সিংহাসন লাভের সাথে সাথে ইলতুৎমিসকে
একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এই সংকটময়
পরিস্থিতির মধ্যে প্রথমত দিল্লির সাংবিধানিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। গজনীর সুলতান মহম্মদ ঘুরীর প্রতিনিধি হিসেবে
তাজউদ্দীন ইলদুজ ও নাসিরউদ্দিন কুবাচা ছিলেন
সমমর্যাদা সম্পন্ন। ইলতুৎমিসকে
দিল্লির সুলতান হিসেবে তারা মেনে নিতে অস্বীকার করে। দ্বিতীয়তঃ
দিল্লির আমির ওমরাহরা নিজেদেরকে সুলতানের সমকক্ষ বলে মনে করতেন। কারণ তুর্কি মালিকদের মধ্যে থেকে
ইলতুৎমিস সুলতান পদে নির্বাচিত, তাই এই শ্রেণী নিজেদের সিংহাসনের প্রশ্চাত শক্তি
বলে মনে করত। তৃতীয়তঃ আলীমর্দান
খলজী বিদ্রোহ করেন এবং সুলতান আলাউদ্দিন উপাধি গ্রহণ করে বাংলাদেশের স্বাধীন
শাসনের সূচনা করেন। চতুর্থতঃ সুযোগ বুঝে রাজপুত রাজা এবং হিন্দু নরপতিগণ সুলতানি শাসন
অধিকার করেন ও গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ দখল করে নিতে থাকেন। পঞ্চমতঃ
সর্বোপরি দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা
চেঙ্গিস খাঁ ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে উপস্থিত হয়ে ইলতুৎমিসকে কঠিন পরীক্ষার
মুখোমুখি করেন।
এইরূপ চরম দুঃসময়ে ইলতুৎমিসের সামনে দুটি পথ উন্মুক্ত ছিল। হয় বিদ্রোহীদের দাবী মেনে নেওয়া এবং নয়তো তা দমন করা। তিনি ধৈর্য ও বিচক্ষণতার পরিচয়
দিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করে সুলতানি সাম্রাজ্যের চারাগাছটিকে টিকিয়ে রাখতে
সক্ষম হয়েছিলেন। ইলতুৎমিস প্রথমে দিল্লি, বদায়ুন, অযোধ্যা, বেনারস প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহী আমিরদের দমন করে ঐসব অঞ্চলে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। খারিজম শাহ কর্তিক গজনী অধিকৃত
হলে তাজউদ্দিন ইলদুজ ভারত ভূখন্ডে
প্রবেশ করে নাসিরউদ্দিন কুবাচাকে বিতাড়িত করে লাহোর দখল করে নেয় এবং পাঞ্জাবের
উপর তার কর্তৃত্ব স্থাপিত হলে ইলতুৎমিসের অস্তিত্ব
বিপন্ন হয়ে পড়ে। ইলতুৎমিস
পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সসৈন্যে লাহোর যাত্রা করেন। কে. কে. দত্তের মতে
ইলতুৎমিস ইলদুজকে পরাজিত ও হত্যা করেন। এইভাবে
তিনি নিজের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করেন।
তাজউদ্দিন ইলদুজের মৃত্যুর পর লাহোর সহ তাঁর অধিকৃত স্থানগুলি নাসিরুদ্দিন কুবাচা দখল করে নিয়েছিল। ইলতুৎমিস কুবাচার স্বাধীনতাস্পৃহা,
উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সহ্য করলেও শিরহিন্দ দখলের চেষ্টা করলে চিনাব নদীর নিকটে মনসুরার
যুদ্ধে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে কুবাচাকে পরাজিত করে লাহোর দখল করেন। লাহোরের দায়িত্ব নিজের পুত্র
নাসিরউদ্দিন মহম্মদের হাতে অর্পণ করেন। পরবর্তী
কিছুকাল কুবাচা সিন্ধু অঞ্চলে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিস ‘উচ’ দখল করে নিয়ে
কুবাচাকে রাজ্যচ্যুত করেন। পরাজিত হয়ে কুবাচা পলায়নের সময় সিন্ধু নদের জলে ডুবে প্রাণ হারান।
ত্রয়োদশ শতকে মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ মোঙ্গলরা চেঙ্গিস খান নেতৃত্বে অসামান্য শক্তির অধিকারী হয়ে
ওঠে এবং একে একে নানান অঞ্চল পদানত করতে থাকে। মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পদানত করে খারিজম রাজ্য আক্রমণ করে।
খারিজম শাহ জালালউদ্দিন মঙ্গাবরনী মোঙ্গলদের কাছে পরাজিত হয়ে
পাঞ্জাবে চলে আসেন। তিনি
দিল্লিতে থাকার জন্য ইলতুৎমিসের সাহায্য
প্রার্থনা করেন। অন্যদিকে
মঙ্গাবরণীকে অনুসরণ করে চেঙ্গিস খাঁ সিন্ধুর তীরে
উপস্থিত হন এবং মঙ্গাবরণীকে সমর্থন না করার জন্য ইলতুৎমিসকে অনুরোধ করেন।
এই পরিস্থিতিতে বিচক্ষণ ইলতুৎমিস মঙ্গাবরনীকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার
করেন। অগত্য মঙ্গাবরনী
পারস্য প্রস্থান করেন। এই
পরিস্থিতিতে চেঙ্গিস খাঁ আর অগ্রসর না হয়ে আফগানিস্থানের উদ্দেশ্যে ভারত ত্যাগ
করেন। এইভাবে
ইলতুৎমিস মোঙ্গলদের হাত থেকে দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে সমর্থ হন।
কুতুবউদ্দিন আইবকের মৃত্যুর পর থেকেই বঙ্গদেশ দিল্লির প্রভুত্ব মানতে
অস্বীকার করে। এই
সময়ে আলীমর্দান খলজী বাংলায় স্বাধীন শাসন প্রবর্তন করেছিলেন। ইতিমধ্যে আলিমর্দানের মৃত্যু হলে তার পুত্র
হিসাবউদ্দিন ইয়াজ 'গিয়াসউদ্দিন’ উপাধি নিয়ে
বাংলার শাসন পরিচালনা করেন। তিনি
নিজ মুদ্রা প্রবর্তন করেন এবং খলিফার উদ্দেশ্যে খুৎবা পাঠ
করে নিজের স্বাধীন অস্তিত্বের জাহির করেন। অতঃপর ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিস ইয়াজের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পাঠালে
ইয়াজ তাঁর
বশ্যতা স্বীকার করে নেন। কিন্তু
ইলতুৎমিশের দিল্লি প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যার কারণে ইলতুৎমিশের জ্যেষ্ঠ
পুত্র নাসিরুদ্দিন বাংলা আক্রমণ করে এবং ইয়াজকে হত্যা করেন। নাসিরউদ্দিনের
মৃত্যুর পর বাংলায় দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেয়।
ইলতুৎমিস দ্রুত বাংলাদেশ উপস্থিত হয়ে বিদ্রোহ দমন করেন এবং বাংলাকে
দিল্লি সুলতানির অন্তর্ভুক্ত করেন।
রাজপুত
রাজ্যগুলি তাদের হৃত রাজ্যাংশ পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিল। তাই কুতুবুদ্দিনের মৃত্যুর পর
দিল্লির সুলতানি রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে তারা স্ব স্ব প্রধান হয়ে ওঠে। ইলতুৎমিসের পক্ষে এই ক্ষতি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তিনি রাজপুত রাজ্যগুলির
বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং একে একে গোয়ালিয়র, রনথম্বোর, আজমির, মান্ডু,
বেয়ান প্রভৃতি স্থান পুনর্দখল করেন। ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দে
মালক আক্রমণ করে ভিলসা ও উজ্জয়িনী ধ্বংস করেন।
সুলতানি
সাম্রাজ্যের এই সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে ইলতুৎমিস নিজে কূটনৈতিক দক্ষতায় যেভাবে সমাধান করেছিলেন তাতে তাঁর কৃতিত্ব নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি
হয়েছে। দিল্লির
সিংহাসনের উপর
ইলতুৎমিসের অধিকার বৈধ ছিল কিনা অথবা তিনি জবর
দখলকারী ছিলেন কিনা তা নিয়ে মতবিরোধ আছে। ড: হাবিবুল্লাহ বলেছেন ইলতুৎমিস
ছিলেন দিল্লির বৈধ শাসক। ড: অমলেশ ত্রিপাঠী বলেন যে ইলতুৎমিসকে বেআইনি জবরদখলকারী বলা যায় না, জোর করে
দখল করার মত কোন কিছু দিল্লিতে ছিল না। পূর্বে
দিল্লির সিংহাসনে কোন সার্বভৌম সম্রাট ছিল না,
ইলতুৎমিস তার স্বীয় যোগ্যতা অদম্য মনোবল, বিচক্ষণতা
ও ধৈর্যের সাথে সুসংগঠিত করেন। তাঁর সিংহাসনে আরোহণের পর ইলদুজ, কুবাচা, রাজপুত
গোষ্ঠীর উচ্চাভিলাষ তিনি কঠোর হাতে দমন করেন। তিনি যে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের
সূচনা করেছিলেন তাকে ভিত্তি করে পরবর্তীকালে খলজীদের
সামরিক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।
১২২৯ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে
ইলতুৎমিসকে বাগদাদের খলিফা ‘সুলতান ই আজম’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং
শিরোপা প্রদান করে বৈধ ও স্বীকৃত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করেন। ইলতুৎমিস প্রথম আরবীয় ধারায় ১৭৫ গ্রেনের
রৌপ্য মুদ্রা চালু করেন। খলিফার
প্রতি কৃতজ্ঞতা বশত এই মুদ্রায়
তিনি নিজেকে খলিফার সেনাপতি বলে উল্লেখ করেন।
ইলতুৎমিস
কেবল রাজ্য জয়ের দিকে নজর দেননি একটি শাসনতান্ত্রিক কাঠামো প্রবর্তনের দিকেও নজর
দিয়েছিলেন। এই কাজে
তার প্রধান সহায়ক ছিলেন বহিরাগত কিছু তুর্কি ক্রীতদাস এবং অতুর্কি মুসলমান।
এদের মধ্যে ছিলেন বলবন, শের খাঁ, মালিক মহম্মদ জুনাইদ ও ফকরুদ্দিন ইসামি।
ইলতুৎমিসের প্রশাসনে
হিন্দুস্থানী মুসলমান নিয়োজিত ছিল কিনা তা জানা যায় না, তবে স্থানীয় হিন্দু
নায়েকরা আগের মতই নিজ দায়িত্বে বহাল ছিলেন। শাসনের সুবিদার্থে গোটা
সাম্রাজ্যকে কয়েকটি ইকতায় বিভক্ত করেছিলেন। ইক্তাদারদের
নিয়োগ ও পদচ্যুতি ছিল সুলতানের
ইচ্ছাধীন। এর মাধ্যমে ইলতুৎমিস দূরবর্তী অঞ্চলে সুলতানের
কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিল।
শিল্প স্থাপত্যের প্রতি ইলতুৎমিসের যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। তিনিই ছিলেন দিল্লি নগরীর প্রধান স্থপতি।
কুতুবউদ্দিন আইবক যে কুতুবমিনার নির্মানের কাজ অসমাপ্ত রেখে গিয়েছিলেন
ইলতুৎমিস তা সম্পন্ন করেন। সমকালীন প্রখ্যাত পন্ডিত মিনহাজউদ্দিন প্রমুখ ইলতুৎমিসের
সভা অলংকৃত করেছিলেন।ইলতুৎমিস ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেও ধর্মীয় উদারতার অভাবছিল তাঁর
চরিত্রে। তিনি ‘সুন্নী’ সম্প্রদায়ের
মুসলমান হওয়ার ফলে ‘শিয়া’ সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি খুবই কঠোর ছিলেন। হিন্দুদের প্রতি তিনি অনুদার
ছিলেন, অসুন্নী
মুসলমান ও হিন্দুদের ধ্বংসসাধনের একটা বাসনা তাঁর মধ্যে সর্বদা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। মধ্যযুগীয় পরিস্থিতিতে এরূপ পরধর্ম
সহিষ্ণুতার অভাব খুব আশ্চর্যজনক বা নিন্দনীয়
বিষয়ে বলে ভাবা অহেতুক হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে
ক্রীতদাস হিসাবে কুতুবউদ্দিনের সেবায় নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং দুই দশকেরও কম সময়ের
মধ্যেই ভারতস্থ তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন। তাঁর একান্ত
ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও মানসিক দৃঢ়তার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। অদম্য মনোবল বিচক্ষণতা ও ধৈর্যের
সাথে সামরিক দক্ষতা ও নেতৃত্ব দানের প্রতিভার সুষম মিল
ঘটিয়ে তিনি মাত্র ছাব্বিশ বছরের মধ্যেই
যে সুসংগঠিত রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন পরবর্তী ত্রিশ বছরে সেই রাজ্যের অস্তিত্বগত সংকট দেখা দেয়নি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিকরা যেমন
ইলতুৎমিসকে দিল্লি সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন তেমনি কেউ কেউ তাঁকে আদিপর্বের সর্বশেষ্ঠ মামেলুক সুলতান বলেও আখ্যায়িত
করেছেন। স্যার
উলসি হেক লিখেছেন তিনি ছিলেন সমস্ত দাস সুলতানদের মধ্যে সর্বোত্তম্।
ইতিহাস অনুসন্ধান – অঞ্জন গোস্বামী, আদি ও মধ্যযুগের ভারত- সুবোধ
মুখোপাধ্যায়, মধ্যকালীন ভারত- গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন