সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সুফিবাদের প্রভাব।

 

সুলতানি যুগের সমাজ ও সংস্কৃতিতে সুফিবাদের প্রভাব


সুলতানি শাসনকালে ভারতবর্ষের দুটি মৌলিক সংস্কার আন্দোলন হয়েছিলভক্তিবাদ যখন হিন্দু ধর্মের পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হয়েছিল ঠিক সেই সময়েই মুসলিম ধর্মে সুফিবাদ নামে একটি উদারনৈতিক সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় বলাবাহুল্য 'সুফী' নামের উৎপত্তি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে ) 'সাফা' বা 'পবিত্রতা' শব্দ থেকে এর উৎপত্তি হতে পারে ) 'সাফ' বা সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ানো কথাটি থেকে সুফী কথাটি এসে থাকতে পারে ) 'সুফা' থেকে সুফী শব্দটি এসে থাকতে পারে ) একটি মতানুযায়ী হজরত মহম্মদ কর্তৃক মদিনায় প্রতিষ্ঠিত মসজিদের বাইরে যারা উপাসনা করেছিলেন তারাই নাকি সুফী ) আবু নাসবাল সাব্বাজ তাঁর গ্রন্থে দাবি করেছেন যে, 'সুফ' বা মোটা পশমের বস্ত্র দ্বারা সুফীরা নিজেদের আচ্ছাদিত করে রাখতেন বলে তাদের সুফী বলা হত জামির মতে ৮০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে বুফার আবু হাসিম সর্ব প্রথম সুফী শব্দটি ব্যবহার করেন অউল্ কুরেশীর মতে ৮১১ খ্রিষ্টাব্দে শব্দটি ইরাকে পবিত্র মানুষদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা শুরু হয় এবং পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সমগ্র মুসলিম সমাজের আধ্যাত্মবাদীদের বোঝাতে সুফী শব্দটি ব্যবহার করা হতে থাকে

 সুফী নাম করণের উৎপত্তি ও প্রেক্ষাপট নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একথা বলা যায় যে, ইসলামের মধ্যে থেকেই সুফীবাদের জন্মইউসুফ হুসেন লিখেছেন যে ইসলামের বক্ষদেশ থেকে সুফীবাদের জন্ম ইসলাম ধর্মের সূচনা কাল থেকেই একশ্রেণীর অতীন্দ্রিয়বাদী মুসলিম ছিলেন যারা পরবর্তীকালে সুফী নামে পরিচিত হন ইসলামের শান্তি দূত সূফীদের ব্রত ছিল অন্ধকারের দেশ 'দার-উল-হার্বকে বিশ্ববাসীর দেশ 'দার-উল-ইসলাম' এ পরিনত করাতাঁর মতে সুফীবাদ ইসলাম ধর্মের একটি অংশ এ বিষয়ে সন্দেহ নেই তফাৎ এই যে, গোঁড়া মুসলমানরা ধর্মাচরণের উপর জোর দেন কিন্তু সুফীরা গুরুত্বদেন অন্তরের শুদ্ধতাকে গোঁড়াপন্থীরা বিশ্বাস করেন যে, ঈশ্বরের করুনা লাভের জন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান নিখুঁত ভাবে পালন করা উচিত কিন্তু সুফীরা মনে করেন যে প্রেম ও ভালোবাসার মধ্যে দিয়েই ঈশ্বরের কাছে পৌছানো সম্ভব প্রখ্যাত মুসলিম ধর্মবিদ - জাকারিয়া আনসারী লিখেছেন সুফীবাদ শিক্ষাদেয় অনন্ত শান্তি লাভের জন্য কিভাবে আত্মাকে শুদ্ধ করতে হয়, নৈতিক মান উন্নত করতে হয় এবং ব্যবহারিক জীবনে আচরণ করতে হয় এর মূল বিষয় হল আত্মার শুদ্ধি এবং প্রধান লক্ষ্য হল স্বর্গীয় আশীর্বাদ লাভ করা ইসলামের অগ্রগতির যুগে সুফী সন্তরা শান্তি ও মানবতাবাদের কথা প্রচার করে বিজীত মানবগোষ্ঠীকে ইসলামের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন

 ইউসুফ হুসেন সুফীবাদকে ইসলামের নিজস্ব সম্পদ বলে দাবী করলেও সুফীবাদের উপর অন্যান্য ধর্ম মতের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না সুফীবাদকে একটি জটিল প্রক্রিয়া বলে অভিহিত করে ঐতিহাসিক তারাচাঁদ বলেছেন কোরান ও মহম্মদের জীবন কেন্দ্রিক সংকীর্ণ প্রবাহ বহুদেশের বহু পথ ও মতের সঙ্গে মিলিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে সুফী মতবাদ পাশ্চাত্যের খৃষ্টধর্ম ও নবপ্লেটোবা প্রাচ্যের হিন্দু ও বৌদ্ধ ভাবাদর্শ পারস্যের জরাথ্রুষ্টীয় মতবাদ অদ্বৈতবাদ সুফীবাদ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে. এস. শীবাস্তবও মনে করেন যে ঈশ্বরকে ভালোবাসা, শান্তি ও অহিংসা, উপবাস ও শরীরের প্রতি নিগ্রহ যা সুফীরা অনুসরণ করে তা হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন মতবাদ থেকে গ্রহণ করা সতীশচন্দ্র উল্লেখ করেছেন যে, ইসলামের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত ছিল পাশাপাশি ইসলামের আবির্ভাবের পরেও হিন্দু যোগীরা পশ্চিম এশিয়ায় যেতেন, বুদ্ধির বহু কাহিনী ইসলামের লোকগাথায় প্রচলিত ছিল এই সকল তথ্যের ভিত্তিতে সতীশচন্দ্র অনুমান করেছেন যে বৌদ্ধ ও হিন্দু যোগ সাধকদের ধর্মচারণ পদ্ধতি সম্বন্ধে সুফীরা পরিচিত হন এবং কালক্রমে সেগুলিকে গ্রহণ করেন

বস্তুতপক্ষে সুফীবাদ হল একজন মুসলমানের ব্যক্তিগত স্তরে আল্লাহর জীবন উপস্থিতির অনুভূতি ১১৬৫-১২৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেকার সময় শেখ মহীউদ্দিন ইবনুল আরবী তত্ত্ব প্রচার করেন যার অর্থ স্রষ্টা বাহক এবং সৃষ্টি বা খালক এক এই বিশ্বের দৃশ্যমান বৈচিত্র্য বা বিভিন্নতা একই ঈশ্বরের নানামুখী প্রকাশ বলা বাহুল্য শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদে এরূপ এক ও অভিন্ন ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে উপনিষদে বলা হয়েছে যা কিছু বিরাজমান বা যা কিছু দৃশ্যমান সবই ব্রম্ভ। শ্রীমদ্ ভাগবত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন সর্বধর্ম পরিত্যজ্য মামেকংরনং ব্রজ অর্থাৎ সবকিছু করে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে হবে এটাই মহীউদ্দিনের "complete detachment from the world." লবেরুনী মনে করেন যে, সুফীবাদের আত্মা সম্পর্কিত মতবাদ পতঞ্জলি যোগসূত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিখ্যাত সুফী সাধক শেখ নিজামুদ্দিন আউলিয়া নাথ যোগীকৃত মানবদেহের বিভাজন মেনেনেনএই মতানুসারে মানবদেহের দুটি অংশ মাথা থেকে নাভি পর্যন্ত অংশ হল আধ্যাত্বিক শিবের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং পবিত্র নাভির নিম্নে দেহের অবশিষ্ট অংশ শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং অপবিত্র প্রায় অনুরূপভাবে সুফী সন্ত শেখ নাসিরউদ্দীন চিরাগ--দেহেলি হিন্দু যোগীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন কাজেই সুফী মতবাদের সঙ্গে ভারতীয় হিন্দু তথা বৌদ্ধ ধর্মের স্বাদৃশ্য কোনভাবে অস্বীকার করা যায় না

