সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

প্রাচীন ভারতে নগরায়নের ইতিহাস

 



১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পরিচালনায় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদারো নামক স্থানে একটি নগরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয় এর ঠিক আগের বছর অর্থাৎ ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে দয়ারাম সাহানি পাঞ্জাবের মন্টগোমারী জেলার হরপ্পায় প্রায় অনুরূপ নগরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছিলেন এই দুই আবিষ্কার একদিকে যেমন ভারতীয় ইতিহাসের প্রাচীনত্বের সীমাকে এক ধাক্কায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্থানান্তরিত করে, তেমনি স্যার জন মার্শাল, মার্টিমার হুইলার, এস. আর. রাও,  জে. পি.  জোসি, . . ঘোষ প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই আবিষ্কার দ্বারা উৎসাহিত হয়ে নতুন উদ্যমে খননকার্য চালাতে থাকেন এর ফলে পরবর্তীকালে চানহুদারো, ঝুকার (পাকিস্তান সিন্ধু) বোপার, বানওয়ালি, রংপুর, সুরকোটডা, লোথাল (গুজরাট), দাইমাবাদ, ধোলাবিরা, কালিবঙ্গান, কুনতাসি প্রভৃতি স্থানে নাগরিক সভ্যতা অনুরূপ ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয় প্রাথমিকভাবে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করতেন যে এই সুপ্রাচীন সভ্যতা কেবলমাত্র সিন্ধু নদের উপত্যাকা অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল- তাই এর নামকরণ করা হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতা কিন্তু বর্তমানকালে রাজস্থান, গুজরাট, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ, উত্তর মহারাষ্ট্র এমনকি নিম্ন আফগানিস্থানের প্রভৃতি স্থানে এই সভ্যতার অন্তর্গত প্রায় ২২০টি কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে সিন্ধু উপত্যকার বাইরে এই সভ্যতার প্রসারকে লক্ষ্য রেখে আধুনিককালে অনেকেই এই সভ্যতাকে 'হরপ্পীয় সভ্যতা’ (প্রথম আবিষ্কৃত কেন্দ্র) নামে চিহ্নিত করেছেন

হরপ্পীয় সভ্যতার অন্তর্গত বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে যে বৈশিষ্ট্যটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল বড় মাপের শহরের নিয়মিত ও ধারাবাহিক উপস্থিতি এই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত প্রধান চারটি নগর মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, লোথাল ও কালিবঙ্গান ছাড়াও ধোলাবিরা, বানওয়ালী, রোপার, সুরকোটডা, কুনতাসি প্রভৃতি স্থানে অপেক্ষাকৃত ছোট নগরের অস্তিত্ব দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে এই নগর সভ্যতার ভিত্তি আলোচনার পূর্বে নগরগুলির পরিকাঠামোগত পরিকল্পনাকে সংক্ষেপে আলোচনা করা প্রয়োজন

হরপ্পার নগর পরিকল্পনা একটি নির্দিষ্ট ছক দেখা যায় মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, কালিবঙ্গান, ধোলাবিরা, সুরকোটডা, কুনতাসি প্রভৃতি নগরগুলি দুটি অংশে বিভক্ত ছিল) উঁচু এলাকা বা সিটাডেল বা দুর্গ এলাকা যেখানে প্রধান ইমারতগুলি থাকত এবং ২) নিম্ন এলাকা যেখানে সাধারন জনমানসের বসতি ছিল শহরের উচু অংশের চারপাশে থাকত সুদৃঢ় প্রাকার; হরপ্পাতে প্রাকারের কোথাও কোথাও প্রহরীদের নজর রাখার জায়গা দেখা যায় কালিবঙ্গানের প্রাকার ছিল বিশালাকার। প্রাকার ছাড়াও পরিখাও সিটাডেলের চারপাশে ব্যবহার করা হত মহেঞ্জোদারো নগর প্রাকার বহুবার সংস্কার করা হয়েছিল কারণ পুরাতাত্ত্বিকদের অনুমান সিন্ধু নদের বন্যায় মহেঞ্জোদারোর প্রাকার একাধিকবার বিনষ্ট হয়েছিল হরপ্পা সভ্যতার অন্তর্গত প্রায় সব নগরের প্রাকারের গায়ে তোরণের উপস্থিতি লক্ষণীয় সুরকোটডা এবং ধোলাবিরাতে তোরণগুলি যথেষ্ট জমকালো ছিল, বাকি সর্বত্র তোরণগুলির গঠন ছিল সাধারণ পুরাতাত্ত্বিকদের অনুমান যে কোন শক্তিশালী বহিঃশত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য নয়, সাধারণ চোর-ডাকাত বিশেষত পশুহরণকারীদের হাত থেকে বাঁচার জন্যই হরপ্পার নগরবাসীরা তাদের নগরগুলিকে প্রাকার দ্বারা সুরক্ষিত করতেন মহেঞ্জোদারোর মত নগরে এই প্রাকার বন্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য নির্মিত হয়ে থাকতে পারে

হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, কালিবঙ্গান এবং সূরকোটডায় উঁচু সিটাডেল বা দুর্গ এলাকার আকা নিম্ন নগর অপেক্ষা অনেকটাই ছোট এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই উঁচু দুর্গ এলাকাটি নিম্ন নগরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, কালিবঙ্গান, লোথাল প্রভৃতি নগরেই সিটাডেলটি আয়তাকার এবং এই এলাকাতেই প্রধান ইমারতগুলির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে লোথালের বৈশিষ্ট্য এর জাহাজঘাটা যেটি লম্বায় ছিল ২১৬ মিটার এবং চওড়ায় ৩৭ মিটার সুরকোটডায় শহরের উচু ও নিম্ন এলাকার মধ্যে কোন বেষ্টনী নেই যদিও তাদের পারস্পরিক অবস্থান হরপ্পার মতই কালিবঙ্গানে আবার সিটাডেল এবং নিম্ন নগর দুটি প্রাকার বেষ্টিত এবং দুটিতে প্রবেশের তোরণ পৃথক হরপ্পীয় কেন্দ্রগুলির মধ্যে কেবলমাত্র ধোলাবিরাতেই তৃতীয় একটি মধ্যমনগরের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় (কালিবঙ্গানেও একটি মধ্যম নগরের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়)


 

হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলি সাধারণতঃ পাঁচ থেকে সাত বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠেছিল এবং চরিত্রগত দিক দিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই মেসোপটেমীয় নগরগুলির সঙ্গে অনুরূপ ছিলনগর সজ্জার ক্ষেত্রে হরপ্পাবাসীর পূর্ব পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট নগরগুলি ছিল সুবিন্যাস্ত, রাস্তাগুলি ছিল প্রশস্ত ও সমান্তরাল, চওড়ায় ৯ ফুট থেকে ৩৪ ফুট পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ছিল এবং কখনো কখনো লম্বায় আধমাইল পর্যন্ত সোজা নির্মিত হচ্ছিল মহেঞ্জোদারো মুখ্য বা প্রধান রাজপথটি ১০-৫ মিটার চওড়া ছিল প্রধান সড়কগুলো পূর্ব-পশ্চিম বা উত্তর-দক্ষিণে সমান্তরালভাবে প্রসারিত ছিল এই আড়াআড়ি এবং সোজাসুজি সংযোগের ফলে রাস্তাগুলির অভ্যন্তরে বর্গাকার ও আয়তকার অনেকগুলি ব্লক গড়ে উঠেছিল এই ব্লগগুলি বেশ কয়েকটি গলির মাধ্যমে বিভক্ত হয়েছিল যার দুপাশে নগরের বাড়িগুলি গড়ে উঠেছিল রাস্তার উপর বাড়িগুলি যাতে চলে না আসে এবং যানবাহন ও মানুষের চলাচলে যাতে অসুবিধা না ঘটে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হত। রাস্তার ধারে নির্দিষ্ট দূরত্বে বাতিস্তম্ভের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মত। কেবলমাত্র বায়ালি ছাড়াও প্রায় সব হরপ্পীয় নগরের পরিকাঠামোগত বিন্যাসে দাবার বোর্ডের মত ব্লক লক্ষ করা যায়

 জলনিকাশি ব্যবস্থা হরপ্পা সভ্যতার নগর জীবনের এক অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য যা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের অন্য কোন সভ্যতায় লক্ষ্য করা যায় না মূল রাস্তাগুলির নীচে এক থেকে দুই ফুট গভীর ঢাকনা দেওয়া বড়নালা ছিল, তার সঙ্গে যুক্ত ছিল অনেক ক্ষুদ্রতর নালা যা দিয়ে প্রতিটি বাড়ির জল নিষ্কাশিত হত সোকপিটের অস্তিত্ব, স্নানাগারের ব্যাপক ব্যবহার নাগরিক পরিছন্নতাবোধ বা স্বাস্থ্যসচেতনতার ইঙ্গিত বহন করে সমগ্র জলনিকাশি ব্যবস্থাকে নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে পরিষ্কার করা হত জলনিকাশের উন্নত ব্যবস্থা মহেঞ্জোদারো হরপ্পা মত কালিবঙ্গান বা লোথালেও উপস্থিত, যদিও সমসাময়িক সুমেরীয় ও অন্যান্য সভ্যতা তা লক্ষ্যণীয় নয় সুমেরীয় নগরগুলোতে বাড়ির আঙ্গিনার লার ভূগর্ভে প্রথিত নালীতে নোংরা জল জমা হত, কিন্তু জল শহরের বাইরে নিষ্কাশন করার কোন ব্যবস্থা ছিলনা সেই দিক দিয়ে হরপ্পা সভ্যতার জল নিকাশি ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে অনেক উন্নততর

 প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে হরপ্পার নগরগুলিতে তিন ধরনের বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে - ১) বসত বাড়ী, ) বৃহৎ অট্টালিকা এবং ৩) রাষ্ট্রীয় স্নানাগার নগরগুলিতে বিভিন্ন আকারের বসতগৃহ ছিল যাদের মধ্যে ছোটগুলিতে কেবল মাত্র দুটি ঘর ছিল তবে সাধার নাগরিকদের বাড়ীতে বেশ কিছু কামরা, রান্নাঘর, স্নানাগার ও আঙ্গিনা থাকত ব্যাবিলনীয় নগরের বাসগৃহের মত সিন্ধু নগরের গৃহগুলিতে উন্মুক্ত আঙ্গিনা থাকত কোনও কোনও বাড়ীতে সিঁড়ির চিহ্ন থেকে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেওয়া চলে যে ঐ বাড়ীগুলিতে একাধিক তলা ছিললোথালে একটি রাস্তার ধারে দুই বা তিন কামরা বিশিষ্ট পরপর যে বারোটি বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলিকে দোকান বলে মনে করা হয় ২৬ X ১২. X ৫.৫ সেমি আয়তন বিশিষ্ট পোড়ামাটির মসৃণ ইটের সাহায্যে বাড়ীগুলি নির্মিত হত যেগুলিতে দেওয়ালের কোনে দরজা (সম্ভবত কাঠের তৈরি) থাকত সাধারণ গৃহের বাইরের দেয়ালে জানলার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে শহরের নিম্ন এলাকাতেই সাধারণ নাগরিকদের বসত বাড়ীগুলি অবস্থিত ছিল

 শহরের দুর্গ বা সিটাডেল এলাকাতেই প্রধান ইমারতগুলি তৈরী করা হয়েছিল যেগুলির অধিকাংশই নগরের সামূহিক জীবনযাত্রার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হত এই প্রসঙ্গে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া দুটি বৃহৎ শস্যাগারের উল্লেখ করা চলে হরপ্পার শস্যাগারটি আয়তন ৯০০০ বর্গফুট; দুটি শাড়িতে শস্যাগারটি বিভক্ত, প্রতি সারিতে ছয়টি করে শস্য সংরক্ষণ করার মঞ্চ; দুই সারি মঞ্চের মাঝখানে ২৩ ফুট লম্বা চলাচলের মূল পথ শস্যাগারের মধ্যে হাওয়া চলাচলের জন্য বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা ছিল এবং এর দ্বারা শস্য শুকনো রাখা যেত স্যাগারটির ঠিক দক্ষিণে গোলাকৃতি গর্ত বিশিষ্ট একটি মঞ্চকে পুরাতাত্ত্বিক ফসল ঝাড়াই এর ক্ষেত্র বলে মনে করেনএই মঞ্চের সঙ্গে লাগোয়া এক কামরা বিশিষ্ট প্রকোষ্টগুলিকে শ্রমিকদের বাসস্থান বলে অনুমান করা হয় চারশ মাইল ব্যবধানে অবস্থিত মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কৃত শস্যাগারের অনুরূপ আয়তন অর্থনৈতিক জীবনে নিয়ন্ত্রণের ছাপ বহন করে শস্যাগারে আনীত শস্য সম্ভবত রাজস্ব হিসাবে গ্রহণ করা হত, স্টুয়ার্ট পিট ও মার্টিমার হুইলারের মতে শস্যাগারটি আধুনিক ব্যাঙ্কের মত শস্য লেনদেন করত 

