সপ্তদশ শতকে
উত্তর ভারতে কৃষক বিদ্রোহগুলির উৎস কতদূর মুঘল কৃষি ব্যবস্থার প্রকৃতিতেই নিহিত ছিল?
মুঘল যুগে কৃষক বিদ্রোহের বর্ণ ধর্মের ভূমিকা কতখানি ছিল?
মুঘল কৃষিব্যবস্থা: অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মুঘল সাম্রাজ্য একটি সমঝোতার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সংস্থান কৃষকের হাতে রেখে বাড়তি উৎপাদন যতটা সম্ভব সংগ্রহ করা হত - যার সিংহভাগ পেত আর কিছুটা যেত জমিদারদের ভাগে। বস্তুতপক্ষে কৃষকদের শ্রমই ছিল মুঘল যুগে শোষক শ্রেণীর বিপুল ঐশ্বর্যের উৎস। এই শ্রমজাত উদ্বৃৎ নির্দিষ্ট আইনানুগ রাজস্ব এবং নানা ধরনের আবওয়াব বা বেআইনি করের মাধ্যমে সংগৃহীত হত। জাবত বন্দোবস্তে আকবরের সময় রাজস্বের পরিমাণ খাতায়-কলমে উৎপন্ন শস্যের এক-তৃতীয়াংশ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে কৃষককে দুই-তৃতীয়াংশই রাজস্ব হিসেবে দিতে হত কেননা রাজস্ব আদায় করা হত রাষ্ট্র - নির্ধারিত নির্দিষ্ট টাকার হারে। (যেহেতু শস্য তোলার মরসুমে – বাজারে রাষ্ট্র নির্ধারিত নির্দিষ্ট হারের চেয়ে শস্যের দাম কম থাকত সেহেতু কৃষকদের উৎপন্ন শস্যের বৃহদাংশই নির্দিষ্ট দেয় অর্থের জন্য বিক্রি করতে হত)। ঔরঙ্গজেবের সময় কৃষকদের কাছ থেকে ভূমি রাজস্ব হিসেবে উৎপন্ন শস্যের দুই-তৃতীয়াংশ আদায় করা হত। রাষ্ট্র নির্ধারিত রাজস্বের চড়া হার এবং আবওয়াবের পার্শ্বিক চাপে মুঘল অর্থনীতিতে কৃষকদের অবস্থা উত্তরোত্তর শোচনীয় হতে থাকে। প্রথমেই যে সমঝোতার কথা বলা হল (কৃষকদের ন্যূনতম সংস্থান বজায় রেখে শোষণ) সপ্তদশ শতকীয় শেষেই তা ভেঙ্গে যায় বলে ইরফান হাবিব মনে করেন। জায়গীরদারদের শোষণ এবং রাজস্বের বাড়তি দাবি কৃষকের গ্রাসাচ্ছাদনে হাত দেয়।
কৃষকদের
উপর চাপ বৃদ্ধির সাথে সাথেই কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন শ্রেণি যেমন - জায়গীরদার, জমিদার এবং কৃষকদের মধ্যেও বৈরিতার সম্পর্ক শুরু হল। সপ্তদশ শতকের মুঘল অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রব্যবস্থায়
এই ভারসাম্যহীনতাকেই সংকট বলে চিহ্নিত করা হয়েছে যার মূলে অবশ্যই ছিল কৃষি সংকট। এই
সংকট সৃষ্টির জন্য যদুনাথ সরকার ঔরঙ্গজেবের অনুদান ধর্মনীতি এবং তার ফলে সৃষ্ট
হিন্দু বিদ্রোহ দমনের জন্য অসংখ্য যুদ্ধ-বিগ্রহকে দায়ী করলেও আধুনিক ঐতিহাসিক
আলোচনায় তার এই মত
প্রত্যাখ্যিত হয়েছে। বস্তুতপক্ষে সংকট ও তার সৃষ্টিকে অত সহজভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না; এর পশ্চাদে বেশ
কয়েকটি কারণ (কারনের ধাপ) কাজ
করেছিল। বস্তুতপক্ষে
লেলিন প্রদশিত তিনটি লক্ষণের আলোকে মুঘল কৃষি সংকটের উৎপত্তি ও প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা
করা যেতে পারে। লক্ষণ তিনটি হল – i) শোষক শ্রেণীর
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং পুরনো কায়দায় শাসন করতে না পারা; ii) শোষিত শ্রেণী আরো
বেশি শোষিত এবং শোষণ সম্বন্ধে
সচেতন এবং iii) শোষিত শ্রেণীর
পুঞ্জিভূত ক্রোধকে বাস্তবায়িত করার জন্য একটি সংগঠন বা নেতৃত্বের উপস্থিতি।
কৃষি সংকট:- মুঘল
রাষ্ট্রব্যবস্থায় সম্পদের সিংহভাগই শোষক শ্রেণীর অতি নগণ্য অংশেরই আয়ত্তে ছিল। মনসব অনুযায়ী প্রাপ্ত
জায়গীরের মাধ্যমে মুঘল শাসক শ্রেণীর সদস্যরা
উদ্বৃত্ত সম্পদের অংশ পেত। কিন্তু
প্রায়ই দেখা যেত যে নির্দিষ্ট জায়গির থেকে
নির্ধারিত রাজস্ব (জমা) আদায় (হাসিল) হচ্ছে না। মুঘল
সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে
স্থানীয় বহু শক্তিকে শোষক শ্রেণীর মধ্যে আনতে হল। যেমন - মারাঠা শক্তিকে
দমনের জন্য ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের মারাঠা সর্দারদের 'মনসব' ঘুষ
দিয়ে নিজের পক্ষে আনার চেষ্টা করেন। ফলে
তাঁর রাজত্বের শেষ ২৯ বছরে এক হাজারি বা তার উপরে মনসবদারদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬৭; আকবরের সময় যা ছিল ১৩৩। মনসবদারের
সংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধির
পাশাপাশি যুদ্ধ জনিত কারণে উৎপাদন হ্রাস, জায়গীরের অভাব, জায়গীরে নিম্নতম কর্মচারীদের দুর্নীতি ও ইজারাদারদের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়ার
ফলে জায়গীর থেকে আয় না হওয়া ইত্যাদি ফলে শাসনব্যবস্থা এক অসহনীয় অবস্থার
সম্মুখীন হয়। কৃষিভিত্তিক
উৎপাদনের স্থিতাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শাসকগোষ্ঠীর বিশাল সম্প্রসারণ, উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষকদের ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করল এবং
সমৃদ্ধ অঞ্চলে জায়গীর পাবার চেষ্টায় মুঘল আমিররা বারবার
নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে থাকেন। মামুরি লিখেছেন
''পৃথিবী জায়গীর শূন্য এবং কোন 'পায়বাকি' অবশিষ্ট নেই।'' ঔরঙ্গজেব নিজে খেদোক্তি করেন, 'ইয়েক আনার সদ বিমার’ (একটি
বেদনা ও একশত অসুস্থ লোক)। ইনায়েৎ উল্লার
রচনাতেও এই সংকট স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। শাসকশ্রেণীর
এই সংকটকালীন অবস্থায় তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ইরানি, তুরানি
ও হিন্দুস্থানীদের মধ্যে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়। খাফি খান, সাকির খান, ইবাদৎ খান, ভিমসেনের রচনায় জায়গীরকে কেন্দ্র করে অভিজাতদের মধ্যে
বিরোধের কথা স্পষ্টভাবে জানা যায়। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সিংহাসন
নিয়ে অন্তহীন লড়াই উদ্বৃত্ত সম্পদের জন্য
শাসকশ্রেণীর নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার
প্রতিফলন মাত্র বলে ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্র মনে করেন।
মুঘল
শাসকশ্রেণীর এই সংকট শোষিত শ্রেণী কৃষকদের
প্রচন্ডভাবে আঘাত করল। দুটি ভাবে কৃষি
এবং কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হল – ১) জমা ও হাসিলের প্রভেদ
কমাবার উদ্দেশ্যে চালু করা 'মাহওয়ারা’ পদ্ধতির
জন্য শাহজাহানের আমল থেকেই জাগীরদারদের বদলির
হার বাড়তে লাগল। ফলে কোন
জায়গীরদারই কৃষির
উন্নতির দিকে নজর দিতেন না, কৃষকদের
উপর চাপ সৃষ্টি হলে তার কোন কিছু এসে যেত না, বরং
তার ধাক্কা সামলাতে হত পরবর্তী জায়গীরদারদের। জাগীরদারদের এই মনোভাবের কথা ফরাসী পর্যটক
বার্নিয়ের এবং ভীমসেনের রচনা থেকে পাওয়া যায়। ১৬৩৪ সালে রচিত 'মজহর-ই-শাহজাহানি'তে সিন্ধু
প্রদেশের জায়গীরদার আহমেদ বেগ খান ও তার ভাইয়ের সম্পদ, বিলাসব্যসন এবং শোষণের চিত্র
অঙ্কিত, মুবাকাৎ -ই- হাসান থেকে
উড়িষ্যার দেওয়ান হাসিমের অত্যাচারের
বিবরণ পাওয়া যায়। শেষোক্ত
গ্রন্থের লেখক লিখেছেন - আমার পক্ষে
রায়তদের অভিযোগ বলা অসম্ভব। স্ত্রী-পুত্র বিক্রয় করে তারা কোনোক্রমে দেহ ধারন করে
আছে। এছাড়াও শস্যের দামের
হেরফেরের সুযোগ নিয়েও জায়গীরদাররা অত্যধিক মুনাফা লাভ করত (ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে
গুজরাটের ঘটনা)।
মানুচ্চি লিখেছেন 'ধনী হবার আশায়
তারা 'জায়গীরদাররা' লুট করতে ও অত্যাচার করতে শুরু করল। খুফিয়ানবিশ ওয়াকিয়ানবিশ
(গুপ্ত সংবাদ সংগ্রাহক) তারা
ঘুষ দিতে শুরু করল যাতে করে রাজার কানে সংবাদ না পৌঁছায়।' দাক্ষিণাত্যে মুঘল সৈন্যের সামরিক
অভিযানের চরিত্র খাফি খান এইভাবে বর্ণনা করেছেন 'আবাদি
জমি ও শস্যময় ক্ষেত্রকে তারা চোখের নিমেষে ধ্বংস
করেছে এবং ঘোড়ার খুরে জমি সমান করে দিয়েছে।' গুজরাট প্রসঙ্গে গেলিন সেন লিখেছেন যে, রাজস্বের
চাপে নির্যাতিত কৃষকরা প্রায়ই পালিয়ে যায় বা কর দেয় না; ফলে
বহু জমি অকর্ষিত পড়ে থাকে রাজস্ব আদায়ও কমে
যায়।
জায়গীরদারি
ব্যবস্থায় কৃষকদের আরো ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলেছিল
ইজারাদারি ব্যবস্থার প্রচলন। যেহেতু জায়গীরদারদের পক্ষে জায়গীর
থেকে অর্থ আদায় করা প্রতিদিনই কষ্টকর হয়ে উঠেছিল, তাই তারা
বার্ষিক একটি নির্দিষ্ট আয়ের পরিবর্তে জমি
থেকে রাজস্ব আদায়ের হার একশ্রেণীর মানুষের হাতে ছেড়ে দিত যাদের ইজারাদার বলা হত। শহরে ব্যবসায়ী, মহাজন, শক্তিশালী
জমিদার থেকে ইজারাদার নিযুক্ত হত (মূলত অন্য
গ্রামে)।
প্রধানত তাকেই ইজারা দেওয়া হত যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব সংগ্রহের প্রতিশ্রুতি দিতে
পারত এবং জায়গীদারকে প্রথমে
এককালীন 'থোক' নগদ টাকা দিত। এই কৃত্রিম
প্রতিযোগিতার ফলে 'জমা'র প্রকৃত হার অনেক বেড়ে গেল এবং ইজারাদাররা তাদের আসল ফিরে পাওয়া ও লাভ করার জন্য কৃষকদের কাছ থেকে যথেচ্ছ
হারে রাজস্ব দাবি করতে লাগল। ইজারাদারদের
অমানুষিক শোষণের কথা খাফি খা ও মানুচ্চি প্রমূখের বর্ণনা থেকে জানা যায়। 'রিসালা -ই –জিরায়তে' বাংলাদেশ মুসতাশিব বা
ইজারাদারদের কার্যকলাপের বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে রাজস্ব সংগ্রহের কঠোরতার
জন্য রায়তরা পালাল, পরগনা জনশূন্য
হল এবং জমিদার ধ্বংস হল।
জায়গীর বদল ও ইজারাদারি ব্যবস্থা প্রচলনের ফলে কৃষকদের উপর অর্থনৈতিক চাপ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি
পাওয়ায় তাদের কাছে বাঁচবার পথ ছিল দুটো – এক, সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করা।
ওলন্দাজ কোম্পানির প্রতিনিধির কাছে ভারতীয় কৃষকদের সহিষ্ণুতা বিস্ময়কর বলে মনে
হয়েছিল। মুকুন্দরাম
মনে করতেন যে, পাপের ফলেই
প্রজারা অত্যাচারিত হত। গৌতম
ভদ্র লিখেছেন যে, ব্যাপক
অত্যাচার না হলে সাধারণ কৃষক চেতনায় প্রতিরোধের ধারণা অস্পষ্ট ছিল। দুই, বিস্তর
অত্যাচারের মাত্রা সীমা অতিক্রম করলেই নিজেদের বাঁচার তাগিদেই কৃষকদের প্রতিরোধ করতে হত। প্রতিরোধের প্রথম অবস্থা ছিল চাষবাস
ত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া। বার্নিয়ের'র রচনায়, মুকুন্দরামের
আত্মজীবনীতে (মামুদ শরীফের অত্যাচারের কারণে), ঘনরামের ধর্মমঙ্গল কাব্যে (অষ্টাদশ
শতক) তারিখ –ই- ফিরিস্তাতে কৃষকদের এককভাবে
বা ব্যাপকভাবে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য কোন স্থানে পালানোর নিদর্শন মেলে। চন্ডীমঙ্গলের কাহিনী থেকে জানা
যায় যে, গ্রামবাসীরা গ্রাম প্রধানের নেতৃত্বে
যৌথভাবে কলিঙ্গ থেকে গুজরাটে গমন করেছিলেন।
মুঘল
যুগে কৃষক বিদ্রোহ: চড়া রাজস্বের
হার, নানা ধরনের আবওয়াব এবং সেগুলি
আদায়ের জন্য জায়গীরদাররা ইজারাদারদের যৌথ শোষণের যাঁতাকলে
পিষ্ট মুঘল যুগীয় কৃষকদের প্রতিরোধের শেষ অস্ত্র
ছিল সশস্ত্র বিদ্রোহ। 'রাইয়তি সরকশথে'র কথা মুঘল দলিলে বারবার উল্লেখিত। গুজরাটে মুঘল গ্রামকে দু'ভাগে ভাগ করা হত – ক) রাসতি বা শান্ত এবং খ) মেওয়াসি বা বিদ্রোহী। আইন-ই-আকবরীতে
বিভিন্ন জায়গায় কৃষকদের প্রতিবাদী মনোভাবের
উল্লেখ পাওয়া যায়। মানুচ্চি এবং পর্তুগীজ
পর্যটকদের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রাজস্ব
না দেওয়া এবং সেই কারণে অত্যাচার সহ্য করা কৃষকদের কাছে প্রশংসনীয় ছিল। বস্তুতপক্ষে অত্যন্ত চড়া হারে রাজস্ব দেওয়ার
ক্ষেত্রে কৃষকদের একটি স্বাভাবিক অনীহা ছিল। অষ্টাদশ শতকের শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধি শাহ
ওয়ালিউল্লাহ লিখেছেন – "কৃষক, বণিক ও
কারিগরদের উপর প্রচন্ড কর চাপানো হচ্ছে এবং অত্যাচার করা হচ্ছে। ফলে যারা ভীরু তারা পালাচ্ছে আর
যারা ক্ষমতাশালী তারা বিদ্রোহ করছে"। মুঘল আমলে সংঘটিত এই কৃষক বিদ্রোহগুলির
প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের পূর্বে
বিদ্রোহগুলির একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা ও বিবরণ দেওয়া হল।
সমস্ত
মুঘল যুগ ধরেই অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের
প্রতিষ্ঠাতা তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন "বহু জায়গায় সমতল ভূমি কাঁটা-ঝোপের দ্বারা এতদূর
আবৃত যে পরগনার জনসাধারণ তাদের আশ্রয়ের জন্য সেই বনের উপর নির্ভরশীল হয় এবং সেই দুর্ভেদ্য
আশ্রয়ের উপর ভরসা দেখেই বিদ্রোহ করে এবং রাজস্ব দিতে অস্বীকার করে।" আকবরের রাজত্বকালে মুঘল সম্রাজ্য
সম্প্রসারনের যুগে হিন্দু সামন্ত ও জমিদাররা প্রায় ২৯টি বিদ্রোহ করেছিল; পাশাপাশি আফগান, গুজরাটি মুসলমান, আমির
ইত্যাদি পুরনো সুবিধাভোগী শাসক শ্রেণীও ৭৯টি
ক্ষেত্রে বিদ্রোহ করেছিল; বলাবাহুল্য
স্থানীয় জনমানস এই বিদ্রোহগুলিতে শামিল হয়েছিল। ১৫৬২-১৫৭৭ এ আগ্রার কৃষকরা
হাঙ্গামা করেছিল, ১৫৮৬ ও ১৫৯২
কাশ্মীরে কাসিম খানের বিরুদ্ধে কৃষকরা খাজনা না দেওয়ার প্রতিবাদে বিদ্রোহ করেছিল। তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে আগ্রায়
বিদ্রোহ হলে মোয়াজ্জম তা দমন করেছিলেন। ১৫৯২ তে
থাট্টায় কৃষক বিদ্রোহ দমনের জন্য আব্দুর রাজ্জাককে পাঠানো হয়েছিল।
১৬১১ খ্রিস্টাব্দে কনৌজ ও কালপির কৃষক বিদ্রোহ দমন করেছিলেন আব্দুর রহিম খান ই খানান। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে কুতুব খানের নেতৃত্বে
পাটনার নিম্নবর্গীয় লোকেদের বিদ্রোহ ও
নিষ্ঠুর হাতে দমন করা হয়েছিল। পাইক সর্দার সনাতনের
নেতৃত্বে খুন্তাঘাট ও হাতিখেদা বিদ্রোহ দমন করেছিলেন মির্জা নাথানের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী। ১৬১৮ খ্রিস্টাব্দে সোহান কুলি নামে এক রাজপুরুষ কৃষকদের
সাহায্যে বিদ্রোহ করেছিলেন। ১৬২০
সালে কিসওয়ার অঞ্চলে জমিদার ও কৃষকদের আরেকটি সম্মিলিত বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। 'পেশকশী' জমিদারদের বিদ্রোহের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল শাহজাহানের
আমলে বুন্দেলাদের বিদ্রোহ। উপজাতীয়
এবং প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনের নিদর্শন হল আকবরের আমলে সংগটিত উত্তর-পশ্চিম
সীমান্তে আফ্রিদি, ইউসুফজাই প্রভৃতি পাঠান
উপজাতিদের 'রোশানিয়া
আন্দোলন' (বায়াজিদ
আনসারী এই আন্দোলনের পরিচালক ছিলেন যিনি নিজেকে 'পীর-উ-রুশন' বা আলোর গুরু বলে মনে করতেন)। সুতরাং বলা যায় যে মুঘল রাজত্বের শুরু থেকেই রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে
প্রতিরোধ আন্দোলন চলছিল; ঔরঙ্গজেব বা তাঁর উত্তরাধিকারীদের আমলে যার তীব্রতা ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি
পেয়েছিল। প্রাক ঔরঙ্গজেবের আমলে
প্রতিরোধ আন্দোলনের কয়েকটি সুস্পষ্ট রূপ দেখা যায় - এক, বিশুদ্ধ কৃষক বিদ্রোহ (সনাতনের নেতৃত্বে খুন্তাঘাট বিদ্রোহ) দুই, বিশুদ্ধ সামন্ত বিদ্রোহ (ঝুঝর
সিংহর পেশকশী বিদ্রোহ) তিন, জমিদার ও কৃষক বিদ্রোহ (কিসওয়ার
বিদ্রোহ) এবং চার, উপজাতিদের
মধ্যে বিদ্রোহ যেখানে ধর্মীয় উন্মাদনা জড়িত (আফ্রিদিদের
রোশানিয়া আন্দোলন)। ঔরঙ্গজেব ও তাঁর
উত্তরাধিকারীদের আমলের বিদ্রোহগুলিতেও একই রূপের সন্ধান পাওয়া যায়।
ঔরঙ্গজেব ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের আমলে অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ ঘটেছিল। ১৬৮০-৮৫ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের
মাতিয়া নামক ধর্মীয় সম্প্রদায় বিদ্রোহ করেছিল। কেননা
এই সময়ের অর্থনৈতিক অবনতি কারিগর, ছোট
বণিক ও কৃষক মাতিয়াদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এছাড়া গুজরাটের কোলি কৃষকরা মাঝেমাঝেই বিদ্রোহ করত। এই বিদ্রোহের পেছনে কাজ করেছে উদ্বৃত্ত সম্পদের উপর সর্দারদের
অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা, কোলি
কৃষকদের উপর আমিন ও ফৌজদারদের অত্যাচার
এবং সেইসঙ্গে সম্প্রদায় হিসেবে বর্ণ ব্যবস্থায় উচ্চতর
স্থান পাবার
অভিলাষ। ১৬৭০-৮০
সালে আমেথি অঞ্চলে ধর্মের উপর ভিত্তি করে
কৃষকরা জমিদার বিরোধী আন্দোলন করেছিল। মুঘল
রাষ্ট্রশক্তি এখানে জমিদারদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রবল অর্থনৈতিক সংকটের মুহূর্তে কৃষকদের সঙ্গে শিকদাএরর পেয়াদার সংঘর্ষের ফলে শুরু হয় সৎনামী বিদ্রোহ। গরিব দাস হাডার নেতৃত্বে দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে ছোট
ব্যবসায়ী ও গ্রামীণ কারিগররাও এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। এখানে প্রতিবাদী ধর্ম সম্প্রদায়ের (হিন্দু ফকির বা সৎনামী) সংহতি
ও চেতনা বিদ্রোহীদের মনে এক আদর্শবাদ হিসেবে
কাজ করেছিল। ১৬৬৯ ও ১৬৮৬ সালে জাঠরা (যারা মূলত ছিল
কৃষিজীবী) বিদ্রোহ করে যাদের নেতৃত্ব দেয় দিল্লি
ও মথুরা অঞ্চলের জমিদাররা। জাতিগত
আনুগত্য জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে সংহতি এনেছিল। জমিদার
গোকলা পরে রাজারাম ও চূড়ামন জাঠ মুঘল
কেন্দ্রীয় শক্তির বিবুদ্ধে প্রতি
কৃষকদের বিরোধী মনোভাবকে সার্থকভাবে কাজে লাগিয়ে ক্রমে গড়ে তুলেছিলেন ভরতপুর রাজত্ব, মুঘল রাষ্ট্রশক্তি যাকে
পরবর্তীকালে স্বীকার করে নেয়। জমিদারদের
নেতৃত্বে কৃষকদের অপর একটি বিদ্রোহের নিদর্শন হল ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় শোভা
সিংহ'র বিদ্রোহ। বর্ণ ব্যবস্থায় উপরে ওঠার চেষ্টায় শোভা
সিংহ এই বিদ্রোহ করেছিলেন অসন্তুষ্ট বাগদী কৃষক
ও পাঠানদের সাহায্য নিয়ে। ১৬৭০-৮০ এরমধ্যে উদ্বৃত্ত সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঘটক ও অন্যান্য আফগান উপজাতিদের
সঙ্গে মুঘলদের বিরোধ বাঁধে এবং
স্বাভাবিক কারণেই আফগান উপজাতিগুলির রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এছাড়াও ১৬৮০-৮১ সালে মেবার ও
মারওয়ারের পেশকশী জমিদার বা আধা স্বাধীন জমিদাররা বিদ্রোহ করেছিল (রাঠোর ও
শিশোড়িয়া গোষ্ঠী)। একইভাবে দাক্ষিণাত্যের মারাঠা আন্দোলনের সাফল্যের পেছনে
স্থানীয় ছোট-বড় জমিদাররা বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল বলে মুজাফফর আলম মনে করেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, যখনই কোন বিদ্রোহ বা আঞ্চলিক আন্দোলন মুঘল শক্তিকে
অস্বীকার করার স্পর্ধা দেখিয়েছিল তখনই জমিদাররা সেই আন্দোলনে সামিল হয়। অষ্টাদশ
শতকের প্রবল অর্থনৈতিক সংকটের মুখে নিপীড়িত কৃষক শ্রেণী বিভিন্ন সময়ে মারাঠা
আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, যদিও এমন ভাবার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই যে মারাঠা সর্দাররা শোষিত কৃষকদের খুব বন্ধু
ছিল। শিখদের আন্দোলনও শুরু হয়েছিল একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠাকামী সম্প্রদায়ের নেতার
উদ্যোগে, যাতে মঘল কেন্দ্রীয়
শক্তি কাছ থেকে কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা আদায় করা যায়। যদিও পাঞ্জাব, হিমাচল
প্রদেশে বসবাসকারী জাঠ কৃষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই মুঘল বিরোধী আন্দোলনে যোগ
দিয়েছিল।
কৃষক বিদ্রোহের প্রকৃতি:
১) নেতৃত্ব (জমিদারদের ভূমিকা):- উৎপাদন ব্যবস্থার চরিত্রগত বিচ্ছিন্নতা তথা আঞ্চলিকতার
কারণে কৃষকরা কখনোই একটি সুনির্দিষ্ট শ্রেণী হিসেবে প্রতিভাত হতে পারত না; ফলে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য
প্রয়োজনীয় সংগঠন তৈরি ও নেতৃত্ব দানের কথা ভাবাও তাদের পক্ষে শক্ত ছিল। কিন্তু মুঘল যুগে অনেক ক্ষেত্রেই
স্থানীয় জমিদাররা কৃষকদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিল। উদাহরণস্বরূপ কিসওয়ার বিদ্রোহ, জাঠ বিদ্রোহ, শোভা সিংহের বিদ্রোহ ইত্যাদি অগণিত বিদ্রোহের কথা বলা যেতে পারে। বস্তুতপক্ষে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের
সিংহভাগ (শিরিন মুসভির গবেষণা
অনুসারে জমিদাররা পেতেন উদ্বৃত্ত সম্পদের এক
পঞ্চমাংশ) রাষ্ট্রের পক্ষে জায়গীরদাররা লাভ করার ফলে রাষ্ট্র তথা জায়গীরদারদের সঙ্গে জমিদারদের
বিরোধ বাধত। মুঘল দলিলে
বহুবার 'জমিনদারানে জোরতলব' কথাটি
উল্লেখিত হয়েছে অর্থাৎ খাজনা দানে অস্বীকার করে জমিদারদের বিদ্রোহী হওয়া
নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। সান্দিলা, বিজাপুর, মুজাফফরগড় ইত্যাদি অঞ্চলের জমিদাররা মুঘল সৈন্যবাহিনী না
পাঠালে রাজস্ব দিতেন না বরং অন্য জমিদারদের প্রাধান্যে রাজস্ব লুট করতেন। কৃষক বিদ্রোহের প্রাথমিক স্তরের
বা মালগুজারি জমিদারদের নেতৃত্ব দেবার কতগুলি সুবিধা ছিল – প্রথমত, কৃষকদের সঙ্গে সমগোষ্ঠীভুক্ত বা সমজাতিভুক্ত হওয়ার জন্য তাদের মধ্যে একটি সামাজিক সম্পর্ক
ছিল। দ্বিতীয়ত, জমিদাররা ছিল
গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে একাত্ম, যেখানে জায়গীরদাররা ছিল বাইরের লোক; ফলে আঞ্চলিক
ক্ষেত্রে সমর্থন জমিদাররাই পেত। তৃতীয়ত, কতিপয় সৈন্য ও মাটির কেল্লার অধিকারী জমিদাররা মুঘল শক্তিকে প্রাথমিকভাবে বাধা দানের
ক্ষমতা ছিল। তবে এমন ভাবার
কোন কারণ নেই যে, মুঘল
রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে জমিদাররা সর্বদাই কৃষকদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই
করেছিল। আগ্রা ও
আলীগড়ে জমিদার ও কৃষক একসঙ্গে লড়েছে। আলোয়ারের মেওঘাটে নানা
জাতির জমিদাররা সমবেত হয়ে লড়াই করলেও কৃষকরা
তাদের সুবিধামত জমিদার বা জায়গীরদারদের সমর্থন
করেছে। আজমির
বা রনথম্বোর অঞ্চলের কৃষকরা সরাসরি জমিদার বিদ্রোহের বিপক্ষেও দাঁড়িয়েছে। ফলে মুঘল রাষ্ট্রব্যবস্থার
বিরুদ্ধে জমিদারদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কৃষকরা সর্বোদাই আন্দোলন করেছিল ইরফান হাবিবের এই
একমাত্রিক ছককে সম্পূর্ণভাবে
স্বীকার করা যায় না।
২) কৃষক বিদ্রোহগুলিতে বর্ণ ও
ধর্মের ভূমিকা:- মুঘল অর্থনীতির উপর
বিশিষ্ট গবেষক ইরফান হাবিব তাঁর রচনায় প্রমাণ
করতে চেয়েছেন যে, রাজস্ব বৃদ্ধির
প্রতিক্রিয়া স্বরূপই মুঘল যুগে কৃষক
বিদ্রোহগুলি সংঘটিত হয়েছিল। এগুলির ক্ষেত্রে
একজোট হবার চরিত্র, কৃষকদের চেতনা, গুজব, ন্যায়বোধ প্রভৃতি বিষয়ে কৃষকদের ধারণা মার্কসবাদী লেখক হাবিবের রচনা স্থান
পায়নি। কিন্তু Subaltern
studies গ্রুপের ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্র কৃষক বিদ্রোহগুলির পেছনে ধর্ম
ও বর্ণ, গুজব, দন্ড
ইত্যাদি বিষয়গুলিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন।
নিজস্ব
গবেষণা গ্রন্থে গৌতম ভদ্র দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে,
মধ্যযুগীয় ভারতে বর্ণের উপর ভিত্তি করে গ্রাম গঠিত হত
এবং কৃষকদের অধিকার রক্ষার সঙ্গেও বর্ণের সম্পর্ক ছিল। আইন-ই-আকবরীতে প্রায় প্রত্যেক অঞ্চলে জমিদারি অধিকারের বিস্তৃতির সঙ্গে
সঙ্গেই তাদের বর্ণের কথা বলা হয়েছে। নতুন
কোন গোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা ও বিস্তৃতির লড়াই
ও সামাজিক সম্পদের উপর কতৃত্বের লড়াই মুঘল যুগে এক হয়ে গিয়েছিল বলে ঐতিহাসিক
ভদ্র মনে করেন। এইসকল
আন্দোলনে জয় লাভ করলে বর্ণ ব্যবস্থায়
উচ্চক্রম লাভ করার একটি সম্ভাবনার থেকে যেত বলেই জমিদাররা এই ধরনের আন্দোলনে যোগ
দিতেন। সর্বোপরি
জমিদার বা গ্রাম প্রধানরা এইসকল আন্দোলনে একই বর্ণভুক্ত রায়তদের
সমর্থন ও প্রত্যাশা করতে পারতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, শিবাজী বা জাঠ সর্দার ঠাকুর বদন সিং সামাজিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য
বিশেষ আগ্রহী ছিলেন বলে ভদ্র মনে করেন। জাঠ বিদ্রোহে 'খপ' বা জাতি পঞ্চায়েতের ভূমিকায়, শোভা সিং এর বিদ্রোহে, কোলিদের বিদ্রোহে বর্ণের ভূমিকার আভাস পাওয়া
যায় বলে তিনি মনে করেন।
এর
পাশাপাশি গৌতম ভদ্র এটাও দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে,
অপেক্ষাকৃত সম্পদশালী জমিদাররা যেসকল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন সেখানেই বর্ণের
ভূমিকা প্রবলতর হয়েছে। তিনি মত
প্রকাশ করেছেন যে, মুঘল যুগের
কৃষকরা আন্দোলন করেছিল জীবনের ন্যূনতম মান বজায় রাখার জন্য;
সম্পদের উপর কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য তারা আন্দোলন করেননি। ফলে আন্দোলনের ক্ষেত্রে বর্ণকেও সে ক্ষেত্রে কৃষকরা ব্যবহার করেনি। উদাহরণস্বরূপ সৎনামী,
মাতিয়া বা বান্দার লড়াইয়ের কথা বলা যেতে পারে যেখানে বর্ণকে ব্যবহার করার
পরিবর্তে বর্ণ ব্যবস্থায় জাত আইনগুলিকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে বর্ণ ব্যবস্থা ভিত্তিক
আন্দোলন মধ্যযুগের কৃষক আন্দোলনকে অনেকাংশেই সমঝোতামূলক ও স্তিমিত করেছিল বলে ভদ্র মনে করেন। কারণ ১) এ জাতীয় আন্দোলন স্বভাবতই অন্যান্য বর্ণের লোকেদের যোগ দিতে বাধা দিয়েছে এবং ২) এই ধরনের আন্দোলনে যে মুহূর্তে একটি
গোষ্ঠী জাতে ওঠার কথা ভাবে অমনি প্রচলিত ব্যবস্থাকেই সে স্বীকার করে নেয় আন্দোলন
তখন সমঝোতামূলক বা গোষ্ঠী কেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। তাই চূড়ামন জাঠ বা ছত্রশাল বুন্দেলা বিপুল আগ্রহে শিখ বিদ্রোহ দমন করতে যায়। সুতরাং বলা চলে যে বর্ণ যেমন কৃষক আন্দোলনে সংহতি
এনেছিল তেমনি অনেক ক্ষেত্রে আন্দোলনকে সমঝোতামূলক ও সীমিত করেও তুলেছিল।
মুঘল যুগের
শেষ পর্যায়ের কৃষক বিদ্রোহগুলিকে যদুনাথ সরকার সহ অনেক ঐতিহাসিক ঔরঙ্গজেবের গোঁড়া ধর্মান্ধ নীতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখানোর চেষ্টা
করেছেন। কিন্তু
এই প্রসঙ্গে কয়েকটি তথ্য মনে রাখা দরকার - i) হিন্দু
জমিদারদের বিরুদ্ধে দাসিরামের কৃষক বিদ্রোহকে মুসলিম ঔরঙ্গজেব কঠোর হাতে দমন
করেছিলেন। ii) সারা
ভারত জুড়ে বহু হিন্দু মন্দির ঔরঙ্গজেবের
পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। iii)ঔরঙ্গজেব
দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজত্বকালে বহু নীতির বিবর্তন ঘটেছিল। তাঁর রাজত্বের শেষদিকে হিন্দুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ কমে
এসেছিল এবং বাহাদুর শাহের সময় থেকে জিজিয়া সহ অনেক করই নাকচ হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও
ইহা অনস্বীকার্য যে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি মুঘল যুগের কৃষক বিদ্রোহগুলিতে ধর্ম
একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
ভারতীয়
জনমানসের চিন্তার জগতে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে। গৌতম
ভদ্র ধর্মমতকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন, যথা – i) সরকারি
ধর্মমত যা সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চায় এবং ii) প্রতিবাদী ধর্ম মত। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে প্রচলিত সুফি ও ভক্তি মতবাদ
মানবিকতার মাধ্যমে কৃষক ও অন্যান্য নিম্নশ্রেণির জনসাধারণের সমর্থন লাভ করেছিল বলে গৌত্ম ভদ্র মনে করেন। প্রাথমিক পর্বে এই ধর্মীয় আন্দোলন কখনই রাষ্ট্রব্যবস্থা ও
কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে কিছু বলেনি। যদিও নানা সামাজিক কারণে এই সময়
ধর্মীয় মতবাদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছিল। উদাহরণস্বরূপ শিখ ধর্মের কথা বলা
যায়। গুরু গোবিন্দ রাষ্ট্রক্ষমতার কাছে আবেদন
নিবেদনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করলেও প্রয়োজন মতো অস্ত্র নেওয়া ও যে যথার্থ তা মুঘল সম্রাটকে জানিয়েছিলেন।
সৎনামী
ধর্মীয় অনুশাসন অনুসারে তারা কারোর আজ্ঞাবহ ছিলনা।
এক্ষেত্রেও ধর্মীয় অনুশাসন প্রয়োজনে আদেশকারীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামকে পরোক্ষে স্বীকার করে নিয়েছিল। অধ্যাপক গৌতম ভদ্র মনে করেন যে, সৎনামী, মাতিয়া বা বান্দার
নেতৃত্বে শিখ বিদ্রোহে প্রতিরোধ আন্দোলনের যে তীব্রতা দেখা
যায় -তা যেকোন প্রতিবাদী ধর্ম ভিত্তিক কৃষক
আন্দোলনের লক্ষণ। এই সকল
আন্দোলনগুলিতে কৃষকদের সামনে একটি আদর্শের উন্মাদনা কাজ করত বলে তিনি মনে করেন, যে আদর্শ আজকের চোখে অদৃশ্য বা অস্ফুট মনে হওয়াই
স্বাভাবিক। ফলে সৎনামী, মাতিয়া বা বান্দার শিখ বিদ্রোহে আত্মদান বা মরণাপন্ন যুদ্ধের কাহিনী
তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এইসকল
প্রতিবাদী ধর্মগুলিতে বর্ণের ভূমিকা কম; ধর্মই এখানে
সংহতি সাধন করে।
ধর্মীয়
চেতনার মধ্যেই জড়িয়ে থাকে মূল্যবোধের প্রশ্ন ও যাদুবিদ্যার প্রশ্ন। কৃষক বিদ্রোহ মূল্যবোধকে স্বীকার করে। সামাজিক কারণে মুঘল আমলে কৃষকদের
মূল্যবোধে মহাজনরা বন্ধু হওয়ার ফলে এই কালপর্বে মহাজন বিরোধী আন্দোলন
বিশেষ একটা পাওয়া যায় না। পাশাপাশি যুদ্ধের সময় শস্য প্রদানকারী
ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী শ্রেণী বানজারাদের লুঠ
করার ফলে বেশকিছু মারাঠা সর্দার কৃষকদের মধ্যে
নিন্দিতও হয়েছিলেন।
সশস্ত্র বিদ্রোহগুলোর ক্ষেত্রে যাদুবিদ্যার ধারনাও বহু সময় দুপক্ষকে
আচ্ছন্ন করেছে। খুন্তাঘাটে সাফল্য অর্জনকারী কৃষক-সৈন্যদের এক যাদুবিদ্যার অধিকারী বলে মির্জা নাথান মনে
করেছেন। জালাল তব্রিজি
ও অন্যান্য মুঘল কর্মচারীদের মৃত্যুর পেছনে যাদুবিদ্যা কাজ করেছে বলে অনুমান করা
হয়েছে। মুঘল
সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই এর সময় সৎনামী এবং মাতিয়ারা মনে করত যে,
ধর্মগুরু বা যাদুকরীর প্রভাবে মুঘল অস্ত্র ব্যর্থ হয়ে যাবে। ধর্মীয় উৎসবের উপর নিষেধাজ্ঞা থেকেও কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষের সম্ভাবনা থাকে বলে গৌতম ভদ্র মনে করেছেন।
আলোচনার
প্রসঙ্গে অধ্যাপক ভদ্র কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ধর্মের নঞ্চার্থক ভূমিকাকে উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে,
ধর্মীয় উন্মাদনা বা একাত্মতা একদিকে যেমন বহু আন্দোলনকে সুসংহত করেছিল, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম কৃষকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি
করেছিল। উদাহরণস্বরূপ
বলা যায় যে, বান্দা খালসা শিখদের হয়ে রামরাইয়া
শিখদের ধ্বংস করেছিলেন। আবার
মুলতানপুরে সামস খান বাফিন্দা বা নিম্নবর্ণের জেলেদের এককাট্টা করে
শিখসৈন্যকে প্রতিরোধ করেছিল। এখানে ধর্মের প্রভাব শিখ বিদ্রোহের শ্রেণী চরিত্রকে
ছাপিয়ে গিয়েছিল।
মুঘল যুগে কৃষক বিদ্রোহগুলিতে একটি স্তরে
ধর্মীয় বিদ্বেষ কিছুটা কাজ করেছিল বা তাকে ব্যবহার করা হয়েছিল। যেমন সৎনামীরা কিছু
মুসলিম মসজিদ ধ্বংস করেছিল, আবার আন্দোলনের
এক পর্যায়ে বিপরীতভাবে এই জাতীয় ধর্ম বিরোধী কোনো কাজ করেনি -এরূপ নিদর্শন রয়েছে।
ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে রাজপুত সেনানায়ক ভীমসিংহ আমেদাবাদের বিখ্যাত মসজিদ সমেত ৩০০টি মসজিদ ধ্বংস করেছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে এই ভীমসিংহ
আবার নিষ্ঠাভরে ঔরঙ্গজেবের হয়ে মারাঠাদের দমন করতে যান এবং ওরঙ্গজেব তাঁকে বিনা আপত্তিতে ৩-৪ হাজার মনসব প্রদান করেন
এবং সমতুল্য ওয়াতন জায়গীর দেন। এখানে মারাঠা আন্দোলনকে দমন করার জন্য গোঁড়া মুসলিম
সম্রাট পুরনো হিন্দু শত্রুর সঙ্গে হাত মেলালেন (রোশানিয়া
আন্দোলন
ও দাসি কুর্মির বিদ্রোহ-দুটিই
পীরের উদ্ভবের সঙ্গে জড়িত ছিল যেখানে নিম্নবর্ণ ও উপজাতিদের অংশগ্রহণই ছিল বেশি। সুতরাং
বর্ণের মত ধর্মও মুঘল যুগের কৃষক আন্দোলনকে ক্ষেত্র বিশেষে সংহতি
বিধান করেছিল। আবার কখনো বা কৃষকদের শ্রেণী
চেতনাকে আঘাত করেছিল। ফলে কোন
একমাত্রিক ছকে এই আন্দোলনগুলিকে বিশ্লেষণ করা
বোকামি।
সপ্তদশ - অষ্টাদশ শতকের কৃষক বিদ্রোহগুলিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা
হয়েছে এবং বিদ্রোহগুলির পশ্চাতে নানা কারণের অনুসন্ধান করা হয়েছে। বলাবাহুল্য ধর্ম-বর্ণ,
অর্থনৈতিক অসন্তোষ, শোষণ ও
অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার সামগ্রিক
প্রতিচ্ছবি হিসাবেই বিদ্রোহগুলির ব্যাখ্যা করা সমীচীন। মনে রাখা দরকার যে, আঞ্চলিক চেতনার অস্তিত্ব গোটা মুঘল
যুগ
ধরেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বজায় ছিল। উপর
থেকে চাপিয়ে দেওয়া মুঘল রাষ্ট্র কাঠামো একে বিনষ্ট
বা অঙ্গীভূত করতে পারেনি। তাই বিদ্রোহগুলিকে
মুঘল শক্তির কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে আঞ্চলিক শক্তির বিদ্রোহ হিসেবেও দেখানো হয়। আরো মনে রাখতে হবে যে,
অধিকাংশ কৃষক বিদ্রোহই প্রাথমিকভাবে
সাফল্য অর্জন করেছিল। এ কথা স্বীকার
করতেই হবে যে, প্রচন্ড মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক
সাফল্য অর্জন করা বৃহত্তর জনসমর্থন ছাড়া সম্ভব
ছিল না। সুতরাং এ কথা মনে রাখার যথেষ্ট অবকাশ
আছে যে, এই আন্দোলনগুলির পেছনে গভীর সামাজিক ও
অর্থনৈতিক কারণ ছিল। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এই গভীর দ্বন্দ্ব
ও
বৈষম্য শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সংকটকে বাস্তবায়িত করেছিল।
Baoooooo
উত্তরমুছুন