 সুফী দর্শনে পীর বা গুরুর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মার মিলনের জন্য মুরিদ বা শিষ্যকে পীর সঠিক পথ ও পদ্ধতির সন্ধান দেনএকটি মতানুসারে একজন সুফী সাধনার দশটি স্তর অতিক্রম করলে তবেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারে এই দশটি স্তর হল i) তত্তবা বা অনুশোচনা, ii) ওয়ারা বা নিবৃত্তি, iii) সবর বা সহনশীলতা অর্জন, iv) শূকর বা কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন, v) সুফ বা অন্যায়ের প্রতি ভীতি, vi) রজা বা আল্লাহর করুণা লাভের ইচ্ছা, vii) তত্তয়াস্কুল বা আনন্দে বিষাদে অচঞ্চল থাকা, viii) রিজা বা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করা ভক্তিবাদী সাধকদের মত সুফীরা ও পার্থিব জগতের সাথে সম্পর্ক শূন্য থাকাকে আবশ্যিক বলে মনে করতেন সুফীদের একাংশ বিবাহ করে সাধারণ সংসার জীবন যাপন করলেও অধিকাংশই পীরের নেতৃত্বে নির্জন স্থানে খানকা বা দরগায় বসবাস করতেন এবং ইসলামীয় শাস্ত্র চর্চা করতেন শিক্ষাদীক্ষা ছাড়াও দরগাগুলি দরিদ্রকে অন্নদান ও চিকিৎসার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হত কোন কোন সুফী পন্ডিত জমিতে চাষাবাদ করলেও সুফীরা জীবিকা নির্বাহের জন্য মূলত মানুষের অযাচিত দানের উপরেই নির্ভর করতেন সুফীরা মূলত দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল যারা ইসলামী আইন কানুন বা শরা অনুসরণ করতেন তাঁরা ছিল শরা, সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশ কোন ধরনের নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে মুক্তভাবে অন্তরের বিকাশে আস্থাবান ছিলেন এদের বলা হত বেশরা ভারতে প্রথমোক্ত গোষ্ঠী অধিক প্রভাব বিস্তার করেছিল

প্রথম পর্বের প্রখ্যাত সুফী সাধকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বসরার মহিলা সুফী রাবেয়া (অষ্টম শতক) এবং মনসুর বি হল্লাজ (দশম শতক) তাঁরা প্রচার করেন সর্বভুতেই ঈশ্বরের সাথে মানুষের মিলন সম্ভব, স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কে এই অভেদ ধারণা গোড়াপন্থীদের ক্ষুব্ধ করে এবং তা শিয়া ও সুন্নী উভয় সম্প্রদায়ই সুফীদের বিরুদ্ধাচারণ করে শেষ পর্যন্ত আরবীয় দার্শনিক আল গজালী (১১০৫-১১১২) সুফীদের অতীন্দ্রিয়বাদ ও ইসলামের গোঁড়া মতবাদের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধনের কাজে কিছুটা সফল হয় তিনি ইসলামের রহস্যবাকে অধিবিদ্যামূলক ভিত্তি দেন এবং যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করেন যে অতীন্দ্রিয়বাদ যুক্তিসম্মত সুফী মতবাদের বিবর্তনে বায়াজিদ বুষ্টামি নামে জনৈক পার্শিয়ান ধর্ম প্রচারকের নাম খুবই প্রশিদ্ধ তিনি ঈশ্বরীয় অনুভূতিতে আবেগ ও অতীন্দ্রিয় ভাববাদ আরোপ করেন প্রথম সুফী লেখক আব্দুল্লা-আল মুহসিন বাইবেলের গসপেলের ভঙ্গিতে সুফী মতবাদ প্রচার করেন হূসেন ইবন হানসুর আল হামাজ রচিত 'ইনসান-- কমিল', ফরিদউদ্দিন অ্যাটার রচিত তদ কিরত অল আউলিয়া এবং জালাল উদ্দিন রুমি রচিত 'মসনবি' গ্রন্থগুলি সুফী সমাজের উপর ঈশ্বরোপাসনা বিভিন্ন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে

 পাঞ্জাবে গজনীর সুলতান মামুদের আগ্রাসনের (১০০০-১০২৭) অব্যবহিত কাল পরেই ভারতে সুফী মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয় লাহোরের শেখ ইসমাইল ভারতে সুফীবাদের প্রথম প্রচারক তাঁর অনুগামী শেখ আলি-বিন-উসমান অ্যাল হুজৌরি ভারতে সুফী মতবাদকে জনপ্রিয় করে তোলেন সুফীদের মধ্যে অনেকগুলি উপদল বা সিলসিলাহ তৈরী হয়েছিল আবুল ফজল লিখেছেন যে ভারতে মোট চৌদ্দটি সুফী সম্প্রদায় প্রবেশ করেছিল এগুলির মধ্যে চিস্তি ও সুরাবর্দী সম্প্রদায়ের কার্যকলাপ মূলত সীমাবদ্ধ ছিল সিন্ধু ও উত্তর পশ্চিম ভারতে কিন্তু চিস্তি সম্প্রদায় প্রভাব সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে

 ভারতে চিস্তি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি। লাহোর, দিল্লি এবং মূলত আজমীরে তিনি তার কার্যকলাপ বজায় রেখেছিলেন একজন হিন্দু সন্নাসীর মত তিনি জীবন যাপন করতেন এবং বেদান্ত দর্শনের মতই অদ্বৈতবাদ প্রচার করেন আজমীরে মনুদ্দিনের (১১৪১-১২৩৫) সমাধি হিন্দু-মুসলমান উভয়ের কাছেই পবিত্র স্থান রূপে গণ্য হয় নুদ্দিনের একজন উল্লেখযোগ্য শিষ্য শেখ হামিদউদ্দিন রাজপুতানার নাগাউবে গৃহী জীবনযাপন করতেন এবং হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সুফীতত্ত্ব প্রচার করেন অপর শিষ্য সেখ কুতুবউদ্দিন সুলতান ইলতুৎমিসের রাজত্বকালে দিল্লিতে দরগা প্রতিষ্ঠা করেন অনুমান করা হয় সঙ্গীতানুরাগী এই সুফী সাধকের স্মৃতিরক্ষার্থে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লিতে কুতুবমিনারের নির্মাণ শুরু করেছিলেন। মনুদ্দিনের অপর শিষ্য শেখ ফরিদ বা বাবা ফরিদ (১১৭৫-১২৬৫) বর্তমান পাকিস্তানের অযোধ্যা অঞ্চলে খানকা স্থাপন করেন হিন্দু ভক্তিবাদী সাধকদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এত উদার ও উচ্চমার্গের ছিল যে পরবর্তীকালে শিখদের আদিগ্রন্থে শেখ ফরিদের বহু উপস্থাপিত হয়েছে বাবা ফরিদের শিষ্য হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া ছিলেন (১২৩৬-১৩২৫) চিস্তি সম্প্রদায়ের সর্বাধিক জনপ্রিয় সুফী সাধক আমির খসরু নিজামুদ্দিনের শিষ্য ছিলেন নিজামুদ্দিনের উদা ধর্মনিরপেক্ষতার মতবাদ উলেমাদের ক্ষুব্দ করলেও তাঁর বাণী সারা ভারতে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল নিজামুদ্দিনের শীর্ষ শেখ নাসিরউদ্দিন মামুদ পরবর্তীকালে চিরাগ--দিল্লী নামে পরিচিত হন চিরাগ--দিল্লীর একজন শিষ্য মহম্মদ গেসুদরাজ গুলবর্গায় গিয়ে সুফীবাদ প্রচার করেছিলেন এবং অলৌকিকতাবাদ সম্বন্ধে ত্রিশটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে চিস্তি সম্প্রদায়ভুক্ত সেলিম চিস্তির একান্ত অনুগামী ছিলেন মুঘল সম্রাট মহামতি আকবরচিস্তি সিলসিলার প্রধান কেন্দ্রগুলি ছিল আজমীর, নবনৌল, সারওয়াল, নাগাউর, হানসী, অযোধ্যা, বাদাউন ইত্যাদি স্থান।

  ইরাকের বাগদাদে সুরাবর্দী সিলসিলাহর প্রতিষ্ঠাতা শিহাব উদ্দিন সুরাবর্দী মুলতানের শেখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া আরব দেশে গিয়ে সুরাবর্দীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন এবং মুলতানে এসে খানকা প্রতিষ্ঠা করেন, সুরাবর্দী ধর্মাদর্শন প্রচার করেনএই সম্প্রদায়ের অন্যান্য প্রখ্যাত সন্ত ছিলেন সদরুদ্দিন আরিফ, সৈয়দ জালালউদ্দিন বুখারী প্রমূখ সুরাবর্দী সিলসিলাহ থেকেই পরবর্তীকালে জন্ম লাভ করে ফিরদৌসী ও সাত্তারি তারিখ সিলসিলা যথাক্রমে বিহার ও বাংলায়

   চিস্তি ও সুরাবর্দী সম্প্রদায়ের মধ্যে কতগুলি মৌলিক পার্থক্য ছিল চিস্তি সন্তরা নির্জন স্থানে খানকা স্থাপন করতেন এবং সহজ সরল ও কঠোর সংযমপূর্ণ জীবন যাপন করতেন সমাজের হীন দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের জন্য তাদের সাধনগৃহ সর্বদাই উন্মুক্ত থাকত কিন্তু সুরাবর্দী সম্প্রদায় অতিরিক্ত কৃচ্ছসাধনে বিরোধী ছিলেন এঁরা ধর্মসংক্রান্ত বা বিচার বিভাগীয় উচ্চপদে যুক্ত থেকে ধর্ম চর্চা করতেন সমাজের উঁচু শ্রেণীর যোগাযোগ ছিল গরীব মানুষেরা এঁদের খানকায় প্রবেশাধিকার পেতেন না

  শেখ মহীউদ্দিনের মতবাদের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে একজন প্রেমিক যেমন প্রেমিকার জন্য উদগ্রীব হয় একজন সুফীও সবকিছু ভুলে ঈশ্বরের সান্নিধ্যেরর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সুফীরা মানবসেবা, দরিদ্র নিরামিষ খাদ্য, শান্তি, মৈত্রী ও অহিংসাব্রতকে অন্তরের সঙ্গে পালন করে ভারতে সনাতন বেদ, উপনিষদ বা ভাগবদ্‌ গীতায় এসব কথা বহুদিন আগে থেকে বলা হলেও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তাঁর বিন্দু বিসর্গও জানতো না উচ্চবর্ণের অবহেলার শিকার হয়ে এই অন্তজ শ্রেণি চরম দারিদ্র, চরম অজ্ঞতা নিয়ে প্রায় মনুষ্যত্বের জীবনযাপন করত ভারতের মধ্যে এই শোষিত দরিদ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে সুফীদের সহজ সরল জীবনযাপন এবং বৈরাগ্য ও উদারতা সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়ে ফীরা এদের শোনালেন ইসলাম ধর্ম প্রেমের ধর্ম এবং ঈশ্বরের কাছে মানুষের কোন ভেদাভেদ নেই হিন্দুদের আকৃষ্ট করার জন্য সুফীরা হিন্দু সাধুদের মত পোশাক পরত এবং আচার-আচরণ পালন করত। তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের প্রতি সাধারণ ভারতীয়দের একটা গভীর টান আগে থেকেই ছিল সুফী পীর ও দরবেশদের অলৌকিক শক্তি প্রদর্শনের দক্ষতা স্বাভাবিক কারণেই সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে তোলে অনেকেই পীরের দরগায় নিয়মিত আসতে শুরু করে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হিন্দু রাজারাও তাদের শাসনাধীন অঞ্চলে সুফীবাদের কার্যকলাপের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে কোন বাধা দান করেন নি ফলে অনুকূল বাতাবরণে সুফীবাদ অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল

মধ্যযুগীয় ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে সুফীবাদের প্রভাব কতখানি পড়েছিল তা আলোচনা করা যেতে পারে সুফীবাদের সার্বজনীন আদর্শ ধর্মীয় উত্তেজনা প্রশমিত করে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে সাবলীল করে তুলতে সাহায্য করেছিল ইসলামের সাম্যবোধ ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব বোধের আবেদন (সুল- -কুলের আদর্শ) সুফী দর্শনের মধ্যে সবচেয়ে বেশী স্পষ্টরুপে প্রকাশ পায় সুফী দর্শন মুসলিম যুব সম্প্রদায়ের নৈতিক মনোনয়ন ঘটাতে সাহায্য করে সুফিবাদের সাম্য ভাবনা বহু নিম্নবর্ণের হিন্দুকে আকৃষ্ট করলেও প্রচলিত হিন্দু ধর্মের উপর সুফীবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল নগণ্য ঐতিহাসিক এ. এল. শ্রীবাস্তব মনে করেন যে, সুফীরা দীর্ঘকাল ধরে ভারতে তাদের ধর্মমত প্রচার করলেও বৃহত্তর সমাজের উপর তার কোনো প্রভাব ফেলতে পারেননি নিম্নবর্ণের হিন্দু গোঁড়া সুন্নীদের কাছে পাত্তা না পেয়ে সুফী সম্প্রদায়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল এবং তাদের সঙ্গে মেলামেশা করত সাধারণ হিন্দুসমাজ সুফিদের সঙ্গে সুন্নী ইসলামের কোন পার্থক্য খুঁজে পায়নি এবং সুফী মতবাদ যা বলত তাদের ধর্মের ঐশ্বর্যের ক্ষেত্রে তা নিতান্তই নগণ্য বলে হিন্দুরা এদের সংশ্রব এড়িয়ে চলত ডঃ অনিল চন্দ্র ব্যানার্জি মনে করেন যে, সুফীরা ত্রয়োদশ শতাব্দীর পূর্বে ভারতের নিম্ন বর্ণের কিছুসংখ্যক হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হলেও শতাব্দীর পরে তাদের কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়ে এর কারণ হলো রাজ ক্ষমতায় ক্ষমতাশালী উলেমাদের কর্তৃত্বের ছায়া থেকে তারা নিজেদের স্বাতন্ত্রকে পৃথক রাখতে পারেননি রমেশচন্দ্র মজুমদার এই প্রসঙ্গে বলেছেন যে, মধ্যযুগের ভারতে সুফীবাদের গুরুত্ব খুব একটা বেশি নয় কারণ এই ধর্মমতের প্রভাবে ধর্মান্তরিত সুফী ইসলামের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য হিন্দুরা হিন্দুদের মত এবং মুসলমানরা মুসলমানদের মতই পার্থক্য বজায় রেখে চলেছিল দুটি ধর্ম যেন একটি নদীর পরস্পর বিপরীত দুই তীর দুই তীরের মধ্যে সুফীরা সেতুবন্ধনের চেষ্টা করলেও তা কার্যকরী হয়নি স্থানীয়ভাবে হয়তো সাময়িক কোন সেতু রচিত হলেও তা চিরস্থায়ী হয়নি অন্যদিকে মুসলিম ঐতিহাসিক ইউসুফ হুসেন মনে করেন যে কোরানের শিক্ষাকে সুফীরা ভারতের মৃত্তিকায় সুপ্রোথিত করেছে। সুফীরা কোরানের মৌলবাদী নীতি থেকে আধ্যাত্ম সাধনার দিকটি পৃথক করে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করেছে যাদের হৃদয় মৌলবাদী ভাবনা-চিন্তায় সন্দীহান, তাদের কাছে সুফী মতবাদ ছিল শান্তির  প্রলেপ

  ঐতিহাসিক বক্তব্যকে অনুসরণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, হিন্দু সমাজে অবহেলিত নিম্নবর্ণের মানুষ যারা একত্রে উপাসনা বা মুক্তি লাভের উপায় সন্ধানের অধিকার থেকে বঞ্চিত তারাই বা তাদের একটি বৃহৎ অংশ সাম্যবাদী সুফী দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এছাড়া মধ্যযুগের শিক্ষা ও সাহিত্যের উপর সুফী দর্শনের ও সুফী আন্দোলনের প্রভাব ছিল লক্ষণীয় সুফীদের খানকা বা জামাতখানাগুলি বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞানান্বেষণের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। অনেক খানকায় নিয়মিত বিদ্যালয় পরিচালন করা হতো সুফীরা হিন্দী ও উর্দু ভাষার সমন্বয়ে হিন্দভী ভাষায় কবিতা রচনা করার ফলে তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয় এবং হিন্দী ভাষারও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে সুফীদের গীত বাউল ধর্মী 'সম' গান ভারতীয় সঙ্গীতকে পুষ্ট করেছিল

ইসলাম ধর্ম তার হিন্দু বিদ্বেষ নিয়ে, মৌলবাদী ধ্যান ধারণা নিয়ে, উলেমাদের অপ্রতিহত ক্ষমতার দম্ভ নিয়ে, জিম্মি বা অমুসলমানদের উপর জিজিয়া প্রয়োগ নিয়ে যখন ভারতে তার রাজকীয় দীপ্তি ও মহিমা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল, হিন্দুরা ও তাদের প্রতি অত্যাচারের ক্ষত বুকে নিয়ে তাদের ধর্ম ও সমাজকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর হয়ে সুকঠীন মৌলবাদী চিন্তার মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রেখেছিলএই ধর্মীয় ঘাত প্রতিঘাতের কালপর্বে ইসলামী ও সুফীবাদ বা হিন্দু ভক্তিবাদ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে এবং অহিংসার মন্ত্রে সকলকে বাঁধতে চেয়েছিল। এই আঙ্গিকে বিচার করলে সুফীবাদ ইসলামের ভারতীয় করন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিল মানুষের ওপর বল প্রয়োগ করে নয়, মানুষের হৃদয় জয় করেছে ভালোবাসার উদারতার দানকার্য ও সমাজ সেবার মাধ্যমে যার ফলশ্রুতি হিসেবে গোঁড়ামী, রক্ষণশীলতা, জাতিভেদ সাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে সহিষ্ণু এবং সমন্বয় মূলক ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশ

 

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

       ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাই মুঘলদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বলে মনে করেন শিরিন মুসবি । শিল্প বাণিজ্য থেকে আয়ের পরিমাণ সামান্য । ভূমি রাজস্ব হল ‘ মাল ’ বা ‘ খারাজ ’ । মুঘলরাষ্ট্র সামন্তরাজাদের কাছ থেকে কর পেত । তাছাড়া রাষ্ট্র পেত যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ ( খামস ); স্থানীয় আবওয়াব জিহত , শয়ের - ই - জিহত , ফুরুয়াত , অমুসলমানদের উপর স্থাপিত কর জিজিয়া এবং মুসলমানদের দেয় কর জাকাত ।         আকবরের আমলে সরকারের মোট রাজস্ব পরিমাণ ছিল ১২ , ৮২ , ৮৩ , ৮২৫ টাকা , সুজন রায়ের মতে , ঔরঙ্গজেবের আমলে ৩২ , ৬৮ , ১৬ , ৫৮৪ টাকা , এই রাজস্বের ৬ % ভাগ বাণিজ্য শুল্ক থেকে এবং ৪ % ঔরঙ্গজেব জিজিয়া থেকে পেতেন । বাকি সব রাজস্ব কৃষি খাতে আদায় হত ।       বাবর ভারতবর্ষ জয় করে অধিকৃত অঞ্চলের সমস্ত জমি ইক্তা হিসেবে অভিজাতদের মধ্যে বন্টন করে দেন । দেশের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য ও সংগৃহীত হত । হুমায়ুন এ ব্যাপারে কোন পরিবর্তন ঘটাননি । মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা গঠন করেন আকবর । আকবরের আগ...