 মহেঞ্জোদারোতে বৌদ্ধস্তূপের কাছে একটি বিশাল ইমারত পাওয়া গেছে যা সম্ভবত পুরোহিত সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট ছিল এই ইমারতের মধ্যে খিলানযুক্ত ও বসবাসের সন যুক্ত ৮০x৮০ ফুট আয়তন বিশিষ্ট একটি বিশাল কামরা পাওয়া গেছে যেটিকে একটি সভাগৃহ বলে অনুমান করা হয়মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত আড়াইশ ফুট দীর্ঘ বৃহৎ ইমারতটিকে কোনও কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক রাজা বা অনুরূপ কোন শাসকের প্রাসাদ বলে মনে করেন যদিও নিশ্চিতভাবে হরপ্পা সভ্যতায় শাসকগোষ্ঠীর কোন পরিচয় পাওয়া যায় না মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত বৃহৎ অট্টালিকাগুলির কোনোটিকে খান্স (khans) আবার কোনোটিকে Collegiate Building বলে মনে করা হয় বৌদ্ধ স্তূপের পশ্চিমে মার্শাল যে বৃহৎ স্নানাগারটি আবিষ্কার করেছেন সেটি দৈর্ঘ্য ৩৯ ফুট, প্রস্থে ২৩ ফুট ও গভীরতায় ৮ 8 ফুট জলাশয়টির চারপাশে ছিল কয়েক সারি ঘর জলাশয়টিতে স্নানের জন্য জল আসত নিকটস্থ একটি কূপ থেকে এবং জল নিষ্কাশনের জন্য আলাদা একটি বড় প্রণালী ছিল  

 হরপ্পার নগরগুলির ধ্বংসাবশেষ থেকে একটি সুনির্দিষ্ট বিন্যাস লক্ষ্য করা যায় নগরের উচ্চ দুর্গ এলাকায় যেমন ছিল ধনীদের বৃহত্তম প্রাসাদপম অট্টালিকা; রাষ্ট্রীয় শস্যাগার, সভাগৃহ ইত্যাদি ইমারতগুলি অন্যদিকে তেমনি নিম্ন এলাকায় ছিল দোকানি ও কারিগরদের ছোট ছোট বসতবাড়ীগুলি ক্রিটের মতই এই নগরগুলিতে গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া অর্থনীতির ধারণা প্রচলিত ছিল প্রকৃতপক্ষে সামাজিক পরিকাঠামোকে নগর পরিকাঠামোর মধ্যে প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস হরপ্পা সভ্যতায় লক্ষণীয় এই পরিকাঠামো নে সচেতনতা ও স্বাতন্ত্র্যকে লক্ষ্য করে হুইলার একে 'meticulous planning' (যে পরিকল্পনায় খুঁটিনাটি বিষয়ে সতর্ক নজর রাখা হত) বলে অভিহিত করেছেন যেখানে শৃংখলাবদ্ধভাবে বিভিন্ন নথিপত্র রক্ষিত হত মিশরীয় সভ্যতার পিরামিড বা সুমেরীয় সভ্যতার মহার্ঘ ঐশ্বর্যময় মন্দিরগুলি হরপ্পার নগরগুলিতে অনুপস্থিত বস্তুতপক্ষে হরপ্পা নগরগুলির নির্মাণ কৌশলে সৌন্দর্যের চেয়ে দৃঢ়তা ও উপযোগীতাকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল হরপ্পা সভ্যতা থেকে যে নগর জীবনের চিত্র লক্ষ্য করা যায় পিগট তাঁকে Monotonous বা একঘেয়ে বলে উল্লেখ করেছেন বস্তুতপক্ষে কি পরিকল্পনায়, কি পরিকাঠামো হরপ্পীয় নগরগুলি ছিল যেন একটি অদৃশ্য কিন্তু দৃঢ় অভিন্ন সূত্রে গাঁথা

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এই ব্যাপক নগরায়নের ভিত্তি কি ছিল তা নিয়ে পুরাতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে রামশরণ শর্মা মনে করেন যে, এই নগর সভ্যতার ভিত্তি ছিল দুটি ১) ব্রোঞ্জ প্রযুক্তি (ব্রোঞ্জ ও তাম্র নির্মিত অস্ত্রের সাজ-সরঞ্জামের ব্যাপক প্রচলন ছিল) এবং ২) কৃষক কর্ত্তৃক উৎপন্ন উদ্বৃত্ত নদীমাতৃক এলাকায় এই সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও প্রসার ঘটায় প্রথমাবধি হরপ্পা সভ্যতার কৃষি অর্থনীতি সুদৃঢ় ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যথেষ্ট পরিমাণ ফসল উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকলে তবে নগরের বাসিন্দাদের কাছে গ্রাম থেকে উদ্বৃত্ত খাদ্য সংস্থান শহরে সরবরাহ করা যেত মহেঞ্জোদারো হরপ্পা আবিষ্কৃত শস্যাগার প্রমাণ করে যে কৃষি অর্থনীতির সাফল্যই হরপ্পা সভ্যতার পেশাদারী ও সর্বসময়ের জন্য নিযুক্ত কারিগর ও বণিকদের ক্রিয়া-কলাপ অব্যাহত রেখেছিল রামশরণ শর্মা আর মনে করেন যে, হরপ্পা নগরায়নের বিকাশে পরিবেশগত আনুকূল্যও কাজ করেছিল সিন্ধু ও তার উপনদীগুলি এবং স্বরস্বতীর অপেক্ষাকৃত বর্ষণমুক্ত ও বন্যাপ্রবণ সমভূমিতে তাম্র প্রস্তর যুগের প্রযুক্তি যথেষ্ট কার্যকর হয়েছিল কেননা যেসব অঞ্চলে হরপ্পার নগর বসতি প্রধানত গড়ে ওঠে সেখানে পলিমাটির আস্তর পরিষ্কার করার কোন সমস্যা ছিল না দিলীপ কুমার চক্রবর্তী মনে করেন যে, গ্রামীণ 'আদি' পর্যায় থেকে 'পরিণত' পর্যায়ের লিপিযুক্ত নাগরিক জীবনের উত্তরণের পেছনে একটি বড় কারণ ছিল ঘর্ঘরা, (হাকরা বা সরস্বতী) রাভি, সিন্ধু প্রভৃতি নদীতে খাল কেটে সেচ ব্যবস্থার সৃষ্টি শর্মার মত চক্রবর্তীও হরপ্পা নগর সভ্যতার বিকাশে কারিগরী শিল্পের ব্যাপকতাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন অন্যদিকে শিরিন রত্নার মনে করেন যে, ব্যাপক বৈদেশিক বাণিজ্য হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলি গড়ে ওঠার পেছনে দায়ী স্যাফার, পোখেল এবং চক্রবর্তী যদি রত্নারের এই মত খন্ডন করেছেন উপরোক্ত আলোচনার উপর ভিত্তি করে হরপ্পার নগর সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের একটি ধারা অনুমান করা যেতে পারে – (ক) সিন্ধু সরস্বতী নদী উপত্যকার অনুকূল পরিবেশে কৃষিব্যবস্থা শক্তিশালী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেচব্যবস্থা যাকে আরো শক্তিশালী করে তোলে, (খ) এর ফলে কৃষি উৎপাদনে উদ্বৃত্ত হতে থাকে এবং বিকল্প পেশা হিসাবে শিল্প ও বাণিজ্যের উদ্ভব ঘটে, (গ)দ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদনের উপর জীবন ধারণ করে নগরবাসী কারিগর ও বণিক শ্রেণী যথাক্রমে কারিগরী শিল্পের এবং বৈদেশিক তথা আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে হরপ্পার কেন্দ্রগুলিতে নগরজীবনের সাফল্যকে ধরে রেখেছিল

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

       ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাই মুঘলদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বলে মনে করেন শিরিন মুসবি । শিল্প বাণিজ্য থেকে আয়ের পরিমাণ সামান্য । ভূমি রাজস্ব হল ‘ মাল ’ বা ‘ খারাজ ’ । মুঘলরাষ্ট্র সামন্তরাজাদের কাছ থেকে কর পেত । তাছাড়া রাষ্ট্র পেত যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ ( খামস ); স্থানীয় আবওয়াব জিহত , শয়ের - ই - জিহত , ফুরুয়াত , অমুসলমানদের উপর স্থাপিত কর জিজিয়া এবং মুসলমানদের দেয় কর জাকাত ।         আকবরের আমলে সরকারের মোট রাজস্ব পরিমাণ ছিল ১২ , ৮২ , ৮৩ , ৮২৫ টাকা , সুজন রায়ের মতে , ঔরঙ্গজেবের আমলে ৩২ , ৬৮ , ১৬ , ৫৮৪ টাকা , এই রাজস্বের ৬ % ভাগ বাণিজ্য শুল্ক থেকে এবং ৪ % ঔরঙ্গজেব জিজিয়া থেকে পেতেন । বাকি সব রাজস্ব কৃষি খাতে আদায় হত ।       বাবর ভারতবর্ষ জয় করে অধিকৃত অঞ্চলের সমস্ত জমি ইক্তা হিসেবে অভিজাতদের মধ্যে বন্টন করে দেন । দেশের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য ও সংগৃহীত হত । হুমায়ুন এ ব্যাপারে কোন পরিবর্তন ঘটাননি । মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা গঠন করেন আকবর । আকবরের আগ...