সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শিবাজীর শাসন ব্যবস্থা

 

 


উত্তরাধিকার সূত্রে শিবাজী কেবলমাত্র পুনা লাভ করলেও মৃত্যুর পূর্বে তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন তার রাজ্য দুটি অংশে বিভক্ত ছিল ১) স্বরাজ (স্বরাজ্য) বা মুল্ক- - কাদিম (পুরাতন রাজ্য) এই স্বরাজ আবার তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল সাম্রাজ্যের মূল অংশে ছিল কোঙ্কন  (গোয়া,ঞ্জিরা, চৌল, বোম্বে,সেট, বেসিন ও দমন বাদ দিয়ে কেননা এই স্থানগুলি বিদেশী বণিকদের অধীনে ছিল), দক্ষিণে কারওয়ার এবং আঙ্কোলা, পূর্বে বাগলানা, নাসিক জেলার অর্ধাংশে পুনা এবং সাতারা জেলা এবং কোলহাপুরের অধিকাংশ অঞ্চল অংশের সঙ্গে যুক্ত ছিল পশ্চিম কর্ণাটক (বেলগাঁও থেকে তুঙ্গভদ্রা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল), মহীশূর রাজ্যের উত্তরাংশ, কেন্দ্রান্সে পূর্বাংশ, এবং তামিলনাড়ুর অন্তর্গত বেল্লারি, চিত্তুর এবং আর্কট স্বরাজ্যের এই অংশে কোন সুনির্দিষ্ট শাসনব্যবস্থা ছিলনা, মারাঠা সেনাবাহিনী এই অঞ্চলের উপর অধিকার বজায় রেখেছিলস্বরাজ্যের তৃতীয় ভাগের অন্তর্গত ছিল কানাডা উচ্চভূমি দক্ষিণ ধারওয়ার, সুন্ডা এবং বেদনার যার অন্তর্গত ছিল; এই অংশে স্থানীয় শাসকরা শিবাজীর আধিপত্যকে অনেক ক্ষেত্রেই অস্বীকার করতেন ) স্বরাজ্যের বাইরে ছিল একটি বিতর্কিত অঞ্চল; যেটি প্রকৃতপক্ষে মোগল সাম্রাজ্যাধীন এবং মারাঠা প্রশাসনের বাইরে থাকলেও শিবাজীর সৈন্য সেখান থেকে চৌথ আদায় করতেন

একটি সুসংগঠিত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গিয়ে ছত্রপতি শিবাজীকে বেশ কয়েকটি বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল প্রথমত, অধিকারভুক্ত অঞ্চল জুড়ে নানা জাতি এবং উপজাতি গোষ্ঠী আপন আপন নিয়মকানুন নিয়ে বসবাস করত যাদের একটি ঐক্যবদ্ধ শাসন ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা যথেষ্ট কঠিন কাজ ছিল দ্বিতীয়ত, উত্তরাধিকার সূত্রে শিবাজী লাভ করেছিলেন নিয়ম-শৃঙ্খলা হীন এক অরাজকতাপূর্ণ অঞ্চল তৃতীয়ত, অনেক অঞ্চলেই স্থানীয় শাসকরা এতদিন ধরে ভোগ করে আসা বেশ কিছু অধিকার ছাড়তে চাই ছিলেন না তাছাড়া, তাঁরা শাসনকার্য থেকে যুদ্ধবিগ্রহে বেশী আগ্রহী এবং সাবলীল ছিলেন শিবাজী দক্ষতার সঙ্গে উপরোক্ত সমস্যাগুলির সমাধান করেছিলেন রানাডের মতে শিবাজী নেপোলিয়নের মত একজন সুসংগঠক ছিলেন যিনি সম্পূর্ণভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীনে কয়েকটি প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিলেন তাঁর শাসনব্যবস্থায় শিবাজী নিজেই ছিলেন কেন্দ্রবিন্দু; যাঁরা তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন তাঁদের বিন্দুমাত্র স্বাধীনতা ছিল না সমগ্র শাসন পরিকাঠামোটাই দাঁড়িয়ে ছিল রাজার ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও দক্ষতার উপর শিবাজীর মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলি দক্ষ শাসকের অনুপস্থিতিতে দুর্বল হয়ে পড়েছিল  

 শাসনকার্যে হিন্দুদের নিয়োগ করে এবং উর্দু পার্সির বদলে মারাঠা ভাষাকে সরকারী ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে শিবাজী মারাঠা শাসনব্যবস্থা হিন্দুত্বকরণ করেছিলেন রঘুনাথ পন্ডিত হনুমন্ত'র তত্ত্বাবধানে 'রাজ ব্যবস্থার কোষ' নামে প্রশাসনিক অভিধান একটি অভিধান তৈরি করা হয়

১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যাভিষেকের সময় শিবাজীর অধীনে আট জন মন্ত্রী বিশিষ্ট একটি 'অষ্টপ্রধান মন্ডল' গঠিত হয়েছিল আধুনিক মন্ত্রীসভার মত এদের কোন 'collective responsibility' বা যৌথ দায়িত্ব ছিল না, এমনকি নিজ নিজ দপ্তরে ও এঁদের কোন স্বাধীনতা ছিল না। প্রশাসনের সব ক্ষমতা ছিল শিবাজীর হাতে- মন্ত্রীরা কেবলমাত্র উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করতেন 'সেনাপতি' এবং কখনো কখনো 'মন্ত্রী' বাদ দিয়ে এই অষ্টপ্রধানের বাকী সদস্যরা ব্রাহ্মণদের মধ্যে থেকে নিযুক্ত হতেন মন্ত্রীর পদগুলি বংশানুক্রমিক ছিল না

. পেশবা বা মুখ্য প্রধান: প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি প্রশাসনের সকল কার্য সম্পাদন করতেন, সরকারী চিঠিপত্র এবং দলিলে ছাপ দিতেন এবং নতুন বিজিত অঞ্চলের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতেন

. মজুমদার বা অমাত্যঃ  অর্থমন্ত্রী হিসাবে তিনি সমগ্র রাজ্যের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখতেন এবং অর্থ সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্রে সইসাবুদ করতেন

. ওয়াকিয়া নবিশ বা মন্ত্রী: মন্ত্রী রাজার দৈনন্দিন কাজকর্ম রাজসভার দৈনন্দিন ঘটনা ইত্যাদি সংক্রান্ত সংকলন করতেন, রাজার বিভিন্ন নিমন্ত্রণ সংক্রান্ত ব্যবস্থা এবং তার সাপেক্ষে গুপ্তচরদের রিপোর্ট অনুযায়ী রাজার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও মন্ত্রীকে করতে হত আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা যে ধরনের ভূমিকা পালন করেন শিবাজীর শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রী ও অনুরূপ ভূমিকা পালন করতেন

. দবির বা সামন্ত: সামন্ত বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়টি দেখাশুনা করতেন অন্য রাজ্য থেকে আগত দুতদের স্বাগত জানানো বৈদেশিক সম্পর্ক সংক্রান্ত নথি বা চিঠিপত্রে সইসাবুদ করা ইত্যাদির দায়িত্ব তাকে পালন করতে হত

. শুনিস বা সচিব: রাজকীয় চিঠিপত্রের আদান-প্রদান, সেগুলির বিষয়বস্তুর ভুল সংশোধন, সেগুলিকে সীল দিয়ে অনুমোদন করা ইত্যাদি কাজ সচিবকে করতে হত প্রত্যেকটি রাজকীয় চিঠির উপরে তিনি সু ষুদ্ (Here begins) শব্দটি লিখতেন

. পন্ডিত রাও: রাজ্যে অন্তর্গত সকল ধর্মীয় প্রশ্নের শেষ মীমাংসা করতেন পণ্ডিত রাও অধার্মিক এবং প্রচলিত ধর্ম মতের বিরুদ্ধাচারণকারীদের শাস্তি বিধান করা, প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার প্রায়শ্চিত্ত সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান, ধর্মীয় যাজ্ঞ সম্পাদন ইত্যাদি কার্যসম্পাদন পণ্ডিত রাওকেই করতে হত পুরস্কার এবং দান প্রদানের কাজ করে পণ্ডিত রাও দানাধ্যক্ষের ভূমিকা ও পালন করতেন মুসলিম রাষ্ট্রে সদর এবং মুহাতসিব এর দায়িত্ব ও কর্তব্য শিবাজীর রাষ্ট্রে পন্ডিত রাও পালন করতেন

. সর - নৌবত বা সেনাপতি: সেনাপ্রধান হিসেবে সৈন্যবাহিনীর দেখভাল করতেন যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতেন, যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব প্রদান করতেন এবং সর্বোপরি নববিজিত অঞ্চলের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন

 . ন্যায়াধীশ: তিনিই ছিলেন প্রধান বিচারপতি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সকল ফৌজদারি এবং প্রশাসনিক বিচার কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব ন্যায়াধীশের উপর অর্পিত ছিল

নিজস্ব দপ্তরের দায়িত্ব পালন করার বাইরেও পেশবা, সচিব ও মন্ত্রীকে বিশাল প্রদেশগুলির প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হত এছাড়াও পন্ডিত রাও বাদ দিয়ে অষ্টপ্রধান মন্ডলের সকল সদস্যদের প্রয়োজনে যুদ্ধে যেতে হত প্রত্যেক দপ্তরে মন্ত্রীদের সাহায্য করার জন্য আটজন করে কেরানি থাকতেন- দেওয়ান, মজুমদার (হিসাবরক্ষক); ফড়নিশ (সহ- হিসাব রক্ষক) সবনিশ বা দপ্তরদার, কারখানিশ (সৈন্যবাহিনীকে খাদ্যাদি সরবরাহকারী সামরিক কর্মচারী), টিটনিস (সংযোগ রক্ষাকারী করণিক) জমাদার (কোষাধক্ষ্য) এবং পোটনিস (খাজাঞ্জি) আঠারটি কারখানা বারোটি মহল নিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন অঙ্গগুলির দায়িত্বে থাকছেন মন্ত্রীদের অধীনস্থ আধিকারিকরা এদের মধ্যে অধিকাংশ আধিকারিকের দায়িত্ব ছিল রাজা এবং তাঁর পরিবার-পরিজনবর্গের দেখাশুনা করা, যদিও কথিপয় আধিকারিক গোলন্দাজ বাহিনীর টাকশাল, রাষ্ট্রীয় কোষাগার ইত্যাদির দেখাশুনা করতেন টিটনিস বা রাজার ব্যক্তিগত সচিব মন্ত্রী না হলেও একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক ছিলেন এবং যে কোন চিঠিপত্র- রাষ্ট্রীয় বা কূটনৈতিক তিনিই লিখতেন

রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে শিবাজী স্বরাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে, প্রদেশগুলিকে কয়েকটি প্রান্ততে (দুই বা ততোধিক জেলা নিয়ে গঠিত) বিভক্ত করেছিলেন শাহুর সময় এরূপ ৩৭টি প্রান্ত ছিল রাজস্ব ব্যবস্থার ক্ষেত্রে শিবাজী আহম্মদনগর রাজ্যে মালিক অম্বর কর্তৃক গৃহীত নীতি অনুসরণ করেছিলেনজমি পরিমাপের ক্ষেত্রে কাঠি, মুঠি, বিঘা, বর ইত্যাদি এককগুলি ব্যবহৃত হত শিবাজীর শাসনকালে প্রথম দিকে মোট উৎপাদনের ৩৩ শতাংশ ভূমি রাজস্ব হিসেবে নির্ধারণ করা হয়, পরবর্তীকালে আমদানি রপ্তানি শুল্ক বাদ দিয়ে সকল প্রকার কর প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে ভূমি রাজস্বকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হয় বস্তুতপক্ষে শিবাজী রাজস্ব ব্যবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসেন নি গ্রাম স্তরে পালিত কুলকানি এবং জেলাস্তরে দেশমুখ দেশপান্ডে প্রাক শিবাজি যুগের মত এই সময়ে বংশানুক্রমিকভাবে রাজস্ব ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন তবে মুসলিম শাসিত অঞ্চল সমূহে মিরাশদারদের ক্ষমতা ও আধিপত্য শিবাজী অনেকাংশেই খর্ব করেছিলের। শিবাজী জমির সঠিক পরিমাপ করে মিরাশদারদের প্রাপ্য রাজস্বের পরিমাণ ও কোষাগারে দেয় অর্থের পরিমাণ বেঁধে দেন এবং তাদের দুর্গ নির্মাণের অধিকার কেড়ে নেন রাজস্ব সংগ্রহের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীদের রাজা নিজে নিয়োগ করতেন তরফের রাজস্ব সংগ্রহ করতেন হাবালদার বা কারকুন, প্রান্তগুলির দায়িত্বে থাকতেন সুবেদার, কারকুন বা মুখ্য দেশাধিকারি কখনো কখনো কয়েকটি প্রান্তের মিলিত দায়িত্ব দেওয়া হত 'সর-সুবেদার' নামক রাজকর্মচারীদের

 রাষ্ট্রের সঙ্গে কৃষককূলের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে দিয়ে শিবাজী কৃষি ব্যবস্থা উন্নতি সাধনের ঐকান্তিক চেষ্টা করলেও রাজস্ব বিভাগীয় কর্মচারীদের দুর্নীতি তাঁর চেষ্টাকে অনেকাংশে ব্যর্থ করে দেয় উৎকোচ গ্রহণ বন্ধ করার কোন ব্যবস্থা বা আইন শিবাজী কার্যকরী করতে পারেননি শিবাজীর রাজত্বকালে শেষদিকে দাক্ষিণাত্য পরিভ্রমণকারী Dr. Fryer বর্ণনা দিয়েছেন They (i- e, the officers) are neither for public good nor common honesty, but their own private interest only. এই মন্তব্য সম্পূর্ণ সত্য না হলেও শিবাজীর অনেক রাজকর্মচারী যে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেটা অনুমান করা যায়

সর -নৌবাদ, মজুমদার, কারকুন প্রমূখ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের নগদ অর্থের মাধ্যমে বেতনের পরিবর্তে অনেক সময় কোন একটি অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের অধিকার দেওয়া হলেও কখনই তাদেরকে উক্ত অঞ্চলের প্রশাসনিক অধিকার দেওয়া হতো না এই সকল কর্মচারীদের অধিকৃত জমি পরিমাপ করা হত এবং রাজস্বের পরিমাণ ও নির্দিষ্ট করা হত সামরিক কর্মচারীদের ও কখনোই সমগ্র গ্রামের স্বত্ব প্রদান করা হত না রাজস্ব হ্রাসের মাধ্যমে বা রাজকোষ থেকে অর্থ প্রদানের মাধ্যমে তাদের বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া হত মহারাষ্ট্রের পার্বত্য মালভূমি অঞ্চল চাষবাষের পক্ষে উপযোগী ছিলনা ফলে রাজস্ব আদায় কম হত পাশাপাশি পশ্চিম উপকূলের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বন্দর বিদেশী বণিকদের অধিকারে থাকায় শিবাজীর রাজকোষে বাণিজ্য শুল্ক বিশেষ একটা আসত না রাজস্ব, বাণিজ্য শুল্ক এবং টাকশাল থেকে প্রাপ্ত মোট আয়ের বাৎসরিক পরিমাণ ছিল এক কোটি হুন, এছাড়াও চৌথ থেকে আদায় হত ৮০ লক্ষ হুন সঠিকভাবে আদায় করা গেলে শিবাজীর মারাঠা রাজ্যের সামগ্রিক আয়ের পরিমাণ ছিল সাত কোটি টাকা

 শিবাজীর রাজস্ব ব্যবস্থার দুটি বিশিষ্ট অঙ্গ ছিল চৌথ ও সদেশমুখী আদায় রামনরের কোলি বংশীয় রাজারা পর্তুগিজ অধিকৃত দমন থেকে সর্বপ্রথম চৌথ (রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ) আদায় শুরু করেছিলেন মুঘল এবং বিজাপুর রাজ্যের অধিকৃত নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহে শিবাজী চৌথ আদায় শুরু করেন রানাডের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল এই যে, তৃতীয় কোনো শক্তির আক্রমণের হাত থেকে বাচার বিনিময়ে চৌথ নামক নিরাপত্তা কর আদায় করা হত কিন্তু ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেমন অধীনতামূলক মিত্রতা আবদ্ধ দেশীয় রাজ্যকে তৃতীয় শক্তির আক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, শিবাজী চৌথ আদায়কৃত অঞ্চলকে এরূপ কোন প্রতিশ্রুতি দিতেন না সরদেশাই এর মতে শত্রুভাবাপন্ন এবং বিজিত রাজ্যগুলি শিবাজীকে বশ্যতার বা অধীনতার নিদর্শন স্বরূপ চৌথ প্রদান করত এই মও সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় অধীনতা নিদর্শন স্বরূপ কোন স্থান থেকে কর আদায় করলে সেই স্থানের উপর কর আদায়কারী কোনো না কোনো দায়িত্ব থেকেই যায় তবে চৌথ প্রদানকারী অঞ্চলগুলির একমাত্র উদ্দেশ্য থাকত পুনরায় অনভিপ্রেত মারাঠা বাহিনীর আক্রমণের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানো বস্তুতপক্ষে লুণ্ঠন এবং ধ্বংসলীলার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেক অঞ্চল শিবাজীকে চৌথ প্রদান করত শিবাজী চৌথ আদায় করতেন দুটি উদ্দেশ্যে প্রথমত তাঁর রাজকোষের অনিশ্চিত আয়কে কিছুটা সুনিশ্চিত করতে এবং দ্বিতীয়ত চৌথ প্রদানকারী অঞ্চলের প্রকৃত মালিককে আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল করতে স্বদেশমুখী ছিল ১০ শতাংশ অতিরিক্ত কর মারাঠা রাজ্যের বংশানুক্রমিক স্বদেশমুখী বা প্রধান হিসাবে শিবাজী একটি বৈধ কাহিনীর অনুসরণে এই কর আদায় করতেন

 শিবাজীর রাজ্য ছিল একটি সামরিক রাজ্য, যেখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ছত্রপতি সেনাবাহিনীর প্রকৃত প্রধান হলেও সেনাপতিকে মূল দায়িত্ব পালন করতে হত,র্বনিসরা সেনাপতিকে নানাভাবে (বেতন ঠিক করা ইত্যাদি) সাহায্য করতেনশিবাজীর রাজ্যে দুর্গগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত সাম্রাজ্যের প্রত্যেকটি পথে শত্রুবাহিনীর আক্রমনকে বাধা দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে দুর্গগুলি নির্মিত হত শিবাজীর মৃত্যুর সময় মোট ২৪০টি দুর্গ ছিল প্রত্যেকটি দুর্গে তিনজন প্রধান রাজকর্মচারী থাকতেন তাদের কেউই একা আত্মসমর্পণ করার অধিকারী ছিলেন না, প্রধান ছিলেন হাবিলদার, তার কাছেই থাকত দুর্গের চাবিকাঠি, সর্বনিশ হিসাবপত্র দেখতেন, সর-- নৌবাদ পাহারাদার এবং নৈশ্য প্রহরীদের ওপর নজর রাখতেন রসদ এবং গুদামের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল কারখানার নবিসের উপরবিভিন্ন জাতির মধ্যে থেকে দুর্গ রক্ষাকারী সামরিক কর্মচারীদের নিয়োগ করা হত রামসি এবং পাতয়ারি উপজাতির মানুষ দুর্গের চারপাশের পরিবেশ রক্ষা করতেন

  পদাতিক বাহিনীর সদস্যদের শিবাজী নিজে নিয়োগ করতেন, সেনাবাহিনীর কয়েকটি রেজিমেন্ট বা ব্রিগেডে বিভক্ত ছিল পদাতিক বাহিনীর সদস্যরা নায়েক, হাবিলদার, জুমলেদার, হাজারী এবং সর- - নৌবাদ ক্রমাগত যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বাড়াবেন মানুচ্চি লিখেছেন যে, সৈন্যদের তরোয়ালকে বিশ্রাম দেবার কোন উপায় শিবাজীর জানা ছিল না অশ্বারোহী বাহিনী দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল, বর্গি রাষ্ট্রীয় অশ্ববাহিনীর বা পাগার স্থায়ী সদস্য হিসাবে বর্গীরা সরাসরি রাষ্ট্রের কাছ থেকে অশ্ব এবং অস্ত্র লাভ করত এবং সিলাদার এরা ছিল অস্থায়ী এবং পদমর্যাদায় বর্গীদের নিচে এদের নিজেদের অশ্ব এবং অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে যেতে হত অশ্ববাহিনীর নেতাদের হাবালদার, জুলেদার, হাজারী, পাঁচ হাজারী, সর- - নৌবাদ প্রভৃতি পদ থাকত শিবাজী তাঁর সৈন্য বাহিনীর সংখ্যা অপেক্ষা গতির উপর বেশি প্রাধান্য দিতেন হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত শিবাজীর বাহিনী প্রকৃত অর্থে দারুন ক্ষীপ্র ছিল শিবাজী সামরিক কর্মচারীদের জায়গীর দানের বিরোধী ছিলেন, তাদের নগদ অর্থ বা জেলাস্তরে রাজস্ব আদায়ের অধিকার দানের মাধ্যমে বেতন দেওয়া হত সামরিক কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা ছিল সৈন্য বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য শিবাজী কঠোর সামরিক অণুশাসন জারি করেছিলেন যেগুলি তাঁর উত্তরাধিকারীদের আমলে দুর্বল হয়ে পড়ে

 পশ্চিম উপকূলের উপর অধিকার বজায় রাখার জন্য একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী প্রয়োজন ছিল এবং শিবাজীর জীবনীকার লিখেছেন 'the Raja put the saddle in the ocean'। এছাড়াও মালাবার উপকূলের বিশাল সম্পদ আহরণের জন্য মারাঠা নৌবাহিনী ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে শিবাজীর নৌ-বাহিনী দুটি অংশে বিভক্ত ছিল প্রত্যেকটির নেতৃত্বে থাকতেন একজন দরিয়া সরঙ্গ (একজন মুসলিম) এবং একজন নায়েক (হিন্দু)। কোলি,ঙ্গা, বাহের, ভান্ডারী প্রভৃতি মালাবার উপকূল অঞ্চলে বসবাসকারী নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে থেকে নাবিকদের নিয়োগ করা হত কেননা এই বিষয়ে তাদের বংশানুক্রমিক দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত শিবাজীর নৌ-বাহিনী নানা আকারের এবং নানা ধরনের জলযানের সাহায্যে গঠিত ছিল ঘুবার (gun boats) তারন্দে (বিশাল জলযান) তারাম্বে, গুল্লিবত (দ্রুতগামী জলযান) সিবার (ব্যবসায়ী নৌকা) পাগার (ডিঙ্গি) মানচোয়া (শক্তিশালী বাণিজ্য তরণী) ইত্যাদি এদের অধিকাংশই ছিল মাল সরবরাহকারী জলযান মারাঠা সূত্র অনুসারে শিবাজীর নৌবাহিনীতে ৪০০ এর মত জলযান ছিল অন্যদিকে সমসাময়িক ইংরেজ কুঠির নথি অনুসারে মারাঠাদের জলযান সংখ্যায় কখনো ১৬০ এর বেশি ছিল না ইংরেজ সূত্র অনুসারে একটি ব্রিটিশ জাহাজ কোনরূপ ঝুঁকি না নিয়ে এরূপ একশটি মারাঠা জলযানকে ধ্বংস করতে পারতগোলন্দাজ বাহিনীর অনুপস্থিতি এবং নৌযুদ্ধে দক্ষতার অভাব সম্ভবত শিবাজীর নৌবাহিনীকে দুর্বল করেছিল

 ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার শিবাজীর শাসন ব্যবস্থাকে 'মধ্যযুগের রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিস্ময়' বলে অভিহিত করেছেন অপরদিকে আধুনিক ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র তাঁর শাসন ব্যবস্থার কোন মৌলিকত্ব খুঁজে পাননি তাঁর মতে দক্ষিণী সুলতানি রাজ্য সমূহের প্রচলিত শাসনব্যবস্থার অনুকরণে শিবাজী তাঁর শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন শিবাজীর শাসন ব্যবস্থা একেবারে ত্রুটি মুক্ত ছিল না। i) ঈশ্বরী প্রসাদের মতে তাঁর শাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল ছিল তাঁর মৃত্যুর পর মারাঠা রাজ্যে বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। ii) শিবাজী জায়গীর প্রথা সম্পূর্ণ বিলোপ করেননি এর ফলে পরবর্তীকালে মারাঠা রাজ্যে বিশৃংখলার সৃষ্টি হয় সিন্ধিয়া, ভোঁসলে, হোলকার প্রভৃতি সামন্ত রাজাদের উৎপত্তি হয় iii) ফ্রায়ারের মতে শিবাজীর রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীরা ছিল নিষ্ঠুর- তারা প্রজাদের উপর অত্যাচার চালাত। iv) প্রতিবেশী রাজ্যগুলি থেকে বলপূর্বক 'চৌথ''সরদেশমুখী' আদায় করা হত এতে মারাঠা রাজ্যের সুনাম নষ্ট হয় স্মিথ তাই শিবাজী রাষ্ট্রকে 'দস্যু রাষ্ট্র বলে অভিহিত করেছেন। v) শিবাজী শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির দিকে নজর দেনি। vi) রাজ্য থেকে তিনি জাতিভেদ প্রথা দূর করতে পারেননি তিনি ব্রাহ্মণদের খুশি করে চলতেন, তার 'অষ্টপ্রধানে'র অধিকাংশই ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং 'পেশোয়া' পদ চিপাবন ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া ছিল

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

       ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাই মুঘলদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বলে মনে করেন শিরিন মুসবি । শিল্প বাণিজ্য থেকে আয়ের পরিমাণ সামান্য । ভূমি রাজস্ব হল ‘ মাল ’ বা ‘ খারাজ ’ । মুঘলরাষ্ট্র সামন্তরাজাদের কাছ থেকে কর পেত । তাছাড়া রাষ্ট্র পেত যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ ( খামস ); স্থানীয় আবওয়াব জিহত , শয়ের - ই - জিহত , ফুরুয়াত , অমুসলমানদের উপর স্থাপিত কর জিজিয়া এবং মুসলমানদের দেয় কর জাকাত ।         আকবরের আমলে সরকারের মোট রাজস্ব পরিমাণ ছিল ১২ , ৮২ , ৮৩ , ৮২৫ টাকা , সুজন রায়ের মতে , ঔরঙ্গজেবের আমলে ৩২ , ৬৮ , ১৬ , ৫৮৪ টাকা , এই রাজস্বের ৬ % ভাগ বাণিজ্য শুল্ক থেকে এবং ৪ % ঔরঙ্গজেব জিজিয়া থেকে পেতেন । বাকি সব রাজস্ব কৃষি খাতে আদায় হত ।       বাবর ভারতবর্ষ জয় করে অধিকৃত অঞ্চলের সমস্ত জমি ইক্তা হিসেবে অভিজাতদের মধ্যে বন্টন করে দেন । দেশের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য ও সংগৃহীত হত । হুমায়ুন এ ব্যাপারে কোন পরিবর্তন ঘটাননি । মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা গঠন করেন আকবর । আকবরের আগ...