মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল
সামরিক শক্তির উপর ভিত্তি করে। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর
থেকে মুখ সৈন্যবাহিনীতে মোঙ্গল, তুর্কী, উজবেগ, ইরানী ও
আফগানদের প্রাধান্য ছিল। এই সকল
জাতিগোষ্ঠীর মুঘল সৈন্যাধ্যক্ষরা তাদের অধীনস্থ বাহিনীর জন্য
নগদ টাকার পরিবর্তে জায়গীর লাভ করত। বস্তুতপক্ষে
সাম্রাজ্যের মোট ৮০ শতাংশ জমির রাজস্ব সম্রাট বরাত হিসাবে
সামরিক শাসকশ্রেণীকে দিয়ে দিতেন। যারা এরূপ দায়িত্ব পালনের
বিনিময়ে জায়গীর লাভ করত তাদের বলা হত জায়গীরদার। অর্থাৎ
রাষ্ট্রীয় কর্মচারী হিসাবে জায়গীরদার
উদ্বৃত্ত উৎপাদনের একাংশ ভোগ করত, যদিও এর ফলে জমির উপর তার কোন
মালিকানা
স্বত্ত্ব জন্মাত না। সাধারণত সম্রাট
সমেত এই জায়গিরদাররাই মুঘল
অর্থনীতিতে প্রধান শোষক শ্রেণীর ভূমিকা পালন করেছিল।
আকবরের রাজত্বকালের সূচনার
আগে থেকেই জায়গিরদারী ব্যবস্থার ত্রুটি পরিলক্ষিত হতে থাকে। বহুজাতি গোষ্ঠী ভুক্ত উচ্চপদস্থ সামরিক শাসক শ্রেণী
জায়গীর প্রথা দুর্বলতাকে নিন্মলিখিতভাবে কাজে লাগাতে থাকে- ১)
জায়গীরদাররা কখনো বা অপদার্থ আবার কখনো বা ধার করে
সৈন্য প্রেরণ যার ফলে সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ত, ২) তারা
অনেক সময় পরাক্রান্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করত
এবং ৩) সম্রাটের রাজকোষে কম অর্থ
আদায় হওয়ার ফলে রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক দিক দিয়েও দুর্বল হত এই সকল দুর্বলতাকে দূর
করার জন্য এবং সামরিক শ্রেণীকে সংগঠিত করার জন্য সম্রাট আকবর
১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রিয় মীরবক্সী শাহবাজ খানের
সহায়তায় মনসবদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। আরবি
শব্দ 'মনসব' শব্দের
অর্থ পদমর্যাদা। আরভীন এর মতে এই প্রথার লক্ষ্য ছিল বেতন
অনুযায়ী কর্মচারীদের পদমর্যাদা স্থির করা। প্রসঙ্গত
উল্লেখযোগ্য যে আকবরের পূর্বে পারস্য দেশের সম্রাটরা এই প্রথা চালু করেছিলেন। অধ্যাপক অনিরুদ্ধ রায় এর মতে দিল্লির
সুলতানি যুগে সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের 'দেওয়ান
–ই- আর্জ বিভাগ থেকে বেতন দেয়ার
রীতি চালু ছিল। ঐতিহাসিক
সতীশচন্দ্র অবশ্য মনে করেন যে, আকবরই এই মনসব
ব্যবস্থাকে একটি সঠিক নিয়ম ও গঠন প্রদান করে এই ব্যবস্থায় কতগুলি নতুন বৈশিষ্ট্য
প্রদান করেন। অধ্যাপক
এ. জে. কাইজার উল্লেখ করেন যে, আকবরই প্রথম
মনসবদারি প্রথা চালু করেন তাঁর রাজত্বের অষ্টাদশ বছরে (১৫৭৩-৭৪)।
শ্রীমতি শিরিন মুসভির সাম্প্রতিক গবেষণা
থেকে জানা যায় যে, আকবর কয়েকটি ধাপে মনসবদারি ব্যবস্থা
চালু করেছিলেন। ১) আকবরের সিংহাসন আরোহণের পূর্বে এবং তার রাজত্বকালে
প্রথম দশ বছর রাজকর্মচারীদের বিশেষ কোনো ধরাবাঁধা
সামরিক দায়িত্ব ছিল না, মাইনেও খুশিমতো নির্ধারণ করা হত। ২)
একাদশ
বছরে (১৫৬৬-৬৭) আকবর
প্রথম রাজকর্মচারীদের উপর কিছু নির্দিষ্ট সামরিক দায়িত্ব চাপানোর
কথা ভাবলেন এবং কিছু কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করার চেষ্টা করলেন যাতে তারা তাদের
জায়গীর থেকে উপার্জন অনুযায়ী কিছু সংখ্যক সৈন্য সামন্ত রক্ষা করতে পারেন। ৩) রাজত্বকালের
অষ্টাদশ বছরে (১৫৭৩-৭৪)
অধীনস্থ সৈন্যের সংখ্যা অনুযায়ী পদের অর্থাৎ মনসবের ব্যবস্থা
প্রবর্তিত হয়। এতে অভিজাতদের
সংখ্যাসূচক পদমর্যাদা দেওয়া হয়, যার দ্বারা তাদের বেতন ও পোষ্য
পশুর সংখ্যা নির্ধারিত হত। মনসবের সমান
সংখ্যায় অশ্বারোহী পুষতে বাধ্য করা হয়। বাস্তবে
সংখ্যানুসারে ভাতা নিলেও খুব কম সংখ্যক মনসবদারি চিহ্নিতকরণের
সময় সঠিক সংখ্যার সৈন্য ও অশ্ব হাজির করতে
সমর্থ হতেন। ৪) তাই তার
রাজত্বকালের চল্লিশতম বছরে (১৫৯৫-৯৬) আকবর
তার মনসবদারদের তিনটি ভাগে ভাগ করেন। পদ
অনুযায়ী কে কত সংখ্যক সওয়ার
রক্ষণাবেক্ষণ করছেন তার ভিত্তিতে এই সময় থেকেই সওয়ার
সংখ্যা ও মনসব সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয়। এবং এই সময় থেকেই সওয়ার পদের আলাদা গুরুত্ব দেখা
দিতে শুরু করে এবং পরের বছর থেকেই মনসবদারি প্রথা জাঠ ও
সওয়ার এই দ্বৈত পদের পাকাপাকি অস্তিত্ব দেখা দেয়।
মুঘল আমলে মনসবের কতগুলি নিজস্ব
বৈশিষ্ট্য ছিল, i) মুঘল আমলে প্রত্যেক মনসবদার সরাসরি সম্রাটের অধীনে
ছিলেন। এদিক দিয়ে দিল্লির তুর্ক আফগান
যুগের সামরিক ব্যবস্থা একেবারে আলাদা ছিল। কারণ সেখানে ঊর্ধ্বতন সেনাধ্যক্ষের
অধীনে বিভিন্ন শ্রেণীর অধস্তন সেনাধ্যক্ষ ছিল এবং
শুধুমাত্র প্রধান প্রধান সেনাপতিরাই সুলতানের
সরাসরি আজ্ঞাবহ ছিলেন। অবশ্য দুই সামরিক ব্যবস্থাতেই সৈন্যসংখ্যা
নির্ধারিত হত দশের গুণিতকের উপর। ২) মনসবের দুটি
দিক ছিল – 'জাঠ' ও 'সওয়ার' এই
দ্বৈত পদের ভিত্তিতেই মনসবদারদের অবস্থান ও
পাওনাগন্ডার হিসাব করা হত। মোরল্যান্ড এবং
আব্দুল আজিজের মতে জাঠ পদ ছিল
প্রত্যেক মনসবদারের ব্যক্তিগত পদমর্যাদাসূচক।
এছাড়াও জাঠ এর মাধ্যমে প্রচলিত আয় ক্রমের
পরিপেক্ষিতে মনসবদারদের মাইনেও সূচিত হত।মোরল্যান্ডের
মতে পাঁচ হাজারী মনসবদার বাৎসরিক মাইনে পেতেন ৪৮০০০ দাম। আর সওয়ার পদ সূচিত
করত তিনি কত সংখ্যক সৈন্য রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। সওয়ার পদের সংখ্যা দ্বারা আরো ঠিক হত যে সৈন্য সামন্ত দেখাশুনার জন্য কি পরিমাণ অর্থ সরকার কোষাগার থেকে পাবেন। মোরল্যান্ড এর মতে
সওয়ার পদের প্রাপ্য ১৫৯৫ সাল থেকে প্রতি বছরে ৯,৬০০ দাম
নির্ধারিত হয়। আবুল
ফজলের লেখায় এরূপ কোন নির্দিষ্ট হারের উল্লেখ না
থাকার ফলে ইরফান হাবিব মোরল্যান্ডের
বক্তব্যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। হাবিব
এর মতে এক জটিল হিসাব নির্ধারণ পদ্ধতির মধ্যে দিয়েই সওয়ার পদের প্রাপ্য ঠিক করা
হত। প্রথম পর্যায়ে যখন কাউকে সওয়ার পদ দেওয়া হত
তখন তার একটি আনুমানিক প্রাপ্য ধার্য করা হত, যাকে
বলা হত 'বরাবদী'। ইরানি ও
তুরানি মনসবদারদের ক্ষেত্রে এই হার ছিল বছরে সওয়ার প্রতি
১২ হাজার দাম এবং ভারতীয়দের ক্ষেত্রে ৯,৬০০ দাম। পরের পর্যায়ে বকসির তত্ত্বাবধানে
ঘোড়ার মান ও জাত অনুযায়ী পুনরায় পাওনা নির্ধারণ করা হত। 'ইয়াক
আসপা' বা এক ঘোড়ার সওয়ারিদের জন্য ধার্য করা
হত মাসে ১২ থেকে ২৫ টাকা। দুই বা
তিন ঘোড়ার সওয়ারিদের ক্ষেত্রে এর হার ছিল আরো বেশী। এর ফলে মূল্যায়নের এই দ্বিতীয় পর্যায়ে
ঠিকঠাক হিসাবমতো সৈন্য ও ঘোড়া হাজির করতে পারলে যেকোনো
মনসবদার প্রথম পর্যায়ের বরাবদী হারের চেয়ে অনেক বেশী অর্থ
দাবী করতে পারতেন। ১৫৯৫ -৯৬
সালে এই ব্যবস্থায় আকবর কিছু পরিবর্তন আনেন এবং এর ফলে ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দের তালিকা
'ইয়াক আসপা' সৈন্যদের জন্য ৯,৬০০ দাম
বরাবদী হার নির্দিষ্ট করে এই হার আগের
থেকে অনেক কম এবং পরিবর্তনযোগ্য ছিল।
পদমর্যাদা অনুযায়ী মনসবদাররা বহু শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন যদিও এই বিভাগ নিয়ে ঐতিহাসিক
মহলে মতপার্থক্য বিদ্যমান। বার্নিয়ের
বলেছেন যে, মনসবদারদের মধ্যে শ্রেণীগত পার্থক্য ছিল। যদিও ইংরেজ রাষ্ট্রদূত এরূপ কোন পার্থক্য দেখতে পাননি। মানুচি ও আবুল ফজল মনসবদারদের এই
পার্থক্য অবলোকন করেছিলেন। আবুল
ফজলের মতে মনসবদাররা ৬৬টি শ্রেণীতে
বিভক্ত ছিল যদিও বাস্তবে তা কখনই ৩৩ এর উর্দ্ধে যেত না। অধ্যাপক অনিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে "সম্ভবত আকবর ৬৬টি শ্রেণীর পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে ৩৩টি শ্রেণী গঠন করতে পেরেছিলেন।" তবে সর্বনিম্ন মনসবদারের
অধীনে দশ জন এবং সর্বোচ্চ মনসবদারের অধীনে পাঁচ হাজার সৈন থাকত।
অবশ্য রাজকুমার ও বিশিষ্ট
রাজকর্মচারীদের সাত বা দশ হাজারী মনসবদার হিসেবে নিযুক্ত করার রেওয়াজ ছিল।
মানসিংহ, রাজা টোডরমল ও
কুলিচ খাঁ সাত হাজারী মনসবদার পদে ভূষিত হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে মনসবের পদমর্যাদার সঙ্গে (জাঠ) সেনার সংখ্যার সঙ্গতি রক্ষা (সওয়ার) বাধ্যতামূলক
ছিল না।
মনসবদারদের
মধ্যে যারা নগদ টাকায় বেতন পেতেন তাদের বলা হত 'মনসবদার
-ই –নগদি'। আর
বাকিদের জন্য ধার্য করা হত নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি বা জায়গীর, যার নির্ধারিত রাজস্ব বা 'জমা'র পরিমাণ ছিল মনসবদারের
নির্দিষ্ট বেতন এবং সৈন্য রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রাপ্য অর্থের
সমান। এই সকল জায়গীরদারদের
জমির উপর কোন স্বত্ব ছিল না এবং প্রায়ই এদের বদলি করা হত। এগুলিকে বলা হত 'তনখা জায়গীর'। এছাড়াও ছিল 'ওয়াতন জায়গীর' যেগুলি
আঞ্চলিক শাসক বা সামন্তরা বংশানুক্রমিক ভাবে ভোগ দখল করত।
আকবরের সময় থেকেই এই সমস্ত সামন্ত রাজা ও জমিদারদের মনসবদারি
ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছিল।
মনসবদারদের নিয়োগ, পদবৃদ্ধি এবং
খারিজ করার ক্ষমতা ছিল কেবলমাত্র সম্রাটের।
কাজেই সমন্ত মনসবদারদের আনুগত্য ছিল একমাত্র সম্রাটের প্রতি এবং তা
নির্ভর করত সম্রাটের ব্যক্তিগত গুণাবলী এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তার সাফল্যের উপর। এম. এন. পিয়ারসন এর মতে মুঘল
যুগে সম্রাট ও মনসবদারদের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা হল পৃষ্ঠপোষক ও পোষ্যবৃন্দের
সম্পর্ক (patron client relationship) স্বভাবতই এই সম্পর্কের
স্থায়িত্ব নির্ভর করত সাম্রাজ্য ও সম্পদের নিয়ত বিস্তারের উপর।
কোন জাতিগত বা ধর্মীয় আনুগত্য সম্রাট ও মনসবদারদের মধ্যে যোগসূত্র
রচনা করতে পারেনি। সাধারণত বংশমর্যদাযুক্ত
ব্যক্তিদেরই মনসব দেওয়া হত (বংশ গৌরবহীন ও প্রতিভাবান ব্যক্তিরা মনসব পেতেন
কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম)। মনসবের সবচেয়ে বড় দাবীদার
ছিলেন অন্যান্য মনসবদারের পুত্র এবং বংশধরেরা যাদের বলা হত 'খানাজাদ'। 'খানাজাদ' বা ছাড়াও
অন্যান্য বিভিন্ন শ্রেণী থেকে মনসবদাররা নিযুক্ত হতেন।
আকবর থেকে ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত সকলেই চেষ্টা করেছেন যে কখনই কোন বিশেষ
জাতি বা গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে উঠত তখনই তাদের মনসবদার ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে
আসতে। বস্তুতপক্ষে মুঘল সম্রাটরা নিজেরাই শাসকশ্রেণীর
মধ্যে এই জাতি বা গোষ্ঠী স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে উৎসাহ দিতেন, যাতে একদল লোকেদের
আরেক দলের বিরুদ্ধে কাজে লাগান যায়।
'খানাজাদ' ছাড়াও
যাঁরা মনসবদার হিসাবে নিযুক্ত হতেন তারা হল
স্থানীয় জমিদার, দেশীয়
রাজন্যবর্গ বা উপজাতীয় সংগঠনের নেতারা।
আঞ্চলিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাবশালী এই জমিদার শ্রেণীকে মনসবদার পদ দিয়ে আকবর এদের আনুগত্য লাভ করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের নিজস্ব
ভূ-সম্পত্তিকে 'ওয়াতন জায়গীর' হিসাবে গণ্য করা হত; এছাড়া
রাজকর্মচারী হিসেবে সাম্রাজ্যের অন্যান্য প্রদেশে সাধারণ
জায়গীরও এরা পেতেন। আতাহার
আলীর গবেষণা অনুসারে ১৬৫৮-৭৮ সালে ৪৮৬ জন
মনসবদারের মধ্যে ৬৮ জন এবং ১৬৭৯-১৭০৭ কালপর্বে ৫৭৫ জন মনসবদারের মধ্যে ৮১ জন ছিলেন
জমিদার।
খানাজাদ এবং দেশীয় রাজন্যবর্গ ছাড়া
মনসবদার হিসাবে নিযুক্ত হতেন পারসিক, চাকতাই, উজবেক প্রভৃতি বহিরাগত সামরিক নেতৃবৃন্দ। মুসলিম শাসনের শুরু থেকেই ভাগ্যের
অম্বেষণে এরা ভারতে এসেছিল। মোরল্যান্ড দেখিয়েছেন যে,
আইন-ই-আকবরিতে মনসবদারদের যে তালিকা আছে তাদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবারই হয়
হুমায়ূনের সঙ্গে ভারতে এসেছেন অথবা আকবরের সিংহাসন আরোহণের পর ভারতবর্ষে প্রবেশ
করেছেন। ১৬৫৮-৭৮ কালপর্বে এক
হাজার জাঠ পদাভিষিক্ত ৪১৭ জন মনসবদারদের মধ্যে ২৮ জন ছিল বহিরাগত। যদিও ১৬৭৯-১৭০৭ সালে তা যথেষ্ট
কমে যায়,
৪৮২ জনের মধ্যে বহিরাগত ১৯৭ জন যাদের মাত্র ৪৬ জনের জন্ম ভারতের
বাইরে। সুশাসক
হিসেবে রক্ষণে দক্ষ ব্যক্তি, আবুল
ফজল, সাদুল্লা খানের মত পন্ডিত ব্যক্তি বা
ধর্মশাস্ত্রবিদরাও মনসবদার হিসাবে নিযুক্ত হতেন।
এইসব বিভিন্ন ধরনের লোকেদের রাজপদে নিয়োগ করার ফলে মুঘল মনসবদারদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই কিছু উপজাতীয়
ও ধর্মীয় উপদলের সৃষ্টি হয়- যথা তুরানি, ইরানি, আফগান, শেখজাদা বা ভারতীয় মুসলমান, রাজপুত, দক্ষিণী মারাঠা এবং অন্যান্য হিন্দু। মধ্য এশিয়ার তুর্কি ভাষী অঞ্চল থেকে আগতরা ছিলেন তুরানি, পারস্য, আফগানিস্তান ও
ইরাকের পারসিক ভাষাভাষীর লোকেরা পরিচিত ছিলেন ইরানি, আফগান
মনসবদাররা ছিলেন আফগানিস্থান অঞ্চলের বাসিন্দা। (এদের সংখ্যা ঔরঙ্গজেবের বিজাপুর
দখল করার পর বেড়ে যায় কেননা বিজাপুরের আগে থেকেই অনেক আফগান বাস করত); ভারতীয়
মুসলমান বা শেখজাদারা ছিলেন সঈদ, কম্বু ইত্যাদি
উপজাতির অন্তর্ভুক্ত। সম্রাট
আকবরের সময় থেকেই বহু রাজপুত নেতৃবৃন্দ মনসবদার পদে নিযুক্ত হন,
ঔরঙ্গজেব জয়সিংহ ও রাই যশোবন্ত সিংহ মত রাজপুতদের উচ্চ দায়িত্বশীল পদে নিযুক্ত
করেছিলেন। ১৬৫৮-৭৮
কালপর্বে অদক্ষিণী মনসবদারদের
মধ্যে রাজপুতরা ছিলেন ১৬.৬ শতাংশ, ১৬৭৯-১৭০৭
এ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭.৬ শতাংশ। (তবে এটাও ঠিক রাজপুত নিয়োগের ব্যাপারে
ঔরঙ্গজেব আকবরের মত উদার ছিলেন না) ঔরঙ্গজেবের
দক্ষিণী অভিযানের সময় থেকেই বিজাপুর এবং গোলকুণ্ডা যেসকল রাজকর্মচারী মুঘল রাজপদে নিযুক্ত হতে
থাকেন তাদের বলা হত দক্ষিণী মনসবদার। এইসকল
মনসবদার অনেকেই দাক্ষিণাত্যের বাইরে জায়গীর লাভ করে অন্যান্য মনসবদারদের ঈর্ষার
পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। শাহজাহানের
সময় থেকেই মারাঠা সরদারদের মনসবদারি ব্যবস্থায়
অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা শুরু হয়, ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের শেষ দিকে বহুসংখ্যক মারাঠা নেতা মুঘল রাজপদে নিযুক্ত হন। যদিও মারাঠা মনসবদারদের আনুগত্য খুব শিথিল এবং তারা কখনোই রাজপুতদের মত মুঘল শাসক শ্রেণীর মধ্যে
প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। তবে
মারাঠা ও দক্ষিণী মনসবদারদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মুঘল শাসক শ্রেণীর গঠনে বেশ
কয়েকটি পরিবর্তন এসেছিল।
বস্তুতপক্ষে সপ্তদশ শতকে মোগলদের
মনসবদারি সংগঠন কয়েকটি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। মনসবদারি ব্যবস্থার আওতায় যে সকল ওয়াতন জায়গীর ভোগী
মনসবদাররা ছিলেন তাদের এক ধরনের ভূমি কেন্দ্রিক
ক্ষমতা ছিল। আইন-শৃঙ্খলা
বজায় রেখে মুঘল রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি সামরিক ও অন্যান্য দিক দিয়ে আনুগত্য
স্বীকার করলে নিজেদের 'ওয়াতন জায়গীরের' উদ্বৃত্ত সম্পদের উপর নিরঙ্কুশ অধিকার তাদের হাতে থাকত। অন্যদিকে
তথাকথিত বিদেশি মনসবদারদের এদেশে কোন ভূমি কেন্দ্রিক অধিকার ছিল না। তাই ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে মুঘল শাসন
ব্যবস্থায় নিজেদের একটি মৌরসী স্বত্বের বন্দোবস্ত করতে তারা সচেষ্ট হন। ফলে শাসকশ্রেণীর মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়
পরিবারকেন্দ্রিক আনুগত্য এবং জাতি বা গোষ্ঠীগত বৈষম্য একে আরো তীব্রতর করে।
অর্থনৈতিক
বৈষম্য ও মনসবদারদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে
আরো তীব্রতর করে তোলে। অধ্যাপক কাইজার
এবং হাবিবের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, মোট
রাজস্বের ৪/৫ অংশ ভোগ
করলেও মনসব বা জায়গীরদারদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বৈষম্য ছিল। ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে মোট ৮ হাজার মনসবদারের মধ্যে ৭,৫৫৫
জনের পদ ছিল ৫০০ জাঠ এর কম এবং ভূমির রাজস্বের
মাত্র ৩০ শতাংশ ছিল এদের নিয়ন্ত্রণে। এদের
উপরে ছিলেন ৪৪৫ জন উচ্চ পদাভিষিক্ত মনসবদার (৫০০ জাঠ
এর উপরে) যারা আত্মসাৎ করতেন সামগ্রিক রাজস্ব আয়ের ৬১
ভাগেরও কিছু বেশি এবং জায়গীরদার হিসেবে নিয়ন্ত্রণ করতেন সাম্রাজ্যের প্রায়
অর্ধেক অঞ্চল। আবার
এদের মধ্যেও মাত্র ৬৮ জন রাজপুরুষ ভোগ করতেন সাম্রাজ্যের মোট রাজস্বের শতকরা ৩৬.৬ ভাগ
এবং নিজেদের জায়গীর হিসাবে নিয়ন্ত্রন করতেন সাম্রাজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জমি
মুষ্টিমেয় রাজপুরুষের হাতে সম্পদের এই প্রচন্ড কেন্দ্রীকরণ মনসবদারদের মধ্যে দ্বন্দ্বকে স্বভাবতই আরো তীব্রতর করে তুলেছিল। যা খোলাখুলি ভাবে প্রকাশ পেল অষ্টাদশ
শতাব্দীর সামগ্রিক অর্থনৈতিক সংকটের পরিপেক্ষিতে।
সম্রাট শাহজাহানের সময় থেকেই 'জমা' এবং 'হাসিলের' মধ্যে পার্থক্য
মনসবদারদেরও ক্রমশ সংখ্যা বৃদ্ধি এবং এর ফলে জায়গীরে টান সংকটকে আরো ঘনীভূত করে। ইরফান হাবিব এর হিসাব অনুযায়ী ১৬০৫-১৬২১
এরমধ্যে জাঠ মনসবের সংখ্যা প্রায়
দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল। জমা এবং
হাসিলের পার্থক্যকে ঘুচিয়ে দেবার জন্য শাহজাহান 'মাসিক
হার' (১০,৮,৬ বা ৪ মাসের
বেতন ধার্য করা হত) চালু করেন কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি। ওরঙ্গজেবও ব্যয়
সংকোচ করে বা নতুন কর ধার্য করে সমস্যার সমাধানের কোনো রাস্তা বার করতে পারেননি। উপরন্তু জে. এফ. ডেভিড মনে করেন যে,
ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত নীতির ফলেই মনসবদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং জায়গীরে ঘাটতি দেখা দেয়। প্রসঙ্গত
উল্লেখযোগ্য যে ঔরঙ্গজেব শিবাজীর বিরুদ্ধে লড়াই এর সময় বহু মারাঠা নেতাকে মনসব পদ দিয়ে নিজের দলে টানার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর রাজত্বে
মারাঠা মনসবদারদের সংখ্যা ২৪
শতাংশ (৭+১৭%) বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রচন্ড হারে মনসব পদের সংখ্যা বৃদ্ধি জায়গিরের ঘাটতি
সৃষ্টি করে কেননা আর্থিক সংকটের যুগে এত বেশিসংখ্যক মনসবদারকে নগদ অর্থে বেতন দেওয়া অসম্ভব ছিল। লাহোরির 'বাদশাহনামা' এবং শাহজাহানের
রাজত্বকালের ২৭ তম বর্ষের
একটি ফরমান থেকে জানা যায় যে, হিন্দুস্থানে
চাকরি পাওয়া মনসবদারদের তাদের সওয়ার পদের এক-তৃতীয়াংশ সৈন রক্ষণাবেক্ষণ করতে হত। ঔরঙ্গজেব এর
রাজত্বকালে শেষদিকে রচিত 'খুলাসাৎ- উস –সিয়াক' গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে,
সমসাময়িক কালে ও এক-তৃতীয়াংশ চালু ছিল। এছাড়া
আকবরের সময় চালু করা 'দাগ' বা 'চিহ্নিতকরণ' প্রথাও কঠোরভাবে মেনে চলা হত। তা সত্ত্বেও ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের শেষ দিকে যখন জায়গির থেকে
মনসবদারদের অ্যায় উল্লেখযোগ্য
ভাবে
হ্রাস পেল তখন অনেকেই তাদের সামরিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতেন না। পরবর্তী সম্রাটদের আমলে অবস্থার ক্রমশ অবনতি
ঘটতে থাকে। অধ্যাপক
মালিকের মধ্যে সম্রাট মুহম্মদ শাহের রাজত্বকালে উজির, মীরবক্সী ও মুষ্টিমেয় কয়েকজন আমির ছাড়া আর কোন মনসবদারই প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে সৈন্যবাহিনীর দিকে বিশেষ নজর
দিতেন না।
মুঘল
যুগে সম্রাট মনসবদার সম্পর্ক ছিল মূলত পৃষ্ঠপোষক এবং পোষ্যবৃন্দের সম্পর্ক, কোন জাতিগত বা
ধর্মীয় আনুগত্য না থাকার ফলে সম্রাট ও মনসবদারের সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল সম্পূর্ণ
ব্যক্তিগত এবং সামরিক চরিত্রের। আকবর তাঁর ব্যক্তিগত গুণাবলী এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য সাফল্য দ্বারা এই
শাসকশ্রেণীর আনুগত্য জয় করেছিলেন। শাহজাহানের
অসাফল্য সেই আনুগত্যের ভিত্তিকে টলিয়ে দিয়েছিল। শাহজাহানের চেয়ে নিজেকে মনসবদার
শ্রেণীর কাছে যোগ্যতার প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে ঔরঙ্গজেব মহারাষ্ট্র, পালামৌ, কুচবিহার, আসাম, গুজরাটের নবনগর
প্রভৃতি জায়গায় সামরিক অভিযান শুরু করেন। কিন্তু
পরবর্তীকালে দাক্ষিণাত্যে তাঁর চরম অসাফল্য
আবার সেই আনুগত্যকে বিনষ্ট করে।
অন্যদিকে এই সমস্ত যুদ্ধবিগ্রহের ফলে সাম্রাজ্যের ব্যয় ভার যে হারে বৃদ্ধি পেল সম্পদ সে হারে বাড়ল না। পরিণামে
যে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হল তা সম্রাট ও রাজপুরুষদের মধ্যে তথা রাজপুরুষদের
নিজেদের মধ্যে পারস্পারিক আদান-প্রদানের সম্পর্কটিকে ক্ষুন্ন করল। স্বাভাবিক কারণেই অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই
সাম্রাজ্য এগিয়ে চলল তার চূড়ান্ত ও অনিবার্য পরিণতির দিকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন