সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

রাওলাট আইন

 


 

 ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ভারত সরকার ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রকোপ ও গণ অসন্তোষ দমনের জন্য এবং তার সম্ভাব্য প্রতিরোধ সম্পর্কে বিচার বিবেচনার জন্য ভারত সরকারের আইন সচিব রাওলাটের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি নিয়োগ করেন এটি রাওলাট কমিটি নামে খ্যাত রাওলাট কমিটি ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তার একাংশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিপ্লবী কার্যকলাপের গতিধারা এবং অপর অংশে বিপ্লবী আইনের জন্য যুদ্ধকালীন অবস্থায় সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেনি সুতরাং শান্তির সময় বিশেষ আইনের প্রয়োজনীয়তা আছে তা উপলব্ধি করে রাওলাট কমিটি সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ১৮ই মার্চ ভারত সরকার রাওলাট আইন পাস করে

দুটি বিল নিয়ে রাওলাট আইন রচিত হয়েছিল প্রথমত রাজদ্রোহ মামলা বিচারের জন্য একটি নতুন বিচারালয় গঠন করার প্রস্তাব করা হয় এই আইনের বলে রুদ্ধদ্বার আদালতে বিনা উকিলের সাহায্যে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বিচার করে অন্তরীণ বা বিনা বিচারে আটকে রাখার ব্যবস্থা করা হয় মোটকথা ভারত রক্ষা আইন যুদ্ধশেষে উঠে গেলেও রাজদ্রোহ দমনের নামে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলন দমন করার জন্য সরকারের হাতে অস্বাভাবিক ক্ষমতা দান করাই ছিল প্রথম বিলের উদ্দেশ্য দ্বিতীয়ত ফৌজদারী আইন বা ভারতীয় দণ্ডবিধির পরিবর্তন করা বিল অনুসারে প্রাদেশিক সরকারের অনুমতি না নিয়েই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশী রিপোর্টের ভিত্তিতে তদন্ত করে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করলে তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে পারত

 এই স্বৈরাচারী বিলের বিরুদ্ধে সারা ভারতবর্ষে প্রতিবাদের ঝড় ওঠেঅমৃতবাজার পত্রিকা এই আইনকে এক ভয়াবহ ভ্রান্তি বা ‘A gigantic blunder’ বলে অভিহিত করেছে। মুম্বাই থেকে প্রকাশিত 'the Indian social reformer’ প্রথমে এই আইন সম্পর্কে নীরব থাকলেও রাওলাট আইন পাস হলে তার বিরোধিতা করে ভি জি প্যাটেল, মদনমোহন মালব্য এবং সাপ্রু রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় গান্ধীজী ব্যঙ্গ করে বলেন আপিল নেহি, দলিল নেহি, উকিল নেহি। গান্ধীজী এই আইনের প্রতিবাদে 'সত্যাগ্রহ সভা' প্রতিষ্ঠিত করেন এবং সর্বস্তরের মানুষকে এই সভার আতায় এনে সরকার বিরোধী সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে জোরদার করার প্রয়াস চালান ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ৩০ ই মার্চ গান্ধীজী সমগ্র দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেন ভারতবর্ষে এটাই ছিল প্রথম সর্বভারতীয় ধর্মঘট এবং তার সাফল্য লাভ করে গান্ধীজী মন্তব্য করেছিলেন যে এই সে দিন পর্যন্ত ভারতবাসী খোলা মনে ইংরেজকে যুদ্ধজয়ের সাহায্য করার পর তাদের বিরুদ্ধে এরূপ দমনমূলক আইন পাস করা লজ্জাজনক ঘটনা তিনি এই আইনের প্রতিবাদে ৬ এপ্রিল ভারতব্যাপী হরতালের ডাক দেন

 কলকাতায় কংগ্রেস ও খিলাফত পন্থীদের সমবেত মিছিলে উপনিবেশিক সরকার গুলি চালালে বেশ কয়েক জন মারা যায়। দিল্লি ও পাঞ্জাবে জনতা পুলিশের সংঘর্ষ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে পরিস্থিতি শান্ত করতে দিল্লির নেতৃবৃন্দ গান্ধীজীর নিকট আহ্বান জানান গান্ধীজীর দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করলে কেন্দ্রীয় সরকার তার দিল্লি ও পাঞ্জাব প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তিনি এই আদেশ অমান্য করলে গান্ধীজিকে গ্রেপ্তার করা হয়, যার ফলে সারাদেশে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে রাওলাট আইনের প্রতিবাদে পাঞ্জাবে আন্দোলন সংঘটিত হয় জালিয়ানওয়ালাবাগের বিদ্রোহী নিরস্ত্র জনতার উপর জেনারেল ডায়ার নিষ্ঠুর ভাবে গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন ও বহু মানুষের প্রাণনাশ ঘটায় ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল এই ঐতিহাসিক ঘটনা জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড নামে

 রাওলাট সত্যাগ্রহ হল প্রথম ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় ধর্মঘট জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল অঞ্চলে সকল ধর্মের সর্বস্তরের মানুষ এই আন্দোলনে যোগদান করে ধর্মঘটের সাফল্য গান্ধীজীর প্রভাব ও মর্যাদা বহু পরিমাণে বৃদ্ধি করে এবং তিনি সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস

    মার্টিন লুথার ছিলেন লুথা রিয়ান মতবাদের প্রবক্তা । জার্মানির স্যাক্সসনিতে ইসলিবেন নামে একটি গ্রামে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের জন্ম হয় । ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ইউটে ম বা র্গ চা র্চে র দরজায় তিনি তাঁ র ৯৫ তত্ত্ব ঝু লিয়ে দেন । এটি ছিল পোপের স্বর্গীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ । সমস্ত জার্মানির শিক্ষিত মানুষেরা লুথারের তত্ত্বে র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । এই ৯৫টি ছিল তাত্ত্বিক প্রশ্ন , এতে বাইবেল ও খ্রিস্টান দর্শন সম্বন্ধে তাত্ত্বিক গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রশ্ন ছিল । উইলিয়াম ওকামের চিন্তাভাবনা দ্বারা মার্টিন লুথার প্রভাবিত হয়েছিলেন । ইউরোপের এই চিন্তা ধারা পরিণত ছিল nominalism নামে । নমিনালিস্ট চিন্তাধারায় উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্বাস ও নিবেদিতপ্রাণতা । নমিনালিস্টরা মনে করত বিশ্বাসই মুক্তি আনবে , তবে এই বিশ্বাস অর্জনের জন্য শাস্ত্র পড়তে হবে এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের বোধগম্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করতে হবে । লুথার এইমতে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হওয়া উচিত এবং আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল রচনা করা একান্ত দরকার । তিনি খ্...