গজনীর সুলতান মামুদের থেকে মহম্মদ ঘুরীর আক্রমণ কোন কোন
ক্ষেত্রে ভিন্ন ছিল। ঘুরীর সাফল্যের কারণগুলি কি ছিল?
ভারতের
বিরুদ্ধে আরবের সামরিক অভিযানের ব্যাপ্তি ছিল
সীমিত এবং স্থায়িত্ব ছিল স্বল্প। পশ্চিম
সীমান্তের মুলতান ও সিন্ধু
ছাড়া অন্য কোন অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত হয় নি। কিন্তু আরবদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে
পরবর্তীকালে তুর্কীরা ভারতের বিরুদ্ধে বিশাল ও
ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করেছিল। এই
কাজের সূচনা করেন আফগানিস্থানের অন্তর্গত গজনীর তুর্কী
মুসলমানগণ। গজনীর
সুলতান মামুদ ও মহম্মদ ঘুরীর অভিযানের মধ্য দিয়ে ভারতে তুর্কি মুসলমানদের আধিপত্য
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে
দুজনের আক্রমণের চরিত্র কেমন ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতান্তরের সৃষ্টি হয়েছে।
সুলতান মামুদ ও মহম্মদ ঘুরীকে পাশাপাশি
রেখে আলোচনা করলে দেখা যাবে যে এরা দুজনে ভিন্ন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ করেছিলেন। এমনকি দুজনের ভারত অভিযানের
রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্যও পুরোপুরি এক ছিল না। তাসত্ত্বেও কয়েকটি ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে কিছু মিল
দেখা যায়। দুজনেই
ছিলেন বহিরাগত মুসলমান এবং ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ হত্যা ও লুন্ঠনের নায়ক। দুজনেই মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক
শক্তির কেন্দ্র থেকে ভারতের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়েছিলেন।
মহম্মদ ঘুরী ভারতের ইতিহাসে তুর্কী সাম্রাজ্যের স্থপতি রূপে পরিচিত হয়েছেন। আফগানিস্তানের ক্ষুদ্র ঘুর
রাজ্যকে তিনি উত্তর ভারতীয় সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। কিন্তু স্ট্যানলি লেনপুল সুলতান মামুদকে ঘুরীর তুলনায়
অনেক বেশি সফল ও প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করা হয়। সমর কুশলী যোদ্ধা ও সময় বিজয়ী সেনাপতি হিসেবে সুলতান মামুদ মহম্মদ ঘুরীর তুলনায় অনেক
বেশি আগ্রহী ছিলেন। তিনি
গ্রীষ্মকালে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধ বিজয় সেরে শীতকালে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ভারতের
বিরুদ্ধে। দেশে ও বিদেশে কোথাও যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি তাকে ভোগ করতে হয়নি। তুলনামূলকভাবে সামরিক দিক থেকে
মহম্মদ ঘুরী অনেক নিষ্প্রভ। তিনি আনহিলওয়ারায় দ্বিতীয়
মূলরাজার সঙ্গে যুদ্ধে, চালুক্য রাজ
ভীমদেবের সঙ্গে যুদ্ধে এবং পৃথ্বীরাজের বিরুদ্ধে প্রথম তরাইনের যুদ্ধে (১১৯১) পরাজিত হন। তাছাড়া
খারাজম শাহের বিরুদ্ধে আন্ধখুদের যুদ্ধে তিনি পরাজিত
হন।
ডঃ ইরফান হাবিবের মতে মহম্মদ ঘুরী কয়েকটি
যুদ্ধের পরাজিত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি
প্রকৃত যোদ্ধার মত পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে পরবর্তী অভিযানের জন্য
প্রস্তুত হয়েছেন। মামুদের তুলনায় মহম্মদ ঘুরীকে অনেক
বেশি বড় ভারতীয় সুসংগঠিত রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল।
যুদ্ধ ও
সেনাপতি হিসেবে পিছিয়ে পড়লেও সংগঠক হিসেবে মহম্মদ ঘুরী সুলতান মামুদকে অতিক্রম করে যেতে পেরেছেন। সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের মূল
প্রেরণা ছিল এদেশের অপ্রতুল সম্পত্তি। এই সম্পদ লুণ্ঠনের আশায় তিনি
অনুগামীদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিলেন। ভারতের সাম্রাজ্য স্থাপনের কোন ইচ্ছাই তার ছিল না, কারণ
মধ্য এশিয়ার সাথে তার রক্তের বন্ধন অটুট ছিল। ভারতবর্ষের সম্পদকে তিনি মধ্য এশিয়ার রাজনীতির সংগ্রামে ব্যবহার করার
লক্ষ্যে স্থির ছিলেন। অর্থলোভে অন্ধ
মামুদ ভারতের মাটিতে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গৌরব অর্জনের কোন
স্বপ্ন দেখতে পারেননি। কিন্তু
মহম্মদ ঘুরী ছিলেন রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির
অধিকারী। ভারতীয়
সম্পত্তি নয়, ভারতের মাটিতে নতুন রাজ্যের ভিত্তি
স্থাপনই ছিল তার লক্ষ্য।
মধ্য এশিয়ায় নিজের সাম্রাজ্য থেকে দূরবর্তী ভূখণ্ডে নতুন
শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি রচনা জন্য যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রয়োজন মহম্মদ ঘুরীর চরিত্রে তার অভাব ছিল না। নিজামী মনে করেন যুদ্ধে পরাজয়ের পরেও
যেমন তিনি যুদ্ধ প্রেরণা হারিয়ে ফেলেননি, তেমনি
ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করার পরেই সেখানে তৎক্ষণাৎ নিজের শাসন শুরু করেননি। কারণ তুর্কী মুসলমানদের সংখ্যা কম থাকায় পাঞ্জাব থেকে বাংলা পর্যন্ত
এত বড় অঞ্চলের শাসন দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনা করা তাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। তাই যুদ্ধজয়ের পরে মহম্মদ ঘুরী
ভারতীয় শক্তির প্রতি ধর্মীয় জিঘাংসামূলক আচরণ করেননি। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের (১১৯২) পর পৃথ্বীরাজের বশ্যতার
ভিত্তিতে দিল্লি ও আজমীরের শাসনভার খান্ডেরায় ও
পৃথ্বীরাজের পুত্রের হাতে অর্পণ করেছিলেন। মহম্মদ ঘুরী উপলব্ধি করেছিলেন যে গুরুত্বপূর্ণ
স্থানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে এবং প্রদেশ ও জেলার শাসকদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায়
রেখে স্থানীয় শাসকদের হাতে শাসন দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন।
ভারতবাসীর
কাছে সুলতান মামুদ ধর্মোন্মাত আক্রমণকারী রূপে
প্রতিভাত হলেও ব্যক্তি হিসেবে তিনি বিভিন্ন গুণের অধিকারী ছিলেন। অলবিরুণী, উতবি, ফিরদৌসী, আনসারী
প্রমুখের মত জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত, দার্শনিক গজনীর রাজসভা উজ্জ্বল
করেছিলেন। রাজধানী
গজনীতে মামুদ একটি বিশ্ববিদ্যালয়, পাঠাগার ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে আন্তরিক শিক্ষানুরাগীর
পরিচয় স্থাপন করেন। লেনপূল্
বলেন যে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বিজিত রাজ্য থেকে শিল্পকর্ম এনে নিজ রাজধানীকে
সুসজ্জিত করেছিলেন, কিন্তু সুলতান মামুদ বিদেশ থেকে শিল্পী
ও কবিদের আমন্ত্রণ করে এনে নিজের রাজসভা উজ্জ্বল করেছিলেন। বহু মসজিদ, প্রাসাদ, খানকা নির্মাণ
করে গজনী নগরীকে সুশোভিত করেন। মামুদের চেষ্টায় গজনী নগরীকে ইসলামিক
সংস্কৃতি চর্চার একটি বিখ্যাত কেন্দ্রে পরিণত করে। তবে মহম্মদ ঘুরীর শিল্প সাহিত্যের অবদান ছিল নগণ্য।
মহম্মদ ঘুরী হয়তো সুলতান মামুদের মত শিল্পানুরাগের
স্বাক্ষর রেখে যেতে পারেননি, তবে তিনি আদৌ সংস্কৃতিমনস্ক
ছিলেন না এ কথা বলা যায়না। গিয়াসউদ্দিন
ও মহম্মদ ঘুরীর আমলেই ঘুর সংস্কৃতির ধারা
নব রূপ পরিগ্রহ করেছিল। মহম্মদের আমলে এক ধরনের রঙিন টালি
আবিষ্কৃত হয়েছিল। সুলতান মামুদ গজনীকে শিল্পসমৃদ্ধ করলেও ভারতের শিল্প নিদর্শনের
উপর যে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন মহম্মদ ঘুরী কখনোই
তা করেননি। তবে এটা
অবশ্য ঠিক যে শিল্প সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য মহম্মদ ঘুরী সুলতান মামুদের মত আন্তরিকভাবে সময় ও উদ্যোগ ব্যয় করেননি।
ভারত ইতিহাসে মহম্মদ ঘুরী নিঃসন্দেহে
স্থায়ী কীর্তিলাভ
করেছিল। যদিও
তিনি দিল্লিতে তার নিজ রাজধানী হিসেবে গণ্য করেন নি, তার
নিজ পৈত্রিক নগর ঘুর ও অর্জিত নগর গজনীকে কেন্দ্র করে তিনি তার রাজধানী স্থাপন করেন। তথাপি তিনি
তাঁর শাসনকর্তা কুতুবউদ্দিন আইবককে দিল্লিতে প্রাদেশিক শাসনকেন্দ্র গঠনের অনুমতি
দেন। মহম্মদ ঘুরী ভারত শাসনের ক্ষেত্রে
একটি বাস্তবসম্মত নীতি গ্রহণ করেন।
মহম্মদ
ঘুরী ছিলেন মানব চরিত্রের দক্ষ বিচারক, যোগ্য
ও প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিকে চিনে নিতে তিনি ভুল করেননি। তিনি তার দূরদর্শিতার দ্বারা কুতুবউদ্দিন
আইবক, তাজউদ্দীন ইলদুজ, বাহাউদ্দিন তুখিল প্রমূখ সৈনিকদের সংগ্রহ করেছিলেন যাঁরা ভারতবর্ষে তুর্কী শাসনের
ভিত্তি রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দ্বিস্তর কাঠামো গঠন করেন। গ্রাম ও ছোট শহরগুলি স্থানীয় রায়ত ও রাণারা শাসন করত। মহম্মদ
সুদূর ঘুর রাজ্যে থাকলেও সর্বদা ভারতের দিকে নজর রাখতেন। খোক্কর উপজাতির বিদ্রোহ দমনে তিনি নিজেই উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন