চৌদ্দশতকে
কাসতিল, আরাগণ এবং নাভার প্রভৃতি রাজ্য নিয়ে এক
নেতৃত্তের অধীনে সংযুক্ত হয়ে স্পেন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
মুরদের অধিকৃত স্থান হিসেবে গ্রানাদা স্বীকৃতি পায়। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে
স্পেন গ্রানাদা জয় করে মুর বা মুসলমানদের পরাজিত করে। কতগুলো বিষয় স্পেনকে সামুদ্রিক অভিযানে উত্সাহ
জুগিয়ে ছিল। যথা
নাগরিকদের অপরিসীম ইচ্ছা, রাজতন্ত্রের
পৃষ্ঠপোষকতা, আইবেরীয় উপদ্বীপের শক্তি হিসেবে cortile,
Aragon এবং Navarre এই তিনটি প্রদেশ
একত্র হয়ে স্পেনের শক্তি বাড়ায়, অর্থের দিক থেকে
স্পেন অনেক ধনবান ছিল, এবং রপ্তানিযোগ্য জিনিসের প্রাচুর্যতা ছিল।
স্পেনীয়রা
তিনটি অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল,
এরমধ্যে আমেরিকাসহ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ
আমেরিকা এবং এশিয়ার ফিলিপাইন দ্বীপ সমূহ। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাস বর্তমানের
কিউবা এবং ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র বা রিপাবলিক
আবিষ্কার করেছিলেন। তবে তার
পূর্বে দুজন স্পেনীয় দুলমো এবং এস্ত্রেইতো আটলান্টিকের ওপর অভিযান চালিয়েছিলেন।
কলম্বাস
ইতালির জেনেভা শহরে জন্মগ্রহণ করেন, যুবক বয়সে তিনি ভূমধ্যসাগরে ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে পশ্চিমী পথে এশিয়া পৌঁছানো যায়। তিনি ১৪৮৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা
দ্বিতীয় জনের নিকট সামুদ্রিক অভিযানে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সফলকাম হননি। পরে কলম্বাস স্পেনের রাজা
ফার্দিনান্দ (Fardinand) ও রানী
ইসাবেলার (Isabella) নিকট আবেদন করেন এবং রাজা রানী তাঁর আবেদনে সম্মতি জানায়।
প্রথমদিকে
কলম্বাসের তেমন একটা উচ্চাকাঙ্খা ছিল না তাই তিনি কয়েকটি ছোট আয়তনের জাহাজ নিয়ে
সামুদ্রিক অভিযান শুরু করেন। এই
জাহাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল নৌসেনা বাহিনীর জাহাজ, যার নাম
ছিল The Santamarid এটির ওজন ছিল প্রায় ১২০ টনের মত।
এছাড়াও ৮০ টন ওজন বিশিষ্ট জাহাজ ছিল The Nima ও The Pinta। তিনি বোহেমিয়া (Bohamas) পরে কিউবা,
হিসপানীইয়োলা আবিষ্কার করেন। তিনি মূল্যবান সোনা ও ধাতুর সন্ধানে উৎসাহী ছিলেন। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাস আমেরিকায়
পৌঁছেছিলেন। ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে
তিনি সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি সহ lisbon এ
প্রত্যাবর্তন করেন ও সেখান থেকে স্পেনে এলে তাঁকে
সম্বর্ধনা জানানো হয়। তবে ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রকৃতপক্ষে
আমেরিকার আবিষ্কারক ছিলেন না। কারণ
দশম ও একাদশ শতাব্দীতে নরওয়ে সুইডেন এবং ডেনমার্কের
দুঃসাহসী নাবিকেরা গ্রীনল্যান্ড পৌঁছায়। তবে
গ্রীনল্যান্ড যে উত্তর আমেরিকার অংশ তা তারা বুঝতে পারেন নি। তাই পরে কলম্বাসের আমেরিকা হিসেবে
সম্মান দেওয়া হয়।
স্পেনের রাজা ও রানী দ্বিতীয়বার
কলম্বাসের সামরিক অভিযানের ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু পর্তুগিজরা কোন অঞ্চল দাবী করবে
সেটাই ছিল সমস্যা। অতএব তাঁরা Pope Alexander vi এর নিকট
আবেদন করেছিলেন এবং পোপ আলেকজান্ডার ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে এক হুকুমনামা জারি করেন ‘Inter caetera pivina co’ যেখানে
তিনি Azores এর পশ্চিমে উত্তর থেকে দক্ষিনে একশ মাইল
একটি কাল্পনিক রেখা টেনে ছিলেন। এর ফলে
পর্তুগাল রেখাটির পূর্বদিকে একচেটিয়া অভিযানের অধিকার পায় আর স্পেন পায় পশ্চিম দিকের অংশ। রাজা দ্বিতীয়
জন আরও পশ্চিমে সরাতে চাইলে ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে Tordsillas এর সন্ধি পত্রের মাধ্যমে একছত্র
অধিকার লাভ করে Cope route ধরে
ভারতে আসার।
১৪৯৩
খ্রিস্টাব্দে কলম্বাস দ্বিতীয়বার জাহাজ ও এক হাজারেরও বেশি সংখ্যক লোক নিয়ে
সমুদ্র যাত্রা শুরু করেন। এই
অভিযানের প্রধান লক্ষ্য ছিল নতুন দ্বীপসমূহের অনুসন্ধান। হিসপানিয়োলাতে প্রধানত আধিপত্য স্থাপন
করেছিলেন। ১৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্পেনে প্রত্যাবর্তন করেন। পরে উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ
উপকূলের উপর দখল রাখেন, কিন্তু কলম্বাস
নতুন আবিষ্কৃত অঞ্চলগুলোর উপর শাসন কায়েম করতে সক্ষম হননি। স্পেন
সরকার ফ্রান্সিস্কো দা বোদাদিলাকে (Fransisco de
bodadilla) শাসক হিসেবে নিয়োগ করেন। তিনি ছিলেন স্পেনের উপনিবেশগুলোর একজন
নিষ্ঠুর শাসক।
১৫০২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাস পুনরায়
এক অভিযান চালান ও তিনি এবিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। cathey এর একটি পশ্চিমী পথ আবিষ্কার করেন। তবে
একথা অনস্বীকার্য যে, কলম্বাস অজানা
একটি জায়গা আবিষ্কার করেছিলেন। ১৫০৭ খ্রিস্টাব্দে
একজন জার্মান মানচিত্র নির্মাতা একটি মানচিত্র প্রকাশ করেন। যেখানে প্রথম আমেরিকা মহাদেশকে পৃথক একটি ভূখণ্ড হিসেবে
দেখিয়েছেন এবং তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘আমেরিকা’। পরে কলম্বাস কর্তৃক আবিষ্কৃত
নতুন বিশ্বে অনুসন্ধান চালান ও ভেনেজুয়েলা উপকূল অনুসন্ধান করেন এবং এর নাম দেন
আমেরিকা।
প্রশান্ত
মহাসাগরের প্রকৃত বিস্তৃতি সম্পর্কে দৃঢ়মূল ধারণা
স্পেনীয়দের হয় যখন ম্যাজেলান ১৫১৯ খিষ্টাব্দে দক্ষিণ আমেরিকাকে কেন্দ্র করে
সমুদ্র যাত্রা শুরু করেন এবং ফিলিপাইন দ্বীপে এসে উপস্থিত হন। ক্যারিবিয়ান দ্বীপ আবিষ্কারের
সময় স্পেনীয়রা দক্ষিণ আমেরিকার আর একটি সাম্রাজ্য সম্বন্ধে অবহিত হয়। এটি ছিল উপকথার রাজ্য অ্যাজটেক সাম্রাজ্য, শান্তিপ্রিয় মানুষ,
সূর্যের পূজারী, সঙ্ঘবদ্ধ কৃষিকাজকে অবলম্বন করে গড়ে
ওঠা সুষ্ঠ সুবিন্যস্ত এক সভ্যতা।
স্পেনীয়রা তাদের উন্নত প্রযুক্তির
সাহায্যে স্থানীয় মানুষের সমর্থনের ওপর ভিত্তি করে এর প্রাচীনত্বকে অতিক্রম করতে
সমর্থ হয়েছিল। তেনোচতিৎলান
ছিল এর রাজধানী। দস্যুতা
লুন্ঠন এবং খুন-জখমের ওপর ভিত্তি করে এই সভ্যতাকে পদানত করে
স্পেন। সোনা রূপোর তাল যথেষ্ট পরিমাণে
লুণ্ঠন করা হয় এবং তা স্পেনে পাঠানো হয়। অ্যাজটেকের ভূমি স্পেনীয়দের হাতে
হস্তান্তরিত হয়ে যায়। স্পেনের
উপনিবেশীকরনের ক্ষেত্রে দুটি দিক স্পষ্ট
লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত
লুটতরাজ এবং ডাকাতি রাহাজানি, যার মধ্যে
সরাসরি রূঢ় পদ্ধতিতে স্থানীয় ও দেশীয় সমাজের
ধ্বংসসাধন। যে
পদ্ধতির প্রতিটি
পদক্ষেপ পরবর্তীকালে ডাচ ও ইংরেজরা অনুসরণ করেছিল। দ্বিতীয়টি ছিল পুঁজির প্রকৃতি যা
স্পেনীয় রাজ অভিযানের সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার্থে ও উপনিবেশ স্থাপনের জন্য
বিনিয়োগ করেছিলেন। অভিযাত্রীরা
অভিযান ও আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ইউরোপে বিশাল ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছিল। সমুদ্র যাত্রা ও অভিযানে পুঁজি
বিনিয়োগ করা ছাড়াও ‘ফুগাররা’
ব্যবসা-বাণিজ্যে ও সমান ভাবে অংশগ্রহণ করত। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ফুগার
ও ওয়েলসারদের যৌথ উদ্যোগে স্পেনীয় জাহাজ আটলান্টিক বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা
করত।
উপনিবেশিকরনে দক্ষিণ আমেরিকার বসতি ও
বন্দোবস্ত ক্রমে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সমর্থিত হয়ে উঠতে থাকে। এই ব্যাপারে আন্তঃআঞ্চলিক ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ও উন্নয়ন বিশেষ ভূমিকা
নিয়েছিল। যদিও তারা
লাভজনক হারে বিস্তার লাভ করতে পারেনি। ব্যবসার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা
করে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবহনের উন্নতি সাধন সম্ভব হয়নি। তাই এটির স্থায়িত্ব স্পেনের মধ্যস্থ উদীয়মান জনসংখ্যা ও সম্পদের
সংকোচনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। যার
মূল্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সামুদ্রিক ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যে
স্পেনীয়রা এক আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিগোচর
প্রশাসনিক কাঠামোর সৃষ্টি করেছিল। উপনিবেশগুলো
স্পেনীয় ধারা, রীতিনীতি,
নিয়মাবলী, ল্যাটিন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তাদের প্রতিষ্ঠিত ও নির্মিত নগরগুলোর উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। গ্রামীণ সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের ওপর স্পেনীয়
শিল্প স্থাপত্য শৈলীর ধারাও বিশালত্ব পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে।
উপনিবেশিক বন্দোবস্ত স্বয়ংভর হলেও স্পেনীয় প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়নি। স্পেনীয় রাজা প্রশাসক নিযুক্ত করে প্রতিটি রাজ্যে তা পেরন করেছিলেন। যারা আইনানুগ বা উকিল, হিসেব রক্ষক এবং
রাজকর্মচারী প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত ও সাহায্যপ্রাপ্ত হতেন- এদের সংগঠিত কাঠামো Audience নামে পরিচিত।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় পর্তুগালের সঙ্গে ভৌগোলিক আবিষ্কার ও অভিযানে স্প্রেন কমাগত অগ্রসর হয়েছিল এবং অনেক বেশি সাফল্য লাভ করেছিল। উপনিবেশীকরন স্পেনীয় বসতি ও বন্দোবস্ত নতুন ধারায় মিশ্রজাতের জন্ম দিয়েছিল। স্পেন অধ্যুষিত স্পেনীয়দের থেকে তাদের পৃথক পরিচয় আর অবশিষ্ট নেই। স্পেনীয়দের উপনিবেশিক জাঁকজমক ও আড়ম্বরের প্রভাব কোন জাতিকেই তাদের প্রকৃত সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূলে অবস্থান করতে দেয়নি। স্পেনীয় সামুদ্রিক সাম্রাজ্য বর্বরতা, নিঃসঙ্গতার ওপর ভিত্তি করে ছিল যা উগ্রতা আক্রমণকে ত্বরান্বিত করেছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন