চোলরা
ছিল প্রাচীনজাতী, মহাভারতের চোলদের উল্লেখ আমরা
দেখতে পাই। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে অশোকের শিলালিপি,
গ্রিক ও রোমান ঐতিহাসিকদের রচনায় চোলদের নামের উল্লেখ রয়েছে। চোলরা আদিতে শক্তিশালী হলেও
চালুক্য পল্লব ও রাষ্ট্রকূটদের আগ্রাসনের ফলে
তারা দীর্ঘকাল হীনবল হয়ে পড়ে এবং নবম খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে চোলশক্তির পুনরায় অভ্যুত্থান ঘটে। প্রায় শতাব্দীকাল ধরে চোলরা
তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণ তীরে তাদের রাজ্য ও সভ্যতার প্রতিষ্ঠা করে। দাক্ষিণাত্যের
চালুক্য রাষ্ট্রকূট রাষ্ট্র বিন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে চোলদের রাষ্ট্রবিন্যানের মৌলিক পার্থক্য ছিল। চোলদের রাষ্ট্রবিনাশী শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা সামঞ্জস্যের রূপটিও পরিস্ফুট করেছিল। দক্ষিণ ভারতের লেখ ও অসংখ্য
শিলালিপি এই স্বয়ং শাসিত সংস্থাগুলির কার্যাবলীর উপর আলোকপাত করেছে। চোল
সাম্রাজ্যের সমগ্র প্রশাসনিক কাঠামোই
বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল।
কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থায় সঙ্গম যুগের
মতও চোল আমলে রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল। তবে
ভারতের আদিম রাজতন্ত্র ও চোলদের রাজতন্ত্রের প্রকৃতি একই রকম ছিল না। অসংখ্য প্রাসাদ কর্মচারী ও বিভিন্ন জাঁকজমকপূর্ণ
উৎসব অনুষ্ঠান সমৃদ্ধ এই রাজতন্ত্র
বাইজানটাইন রাজতন্ত্রের সঙ্গে তুলনীয়। চোল
শাসন ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য
হিসেবে রাজার জীবনদশায় যুবরাজ রাজকার্যে অংশগ্রহণ করত। বংশানুক্রমিক শাসন ব্যবস্থার ফলে রাজার জ্যেষ্ঠপুত্র পিতার সিংহাসনের
উত্তরাধিকারী মনোনীত হত। তবে
প্রয়োজনানুসারে রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্রের পরিবর্তে যোগ্যতম পুত্র ও সিংহাসন লাভ করতে
পারতো। ‘চোল মত্তন্ড’ ‘গঙ্গাইকোন্ড’ ইত্যাদি আড়ম্বরপূর্ণ উপাধি চোল রাজারা গ্রহণ করতেন। মৃত রাজার মূর্তি প্রতিষ্ঠা ও পূজা চোল রাজারা ঐশ্বরিক অধিকার বলে দাবি
করতেন। মৃতরাজার নামাঙ্কিত মন্দির নির্মাণ করা হত। উদাহরণ হিসেবে
বলা যায় যে প্রথম পরান্তক কর্তৃক
নির্মিত আদিত্যেশ্বর মন্দির, অনুরূপ মন্দির প্রথম রাজারাজ এবং প্রথম রাজেন্দ্র চোল
নির্মাণ করেছিলেন। চোল রাজারা নানাভাবে রাজস্ব আদায় করত এবং অর্জিত অর্থ বহুলাংশে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয় করা হত। সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও
চোল রাজারা স্বৈরাচারী ছিলেন না। মৌলিক
আদেশ দ্বারা রাজকার্য পরিচালনা করতেন। মন্ত্রী ও অমাত্যরা পরামর্শ দিলেও রাজগুরু ছিলেন রাজার
খুবই বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা। মন্ত্রিপরিষদ
ও সুগঠিত কর্মচারীদের অবস্থানের ফলে রাজ ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করেছিল। রাজ্য পরিদর্শনের নীতি চালু থাকার ফলে রাজ্যের বিভিন্ন
অংশে শাসন ব্যবস্থার শৈথিল্যের প্রকাশ ঘটেনি।
চোল শাসন ব্যবস্থায় একটি সুগঠিত
আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন শাসন পরিচালনা বিভাগ সৃষ্টি করেছিল। চোলদের কেন্দ্রীয় কর্মচারীগণ
স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেন, কিন্তু তাদের স্বাধীনতা ও উদ্যোগকে খর্ব করতেন না। রাষ্ট্রীয় কাজ ও
বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর কাজের মধ্যে ভারসাম্য তারা নিপুনভাবে রক্ষা করেছিলেন। কর্মচারীদের
পদমর্যাদানুসারে সামাজিক মর্যাদা ছিল এবং যোগ্যতা ছিল কর্মচারীদের
উন্নতির মাপকাঠি। কর্মচারীরা
তাদের প্রাপ্য নগদ অর্থে পেতেন না, ভূমির দ্বারা তাদের
প্রাপ্য দেওয়া হত। এই জমি
থেকে তাদের যা আয় হত তার এক অংশ তারা দ্রব্যের মাধ্যমে অন্যাংশ অর্থের মাধ্যমে নিতেন। জমির মালিকানা কর্মচারীদের দেওয়া হত না, রাজস্ব আদায়ের জন্য কয়েকটি শর্ত দেওয়া হত। চোল শাসন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন
বর্গের কর্মচারীর সাহায্য নেওয়া হত। এই সকল
পথ বংশানুক্রমিক সূত্রে ভোগ করা এবং বেতনের বদলে জমি দ্বারা পারিশ্রমিক দেওয়া হত।
চোল শাসন ব্যবস্থায় বলিষ্ঠ
কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও বহুল পরিমাণে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। রাজকীয় কর্মচারীদের মধ্যে উচ্চ নিচ ভেদ এবং তাদের
বিভিন্ন অভিধা ছিল। সামরিক
ও বেসামরিক বিভাগের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। উভয় বিভাগের মধ্যে উচ্চপদস্থ
কর্মচারীদের ‘অদিগারিগলত’
বলা হত। উচ্চপদস্থ
কর্মচারীদের সাধারণত ‘পেরুন্দরম’ এবং নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের ‘সিরুদণম’ বলা হত। প্রদেশগুলির
নাম ছিল ‘মন্ডলম্’, এই
মন্ডলমকে ‘কোট্টাম’ বা জেলায় ভাগ করা হয় এবং জেলাকে ‘নাড়ু’ বলা হয়। নাড়ুর
অধীন ছিল ‘কুররম’ এবং
কিছুসংখ্যক গ্রাম নিয়ে ‘কুররম’
গঠিত হত। বড়গ্রামকে বলা
হত ‘তনিয়ুর’, রাজার
বিশ্বাসভাজনলোকেরা এই পদ লাভ করত।
চোল আমলে ভূমিকরই ছিল রাষ্ট্রীয় রাজস্বের
প্রধান উৎস। এই কর
নগদ অর্থে অথবা দ্রব্যের বা ফসলের মাধ্যমে আদায় করা হত। জমির মালিকানা ছিল
ব্যক্তিবিশেষের অথবা গ্রাম সম্প্রদায়ের হাতে। গ্রাম থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য
ভূমি রাজস্বের জন্য গ্রাম সভাগুলি দায়ী থাকত। যুদ্ধ, মন্দিরের প্রয়োজনে এবং
বন্যা প্রতিরোধের জন্য, বাঁধের সংস্কার
কাজের জন্য, অতিরিক্ত কর ধার্য করা হত। সর্বদা
অতিরিক্ত কর ধার্য করার আগে করদাতাদের সম্মতি নেওয়া হত। ভূমির রাজস্বের হার ছিল
সম্ভবত ১/৩ ভাগ। তবে জমির উর্বরতানুসারে রাজস্বের পরিমাণ কমবেশি হত। প্রথম রাজা রাজের তাঞ্জোর লেখতে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে প্রতি
গ্রামে কিছু পরিমাণ জমি থাকত যার উপর কোন প্রকার কর ধার্য করা হত না। তবে সস্থানীয় নরপতিগণ তখন কেন্দ্রীয় সরকারকে অগ্রাহ্য করে নানা উপায়ে অর্থ
আদায় করতেন। বাকি কর
আদায়ের জন্য জমি ক্রোক অথবা বিক্রয় করা হত। মাঝে
মাঝে জমি জরিপ করে ভূমি রাজস্ব ধার্য করা হত। ভূমি রাজস্ব ছাড়া চোল রাজারা বাণিজ্য শুল্ক, লবণ শুল্ক প্রভৃতি আদায় করতেন।
চোল রাজারা গ্রামসভাগুলির উপর বিচার
সম্পর্কিত ব্যাপক ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন।
ধর্মীয় শপথ দ্বারা বিচার অথবা সাক্ষী ও আইনের দ্বারা উভয় প্রকারের বিচার হত। ধর্মাসনগুলিতে যেসব
মামলা বিচারের জন্য আনা হত সেগুলি নিষ্পত্তির জন্য আইনজ্ঞ ব্রাহ্মণের সাহায্য
নেওয়া হত। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচার একই আদালতে হত। সাধারণ ভাবে অপরাধীদের বিচার গ্রামসভাগুলিতে হত এবং সেই
বিচারে সন্তুষ্ট না হলে মামলা ‘নাড়ু’র ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী কাছে আনা যেত। রাজদ্রোহের বিচার রাজা নিজেই
করতেন এবং শাস্তি
হিসেবে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা অথবা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত।
চুরি ব্যভিচার জালিয়াতি ইত্যাদি অপরাধকে গুরুতর মনে করা হত। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে গরু চুরি
ছিল একটি সাধারন অপরাধ এবং তার নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ ছিল না। জঘন্য অপরাধের জন্য অপরাধীদের শিরশ্ছেদ করা হত অথবা তাদের
হাতির পায়ের তলায় ফেলে মারা হত। কোন কোন
ক্ষেত্রে নরহত্যার জন্য অপরাধীকে শাস্তি হিসেবে নিকটতম মন্দিরে স্থায়ীভাবে একটি
প্রদীপ জ্বালানোর দায়িত্ব দেওয়া হত। এই দেখে অনেকে চোলদের শাস্তিদান ব্যবস্থাকে
অতিশয় লঘু বলে বর্ণনা করেছেন।
চোল শাসনে দুই ধরনের সেনাদল ছিল স্থল ও
নৌ বাহিনী। স্থল সেনারা ধানুকী জঙ্গলের লড়াইয়ে দক্ষ সেনা। অশ্বারোহী, হস্তী
বাহিনী প্রভৃতি ভাগে বিভক্ত ছিল। সেনাবাহিনী
বিভিন্ন দুর্গে এবং সামরিক ছাউনিতে ছড়িয়ে থাকত। চোল রাজারা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর
প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করতেন। শত্রুর
দেশে সাধারণ নাগরিকের ঘর-বাড়ি লুটপাট, নারী
হরণ, ধনসম্পত্তি লন্ঠন ছিল চোলদের যুদ্ধনীতি । সেনাবাহিনীর বেসামরিক কাজের মধ্যে মন্দির
সুরক্ষা এবং রাজস্ব বিভাগের সঙ্গে সহযোগিতার কথা বিভিন্ন লেখতে পাওয়া যায়। শত্রু
শিবির থেকে যে সমস্ত ধন সম্পদ লুণ্ঠিত হত তা রাজার হাতে আসতএবং তিনি তা ইচ্ছামত দান
করতেন।
চোল শাসন বিন্যাসের ভিত্তি ছিল গ্রাম, সেদিক
থেকে চোলদের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে গুপ্তদের শাসনব্যবস্থার বিশেষ পার্থক্য ছিল না। চোলগণ গ্রাম পর্যায়ে যে
স্বাধীনতা ভোগ করত তদানীন্তনকালে তাকে অভূতপূর্ব বলা যায়। চোলদের সরকারি কর্মচারীগণ গ্রামীণ
ব্যাপারে দর্শক এবং উপদেষ্টা হিসাবে অংশগ্রহণ করতেন, শাসক হিসাবে নয়। চোল গ্রামীণ শাসন এতই স্বাধীন ছিল যে
রাজধানীতে রাজার পরিবর্তন হলেও গ্রাম শাসন তার নিজ নিয়মে চলত। উপরতলার ওঠাপড়ার প্রভাব তাকে
স্পর্শ করত না। অষ্টম ও নবম শতাব্দীর পান্ড্য ও পল্লবগণের মত চোল আমলে গ্রামীণ শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত
হয়েছিল। তবে সে
শাসনব্যবস্থা চোলদের মত এত পরিণত ছিলনা। সমিতির
মাধ্যমে গ্রাম শাসনই ছিল গ্রামীণ
সংগঠনের বৈশিষ্ট্য। সমিতি
ভিন্ন অনেকগুলি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং
ধর্মীয় গোষ্ঠী ছিল, প্রতি গোষ্ঠীর
একটি নির্দিষ্ট কাজ ছিল অথবা তাকে একটি প্রতিষ্ঠান দেখাশুনা করতে হত। গোষ্ঠীর যে
বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল সে বিষয়ে সমিতিরও দায়িত্ব থাকত। গ্রামের
সাধারণ সভায় প্রাপ্তবয়স্করা যোগ দিতে পারতেন।
সাধারণত গ্রাম সমিতি ছিল দুই ধরনের ‘উর’ ও ‘সভা’। তাছাড়া শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের জন্য
স্থানীয় সমিতি ছিল তাকে বলা হত ‘নগরম’। এইগুলি
ছিল সাধারণ বাসিন্দাদের প্রাথমিক সমিতি। এই
সমিতিগুলি যখন তাদের সংবিধান পরিবর্তন অথবা ভূমিস্বত্ব পুনর্নির্ধারণ বিষয়ে
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত তখন কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীগণ তাদের অধিবেশনে উপস্থিত
থাকত।
‘উর’ কিভাবে
গঠিত হত সঠিক জানা যায়না, তবে
গ্রামের প্রাপ্তবয়স্ক করদাতাদের দ্বারা গঠিত হলেও ‘উরে’র আলোচনায় বয়স্করাই প্রাধান্য ভোগ করত।
প্রতি ‘উরে’
একটি শাসন পরিচালনা বিভাগ ছিল। গ্রামের প্রতি ‘কুড়ুম্বু’ বা ‘পাড়া’ থেকে প্রতিনিধি
দ্বারা ‘উর’ গঠিত
হত। কখনও বা একই গ্রামে দুইটি ‘উর’ থাকত।
১২২৭ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে সত্তম মঙ্গলম গ্রামে দুটি ‘উর’ ছিল, একটি
হিন্দু অংশের বাসিন্দাদের এবং অন্যটি জৈন অংশের বাসিন্দাদের।
চোলদের লেখতে সভা সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া
যায়। সর্বত্র
একই সভা ব্রাহ্মণ গ্রাম অথবা চতুর্বেদী মঙ্গলমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। রাজারা তাদের দানের দ্বারা অনেক মঙ্গলম সৃষ্টি করেছিলেন। ব্রাহ্মণকে ভূমিদান তখন পূর্ণ কর্ম বলে
বিবেচিত হত। সভা অথবা মহাসভা স্থানীয় শাসনযন্ত্র তুলনায় অনেক বেশি জটিল ছিল। সাধারণভাবে এই
মহাসভায় বিভিন্ন কার্যনির্বাহী সমিতির মাধ্যমে কাজ চালাত। বিভিন্ন পরীক্ষা
নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এই সমিতিগুলি গঠিত হয়েছিল। বিভিন্ন মহাসভায় সমিতির সংখ্যা এবং
তাদের সদস্যদের নিয়োগ পদ্ধতি ও ছিল ভিন্ন। মহাসভা সম্পর্কিত বেশিরভাগ লেখগুলির
মধ্যে প্রথম পরান্তকের রাজত্বকালের যথাক্রমে ৯১৯ ও ৯২১ খ্রিস্টাব্দের দুটি লেখ
বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
৯২১ খ্রিস্টাব্দে লেখ অনুসারে উত্তর
মেরুর গ্রামের ত্রিশটি কুড়ুম্বু অথবা পাড়া থেকে কার্যনির্বাহী সমিতিগুলির জন্য
প্রথমে যোগ্য ব্যক্তিদের মনোনীত করা হত। এই
যোগ্যতার মাপকাঠি বেশ উঁচু ছিল। যোগ্য
হতে গেলে প্রায় দেড় একর জমির পরিমাণ কর দেয় জমি, স্বস্থানে স্বনির্মিত বাসগৃহ, ৩৫ থেকে
৭০ এর মধ্যে বয়স এবং মন্ত্র ও ব্রাহ্মণগুলি সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে, নৈতিক চরিত্র নির্মল না হলে, সমিতির টাকা করি আগে তছরুপ না করলে, পরদ্রব্য অপহরণের অপবাদ
না থাকলে তবে প্রার্থী হিসেবে যোগ্য মনে করা হত। প্রতি পাড়া থেকে মনোনীত
ব্যক্তিদের একজনকে ভাগ্য পরীক্ষা দ্বারা বেছে নেওয়া হত। তারপর এই সদস্যের দ্বারা
উদ্যান সমিতি, পুষ্করিণী সমিতি, স্বর্ণ সমিতি প্রভৃতি গঠন
করা হত।
আধার শহর ও আধা গ্রাম নিয়ে ‘নগরম’ গঠিত হত। এটি ‘উর’, ‘সভা’ অথবা ‘মহাসভার’ মত আরেকটি
স্থায়ী প্রতিষ্ঠান ছিল। ‘নগরম’ ছিল ব্যবসায়ীদের একটি প্রাথমিক সমিতি।
গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যে ‘নগরম’ অন্যতম প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে উঠেছিল। যেখানে বাণিজ্য স্বার্থ প্রাধান্য
অর্জন করেছিল সেখানে নগরমই ছিল একমাত্র স্থানীয় প্রতিষ্ঠান। অনেকে নগরমকে
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের গিল্ড বলে বর্ণনা করেছেন। এই গিল্ডগুলি উৎপাদন স্থান থেকে দ্রব্য
ক্রয় করে পরে তা অন্যত্র বন্টন করত। রাজা
এবং উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারীগণ এই বাণিজ্যের অর্থলগ্নি করতেন।
নাড়ুগুলিতে
একটি করে সভা ছিল এবং এই সভাগুলি ভূমি রাজস্ব প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করত। এই ‘নাত্তার’ কিভাবে গঠিত হত
তার কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় না, তবে
এখানে যে গ্রাম দানের কথা বলা হত তাতে স্বাক্ষরকারীদের নামের তালিকা থেকে মনে করা
হয় যে নাড়ুর অন্তর্গত বিভিন্ন গ্রামের প্রতিনিধি নিয়ে ‘নাত্তার’ গঠিত হত। সেখানে অন্যান্যদের মধ্যে হিসাবরক্ষকগনও উপস্থিত থাকবেন।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলতে পারি যে, চোল শাসন ব্যবস্থা একদিকে যেমন ছিল যোগ্য আমলাতন্ত্র
তেমনি অন্যদিকে ছিল সক্রিয় স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলি। এই দুইয়ের সাহায্যে চোল আমলের
শাসনব্যবস্থা যে উচ্চমান লাভ করেছিল তা হয়তো অন্য কোন হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে
সম্ভব হয়নি। ভি. সি. স্মিথ
চোল প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রশংসা করে
বলেছেন “Administrative system was well thought out and reasonable
efficient” গ্রামীণ জনপদের উপর গুরুত্ব আরোপের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার
জনসমর্থন সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতেন এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকেই জনপরিষদের আদেশ স্বয়ংক্রিয় ভাবে পালন করতেন। তারা জানতেন যে এই পরিষদগুলোর
প্রতি রয়েছে প্রবল জনসমর্থন। স্মিথ
এর মতে “আধুনিক সরকারগুলি আরও সুখী ও কার্যকরী হত
যদি তাদেরও এই প্রকার জনসংযোগের সমর্থন থাকত”।
--০--
খুব ভালো
উত্তরমুছুন