সর্ব
প্রথম ছাপাখানা বা মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেন জোহানেস গুটেনবার্গ। তিনি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ছাপার ধাতব অক্ষর ইংরেজি
বর্ণমালা বিভাজন, বর্ণগুলিকে
বিভিন্ন খাপে রাখার নিয়ম ইত্যাদি উদ্ভাবন করে
পুস্তক উৎপাদনের ব্যাপারে বিপ্লব আনেন। Engine
– F Rice এর গবেষণায়ও সমকালীন নথিপত্র থেকে দুইজন এর নাম পাওয়া
যায় যথা জোহানন ফাস্ট এবং পিটার সোফার Rice বলেছেন মুদ্রণ
ব্যবস্থার আবিষ্কারে এই দুইজনের কৃতিত্ব ও উল্লেখযোগ্য।
জাইলোগ্রাফি
বা block printing প্রথম এসেছিল চীনদেশে অষ্টম
শতকের গোড়ার দিকে। মুদ্রাকার
যে ছবি ছাপতে চাইতেন তা একটা কাঠের ফলকের ওপর উল্টো
করে খোদাই করে তাকে চাইনীজ কালিতে ডুবিয়ে ছবির
প্রিন্ট তৈরি করা হত। অক্ষরের
ব্লগ তৈরি করে একেবারে প্রথম দিকে কাগজের বদলে চামড়ার ওপর ছাপ মারা হত। কিন্তু এই ব্যবস্থা বেশিদিন চলেনি। ইতিমধ্যে চীনদেশে কাগজের ব্যবহার
শুরু হয়। ১২৫০-১৩৫০এ
চীনা সভ্যতা আর সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের
পর্বে ছাপার ওই পদ্ধতি ইউরোপে আসে। কাঠের
ফলকে হরফ খোদাই করে পুঁথি ছাপানো আর ছবিওয়ালা খেলার তাস বানানো শুরু হয়। কাগজ তৈরি রীতি নীতিও চীন দেশ
থেকে আরবদের মারফত ইউরোপে চালু হয়েছিল ইতালিতে তেরো শতকে।
ফ্রান্স ও জার্মানিতে চোদ্দো শতকে, সুইজারল্যান্ডে পনেরো শতকে, ইউরোপে পুরনো ধাঁচের কাগজকল এই সময় তৈরি হয়। পার্চমেন্ডের বদলে কাগজ দিয়ে ছাপার কাজ শুরু হতে থাকে।
গুটেনবার্গ ফাস্ট এবং শোফার মেইনজ শহরে যে মুদ্রণ
ব্যবসা চালাতেন তাতে লাগানো হয় বিশেষ ধরনের
কালি, পঞ্চদশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে
ফ্লেমিশ শিল্পীদের ব্যবহার করা তেল রঙ বা তেলকালির ব্যবহার দেখে মানুষ বিস্মিত হত। মুদ্রণ
শিল্পীরা চাইনীজ কালি
ছাড়া ঐ ফ্লেমিশ তেলকালি ব্যবহার শুরু করে ছাপার
জন্য। ধাতব
অক্ষরে কালি লাগিয়ে জোর চাপ দেওয়ার পদ্ধতিও
আবিষ্কার হয়। কাগজের
কলে ভিজে কাপড় থেকে জল বের করার জন্য যে চাপ দেওয়ার কাঠের যন্ত্র ব্যবহার করা
হতো, সেই ধরনের যন্ত্রই কাজে লাগানো হত। ধাতুর হরফ তৈরি কারিগরি
কৌশল এসেছিল ধাতুর নানারকম সূক্ষ্ম কাজকর্মের বহুকালের পুরনো ঐতিহ্য থেকে। এদের
মধ্যে ছিল মুদ্রা তৈরির কাজ, সোনা রুপোর
গয়নাগাটির কাজ, বাসন কুশনের উপর অক্ষর খোদাইয়ের কাজ
ইত্যাদি। চোদ্দো শতকের শেষ এবং পনেরো শতকের গোঁড়ার দিকে নানা জায়গায় শিল্পোদ্যোগী আর কারিগররা ঠিক ঠিক
মুদ্রণযন্ত্র তৈরি করার জন্য নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল।
ছাপার
ব্যাপারে অগ্রণী ছিল মেইনস শহর। ল্যাটিন ভাষায় মুদ্রিত বাইবেল গুটেনবার্গের নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে তার হরফের সৌন্দর্য হরফ সাজাবার আর ছাপার মুনশিয়ানা
প্রায় তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত নিখুঁত এবং এটি ১৪৫৫ সালে
ছাপা হয়েছিল। এর দু
বছরের মধ্যে ১৪৫৭ এর ১৪ ই আগস্ট ফাস্ট এবং শোফার
প্রকাশ করেন ‘সাম’ ওল্ড
টেস্টামেন্টে স্তোত্রসার। ইউরোপের প্রথম স্বাক্ষরিত আর তারিখ
দেওয়া মুদ্রিত এই বই। প্রথমদিকে অক্ষরগুলি হাতে লেখা হত, পরে অক্ষরগুলি শোভন হতে শুরু করে। মুদ্রণ ব্যবস্থা তখনো ধর্মীয় যাজকরা বেশি করে কাজে লাগাতেন। ইনডালজেন্স ফর্ম, সেন্ট টমাস ত্র্যাকুইনাসের
প্রবন্ধ বাইবেল স্তোত্রগাথা বেশি করে
ছাপা হত। পৌর
মানবতাবাদের উত্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর
সংখ্যা বাড়া ইত্যাদি কারণে ছাপাখানাগুলির
আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছিল। পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে মেইনস এর
শিল্পোদ্যোগ আর কারিগরদের হাতে যে মুদ্রণযন্ত্র তৈরি হয়েছিল পরবর্তী ৩০০ বছরে তাতে আর কোনরকম হাত দিতে হয়নি।
ষোড়শ শতকে যেসব গ্রন্থ ছাপা
হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাইবেল থেকে শুরু করে বিশ্বকোষ, বীরগাথা সহ প্রাচীন গ্রিক রোমান গ্রন্থ অনুবাদ, গণিত, জ্যোতিষ, চিকিৎসা ও জ্যোতির্বিদ্যার উপর গ্রন্থ, যা মানুষের সামনে জ্ঞান ভান্ডারের দ্বার উন্মুক্ত
করেছিল। রেনেসাঁর
সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন মুদ্রণ কৌশল হলেও প্রথমদিকে যাজকদের প্রয়োজন মেটানোই এর বড় কাজ ছিল।
রেনেসাঁর পীঠস্থান ইটালিতে নয়, মুদ্রণযন্ত্র
আত্মপ্রকাশ করেছিল এক ছোট প্রাদেশিক শহরে যার জনসংখ্যা তিন হাজারের মতো আর ধর্ম
যেখানে প্রধান।
পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে ১৪৬০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে
ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল ইতালি, সুইজারল্যান্ড,
বোহেমিয়া ও নেদারল্যান্ড। ১৪৮৩ সালের মধ্যে ডেনমার্ক ও সুইডেনে এবং ১৮৭৬ সালের মধ্যে স্পেন,
ইংল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল ছাপাখানা। ১৪৫৫-১৫০০ সালের মধ্যে চল্লিশ
হাজার সংস্করনে ছাপা হয়েছিল প্রায় ষাট লক্ষ বই।
ছাপাখানার আবিষ্কার বই প্রকাশের
সাংস্কৃতিক ফলাফল হয়েছিল সুদুরপ্রসারী। লিখিত
পান্ডুলিপি রাখার দিন শেষ হয়ে গিয়েছিল। গড়ে
উঠেছিল পুস্তক বিপণি ও লাইব্রেরী, পুরনো
পান্ডুলিপিগুলো প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল পরিমার্জিত, পরিবদ্ধিত ও সংশোধিত হতে
লাগলো ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে কোপার্নিকাসের বই প্রকাশিত হবার পর ইউরোপের শ্রেষ্ঠ মনীষীরা তাঁর তত্ত্ব নিয়ে গভীর ভাবনাচিন্তা শুরু করেন।
তাঁদের সমবেত প্রচেষ্টা বিশ্বজগতের স্পষ্ট
ছবি গড়ে ওঠে অল্প সময়ের মধ্যে, ইরাসমাসের রচনাবলী পৌঁছে যায় ইউরোপের পন্ডিত আর জ্ঞানী মানুষের
প্রায় সব গোষ্ঠীর হাতে। শুধু বই
নয়, ছাপাখানা ইউরোপের দূর-দূরান্তে পৌঁছে
দেয় মিকেলাঞ্জেলো কাজকর্মে যেমন সিস্তিন
গির্জার ছাদে আর দেওয়ালে তাঁর আঁকা চিত্রগুলি মুদ্রিত ছবি।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে
বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলির সংখ্যা বেড়েছিল, ফলে বইয়ের চাহিদা বেড়ে ছিল। মুদ্রণযন্ত্রের সাহায্যে অল্পসময়ে
অসংখ্য বই সরবরাহ করা সুবিধা হয়েছিল। জ্ঞান
ব্যক্তিগত মেধার কবলমুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। পন্ডিত ব্যক্তিকে ঘিরে যে শিক্ষালাভের
প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল ছাপা যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে অসংখ্য পুস্তক রচিত হয়েছিল যা
সাধারণ মানুষ অনায়াসে পাঠ করতে পারত এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ
হয়ে যায়।
মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার ধর্মসংস্কার
আন্দোলনকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল হাজার হাজার মানুষের কাছে জ্ঞানের আগল মুক্ত হয়, শিক্ষা
সংস্কৃতির বিকাশের পথ আরও প্রশস্ত। ইরাসমাস, ক্যালভিন বা লুথারের চিন্তাধারা অনেক দ্রুত সাধারণ
মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছিল। ধর্মের জিগির তুলে পোপরা
জনসাধারণকে ধর্মের প্রতি অনুপ্রাণিত হওয়ার শিক্ষা দিত। কিন্তু ধর্ম সংস্কারকদের বই পড়ে সাধারণ মানুষের মনে ধর্মের সকল
প্রকার কুসংস্কার তারা জানতে। ফলে
ধর্ম সংস্কার আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করার জন্য চার্চের মাধ্যমে পোপ ছাপাখানার
ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। ইনডেক্স
এর মাধ্যমে নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকা প্রস্তুত করে বই পোড়ানো হয়েছিল, তাতে
ছাপাখানার গুরুত্ব আরো বেড়ে গিয়েছিল। মুদ্রণযন্ত্র
থেকে এসময় বহু বেনামী বই বার হয়ে গোপনে ছড়িয়ে পড়েছিল মানুষের হাতে। শ্রেণিকক্ষে পড়াবার সুবিধা এবং
স্মৃতি নির্ভরতাকে কমিয়ে দিয়েছিল এবং তথ্যমূলক জ্ঞানের চেয়ে মানুষ এবার বেশি
আকৃষ্ট করেছিল বিচার ও যুক্তির দিকে। ধর্মীয়
কুসংস্কার মুক্ত এক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছিল।
গ্রিক
সাহিত্যের পুনরুদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে হিব্রু সাহিত্যের ব্যাপারে উৎসাহ পুনরুদ্ধার
হয়। গ্রিক সাহিত্যের মত হিব্রু
সাহিত্যে মধ্যযুগের পরিচিতি ছিল। কিন্তু
সেগুলো পাঠ করার উৎসাহ মধ্যযুগের দেখা যায়নি। রেনেসাঁ যুগে মৌলিক উপাদানগুলি পাঠ করার
ব্যাপারে সরাসরি উৎসাহ দেখা দিয়েছিল। মুদ্রণ
যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে হিব্রু সাহিত্য ছাপানো হলে ইহুদি জনগণের মধ্যে হিব্রু
সাহিত্যের প্রতি আসক্তি দেখা যায়।
জনসাধারণের মধ্যে ছাপা বইয়ের চাহিদা বৃদ্ধি
পেয়েছিল শহরে থাকা আর শহরে কাজ করা মানুষের মধ্যে নতুন নতুন বাইয়ের চাহিদা ছিল
উল্লেখযোগ্য। নিজেদের
জীবিকা নির্বাহ করার জন্য সমাজে মেলামেশা করার জন্য, সরকারি
দপ্তরে নানা দায়িত্বপূর্ণ কাজ ঠিকঠাক করার জন্য,
ব্যবসা-বাণিজ্য চালানোর জন্য এসব মানুষদের লেখাপড়া করতে হত।
শহরে মানুষের দুটো সংখ্যা বৃদ্ধি আর সেকুলার জ্ঞানচর্চার বিস্তার
মুদ্রণ শিল্পকে ছড়িয়ে দিয়েছিল দ্রুত। শহরের
মানুষের সংখ্যা আর তাদের লেখাপড়া, সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি আর আত্ম সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আয়তনও বেড়ে ওঠে অনেকটাই। নিজেদের প্রয়োজনে নানা অভিধান, বিশ্বকোষ, নানা ধরনের ইতিহাস,
গণিতশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র, আইনের বই,
ভার্জিল, সিসেরো, প্লিনি
প্রমূখ ধ্রুপদী সাহিত্যিকদের ল্যাটিন আর অন্যান্য ভাষায় নানারকম রচনাবলী কিনতেন।
ছাপাখানা বিস্তারের আগে লেখাপড়া নির্ভর
করত সাধারণ প্রাচীন আর সমসাময়িক পণ্ডিতদের রচনাবলী নকলের ওপর। ফলে রচনাবলী নকল করার কাজ ছিল
ধীরগতির আর তাতে ভুলভ্রান্তি থাকত বিস্তর। ছাপাখানার
বিস্তারে এদুটি সমস্যা দূর হল অনেকটাই। ইউরোপের
নানা জায়গায় পণ্ডিতদের সমবেত প্রচেষ্টায় একটু একটু করে নানা রচনাবলীর নির্ভুল সংস্করণ
বেরিয়ে আসতে লাগল আর সেসব সর্বত্র
সহজলভ্য হওয়ার ফলে জ্ঞান আর বিদ্যাচর্চার পরিধিও বিস্তৃত হলো।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপেক্ষিতে বলতে পারি
যে মুদ্রণযন্ত্রের উদ্ভাবনের গুরুত্ব সুপ্রাচীনকালে হাতে লেখার আর আধুনিককালের
কম্পিউটারের উদ্ভাবনের গুরুত্বের সমতুল্য। আর সে কারণেই এল রাষ্ট্রীয় আর রাজনৈতিক নজরদারি কখনো সূক্ষ্মভাবে আর কখনো বা স্থূলভাবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও একাজে
পিছিয়ে থাকেনি। মুদ্রণযন্ত্রের
আবিষ্কার ইউরোপের রেনেসাঁ কেবলমাত্র একটি স্ফুলিঙ্গ হিসাবে পরিণত না হয়ে স্থায়ী ও ধারাবাহিক যুগান্তর হিসেবে দেখা দিয়েছিল। ভৌগলিক সীমাবদ্ধতার সিমা কেটে গিয়েছিল এবং ধ্রুপদী
ও রেনেসাঁ যুগের সাহিত্যিক ও গবেষকদের মূল্যবান লেখাগুলি সমস্ত পশ্চিমবিশ্বে
ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিল। ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরী ১৫২৬ এ নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকা প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। ১৫৬০ এর
মধ্যে পশ্চিম ইউরোপের সর্বত্র বইয়ের সব রকম সেন্সর প্রথা চালু হয়ে যায়।
Very good
উত্তরমুছুন