সম্প্রদায়ের বা শাখা সংগঠনের উদ্দেশ্যে সরকারি অনুদান বা অন্যান্য সাহায্য প্রদান করেছিলেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে তাঁকে এমন কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যা প্রধানত হিন্দুদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল

পরিশেষে বলতে পারি যে, ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির স্বপক্ষে উপস্থাপিত যুক্তিগুলির সার্থকতা স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় যে তাঁর নীতি রাষ্ট্রের স্বার্থে সহায়ক হয়নি একটি বহু জাতি ও ধর্ম সম্বলিত রাষ্ট্রে সংখ্যালঘিষ্ঠের ধর্ম সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা কখন সুফলদায়ী হয় নামহান আকবর এই সত্য উপলব্ধি করে ধর্ম সমন্বয় বা ধর্ম সহিষ্ণুতার নীতি অনুসরণ করেছিলেন শাহজাহান ব্যক্তিগত গোঁড়ামি সত্ত্বেও  অ-মুসলমানদের ওপর কঠোর নীতি প্রয়োগে দ্বিধান্বিত ছিলেন কিন্তু রঙ্গজেব সেই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেননি ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মনে করেন সপ্তদশ শতাব্দীর ভারতীয় পরিস্থিতি চতুর্দশ বা পঞ্চদশ শতাব্দীর মত ছিল না, ঔরঙ্গজেব তা মনে রাখেন নি পারস্পরিক একতাকামী ও সহিষ্ণু শক্তিগুলির বুদ্ধি বিকাশ ঘটেছিল এবং আকবরী ঐতিহ্য ততদিনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল যুগোপযোগী না হওয়ার কারণে তাঁর ধর্মনীতি সাম্রাজ্যের সর্বস্তরেই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস

    মার্টিন লুথার ছিলেন লুথা রিয়ান মতবাদের প্রবক্তা । জার্মানির স্যাক্সসনিতে ইসলিবেন নামে একটি গ্রামে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের জন্ম হয় । ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ইউটে ম বা র্গ চা র্চে র দরজায় তিনি তাঁ র ৯৫ তত্ত্ব ঝু লিয়ে দেন । এটি ছিল পোপের স্বর্গীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ । সমস্ত জার্মানির শিক্ষিত মানুষেরা লুথারের তত্ত্বে র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । এই ৯৫টি ছিল তাত্ত্বিক প্রশ্ন , এতে বাইবেল ও খ্রিস্টান দর্শন সম্বন্ধে তাত্ত্বিক গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রশ্ন ছিল । উইলিয়াম ওকামের চিন্তাভাবনা দ্বারা মার্টিন লুথার প্রভাবিত হয়েছিলেন । ইউরোপের এই চিন্তা ধারা পরিণত ছিল nominalism নামে । নমিনালিস্ট চিন্তাধারায় উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্বাস ও নিবেদিতপ্রাণতা । নমিনালিস্টরা মনে করত বিশ্বাসই মুক্তি আনবে , তবে এই বিশ্বাস অর্জনের জন্য শাস্ত্র পড়তে হবে এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের বোধগম্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করতে হবে । লুথার এইমতে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হওয়া উচিত এবং আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল রচনা করা একান্ত দরকার । তিনি খ্...