সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস

 


 



মার্টিন লুথার ছিলেন লুথারিয়ান মতবাদের প্রবক্তা জার্মানির স্যাক্সসনিতে ইসলিবেন নামে একটি গ্রামে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের জন্ম হয়১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ইউটেবার্গ চার্চের দরজায় তিনি তাঁর ৯৫ তত্ত্ব ঝুলিয়ে দেনএটি ছিল পোপের স্বর্গীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সমস্ত জার্মানির শিক্ষিত মানুষেরা লুথারের তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলএই ৯৫টি ছিল তাত্ত্বিক প্রশ্ন, এতে বাইবেল ও খ্রিস্টান দর্শন সম্বন্ধে তাত্ত্বিক গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রশ্ন ছিল

উইলিয়াম ওকামের চিন্তাভাবনা দ্বারা মার্টিন লুথার প্রভাবিত হয়েছিলেন ইউরোপের এই চিন্তা ধারা পরিণত ছিল nominalism নামে নমিনালিস্ট চিন্তাধারায় উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্বাস ও নিবেদিতপ্রাণতা নমিনালিস্টরা মনে করত বিশ্বাসই মুক্তি আনবে, তবে এই বিশ্বাস অর্জনের জন্য শাস্ত্র পড়তে হবে এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের বোধগম্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করতে হবে লুথার এইমতে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি বিশ্বাস করতেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হওয়া উচিত এবং আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল রচনা করা একান্ত দরকার তিনি খ্রিস্টীয় চেতনাকে আরো প্রসারিত করতে চেয়ে ছিলেন পোপ তন্ত্রের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে আরও আক্রমণাত্মক হয়েছিলেন যার থেকে জন্ম নিয়েছিল লুথারিয়ালিজমের। তিনি babylonian capitivity নামক গ্রন্থে প্রচার করেন জার্মান জাতির গির্জা পোপের অধীনতা থেকে মুক্তি চায় লুথার প্রচলিত খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে প্রচারে ঝড় বইয়ে দিয়েছিলেন এবং প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত লুথারকে ঘিরে একটি নতুন রূপ পেয়েছিল

লুথারের ধর্মতত্ত্ব সাধারণ মানুষের ঈশ্বর বিচ্ছিন্নতাকে মুক্ত করে ঈশ্বর ও মানবের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। তিনি বলেন যে ভাল কাজ করলেই ঈশ্বরের করুণা পাওয়া যায় না, তার আগে ভাল মানুষ হতে হয়। একজন ভাল মানুষের মুক্তির জন্য কিংবা ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য কধ্যবর্তী অন্য কারোর সাহায্যের প্রয়োজন নেই, সে নিজেই নিজের পুরোহিত। এর দ্বারা পোপতন্ত্রকে আক্রমণ করেন। তিনি ‘Open letter to the Christian nobility of the German nation’ নামক চিঠিতে পোপ, ধর্মযাজক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন তফাৎ নেই, ধর্মশাস্ত্রে যা আছে সাধারণ লোকে তাই মান্য করবে, পোপের আদেশ মানবে না। তিনি পোপের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য সম্রাট পঞ্চম চার্লস ও অন্যান্য জার্মান রাজাদের আবেদন করেছিলেন ‘An Appeal to the Christian nobility of the German nation’ নামে জার্মান ভাষায় একটি লেখনীর মাধ্যমে। লুথার একটি বিকল্প ধর্মীয় সংগঠনের কথা ভেবেছিলেন, যে ধর্মীয় সংগঠনে যাজকতন্ত্রকে বর্জন করে ধর্মবিশ্বাসী মানুষের সমাবেশ হিসেবে গড়ে উঠবে।    

