মধ্যযুগীয় বিশ্বের ধর্মীয় ও সামাজিক
কুসংস্কারে ঘেরা গন্ডিবদ্ধ জীবনের
বাইরে মানুষকে টেনে আনতে পেরেছিল সমুদ্রযাত্রা এবং নতুন দেশ আবিষ্কারের প্রবণতা। সামুদ্রিক অভিযানের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কারের ফলে আধুনিক পৃথিবীর দিকে মানুষ গতিশীল হয়ে পড়ে। ইউরোপে সমুদ্রযাত্রা এবং নতুন দেশ
আবিষ্কারেরর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই নতুন বিশ্ব আবিষ্কারের পেছনে
নানা কারণ বিদ্যমান ছিল।
নতুন বিশ্ব আবিষ্কারের কারণগুলির মধ্যে
প্রথম হল নবজাগরণের প্রভাব। দ্বিতীয় হল
বাণিজ্যিক উচ্চাশা এবং বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বীতা। মেনিস ও জেনোয়া প্রাচ্য দেশের সঙ্গে
ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। ১৪৫৩
খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের পতন ঘটলে
তুর্কিদের জয়যাত্রা শুরু হয়। এর ফলে
ভূমধ্যসাগরের পথ ইউরোপীয় জাতিগুলির কাছে বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণে ইউরোপীয় জাতিগুলি প্রাচ্যদেশে যাতাযাতের বিকল্প পথের
অনুসন্ধানের জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করে।
ইউরোপের পশ্চিমে সমুদ্র প্রান্তের দুটি দেশ স্পেন ও পর্তুগাল প্রথম অভিযানে বের
হয়। নতুন দেশ আবিষ্কারের
পেছনে তৃতীয় কারণ ছিল জাতীয় রাষ্ট্রের শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং চতুর্থ
কারণ ছিল ধর্মীয় প্রেরণা।
নতুন
বিশ্ব আবিষ্কারক এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল খ্রিষ্টান চার্চ। নতুন দেশ আবিষ্কারে চার্চের লক্ষ্য ছিল
ধর্মান্তরিত করায় উৎসাহ দেওয়া। এই সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল সামুদ্রিক জ্ঞান। ইউরোপীয় বণিকেরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে সামুদ্রিক জ্ঞান লাভ করতে শুরু
করেছিল এবং এর সঙ্গে আরবীয়দের কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞান। মধ্যযুগে ইউরোপীয়দের
বহির্জগৎ সম্বন্ধে অনেক ভুল ধারণা ছিল। যেমন কলম্বাসের সময়ে ইউরোপীয় নাবিকরা বিশ্বাস করত যে
ইউরোপ থেকে পশ্চিমে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পূর্ব এশিয়ার ভারতে পৌঁছানো যাবে। ইউরোপীয়দের এই ধারণা পরে দূর হয়। ধীরে ধীরে সমুদ্রযাত্রার
প্রয়োজনে আবিষ্কৃত হয় কম্পাস এবং অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ নির্ধারণের জন্য তৈরী হয় এ্যাস্ট্রোল্যব।
মানচিত্র ব্যবহারের ক্ষমতা নাবিকদের আয়ত্তাধীনে আসে।
ইউরোপে ধর্মযুদ্ধের আগে ইতালির নাবিকরা
পূর্ব ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করেছিল এবং উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন
অঞ্চলের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। ইতালির
নাবিকদের পর স্থান নেয় পর্তুগিজরা। পর্তুগিজের
প্রিন্স হেনরী এ বিষয়ে পথিকৃৎ ছিলেন। হেনরীর জীবনের
শেষদিকে তাঁর উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ভেনিসীয়
নাবিক আলভাইস দ্য কাদামোস্তো। যিনি
আফ্রিকা উন্মোচনে বিশেষ তৎপরতা দেখিয়েছিলেন। প্রিন্স হেনরীকে বলা হয় 'হেনরী
দ্য ন্যাভিগেটর’। তিনি ১৪১৬ খ্রিস্টাব্দে সাগরেস এ নৌবিদ্যা শেখানোর স্কুল খোলেন। হেনরীর দ্বারা অনুপ্রাণিত
হয়ে ভাস্কো-ডা-গামা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে
আসার সমুদ্র পথ আবিষ্কার করেন। হেনরীর পাঠানো নাবিকরা ১৪৫৪
খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগাল নদীর কাছে। ১৪৮২-৮৪ খ্রিস্টাব্দে
Diego Cao র অভিযান পৌঁছায় কঙ্গো নদীর কাছে বর্তমান Zaire
তে। ১৪৮৭-৮৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে
বার্থোলোমিউ দিয়াজ ‘কেপ অব গুড হোপ
ঘুরে আসেন। দশ বছর পর ভাস্কো-ডা-গামা
আফ্রিকার পূর্বপ্রান্তে যান।
কলম্বাসের পূর্বে পর্তুগিজরা আফ্রিকার পূর্ব উপকূল ধরে পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপীয় মশলার বাজারের উপর তাদের
নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে
কলম্বাস আবিষ্কার করেন আমেরিকা। অন্যদিকে
ভেনিসের বিখ্যাত নাবিক সেবাস্টিয়ান ক্যাবট ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরীর
পৃষ্ঠপোষকতায় ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে বিষ্টল বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে আমেরিকা
মহাদেশের মূল ভূখণ্ডে পৌঁছান।
ইউরোপের
সমুদ্রযাত্রার শুরু হয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমে
পর্তুগিজ নাবিকদের জাহাজের পালের হাওয়ায়। আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল ধরে দক্ষিণ
দিগন্তের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল পর্তুগালের জাহাজ সোনা, দাস এবং
মশলার সন্ধানে। স্পেনের নাবিকরা
পাড়ি দিয়েছিল পশ্চিম দিগন্তে আর পর্তুগিজরা বেছে নিয়েছিল পূর্ব পথ, উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ার দিকে আসা। স্পেনের নাবিক কলম্বাস আবিষ্কার করেছিল
আমেরিকা।
হেনরী
দ্য ন্যাভিগেটরের
মৃত্যুর পর পর্তুগালের সামরিক অভিযানে কিছুটা ভাটা পড়ে। ১৪৬৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজশক্তি ও ব্যক্তিগত
পুঁজির মধ্যে একটা সমঝোতা হয়। লিসবনের বণিক ফেবনান্দো গোমেজের সঙ্গে চুক্তি হয় যে সে প্রতিবছর একশো লীগ নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার
করবে। এর বিনিময়ে ফেবনান্দোকে গিনির পর্তুগিজ ব্যবসার জন্য লীজ দেওয়া হয়। এরপরে স্পেনের তৎপরতা পর্তুগিজ সরকারকে পুনরায়
ভৌগোলিক আবিষ্কার শুরুর ব্যাপারে সচেতন করে। ১৪৮১ খ্রীষ্টাব্দে পর্তুগালের সিংহাসনে দ্বিতীয় জন আরোহন করে আবিষ্কারে উৎসাহদানে
উদ্যোগী হন। লবঙ্গ ও
অন্যান্য মশলার খোঁজে তিনি
কভিলহাম ও পেইভা নামে দু'জন অভিযাত্রীকে ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের পথে পাঠান।
দিয়াজ ও দিয়েগোর আবিষ্কার অবিস্মরণীয় ছিল কারণ এর ফলে আরও নব নব আবিষ্কারের
সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। দ্বিতীয় জনের পর পর্তুগালের রাজা
এমানুয়েল দ্য ফরচুনেটা ভাস্কো-ডা-গামাকে
প্রয়োজনীয় সাহায্য করেন। ভাস্কো-ডা-গামা অনুপ্রাণিত হয়ে দিয়াজ অনুসৃত পথে ‘কেপ অব গুড হোপ’ বা উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে পৌঁছান এবং
সেখান থেকে এক আরব নাবিকের সাহায্যে ১৪৯৮
খ্রিস্টাব্দে ভারতের কালিকট বন্দরে এসে পৌঁছান।
পর্তুগিজ নাবিকদের আবিষ্কারের বিনিময়ে
পর্তুগালের রাজা নিজেকে নানা উপাধিতে ভূষিত করেন, যেমন Lord of the
conquest, Navigator of Ethiopia, Arabia, Persia & India উপাধি
গ্রহণ করেন। ১৫০৭
খ্রিস্টাব্দে মোজাম্বিক, ১৫১০
খ্রিস্টাব্দে গোয়া, ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে মালাক্কা, ১৫১৫
খ্রিস্টাব্দে হরমুজ, ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে ম্যাকাওতে পর্তুগিজ পদচিহ্ন পড়ে। পর্তুগিজ
উপনিবেশ স্থাপনের অধ্যায় শুরু হয় এবং পশ্চিম গোলার্ধেও সামুদ্রিক অভিযানের সূচনা হয়।
দক্ষিণ
ইউরোপের বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আইবেরীয় উপদ্বীপ। ইউরোপীয়রা মধ্যযুগের সময় থেকে
আটলান্টিকের অপরপারে কি আছে তা
নিয়ে আগ্রহী ছিল। কলম্বাস
তিনবার আটলান্টিক পাড়ি দেন। কিউবা
এবং হিসপানিয়োলা আবিষ্কার করেন। আমেরিগো
ভেসপুচি মেক্সিকো জয় করেন এবং ১৫২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পেরুর ইনকা সাম্রাজ্য
ইউরোপীয়দের অধিকারে আসে। দশম ও
একাদশ শতাব্দীতে নরওয়ে, সুইডেন এবং ডেনমার্কের দুঃসাহসী
নাবিকেরা গ্রিনল্যান্ডে পৌঁছে যায়। গ্রীনল্যান্ড
যে উত্তর আমেরিকার অংশ তা তারা বুঝতে পারেননি তাই পরে কলম্বাসকেই আমেরিকা আবিষ্কারক
হিসেবে সম্মান দেওয়া হয়।
স্পেন ও পর্তুগালের সমুদ্র বিজয়ে পর্তুগিজরা প্রথম দিকে খানিকটা এগিয়ে ছিল। পর্তুগীজদের অগ্রগতির কারণ ছিল
পর্তুগাল জাহাজ ভাসিয়েছিল আটলান্টিকে, ফলে
পশ্চিম দিগন্তের দিকে তার যাবার নিয়তি-নির্ধারিত হয়ে উঠেছিল। গোটা পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দী জুড়ে
পর্তুগালের রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না, ফলে
সমুদ্রযাত্রায় সে মনোনিবেশ করতে পেরেছিল। পর্তুগাল নৌ ব্যবহারে অত্যন্ত দক্ষ ছিল। পর্তুগালে সেনার অভাব দেখা
দিয়েছিল সুতরাং পুঁজির সন্ধানে পর্তুগাল পা বাড়িয়েছিল অন্য দেশের খোঁজে। ফলে বিভিন্ন দেশের মানচিত্রে
পর্তুগালের জাহাজের ছবি ফুটে ওঠে।
পর্তুগিজদের
পাশাপাশি স্পেন ও অভিযানের ক্ষেত্রে যে বিখ্যাত হয়ে ওঠে তার কারণ ছিল স্পেনের নাবিকদের অনুসন্ধানের ইচ্ছা ও
রাজতন্ত্রের সমর্থন। আইবেরীয়
উপদ্বীপের শক্তি হিসেবে Castile, Aragon
এবং
Navarre এই তিনটি প্রদেশ একত্র হয়ে স্পেনের শক্তি বৃদ্ধি করে। গ্রানাডা থেকে মুরেরা বিতাড়িত
হয়েছিল স্পেনীয় রাজতন্ত্রের চেষ্টায়। স্পেন
ক্রমশ পর্তুগালকে বাদ দিয়ে সমস্ত আইবেরীয় অঞ্চল নিজের প্রভাব বিস্তার করেছিল। সমুদ্রযাত্রা করে বিভিন্ন দেশ দখল
করে, লুন্ঠন করে স্পেন অনেক বেশি অর্থ
উপার্জন করেছিল। আমেরিকায়
ও আফ্রিকায় স্পেনীয়ার্ডরা কেমন নিষ্ঠুর অভিযান চালিয়ে ছিল তা আজও ইতিহাসে রক্ত
ও অশ্রুতে লেখা আছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন