ষষ্ঠ শতকে হুনদের অপসারণের পর থেকে প্রায় দেড়শত বছর ভারতবর্ষ বৈদেশিক
আক্রমণের বিপদ থেকে মুক্ত ছিল। কিন্তু খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে ভারতের একটি অংশ
সিন্ধুদেশে আরবদের আক্রমণের ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্বের
চেহারার প্রকাশ ঘটে। যার ফলে
আরবরা সিন্ধু জয় করে। ভারতে
মুসলিম শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তবে
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ফল কি হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকরা দ্বিধাবিভক্ত। একশ্রেণীর পণ্ডিতদের মতে আরবদের সিন্ধু
বিজয়ের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব ভারতে পড়েনি। অপরদিকে যাঁরা আছেন
তাঁদের মতে আরবদের সিন্ধু বিজয় কিছু কিছু
ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। অতএব
দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করা খুবই প্রয়োজন। যথা - রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক তথা সাংস্কৃতিক দিক।
রাজনৈতিক দিক থেকে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের
ফলাফলকে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এই অভিযানের বিশেষ কোনো প্রভাব ভারতে ছিল না। ঐতিহাসিক লেনপুল বলেছেন যে, এই অভিযান ছিল ইসলামের একটি নিষ্ফল বিজয় কাহিনী মাত্র। স্যার উলসলে হেগেল অনুরূপ বক্তব্য
প্রকাশ করেন। বি এম হাবিবুল্লাহ বলেছেন যে, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের উপর আরবদের সিন্ধু বিজয়ের
সুগভীর কোন প্রভাব ছিল না। ঐতিহাসিকদের
এই বক্তব্যকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করাও যায় না। কারণ তিনশো বা ততোধিক বছর ধরে সিন্ধুতে
আরব শাসন প্রতিষ্ঠা ছিল, তবে তা ছিল ভারতবর্ষের একটি অংশে মাত্র। সুবিশাল
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির উপর এর
কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েনি। আরবদের
শাসনকালে অষ্টম ও নবম শতকে কনৌজকে
কেন্দ্র করে বাংলার পাল, উজ্জয়িনীর প্রতিহার এবং দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটদের
মধ্যে যে ত্রিশক্তি সংঘর্ষ সূচনা হয়েছিল তাতে আরবরা জড়িয়ে পড়েনি। তবে একথা স্বীকার্য যে পরাক্রান্ত
গুর্জর প্রতিহারদের প্রবল প্রতাপের
দরুন রাজস্থান, গুজরাট,
কাথিয়াবাড় প্রভৃতি এলাকায় আরব
শাসন সম্প্রসারিত হতে পারেনি। সমকালীন
চালুক্য শাসকরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর ছিল। সুতরাং রাজনৈতিক দিক থেকে আরবদের সিন্ধু
বিজয়ের ফলাফলকে নিষ্ফলা অযৌক্তিক হবে না।
রাজনৈতিক
দিক থেকে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ফলাফলকে নিষ্ফল বলা গেলেও সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য
দিক থেকে এর গুরুত্বকে অস্বীকার করা যুক্তিযুক্ত নয়। আরবদেশ ও ভারতবর্ষ উভয় দিক থেকে বিচার
করে এর গুরুত্বকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মন্তব্য করেছেন যে, আরবদের
সঙ্গে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের
ব্যাপারে আমাদের অজ্ঞতা রয়েছে। তা
সত্ত্বেও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জ্ঞাত হওয়া যায় যে বিশ্বের
সবথেকে ধনী উদ্যমী বণিক ও দক্ষ নাবিক হিসাবে আরবরা খ্যাতি অর্জন করেছিল। ভারতের পশ্চিম উপকূলের বাণিজ্যের
সঙ্গে তারা দীর্ঘদিন ধরেই যুক্ত ছিল এবং সিন্ধু বিজয়ের ফলে তা আরো দীর্ঘ হয়েছিল। সিন্ধু অঞ্চলের বাণিজ্যের উন্নতি
ঘটেছিল এবং জল সেচ ও কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছিল।
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের ফলে সবচেয়ে বেশি
প্রভাবিত হয়েছিল সাংস্কৃতিক জগৎ। অধ্যাপক
সতীশচন্দ্র যদিও এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন,
তাসত্ত্বেও সিন্ধুদেশে আরব প্রশাসনের
সূত্র ধরে সিন্ধুবাসীদের সঙ্গে আরব সভ্যতার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল এ
বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আব্বাসীয়
খলিফাদের আমলে ভারতীয় দর্শন ও সভ্যতা ইরাক ও ইরানের প্রসার লাভ করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে সিন্ধু দেশে শাসন
করার ফলে আরবরা স্বাভাবিকভাবে হিন্দু তথা ভারতীয়দের ধর্ম, দর্শন, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র,
জ্যোতিষবিদ্যা ও লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে যেমন জ্ঞান আহরণ করেন তেমনি নিজের দেশে তা
বহণ করে নিয়ে যান। আমির
খসরুর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, আরবীয়
জ্যোতিষবিদ আবু মাসহার বারাণসীতে এসেছিলেন এবং প্রায় দশ বছর যাবত সংস্কৃত ভাষা ও
হিন্দু জ্যোতিষবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করেন। আমার বাগদাদের রাজদরবারে ভারতীয় পণ্ডিতদের
সমাদর করা হয়েছিল। আব্বাসীয়দের
সক্রিয় সহযোগিতায় ব্রহ্মগুপ্তের ‘ব্রহ্মসিদ্ধান্ত’ ও ‘খন্ডখাদ্যক’ এবং আর্যভট্টের ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’
গ্রন্থটি আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। আরবিয় পন্ডিত
অল তবরির বিবরণ থেকে জানা যায় যে,
ভারতীয় চিকিৎসক মনাকা খলিফা হারুন অর রশিদকে দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত করেছিল। সিন্ধু শাসনের সূত্র ধরে আরব ও
ভারতের মধ্যে সীমিত অর্থে যে সাংস্কৃতিক সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা আরবদের সূত্র
ধরে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যান্য বিষয়ও আরবদেশে
প্রসারিত হয়েছিল। আল
মাসুদি ও এবং ইবন হকল এর বিবরণ
থেকে জানা যায় যে, সিন্ধুদেশে বসবাসকারী আরবরা হিন্দুদের
সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখেছিল। সিন্ধু ও মুলতানে
বসবাসকারী আরবরা দীর্ঘকাল বসবাসের ফলে ভারতীয় হয়ে গিয়েছিল। তারা ভারতীয় স্থপতির কাজের সঙ্গে
যুক্ত ছিল এবং ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীকে নিজেদের দেশের অট্টালিকা, মসজিদ ও বাড়ি ঘর নির্মাণের কাজে লাগিয়েছিল। বিশেষত ভারতীয় সঙ্গীত ও
শিল্পকলার তারা যেমন পৃষ্ঠপোষকতা করে ছিল তেমনি সেগুলিকে নিজেরাও গ্রহণ করেছিল।
সিন্ধু বিজয়ের ফলে আরবিয়রা যেমন ভারতীয় সাংস্কৃতিকে
গ্রহণ করেছিল তেমনি ভারতীয়রাও আরবিয়দের
দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। ইসলামের
‘একেশ্বরবাদী’ ধারণা ধীরে ধীরে ভারতে প্রসারিত হতে থাকে। সর্বোপরি ভারতের সমকালীন রাজনৈতিক
শক্তিগুলিকে বিশেষ করে প্রতিহারদের সচেতনতাকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল। যার কারণে আরবদের বিরুদ্ধে বারে বারে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিল
প্রতিহার রাজারা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন