গজনীর
সুলতান মামুদের ভারত অভিযানের বিস্তারিত বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে, তিনি ছিলেন একজন সামরিক প্রতিভাধর ব্যক্তি ও বড় যোদ্ধা। ১০০০-১২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টানা ২৬ বছর সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাঁর প্রতিটি আক্রমণের নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য পরিলক্ষিত হয়। সামগ্রিকভাবে
তাঁর ভারত বিরোধী অভিযানগুলির কোন সুদূর
প্রসারী বা গঠনমূলক প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। তিনি একমাত্র শাসক যিনি ভারতে সতের বার
আক্রমণ করেন এবং প্রতিবারই জয়লাভ করেন। পৃথিবীর
ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত প্রায় নেই-ই, যখন
একজন মধ্যযুগীয় শাসক কোন একটি দেশের বিরুদ্ধে এক নাগাড়ে এতগুলি অভিযান
পাঠিয়েছেন এবং ফলের দিক থেকে প্রতিটি অভিযানই ছিল স্বতন্ত্র।
তবে কী উদ্দেশ্য নিয়ে সুলতান মামুদ ভারত
অভিযান প্রেরণে ব্রতী হয়েছিলেন? অথবা এই
অভিযানের চরিত্র বা প্রকৃতি কী ছিল? সবুক্তগীনের মৃত্যুর
পর তাঁর পুত্র মামুদ পিতার পথ অনুসরণ করে ভারত অভিযানে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। এছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না
এমন কথা বলা হলে তা হবে ইতিহাসের অতি সরলীকরণ ব্যাখ্যা। তিনি গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ন্যায় দিগ্বিজয়ী স্পৃহা চরিতার্থ করার লক্ষ্য নিয়ে
ছিল এমন ধারণা পোষণ করা হয় তাঁর অভিযানগুলির
গতিপ্রকৃতির নিরিখে। যদি ঐ উদ্দেশ্য থাকত
তাহলে বারবার নিজের রাজ্য গজনীতে ফিরে গিয়ে আবার সেই ভারতের দিকেই মামুদ কর্তৃক অভিযান
প্রেরিত হত না। ড. রোমিলা
থাপার মনে করেন, মামুদের ভারত আক্রমণের লক্ষ্য ছিল
এদেশের অপরিমেয় ঐশ্বর্য এবং পাঞ্জাবের উর্বরা সমভূমি অঞ্চল। ভারত ভূমিতে রাজনৈতিক
আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য দ্বারা মামুদ
পরিচালিত হননি। কারণ
ভারতের থেকে মধ্য এশিয়ার রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ
ছিল বেশি। অধ্যাপক
সতীশচন্দ্রও মনে করেন, সুলতান মামুদের
ভারত আক্রমণের পর্ব অর্থাৎ হিন্দু শাহীরাজ্যের বিরুদ্ধে
অভিযানের লক্ষ্য ছিল সীমান্তবর্তী শত্রু
রাজ্যের ধ্বংস করা এবং ভারতের সমৃদ্ধ অঞ্চলে
প্রবেশের ছাড়পত্র অর্জন করা। অর্থাৎ তাঁর প্রাথমিক আক্রমণের পশ্চাতে ছিল পরবর্তী আক্রমণ শানানোর পথ তৈরি করার লক্ষ্য।
বস্তুতপক্ষে
মামুদের ভারত অভিযানের প্রকৃতিকে দুটি দিক থেকে দেখা বাঞ্ছনীয় হবে, - ধর্মীয়
এবং লুণ্ঠন। তবে প্রথমটি তুলনায় দ্বিতীয়টির উপরই
ঐতিহাসিকরা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এছাড়া সতের বার ধরে প্রেরিত তাঁর অভিযানগুলির বিচার-বিশ্লেষণ করলেও ঐ একই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো বাঞ্ছনীয় হবে। এ কথাও মিথ্যা নয় যে গোঁড়া মুসলমানদের মধ্যে দেবমূর্তি
ধ্বংস করা অনেক ক্ষেত্রেই যেন একটা রীতিতে পরিণত হয়েছিল। ভারতে অভিযানকালে মামুদ একের পর এক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছেন। থানেশ্বর, কনৌজ, মথুরা ও
সোমনাথের ইতিহাস খ্যাত মন্দিরগুলি তাঁর অভিযানের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছে। এ. এল. শ্রীবাস্তব
মনে করেন যে, ইসলাম ধর্মের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করার
উদ্দেশ্য নিয়ে মামুদ অভিযানগুলি প্রেরণ করেছিলেন। অর্থাৎ মামুদের ভারত অভিযানের প্রকৃতির
মধ্যে নিহিত ছিল ধর্মীয় প্রেরণা, এমন মত উপস্থাপিত করতে চেয়েছিল এ. এল. শ্রীবাস্তব।
মনে
রাখা দরকার মামুদ ধর্মোন্মাদ ছিলেন না। এমনকি গোঁড়া ইসলাম
ধর্মাবলম্বী ও না। আসলে
মামুদ যেহেতু ছিলেন গজনীর মুসলমান শাসক এবং ভারতে তাঁর প্রেরিত অভিযানগুলি ছিল
হিন্দু রাজন্যবর্গের বিরুদ্ধে ও বিধ্বস্ত হয়েছিল হিন্দু মন্দিরগুলি সেহেতু তাঁর অভিযানগুলির মধ্যে ধর্মীয় প্রকৃতি খোঁজার চেষ্টা করা
হয়ে থাকে। মহম্মদ
হাবিব এর মতে, মামুদের মধ্যে
ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিলনা। তাঁর ভারত আক্রমণের পশ্চাতে ধর্মীয় প্রেরণা ছিল না, ছিল
ধ্বংসের উন্মাদনা। আসলে
ভারতবর্ষের অতুলনীয় সম্পদ গজনীর সুলতান মামুদকে ঈর্ষান্বিত করেছিল। ড. রমেশচন্দ্র
মজুমদার বলেছেন মিশনারি উদ্দেশ্য নিয়ে ধর্ম প্রচার বা সাম্রাজ্যের সংগঠক হিসেবে
মামুদ ভারতে আসেন নি। তাঁর অভিযানগুলির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ধন সম্পদ লুন্ঠন
এবং এদেশীয় রক্ষকদের ধ্বংসসাধন।
সুলতান মামুদের ভারত অভিযানের প্রকৃতি যে ছিল মূলত লুন্ঠন বৃত্তি
তা
বলার অপেক্ষা রাখে না। ঐতিহাসিক
স্মিথ ও সুলতান মামুদকে নিছক 'লুণ্ঠনকারী দস্যু' বলে অভিহিত করেছেন। ভারতের ভূখণ্ড নয়, ভারতের
ধন সম্পদ লুন্ঠন ছিল তাঁর অভিযানের মূল
লক্ষ্য। ভারতবর্ষের
রাজনৈতিক শক্তিগুলির মধ্যে বিভাজন এবং তাদের অন্তর্নিহিত অনৈক্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে
এই অভিযানের সূত্র ধরে। রাজপুতরানাদের
প্রবল শক্তিমত্তা ও গৌরবোজ্জ্বল বীরত্ব বিনষ্ট
হয়ে যায় প্রবল প্রতিপক্ষ মামুদের বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে। ভারতের
সামরিক শক্তির দুর্বলতা প্রতিভাত হয়ে উঠেছিল এই অভিযানের ফলস্বরূপ। সামরিক শক্তির বিপর্যয় এবং
উপর্যুপরি মুসলিম অভিযান সাধারণ মানুষকে বিপর্যস্ত করে তোলে। শুধু তাই নয় লুণ্ঠনকারীরা এদেশের
বহু মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করে এবং বাগদাদ,
সমরখন্দ ও বুখারার বাজারে তাদের বেচে দেয়।
ধর্মীয়
গোঁড়ামি হয়তো মামুদের ছিল না,
ভারতবর্ষের অধিকৃত এলাকার বাসিন্দাদের ইসলামীকরণ করার বড় ধরনের কোনো চেষ্টা তিনি
করেননি। বহু হিন্দু
মন্দির তিনি ধ্বংস করেছিল অর্থনৈতিক লালসার বশবর্তী হয়ে। এর ফলে এ দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে
গিয়েছিল। ইসলাম ধর্মের
প্রতি তাদের অশ্রদ্ধা জাগ্রত হয়েছিল।
বস্তুতপক্ষে
গজনীর ভারত আক্রমণের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল এ দেশের অর্থনীতি ও পূর্বে
উল্লেখিত সামরিক শক্তির উপর। বছরের-পর-বছর
লুন্ঠনের পর লুন্ঠন চালিয়ে মামুদ এদেশের উত্তর-পশ্চিম ভারতের মন্দিরগুলিতে
বহুকালের সঞ্চিত ধন দৌলত ও মূল্যবান মুদ্রা সমূহ আহরণ করে যে বিপুল পরিমাণ
অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করেছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বলাবাহুল্য অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয় দিক
থেকেই ভারতের শক্তি ক্ষয়ের ফলে
পরবর্তীকালে ভারতীয়দের পক্ষে তুর্কি আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা অনেকাংশে
ম্রিয়মান হয়ে পড়ে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে সবুক্তগীনের সময় থেকে গজনীর সুলতানদের তরফে ভারতবর্ষে অভিযান প্রেরণের যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল পুত্র সুলতান মামুদের সময় তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। তিনি তাঁর সামরিক দক্ষতার দ্বারা নিজের প্রাণ ভয়কে তুচ্ছ করে একের পর এক এদেশে অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। প্রজাবর্গের উন্নতি সাধনের দিকে লক্ষ রেখে সংস্কারমূলক কাজের তিনি প্রাণপাত ও করেননি। তবে সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন পন্ডিত ব্যক্তিদের সমাদর যেমন করেছেন তেমনি শিল্পানুরাগের কারণে জাদুঘর, পাঠাগার, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ নির্মাণ করেছেন। তবে ভারতবর্ষে অভিযান করে তিনি যে সমস্ত কাজ কর্মে লিপ্ত হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে ও তাঁকে কখনো মর্যাদার আসনে বসানো যথোচিত হবে না।
Very good writing
উত্তরমুছুন