 লুথার ইউটেমবার্গের চার্চের দরজায় তাঁযে পোপ বিরোধী স্বর্গীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মতবাদ প্রকাশ করেন তা হল- i) তিনি উদারনীতিকে আশ্রয় করেছিলেন। ii) বাইবেল বা ধর্মশাস্ত্রকে  প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করেছিলেন। iii) তিনি রাজতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন এবং ঘোষণা করেছিলেন ধর্মের জন্য প্রজা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে। iv) রাজাকে খ্রিস্টান শাস্ত্র অনুযায়ী কাজ করতে হবে v) লুথার জার্মান চার্চকে পোপের অধীন থেকে বেরকরেতে বলেছিলেন ভি) লুথার ইউক্যারিস্ট উৎসবকে খ্রিস্টানদের বিশেষ করে পালন করতে বলেছিলেন। vii) তিনি খিষ্টান এবং অখ্রিস্টানদের মধ্যে বিবাহকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তিনি বলেন ক্যাথলিক গির্জার বিবাহ প্রথাকে ঈশ্বরের আদেশ হিসাবে ঘোষণা করেছেন, এটি ঠিক নয়। viii) তিনি পোপের ইনডালজেন্স প্রথার বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন তাঁ মধ্যে পয়সা খরচ করে দুর্নীতি মুক্ত হবার ছাড়পত্র কিনলে কেউ মুক্তি পায় না

 লুথারের বক্তব্য অনেক বেশি প্রতিবাদী এবং নেতিবাচক আনুগত্যের সমর্থক কিন্তু তার ব্যক্তিস্বাধীনতার বোধ ছিল তীব্রদ। তিনি শাসকগোষ্ঠী বিরোধী ছিলেন ঠিকই কিন্তু জনসাধারণের হাতে শাসন ক্ষমতা দেওয়া হোক এমন কোথাও বলেননি লুথার অতীন্দ্রিয় বাদে বিশ্বাস করতেন অর্থাৎ পবিত্র জীবন যাপন করলে অলৌকিক ক্ষমতা জন্মায় এ বিশ্বাস ছিল। অর্থের পরিচলনে তিনি বিশ্বাস করতেন না, যেমন সুদ নেওয়া ও দেওয়া অপছন্দ করতেন। তিনি বিপ্লবে ও গণতন্ত্রে আস্থাশীল ছিলেন না। লুথারের মতবাদ নিয়ে জার্মানিতে তীব্র আলোড়ন দেখা দিয়েছিল যার ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের নতুন পথ তৈরি করে দিয়েছিল

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

       ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাই মুঘলদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বলে মনে করেন শিরিন মুসবি । শিল্প বাণিজ্য থেকে আয়ের পরিমাণ সামান্য । ভূমি রাজস্ব হল ‘ মাল ’ বা ‘ খারাজ ’ । মুঘলরাষ্ট্র সামন্তরাজাদের কাছ থেকে কর পেত । তাছাড়া রাষ্ট্র পেত যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ ( খামস ); স্থানীয় আবওয়াব জিহত , শয়ের - ই - জিহত , ফুরুয়াত , অমুসলমানদের উপর স্থাপিত কর জিজিয়া এবং মুসলমানদের দেয় কর জাকাত ।         আকবরের আমলে সরকারের মোট রাজস্ব পরিমাণ ছিল ১২ , ৮২ , ৮৩ , ৮২৫ টাকা , সুজন রায়ের মতে , ঔরঙ্গজেবের আমলে ৩২ , ৬৮ , ১৬ , ৫৮৪ টাকা , এই রাজস্বের ৬ % ভাগ বাণিজ্য শুল্ক থেকে এবং ৪ % ঔরঙ্গজেব জিজিয়া থেকে পেতেন । বাকি সব রাজস্ব কৃষি খাতে আদায় হত ।       বাবর ভারতবর্ষ জয় করে অধিকৃত অঞ্চলের সমস্ত জমি ইক্তা হিসেবে অভিজাতদের মধ্যে বন্টন করে দেন । দেশের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য ও সংগৃহীত হত । হুমায়ুন এ ব্যাপারে কোন পরিবর্তন ঘটাননি । মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা গঠন করেন আকবর । আকবরের আগ...