সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ

 


 

 স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারতের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত একটি উল্লেখযোগ্য কৃষক বিদ্রোহ হল তেলেঙ্গানা বিদ্রোহ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে হায়দ্রাবাদ দেশীয় রাজ্যের প্রায় ১৬০০০ বর্গমাইল ব্যাপী ৩০০০ গ্রামের ৩০ হাজার কৃষক এই বিদ্রোহের শামিল হয়েছিল পাঁচ বছর স্থায়ী এই বিদ্রোহের একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল গেরিলা কায়দায় সংগ্রাম পরিচালনা করা

 ইংরেজ আমলে হায়দ্রাবাদ ছিল একটি বৃহৎ দেশীয় রাজ্য এবং এর শাসক ছিলেন নিজাম হায়দ্রাবাদের পূর্বদিকে আটটি তেলেগুভাষী জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছিল তেলেঙ্গানা অঞ্চল তেলেঙ্গানার অধিকাংশ প্রজাই ছিল হিন্দু উর্দুভাষী মুসলমান শাসক গোষ্ঠী স্থানীয় কানাড়ী, তেলেগু ও মারাঠা ভাষী হিন্দু প্রজাদের উপর আধিপত্য কায়েম করে তেলেঙ্গানার কৃষকরা সামন্ততান্ত্রিক অমানুষিক অত্যাচারের শিকার হয় এবং তাদের উপর বিভিন্ন প্রকার বেআইনী কর চাপানো হয়অধিকাংশ কৃষকের নিজস্ব কোন জমি ছিল না মুসলমান ও উচ্চবংশজাত হিন্দু দেশমুখ ও জায়গিরদাররা কৃষকদের উপর অকথ্য অত্যাচার করত, তাদের কাছ থেকে নানা ধরনের জোরজবরদস্তি কর আদায় করে এবং অনেক সময় জোর করে তাদের ভেত্তি বা বেগার খাটতে বাধ্য করা হতরাজনৈতিক ক্ষেত্রে তেলেঙ্গানা কৃষকদের কোন অধিকার ছিলনা কৃষকদের পুঞ্জিভূত বিক্ষোভ ও অসন্তোষ ১৯৩০ এর দশক থেকে তেলেঙ্গানায় আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল

তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জুলাই নালগোণ্ডা জেলা জলগাঁও তালুকে। রামচন্দ্র রেড্ডি নামে একজন অত্যাচারী দেশমুখ বা জমিদার তার জমিদারির অন্তর্গত পানাকুর্তি গ্রামের এক ধোপানীর জমি দখল করতে উদ্যোগী হন এই সময়ে তরুণ কমিউনিস্ট নেতা ডোড্ডি কোমবাইয়া অসহায় ধোপানি কে অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে রামচন্দ্র রেড্ডির পোষা গুন্ডাদের হাতে নিহত হয় এই ঘটনা কৃষকদের উত্তেজিত করে এবং নালগোণ্ডা জেলার জলগাঁও, সূর্যপেট এবং হুজুর নগর তালুকে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েবিদ্রোহীরা লাঠি, পাথর ও লঙ্কারগুঁড়োকে বিদ্রোহের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল১৯৪৭ সালের আগস্ট মাস থেকে ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে এই আন্দোলন সবচেয়ে তীব্র আকার ধারণ করেছিল এই আন্দোলনের বিবরণ দিতে গিয়ে অধ্যাপক সমর কুমার মল্লিক দেখিয়েছেন যে বিভিন্ন স্থানে রাজস্ব বা করের নথিপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়, একদিকে গেরিলারা যেসব গ্রাম মুক্ত করতে সক্ষম হয় সেখানে ভেত্তি বা বেগার খাটা তুলে দেওয়া হয় কৃষি মজুরির হার বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং যারা জমিজমা হারিয়েছিল তারা তাদের হারানো জমি ফের পায় ও পতিত জমি বন্টনের ব্যবস্থা করা হয়

 ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর তেলেঙ্গানা বিদ্রোহের অবস্থা দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায় এই সময় পুলিশি তৎপরতা বৃদ্ধি পায় সুমিত সরকার লিখেছেন যেআসলে কমিনিস্ট অগ্রগতিকে রোখার চেষ্টা হিসেবেই সম্ভবত বড় আকারে পুলিশি অভিযানের ব্যবস্থা নেওয়া হয় নিজাম বিরোধী সংগ্রামের ধারা অনেক কমে গিয়েছিল ১৯৪৮ সালের পরে সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্য কেবলমাত্র কৃষি সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার দরকার ছিল রবিনারায়ন রেড্ডি নামে একজন নেতার মতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আবির্ভাবের পর গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি, যার জন্য কমিউনিস্টরা শেষ পর্যন্ত অবস্থাপন্ন চাষীদের সমর্থন হারিয়েছিল সন্ত্রাসের মধ্যে সংগ্রাম নিমগ্ন হয় এবং কর্মীরা আশ্রয় নেয় সুদূর অরণ্যে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনী তেলেঙ্গানা বিদ্রোকে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছিল এই বিদ্রোহে প্রায় ৪০০০ কর্মী নিহত হয়, ৬০০০ বন্দি হয়, এবং ১৯৫১ সালে এই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়

তেলেঙ্গানা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও তার গুরুত্বকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি এই বিদ্রোহ ভারতের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে আছে এই বিদ্রোহের ফলে কৃষকরা কিছুটা উপকৃত হয়, ভেত্তি প্রথা আর ফিরে আসেনি, পুনর্বন্টিত জমি কেড়ে নেওয়া হয়নি এবং জায়গিরদারী উচ্ছেদ করা হয়নি তেলেঙ্গানা বিদ্রোহের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধ্যাপক সুনীল সেন লিখেছেন যে তেলেঙ্গানা আন্দোলনের বিজয় স্বীকার্য নিজামের শাসনের অবসান হয়, শতাব্দী পুরানো স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস হয়, হায়দ্রাবাদ ভারত ইউনিয়নে যোগ দান করে, কোন সাম্প্রদায়িক ঘটনা এখানে ঘটেনি এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি পিছু হটেশেষ পর্যন্ত অন্ধ্র রাজ্য গঠিত হয় ১৯৫২ সালে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে অন্ধ্র জাতীয় ঐক্য সংহত হয়কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও তেলেঙ্গানা ভারতের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রথম আহ্বান জানিয়েছে ও পথ দেখিয়েছিল

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মার্টিন লুথারের ৯৫ থিসিস

    মার্টিন লুথার ছিলেন লুথা রিয়ান মতবাদের প্রবক্তা । জার্মানির স্যাক্সসনিতে ইসলিবেন নামে একটি গ্রামে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের জন্ম হয় । ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ইউটে ম বা র্গ চা র্চে র দরজায় তিনি তাঁ র ৯৫ তত্ত্ব ঝু লিয়ে দেন । এটি ছিল পোপের স্বর্গীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ । সমস্ত জার্মানির শিক্ষিত মানুষেরা লুথারের তত্ত্বে র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । এই ৯৫টি ছিল তাত্ত্বিক প্রশ্ন , এতে বাইবেল ও খ্রিস্টান দর্শন সম্বন্ধে তাত্ত্বিক গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রশ্ন ছিল । উইলিয়াম ওকামের চিন্তাভাবনা দ্বারা মার্টিন লুথার প্রভাবিত হয়েছিলেন । ইউরোপের এই চিন্তা ধারা পরিণত ছিল nominalism নামে । নমিনালিস্ট চিন্তাধারায় উল্লেখযোগ্য ছিল বিশ্বাস ও নিবেদিতপ্রাণতা । নমিনালিস্টরা মনে করত বিশ্বাসই মুক্তি আনবে , তবে এই বিশ্বাস অর্জনের জন্য শাস্ত্র পড়তে হবে এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের বোধগম্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করতে হবে । লুথার এইমতে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হওয়া উচিত এবং আঞ্চলিক ভাষায় বাইবেল রচনা করা একান্ত দরকার । তিনি খ্...