শকাব্দ বা শক সম্বত হল একটি
প্রাচীন ভারতীয় সম্বত যা এখনও প্রচলিত আছে। স্বাধীন ভারত সরকার শকাব্দ কে ভারতীয়
সম্বত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষের
প্রাচীন সম্বতগুলির অধিকাংশ বিলুপ্ত হলেও শকাব্দ এত দিন টিকে আছে। তার কারণ হলো ভারতীয় জ্যোতিষ
বিজ্ঞানীরা প্রাচীন যুগে শকাব্দের ভিত্তিতেই বছর গণনার কাজ করতেন। শকাব্দ পশ্চিম ভারত, মালক প্রভৃতি
অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ছিল। এর নিকট
এই উজ্জয়নী ছিল প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতিষবিজ্ঞানচর্চা কেন্দ্র। মালক অঞ্চল থেকে
জৈন ধর্মাবলম্বী দিগম্বর সম্প্রদায় দক্ষিণ ভারতে চলে আসে এবং তাদের সঙ্গে শকাব্দ
ব্যবহারের প্রথা নিয়ে আসে। ফলে
দক্ষিণ ভারতে দীর্ঘকাল ধরে শকাব্দ প্রচলিত থাকে।
শকাব্দ
কখন কিভাবে উৎপত্তি হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। অনেকের মতে বোনোনেস নামক শক-পার্থিয় রাজা অব্দ প্রচলন করেন। তবে বোনোনেস
শক ছিলেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি
ছিলেন গণ্ড ফার্নেস আগের লোক। শকাব্দের সূচনা হয়েছিল ৭৮ খ্রিস্টাব্দে। বোনোনেস ছিলেন সম্ভবত প্রথম
খ্রিস্টপূর্বাব্দের। সুতরাং
বোনোনেস ৭৮ খ্রিস্টাব্দে শকাব্দ প্রবর্তন করতে পারেননি বলে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে
করেন। অন্যদিকে
কোন কোন ঐতিহাসিক অলবেরুনীর মত উদ্ধার করে বলেছেন যে বিক্রমাদিত্য এক শক রাজাকে
হত্যা করে শকাব্দ চালু করেন। কিন্তু অলবিরুনীর মতের স্বপক্ষে কোন
প্রত্নতাত্ত্বিক বা সাহিত্যিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। অলবিরুনী যেহেতু বহু পরে এদেশে এসেছিলেন তাই তিনি একটি কিংবদন্তি কে
উল্লেখ করেছেন মাত্র।
অধিকাংশ
পন্ডিত ফার্গুসনের মদকে শকাব্দের প্রকৃত ব্যাখ্যা বলে গ্রহণ করেছেন। ফার্গুসনের মতে কনিষ্ক ৭৮ খ্রিস্টাব্দ
হতে শকাব্দ প্রবর্তন করেন। তবে এই
মতের বিরুদ্ধে অনেকে নানা যুক্তি দেখান, তার মধ্যে
প্রধান যুক্তি গুলি হল- ১) কনিষ্ক
হলেন কুষাণ সম্রাট। তার
প্রচলিত সন কে কেন শকাব্দ বলে নামিত হবে? তিনি শক জাতীয়
ছিলেন না। ২) কনিষ্ক কুষাণ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না। সুতরাং তিনি কি কারনে নতুন সম্বত প্রচলন
করবেন? ৩) কনিষ্কের
সিংহাসনে আরোহনের তারিখ নিয়ে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। অনেকে তাকে বিম কদফিসেসের আগের শাসক বলে
মনে করেন। আবার
মার্শাল, স্টেনকোনো তাকে দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের লোক বলে মনে করেন। ৪) শকাব্দ
প্রধানত পশ্চিম ভারত ও দাক্ষিণাত্যে চালু ছিল। ফলে এ অঞ্চলে কনিষ্কের অধিকার ছিল কিনা
তা সন্দেহাতিত।
উপরোক্ত
আলোচনাগুলির উত্তরে বলা যায় যে- কনিষ্ক কুশান
ছিলেন, ভারতবাসীর কাছে শক ও কুষাণদের মধ্যে তেমন
কোন পার্থক্য ছিল না। কনিষ্কের
সময় এই অফ দুটি শকাব্দ নামে পরিচিত ছিল না। কনিষ্কের পরবর্তী সময়ে এই অফ দুটি
বিভিন্ন লেখে শকাব্দ নামে পরিচিত হয়। কারন
কুষাণ সাম্রাজ্যের পতন হলেও পশ্চিম ভারতের শক- ক্ষত্রপরা
দীর্ঘকাল এই অব্দ ব্যবহার করেন। শক- ক্ষত্রপরা
এটি ব্যবহার করার জন্য এটি শকাব্দ নামেই প্রচলিত হয়। রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা না হলেও অব্দ
প্রচলন করার প্রথা বহুবার দেখা গেছে। হর্ষবর্ধন
তার বংশের প্রতিষ্ঠা না করেও হর্ষাব্দ প্রবর্তন করেন। কনিষ্ক তাই করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। বেশিরভাগ পন্ডিত মনে করেন যে
কনিষ্ক ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। অন্য
তারিখগুলি এখন স্বীকার করা হয় না। কনিষ্কের
কামরা লিপি থেকে প্রমাণ হয় যে বিম কদফিসেস কনিষ্কের আগে রাজত্ব করেন। সুতরাং বিম কদফিসেস এই অব্দ
প্রচলন করেন বলে মনে করা যায় না। তবে
দুব্রেইলের একটি আপত্তি গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন যে মার্শাল ১৩৬ সম্বৎসর চিহ্নযুক্ত
একটি লিপি তক্ষশীলায় আবিষ্কার করেছেন। যদি
বিক্রম সম্বতের ভিত্তিতে হিসেব করা যায় তবে এই দলিলের তারিখ ৭৮-৭৯ খ্রিস্টাব্দ
পড়বে। কিন্তু ডাক্তার
রায়চৌধুরী এর মতে কনিষ্কও 'দেবপুত্র' উপাধি
ব্যবহার করতেন। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে শকাব্দ কনিষ্ক চালু করেন বলে মনে করেন। শকাব্দ দক্ষিণ ভারতে চালু থাকার
কারণে মালব ও সৌরাষ্ট্র হতে জৈন রা দক্ষিণ ভারতে এই অব্দ নিয়ে আসে। সুতরাং এখন ধরে নেওয়া হয় যে ৭৮
খ্রিস্টাব্দ থেকেই শকাব্দ প্রবর্তিত হয় এবং কনিষ্ক এটি চালু করেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন