অর্থনৈতিক,
আর্থসামাজিক বা শাসনতান্ত্রিক যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন ঐতিহাসিকরা একটা
বিষয়ে একমত যে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই ছিল কৃষিভিত্তিক চরিত্র। কৃষি জমির উপর সামন্তপ্রভুদের
একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং জমির সঙ্গে যুক্ত ভূমি দাসদের উপর সামন্তপ্রভুর বাধ্যবাধকতা প্রতিষ্ঠিত ছিল। মার্কসীয় ইতিহাস দর্শনে
সামন্ততন্ত্রের পতনের মধ্যেই ধনতন্ত্রের বীজ নিহিত ছিল। কাল মার্কস নিজে সামন্ততন্ত্রের অবসান প্রসঙ্গে বিশদ আলোচনা না করার ফলে সামন্ততন্ত্রের অবসানের সঙ্গে ধনতন্ত্রের
উন্মেষের যোগসুত্র নির্ণয়ের কাজ বর্তায় পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। সামন্ততন্ত্রের অবসান এবং ধনতন্ত্রের উত্থান এই যুগসন্ধিক্ষণের
ঘটনা নিয়ে বিংশ শতকের গোড়ায় বিতরকের সূচনা হয় যা ‘transitional
debate’ নামে পরিচিত।
সামন্ততন্ত্রের
অবসানে ধণতন্ত্রের
উত্থানের এই যুগসন্ধিক্ষণের বিতর্কে প্রথম বিশদভাবে আলোকপাত করেন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক
মরিস ডব। তাঁর ‘studies in the development of
capitalism’ (1946) গ্রন্থে ধনতান্ত্রিক
ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি সামন্ততন্ত্রের অর্থনীতি ও তার পতন
প্রসঙ্গে দুটি অভিমত ব্যক্ত করেন।
প্রথমতঃ সামন্ততান্ত্রিক বা অর্থব্যবস্থার ভারকেন্দ্র ছিল ভূমিদাস প্রথা এবং
ভূমিদাস প্রথার অবসানই
সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির পতনের সূচক। দ্বিতীয়তঃ
সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির পতন হয়েছিল সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় নিহিত অন্তবিরোধের
ফলে। তাঁর
আলোচনা নিহিত ছিল সামন্ততন্ত্রের পতন মূলত সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের বা production
relation এর মধ্যে। ইউরোপীয় অর্থনীতি প্রায় কৃষি সর্বস্ব হয়ে পড়লে সামন্ত শক্তি
কৃষিক্ষেত্রে এবং কৃষি সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। যার কারণে কৃষিকার্যে নিযুক্ত মানুষ পরিস্থিতির চাপে সামন্তপ্রভুর বশ্যতা স্বীকার করে ভূমিদাসত্ব গ্রহণ করেছিল। সামন্তপ্রভুর নিয়ন্ত্রণাধীন ম্যানরে বসবাসকারী ভূমিদাসরা জমির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয় এবং ভূমিদাসদের উপর
সামন্তপ্রভুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইউরোপে ভূমিদাস প্রথাকে অবলম্বন
করেই গড়ে উঠেছিল সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি ম্যানরে যা উৎপন্ন
হত তা ম্যানরের মধ্যেই সম্পূর্ণ ব্যবহৃত হত। ম্যানরের বাইরে বা বাজারে কেনাবেচার জন্য
উৎপাদন হত না। ম্যানরের মধ্যে
সীমাবদ্ধ থাকার ফলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের তাগিদ ছিলনা। যার
ফলে ম্যানরের জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটলেও উৎপাদনক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেড়ে ওঠেনি।
ম্যানরের দুষ্প্রাপ্য পণ্য যেমন নুন, মশলার যোগান আসত সামন্তপ্রভুর
নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরে নগরের বণিকদের থেকে। এই ব্যবসায়ীরা ম্যানরের প্রয়োজনীয়
পণ্যের পরিবর্তে তারা ম্যানর থেকে শস্য এবং খাদ্য বা পণ্যদ্রব্য নিয়ে নগরবাসীদের চাহিদা মেটাত। একাদশ শতকের শেষ লগ্নে বণিকরা
সুদূর এশিয়া থেকে আমদানি করা মশলা, রেশম, মসলিন, ধূপ ইউরোপের সর্বত্র পৌঁছে
দেয় তেমনি ইউরোপের পশম, পশুচামড়া, ফরাসি মদ অন্যপ্রান্তের
বাজারে পৌঁছতে থাকে।
মরিস ডব একথা মনে করেন না যে, নিছক বাণিজ্যিক দিগন্তের উন্মুখতার দরুন অর্থনীতি তার
নির্গমনের পথ পেয়ে যাওয়ার ফলে সামন্ততন্ত্রের কাঠামো ভেঙে পড়েছিল। তাঁর মতে
দূর বাণিজ্য নিছকই অনুঘটকের কাজ করেছিল মাত্র, তা
চালিকা শক্তি ছিলনা। ম্যানরের
বাইরে থেকে বণিকরা নতুন নতুন দ্রব্য আমদানির ফলে সামন্তপ্রভুদের চাহিদা বৃদ্ধি
পায় এবং সেই চাহিদা মেটাতে সামন্তপ্রভুরা প্রজাদের ওপর
বাড়তি কর চাপাতে থাকে। পশ্চিম
ইউরোপে প্রজারা বাড়তি করের চাপ সইতে না পেরে অনেক সময় ভূমিদাস ম্যানর ছেড়ে
পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সামন্ততান্ত্রিক আইন অনুসারে ভূমিদাস যদি ম্যানর ছেড়ে এক বছর গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে
তবে সে ভূমিদাসত্ব থেকে মুক্তি পায়। ইউরোপের
নগরগুলিতে নগর প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া সামন্তপ্রভুর
অনুচরেরা প্রবেশ করতে পারত না। ফলে
ভূমিদাসরা অনায়াসে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারত। ফলে ম্যানরে ভূমিদাসের সংখ্যা কমতে থাকে। সামন্তপ্রভুরা তাদের বর্ধিত চাহিদা
মেটাতে খাজনা আদায়ে শস্যের বদলে নগদে চাইতে থাকে। একে বলা হয় 'খাজনার
নগদীকরণ'।
মরিস ডবের মতে খাজনার নগদীকরণ ভূমিদাস
প্রথার অবসানের নির্দেশক। খাজনার নগদীকরণের ফলে পূর্বের মত সামন্তপ্রভুর উৎপাদনের উপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে ভূমি দাসত্ব থেকে মুক্তি
পেয়ে প্রজারা তখন ম্যানরের বাইরে বাজারের
জন্য উৎপাদন করে নচেৎ ম্যানর ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। মরিস ডব বাণিজ্য বিপ্লবকে উপেক্ষা করেও
সামন্ততন্ত্রের কাঠামোগত সমস্যাকেই সামন্ততন্ত্রের পতনে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে
সামন্তপ্রভুদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে মেটানো সম্ভব
ছিল না। চাহিদা
ও উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে এই বিরোধকে মরিস ডব সামন্ততন্ত্রের অন্তবিরোধ বলেছেন। ডাবের
মত পশ্চিম ইউরোপে নগদের সংখ্যা বেশি থাকায় এই অন্তবিরোধের ফলে ভূমিদাসদের সামনে ম্যানর জীবনের একটি
বিকল্প উপস্থিত ছিল যার ফলে পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটায়, পূর্ব ইউরোপে নগদের সংখ্যা অপেক্ষাকৃতভাবে কম হওয়ায়
প্রজাদের বিকল্প কোন ছিল না। ফলে
ষোড়শ শতকে পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের অবসান হলেও পূর্ব ইউরোপে আরো দৃঢ়ভাবে
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রখ্যাত
অর্থনীতিবীদ পল সুইজী মরিস ডব এর উৎপাদনের উপর শাসকশ্রেণীর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক
চাপের ব্যাখ্যাটি স্বীকার করতে রাজি হননি। ১৯৫০ সালে ‘science and
society’ নামক পত্রিকায় সুইজী ‘feudalism a
critique’ প্রবন্ধে ডবের বক্তব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে একাদশ শতকে
শুরু হওয়া বাণিজ্য বিপ্লবের সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির যোগসাজশ ব্যাখ্যায় বাণিজ্যিকীকরণ তত্ত্ব উত্থাপন করেন। তিনি বলেন যে, একাদশ শতকের শেষ লগ্নে ভূমধ্যসাগরীয় এবং উত্তর সাগরীয়
বাণিজ্য বাড়তে থাকার ফলে পশ্চিম ইউরোপের নগরজীবন উন্মুখ হয়ে উঠতে শুরু করে। ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের
পূর্বভাগে থাকা ইতালির বণিকেরা পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপে প্রবেশ করতে থাকেন। এশিয়া এবং আফ্রিকার পণ্যসম্ভার নিয়ে
ফ্রান্স, ফ্লান্ডার্স, রাইমল্যান্ড প্রমূখ অঞ্চলের বণিকদের সঙ্গে এই ইতালির বণিকদের
বাৎসরিক মিলনক্ষেত্র ছিল শম্পান এর মেলা।
পল সুইজীর মতে দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকের নগরায়নের প্রক্রিয়া
ছিল সামন্ততন্ত্রের অবসানের অন্যতম কারণ। পশ্চিম ইউরোপের নগরায়ন
প্রক্রিয়া যত সচল হয় নাগরিকদের চাহিদা ও ক্রয় ক্ষমতা আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে
কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে, যার যোগান আসত
সামন্ততান্ত্রিক ম্যানরগুলি থেকে। এর ফলে সামন্তপ্রভুরা নতুন নতুন পণ্যের চাহিদা মেটাতে তাদের প্রাপ্য খাজনা
বাড়ালে প্রজাদের উপর চাপ বাড়ে এবং নগদীকরণের সূচনা
হয়। যে সমস্ত প্রজা সামন্তপ্রভুর বর্ধিত খাজনার চাহিদা পূরণ করতে অপারগ হয় তারা ম্যানর
থেকে পালিয়ে গিয়ে নগরাঞ্চলের বিকল্প জীবনে আশ্রয় নেয়। সুইজীর মতে
পূর্ব ইউরোপ, ভূমধ্যসাগরীয়, উত্তর সাগরীয় তথা আন্তঃইউরোপীয়
বাণিজ্য প্রান্তিক অবস্থায় ছিল। বাণিজ্যকে
কেন্দ্র করে পশ্চিম ইউরোপের সমাজ এবং অর্থনীতিতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে
গিয়েছিল তা পূর্ব ইউরোপে উপস্থিত ছিল না। ফলে পূর্ব ইউরোপে নগরায়ন ঘটেনি। তাঁর মতে
সামন্ততন্ত্রের পতনে অর্থনীতির
বাণিজ্যিকীকরণ ছিল একমাত্র অপরিহার্য পূর্ব শর্ত।
মাইকেল পস্টান উপরিউল্লিখিত দুইজনের
মতবাদকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি তাঁর জনসংখ্যা বিষয়ক
তত্ত্বের অবতারণা করে দেখান যে সামন্ততন্ত্রের সমস্যা তার কাঠামোতে নিহিত ছিল না, তা ছিল সামন্ত সমাজের আয়তন এবং শক্তি বিন্যাসের ওপর
নির্ভরশীল। তাঁর মতে দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইউরোপের জনসংখ্যা
ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়, জনসংখ্যা
বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের চাহিদা আনুপাতিক হারে বাড়ে, কিন্তু কৃষি উৎপাদনশীলতা অপরিবর্তিত থাকে। কৃষি জমির উপর চাপ বৃদ্ধি পেতে
শুরু করলে সামনন্তপ্রভু তাদের খাজনার
পরিমাণ বৃদ্ধি করতে শুরু করে। সামন্তপ্রভু
উপরি খাজনা আদায়ের জন্য তুচ্ছ কারণে জরিমানা কর, বাড়তি
শ্রম প্রভৃতির ওপর জোর দেয়। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকে কৃষিজীবীর সংখ্যা কমতে
থাকায় শ্রমের চাহিদা শ্রমের যোগানের
তুলনায় বেশী হতে থাকে। খাজনার
নগদীকরণ হওয়ার ফলে ভূমিদাসপ্রথা এবং সামন্ততন্ত্র ভেঙে পড়ে।
যুগসন্ধিক্ষণের
বিতর্কে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক রবার্ট ব্রেনার। তিনি ১৯৭০ এর দশকে ‘past
and present’ পত্রিকায় ‘agrarian class structure and economic
development in pre-industrial Europe’ প্রবন্ধে বাণিজ্যিকীকরণ তত্ত্ব এবং জনসংখ্যার তত্ত্বের মধ্যে
সামন্ততন্ত্রের অবসানের বক্তব্য
সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে
দেন। তাঁর মতে
সামন্ততান্ত্রিক যুগে পশ্চিম এবং পূর্ব ইউরোপের রাজনৈতিক শক্তির বিন্যাস একই রকম
ছিল না। পশ্চিম
ইউরোপে রোমান ক্যারোলিঞ্জীয় রাজনৈতিক ঐতিহ্যের সুবাদে রাষ্ট্রশক্তির একটি আইনগত
উপস্থিতি ছিল। রাষ্ট্রশক্তির প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায় ছিল রাজকীয় আইন
প্রণয়নের মাধ্যমে সামন্তপ্রভুর ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে রাখা। অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপে ভূমধ্যসাগরীয়
অঞ্চলে রোমান সাম্রাজ্য বাদ দিয়ে রাষ্ট্রশক্তি বলে বিশেষ কিছু ছিল না। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির দরুন
জার্মানরা যখন পূর্ব দিকে তাদের বসতি স্থাপন করতে সচেষ্ট হন তখন পোল, ওয়েল্ড প্রভৃতি উপজাতির সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয় তাতে জার্মানরা
জয়লাভ করে। জার্মানদের এই এলাকা সম্প্রসারণের দায়িত্ব ছিল টিউডর নাইটদের হাতে। তাই ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতকে পশ্চিম
ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের অবসান হলেও রাজনৈতিক শক্তি বিন্যাসের পার্থক্যের জন্যই
পূর্ব ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের ভিত্তি আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে বলে ব্রেনার মনে করেন।
সামন্ততন্ত্রের অবসান প্রসঙ্গে
যুগসন্ধিক্ষণের বিতর্কে ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গিকে যে আঙ্গিক থেকেই আলোকপাত করা
হোক না কেন আর্থসামাজিক, অর্থনৈতিক
জনসংখ্যা তত্ত্ব বা রাজনৈতিক মোটের ওপর সকলেই একমত যে সামন্ততন্ত্রের পতন
ত্বরান্বিত হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে। চতুর্দশ
শতকের ইউরোপের অর্থনীতি এক সংকটের সম্মুখীন হয় যা সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো অবশিষ্ট
বৈশিষ্ট্যকে দূর করে ধনতন্ত্রের আগমনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন