সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আদি মধ্যযুগের উপাদান

 


 

প্রথাগত ভারতবর্ষের ইতিহাসকে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক এই তিনটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হয় তবে অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় ইতিহাসের কালপর্বকে এভাবে চিহ্নিত করার বিরোধিতা করেন তিনি বলেন যে, একটি বিশেষ যুগের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ইতিহাসের কাল বিভাজন হওয়া উচিত তারপর থেকে ইতিহাসে কাল বিভাজনে নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু হয় ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতে আদি মধ্যযুগের সূচনা হয় বলে ঐতিহাসিক মনে করেন হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ভারতের রাজনীতিতে নতুন প্রক্রিয়ার সূচনা হয় এবং সাম্রাজ্যিক ঐক্য বিনষ্ট হয়েছিল এই সময় উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রতিহার, পূর্ব ভারতে পাল রাজারা, দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটরা এবং সুদূর দক্ষিনে চোরা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল আদি মধ্যযুগের ইতিহাসে রাজনৈতিক দিকটা কিছুটা অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত পৃথিবীর বিশিষ্ট ঐতিহাসিকরা রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে, দর্শন, শাসন, আইন ইত্যাদি পঠন পাঠনের কথা বলেছেন আদি মধ্যযুগের উপাদানগুলিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা হয়েছে যথা সাহিত্য, লেখমালা মুদ্রা

সাহিত্য হল সমাজের দর্পণ আর সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অর্থনীতি আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের ছবি যেমন ফুটে ওঠে সাহিত্যের মধ্যে তেমনি রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে অনেকাংশে আমাদের অবগত করে থাকে আদি মধ্যযুগের ইতিহাস আলোচনা উপাদানে সাহিত্যিক উপাদানকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, যথা - দেশীয় সাহিত্য ও বিদেশি সাহিত্য দেশীয় সাহিত্যের মধ্যে পুরাণ’, স্মৃতিশাস্ত্র’, জীবনীমূলকগ্রন্থ’, স্থানীয়উপাখ্যান’, জ্যোতির্বিদ্যা ও বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ বৈদেশীয় সাহিত্য বলতে বোঝায় আদি মধ্যযুগে ভারতে আগত বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ

 আদি মধ্যযুগের ইতিহাসে একটি বড় উপাদান হল পুরাণ আদি মধ্যযুগের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস গঠনে পুরাণের অবদান অনস্বীকার্য রাজনৈতিক ইতিহাস রচনায় পুরাণের বিশেষ ভূমিকা নেই ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা পুরাকে ব্যবহার করে তাঁর সামন্ততন্ত্রের তত্ত্ব খাড়া করেছেন। ভাগব পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বহু তথ্য আহরণ করা হয়েছে আদি মধ্যযুগের আকর উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয় স্মৃতিশাস্ত্র বা ধর্মশাস্ত্রগুলিকে।  এই স্মৃতিশাস্ত্র থেকে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্য সংগৃহীত হয়ে থাকে এই জাতীয় গ্রন্থগুলি হল বল্লালসেনের দানসাগর, ভবদেবভট্ট প্রায়শ্চিত্ত প্রকরণ অপরার্কের যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির ভাষ্য, বিজ্ঞানেশ্বরের মিতাক্ষরা জীমূতবাহনের দায়ভাগ ও ব্যবহার মাত্রিকা প্রভৃতি। এই গ্রন্থগুলি থেকে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধিবিধান, সম্পত্তিরক্ষা, পারলৌকিক ক্রিয়া কলাপ, অপরাধ অনুপাতে দণ্ডবিধানের নিয়মকানুন লিপিবদ্ধ হয়েছে 

আদি মধ্যযুগের আঞ্চলিক স্তরে বেশকিছু জীবনচরিত মূলক গ্রন্থ রচিত হয়েছিল, সেগুলি থেকে নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা করা যেতে পারে যেমন বাণভট্টের হর্ষচরিত’, পদ্মগুপ্তের নবসাহসাঙ্কচরিত’, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত’, বিলহনেবিক্রমাঙ্কদেবচরিত’, বাকপতি গৌড়বহ’, জয়ানকের পৃথ্বীরাজ বিজয় কাব্য’, ন্যায়চন্দ্রের হাসির কাব্য প্রভৃতি এই গ্রন্থগুলি থেকে আদি মধ্যযুগের রাজাদের বা কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা শ্রেণীর প্রতি পক্ষপাতিত্বের পরিচয় প্রদান করে 

আদি মধ্যযুগের ভারতের আঞ্চলিক ইতিহাস লেখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় স্থানীয় উপাখ্যানগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল কলহনের রাজতরঙ্গিনী (১১৪৮ – ৫০), তিনি ঐতিহাসিক হিসেবে যুগকে অতিক্রম করেছেন এবং আধুনিককালের বিশ্লেষণমূলক ইতিহাস রচনার পদ্ধতির ধারণা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন এই কাব্যের তথ্য সংগ্রহ করেছেন এগারোটি আকর গ্রন্থ এবং নীলমত পুরাণ থেকে। এছাড়া মন্দিরের গায়ে খোদিত বেশকিছু লিপি, দানপত্র, প্রশস্তি এবং আকর কিছু পান্ডুলিপি তিনি এই কাব্য রচনায় ব্যবহার করেন সপ্তম শতক থেকে তিনি কাশ্মীরের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস উপহার দেন পরবর্তীকালে অন্যান্য ঐতিহাসিকরা তাঁকে অনুসরণ করে গ্রন্থ রচনা করেন গুজরাটের লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় সোমেশ্বরেরসমালাকীর্তিকৌমুদী’, মেরুতুঙ্গেচিন্তামণি’, বলাচন্দ্রের বসন্তবিলাস গ্রন্থগুলি থেকে 

 গুপ্ত যুগে বরাহমিহির, আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত প্রমূখ জ্যোতির্বিদ ও বিজ্ঞানী দ্বারা যেমন বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করেছিল, তেমনি আদি মধ্যযুগের তা স্তিমিত হয়ে পড়ে নিন ওই সময়ে বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হয়েছিল, যেমন ভাস্করাচার্যের সিদ্ধান্ত শিরোমণি গোলাধ্যায়, বল্লালসেনের অদ্ভুতসাগর’, শ্রীধরেগণিতসা এবং সদানন্দের ভাস্বতী প্রভৃতি চিকিৎসাবিদ্যায় চক্রপাণিদত্তের চিকিৎসারসংগ্রহ ও পালকাপ্যেস্ত্যায়ুর্বেদ গ্রন্থের কথা এই যুগের উপাদান হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে চিকিৎসাবিদ্যা, গণিত, যোগশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাদান করা হত 

আদি মধ্যযুগে চীন, আরব প্রভৃতি দেশ থেকে আগত পন্ডিত ও পর্যটকরা ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিভিন্ন বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন তাদের গ্রন্থে চীনদেশ থেকে আগত যে সমস্ত পন্ডিত ভারতে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দুজন, এরা হলেন হিউয়ে সাঙ (৬২৯-৪৪) এবং ইৎ সিং (৬৭১ – ৯৫) বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান আহরণে ছিল এদের মূল লক্ষ্য হিউয়েসাঙ এর সি ইউ কি গ্রন্থ থেকে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের বিবর্তন, পুষ্যভূতিরাজ হর্ষবর্ধনের রাজত্বকাল এবং সমসাময়িক ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা যায় সিং এর ভারত বিবরণ মূলক গ্রন্থ কাউ-ফা-কাং-সাংচুয়েন নামক গ্রন্থ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে এছাড়াও এই গ্রন্থ থেকে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায় দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকের চীন ও আরবের বাণিজ্যের কথা পাশাপাশি ভারতীয় বাণিজ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন চীনা লেখক চৌ-জু-কুয়ান, তাঁচু-ফান-চি গ্রন্থে

 খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের গোড়ায় আরবদের সিন্ধু বিজয়ের (৭১১ খ্রিঃ) পর থেকে ভারত সম্পর্কে আকৃষ্ট হন, পর্যটক, ভৌগলিক ও পণ্ডিতেরা সিন্ধু বিজয়ের কাহিনী ও আনুষঙ্গিক কিছু তথ্য সম্পর্কে আমাদের অনেকাংশে নির্ভর করতে হয় মহম্মদ আলি হামিদ আবু বকর কুফির চানামা গ্রন্থের ওপর আরব বণিক সুলেমান সিলসিলট-উত-তওয়ারিখ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন যার থেকে তৎকালীন সময়ে ভারতের রাজনৈতিক খন্ডীকরণ এবং প্রধান প্রধান রাজশক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। অল মাসুদীর লেখা মুরাজ-উল-জহর গ্রন্থ থেকে প্রতিহার রাজ মহীপালের সামরিক শক্তি সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এবং ত্রিশক্তি সংঘর্ষের বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায় দশম ও একাদশ শতকে আরবীয় পর্যটক ও লেখকদের বিবরণ থেকে রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি বিজ্ঞান, সমাজ ও অন্যান্য নীতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের ভারতে বিজ্ঞানচর্চা বিষয়ে প্রতিফলন দেখা যায় আবুল কাশিম এর গ্রন্থ তবাকাৎ-উল-উমাস থেকে অল ইদ্রিসির বিবরণ থেকে পশ্চিম উপকূলের সামুদ্রিক বন্দর ও শহরের পরিচয় পাওয়া যায়

 আদি মধ্যযুগের ভারতের সমাজ ও সাংস্কৃতির এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরে একাদশ শতকের আরব পর্যটক অলবিরুনি তিনি সুলতান মাহমুদের সঙ্গে ভারতে আসেন কিক--হিন্দ বা কিতাব-উল-হিন্দ নামে তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন এবং  ভারতের বিষয়ে অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেন তিনি ভারতীয় গণিত, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন তিনি এই গ্রন্থ রচনায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর না করে গ্রন্থ লব্ধ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে ভারত বিষয়ক গ্রন্থ খানি রচনা করেন।

 প্রাচীন ভারতের ন্যায় আদি মধ্যযুগের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও শিলালেখ বা লেখমালাগুলি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয় সরকারি ও বেসরকারি লেখগুলি থেকে সংশ্লিষ্ট সময়ের রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে আমরা জানতে পারি সরকারি লেখ বলতে সাধারণত রাজকীয়প্রশস্তি মূলক লেখ এবং তাম্রশাসন বা ভূমিদান পত্রগুলিকে বোঝায় এই প্রশস্তিগুলিতে রাজার সামরিক কর্মকাণ্ড তথা রাজ্যজয়, সংস্কারমূলক কোন কাজ মানবহিতৈষনা প্রভৃতির উল্লেখ থাকে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সভাকবি রবিকীর্তির আইহোল প্রশস্তি, পাল শাসক নারায়নপালের ভাগলপুর তাম্রশাসন, প্রথম মহীপালের বাণগড় প্রশস্তি, সেন শাসক বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তি, প্রতিহার রাজ মিহিরভোজের গোয়ালিয়র প্রশস্তি এবং চোল রাজ প্রথম রাজেন্দ্র চোলের বিখ্যাত তিরুবলাঙ্গাডু প্রশস্ত রাজবংশের গৌরব ও কর্মকাণ্ডের বিষয় লিপিবদ্ধ হয়েছে

সরকারি লেখগুলির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল তাম্রশাসন আদি মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস বিশেষ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাম্রশাসনগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য তাম্রশাসনগুলি হল ভূমি দানের দলিল এই সময়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শাসনরত রাজাদের বহুসংখ্যক তাম্রশাসন পাওয়া যায় এগুলি হল দেবপালের মুঙ্গের তাম্রশাসন, প্রথম শূর পালের মির্জাপুর তাম্রশাসন, তৃতীয় বিগ্রহ পালের আমগাছী তাম্রশাসন, হর্ষবর্ধনের মধুবন‘বাঁশখেরা তাম্রশাসন, পল্লব শাসক নন্দীবর্মনের কাসাকুড়ি বা ‘কোডুকল্লি তাম্রশাসন প্রভৃতি

 বেসরকারি লেখগুলি ও আদি মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস রচনার একটি অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয় পাল, সেন, প্রতিহার, রাষ্ট্রকূট ও পল্লবদের লেখ সংখ্যা ও কম নয় যেখানেই যাঁর রাজত্বকালে এটি উৎকীর্ণ হয়েছে তাঁর নাম বংশ পরিচয় কখনো কখনো পিতৃপুরুষের নামের উল্লেখ পাওয়া যায় প্রধানত ধর্মীয় উদ্দেশ্যে প্রচারিত লেখগুলিকে বেসরকারি লেখ মর্যাদা দেওয়া হয়। লেখাগুলি অনেকাংশে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দেওয়ালে বা দেবদেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ থাকত। বলাবাহুল্য ইতিহাস রচনায় এগুলি হল আকর উপাদান

 ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মুদ্রার এক বড় ভূমিকা রয়েছে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনায় মুদ্রা বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে তবে বাণিজ্য কেন্দ্রিক অর্থনীতি বোঝার জন্য মুদ্রা অপরিহার্য গুপ্ত সাম্রাটদের পতনের পর ভারতীয় রাজাদের খুব কমসংখ্যক মুদ্রা পাওয়া গেছে পাল, প্রতিহার, রাষ্ট্রকূট রাজাদের প্রবর্তিত মুদ্রার নজির খুব কম, তাই ঐতিহাসিকরা ধরে নিয়েছেন যে আদি মধ্যযুগের মুদ্রার ব্যবহার কমেছিল মুদ্রা থেকে অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও আরো অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায় আবার পল্লব রাজাদের মুদ্রা হয় একদিকে বৃষ অপরদিকে বৃক্ষ, অর্ণবপোত, তারকা প্রভৃতি লক্ষ্য করা যায় শেষের দিকের পল্লব রাজাদের মুদ্রায় লাঞ্চ সিংহমূর্তি এবং সংস্কৃত অথবা কানাড়া ভাষায় লিপি খোদিত আছে চোল মুদ্রার অনুকরনে সিংহলের রাজারা বেশকিছু মুদ্রার প্রবর্তন করেছিল এর একদিকে দণ্ডায়মান রাজারমূর্তি এবং অপরদিকে লক্ষ্মীমূর্তি অঙ্কিত আছে

 আদি মধ্যযুগের সাহিত্যিক উপাদান বিশেষ করে দেশীয় সাহিত্যের সংখ্যা পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় অনেক বেশি, তবে সেগুলি ঐতিহাসিক মূল্য সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয় হর্ষচরিত, বিক্রমাঙ্কদেবচরিত, রামচরিত প্রভৃতি গ্রন্থগুলি সংশ্লিষ্ট রাজাদের প্রতি পক্ষপাত দোষে দুষ্ট তা সত্তেও ইতিহাস রচনার কাজে এগুলি ব্যবহার করা হয় উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে কৈবর্ত বিদ্রোহ সম্পর্কে অবহিত হতে গেলে রামচরিতের সাহায্য ছাড়া তা সম্ভব নয়আদি মধ্যযুগের ইতিহাস রচনায় শিলা লেখগুলি অমূল্য সম্পদ তা বলার অপেক্ষা রাখে না ভারতের সামন্ততান্ত্রিক ভাবধারা বোঝার জন্য ভূমি দানপত্র গুলিকেই ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বুঝতে ও লেখমালা অপরিহার্য। মুদ্রার অপ্রতুলতা ও প্রাচুর্যের ওপর ভিত্তি করে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব অনস্তিত্বের বিষয়টি অনেকখানি নির্ধারিত হয়ে থাকেসীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আদি মধ্যযুগের আকর উপাদানগুলি ইতিহাস রচনায় কাজে যথেষ্ট সাহায্য করে

--------০---------

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পল্লব যুগের শিল্প ও স্থাপত্য

  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়কাল বিন্ধ্যর দক্ষিনে উপদ্বীপীয় ভারতের তিনটি শক্তির সহাবস্থান লক্ষ করা যায় - দাক্ষিণাত্যে বাদামীর চালুক্য বংশ , সুদূর দক্ষিনে কাঞ্চিপুরমের পল্লববংশ এবং আরো দক্ষিনে মাদুরাইয়ের পান্ড্যবংশ। দক্ষিণ ভারতের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এই তিনটি শক্তি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল । তথাপি এই তিনশ বছরের কালপর্বে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল আলবার , নয় নারদের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটেছিল এবং এই ধর্মীয় পুনর্জাগরনের আবর্তে স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্পী ও গান-বাজনার জগত দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিল । এই সাংস্কৃতিক আলোড়নে পল্লবদের ভূমিকা ছিল অসীম । পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীর এক অসামান্য দৃষ্টান্ত । পল্লব রাজত্বকালেই দক্ষিণ ভারতের প্রথাগত পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শিল্প পরিত্যক্ত হয় এবং নতুনভাবে তৈরি কাঠামো যুক্ত মন্দির নির্মাণ শুরু হয় । পল্লব রাজ মহেন্দ্রবর্মনেরর রাজত্বকালে পাহাড় বা পাথর কেটে বেশ কয়েকটি...

দিল্লি সুলতানি কি ধর্মাশ্রয়ী ছিল ?

  দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ইসলাম ধ র্মাশ্রয়ী ছিল কিনা , এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । জিয়াউদ্দিন বার নী র মতো সমসাময়িক ঐতিহাসিক সুলতানি রাষ্ট্রকে ' জাহানদারী ' বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত রাষ্ট্রবি দ্‌ দের চিন্তা ও রাষ্ট্রের পার্থিব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ।   কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত । একটি ইসলামীয় রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় । প্রথমত , রাষ্ট্র কোরানে র ভিত্তিতে রচিত আইন বিধি শ রি য়ত মেনে চলতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত , সব ইসলামীয় রাষ্ট্র ধর্মগুরু খলিফার সার্বভৌম শাসনের অধীন । ফলে সুলতা নগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না , তাঁরা খলিফার আজ্ঞাবহ । তৃতীয়ত , ইসলামী য় রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হল ' মিল্লাত ' অর্থাৎ মুসলমান জনসাধারণের সৌভ্রাতৃত্ববোধ । ইসলামীয় রাষ্ট্রচিন্তায় এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মৌলিক ও অভিন্ন বলে মনে করা হত ।   ধ র্মা শ্র য়ী রাষ্ট্রের স্বপক্ষে বক্তব্য : ঈশ্বরীপ্রসাদ , রমেশ চন্দ্র মজুমদার , আশীর্বাদিলাল শ্রীবাস্তব , শ্রী রাম শর্মার মতো ঐতিহাসিক দিল্লির সুলতানকে ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হ...

মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

       ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাই মুঘলদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বলে মনে করেন শিরিন মুসবি । শিল্প বাণিজ্য থেকে আয়ের পরিমাণ সামান্য । ভূমি রাজস্ব হল ‘ মাল ’ বা ‘ খারাজ ’ । মুঘলরাষ্ট্র সামন্তরাজাদের কাছ থেকে কর পেত । তাছাড়া রাষ্ট্র পেত যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ ( খামস ); স্থানীয় আবওয়াব জিহত , শয়ের - ই - জিহত , ফুরুয়াত , অমুসলমানদের উপর স্থাপিত কর জিজিয়া এবং মুসলমানদের দেয় কর জাকাত ।         আকবরের আমলে সরকারের মোট রাজস্ব পরিমাণ ছিল ১২ , ৮২ , ৮৩ , ৮২৫ টাকা , সুজন রায়ের মতে , ঔরঙ্গজেবের আমলে ৩২ , ৬৮ , ১৬ , ৫৮৪ টাকা , এই রাজস্বের ৬ % ভাগ বাণিজ্য শুল্ক থেকে এবং ৪ % ঔরঙ্গজেব জিজিয়া থেকে পেতেন । বাকি সব রাজস্ব কৃষি খাতে আদায় হত ।       বাবর ভারতবর্ষ জয় করে অধিকৃত অঞ্চলের সমস্ত জমি ইক্তা হিসেবে অভিজাতদের মধ্যে বন্টন করে দেন । দেশের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য ও সংগৃহীত হত । হুমায়ুন এ ব্যাপারে কোন পরিবর্তন ঘটাননি । মুঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা গঠন করেন আকবর । আকবরের আগ...