কুমারগুপ্ত
মহেন্দ্রাদিত্যর মৃত্যুর পর গুপ্ত রাজসিংহাসনের অধিকার নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে
বেশ কয়েকটি বিতর্ক রয়েছে। ১৮৮৯ পর্যন্ত
আবিষ্কৃত লেখ ও মুদ্রার সাক্ষ্য এবং আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প অনুসারে কুমার গুপ্তর
মৃত্যুর পর স্কন্দগুপ্ত বিক্রমাদিত্য সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু ভিতরী থেকে পাওয়া তৃতীয়
কুমারগুপ্তর (মহেন্দ্রর পৌত্র) একটি রৌপ তাম্র সিলে কুমারগুপ্তর প্রধান
পত্নী অনন্তদেবীর পুত্র হিসাবে পুরুগুপ্তের নাম
পাওয়া গেছে। কয়েকটি
নালন্দা সিলেও অনুরূপ তথ্য পাওয়া গেছে, এর ফলে ঐতিহাসিক মহলে সন্দেহ দেখা দিয়েছে
যার ফলশ্রুতি নানারকম মত প্রকাশ ও বিতর্কের উৎপত্তি। ঐতিহাসিক Aoernle
মনে
করেন যে স্কন্দগুপ্ত ও পুরুগুপ্ত একই ব্যক্তির
নাম এবং স্কন্দগুপ্ত ‘পুরুগুপ্ত’ নাম ধারণ
করেছিলেন। এই মত
গ্রহণযোগ্য নয় কেননা ভিতরী সিলে প্রাপ্ত নাম পুরুগুপ্ত
এবং অসংখ্য ঐতিহাসিক উপাদানের কোথাও স্কন্দগুপ্ত অন্য নামের কোনো ইঙ্গিত নেই। প্রথম কুমারগুপ্তর পর গুপ্ত রাজবংশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এ্যালানের এই মতের সমর্থনেও কোন
ঐতিহাসিক দলিল পাওয়া যায় না
কুমার গুপ্তর মৃত্যুর পর গুপ্ত রাজ
সিংহাসন নিয়ে ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্বের স্বপক্ষে
সর্বাধিক জোরালো সওয়াল করেছেন
রমেশচন্দ্র মজুমদার। রমেশচন্দ্র
মজুমদার এবং এ এলবাম ও পি এল গুপ্তা মনে করেন যে ভিতরী স্তম্ভলেখ ও অন্যান্য
লেখসমূহতে স্কন্দগুপ্তর মাতার কোন নাম
উল্লেখ নেই যা থেকে প্রমাণিত হয় যে স্কন্দগুপ্তের মাতা কোন সম্মানীয় স্থানে
ছিলেন না এবং রাজ সিংহাসনে স্কন্দগুপ্তর কোনো বৈধ ও জোরালো দাবি ও ছিল না। ঐতিহাসিক ড: মজুমদার ভিতরী
স্তম্ভলেখর চতুর্থ স্তবকে যুদ্ধ-‘অমিত্রান’ শব্দটিকে
বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে শত্রুদের কোন নামের উল্লেখ এক্ষেত্রে না থাকার অর্থ হল
শত্রুরা স্কন্দগুপ্তর নিজের বংশেরই
সদস্য ছিলেন এবং বস্তুতপক্ষে তাদের মধ্যে একটি গৃহ যুদ্ধ হয়েছিল তাতে বিজয় হয়ে
স্কন্দগুপ্ত সিংহাসন দখল করেছিলেন। এছাড়াও
জুনাগর লেখ পঞ্চম স্তবকে বলা হয়েছে যে দেবীলক্ষ্মী রাজার অন্যান্য সন্তানদের
প্রত্যাখ্যান করে স্কন্দগুপ্ত গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকেই রাজা হিসাবে গ্রহণ করেন।
রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রদত্ত উপরোক্ত যুক্তিগুলি
ঐতিহাসিক মহলে প্রত্যাখ্যিত হয়েছে। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী এই বক্তব্য
পেশ করেছেন যে লেখতে প্রধান বা মহারানী ছাড়া অন্যান্য রানীদের নাম উল্লেখে কোনরূপ বিধিনিষেধ সেই সময় ছিল না। উদাহরণস্বরূপ তিনি দেখিয়েছেন যে
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তর কমবয়সী রানী কুবেরনাগার
নামও রিদ্ধপুর ও পুনা তাম্রলেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং লেখতে মাতার নামের উল্লেখ না
থাকায় প্রমাণ করে না যে স্কন্দগুপ্তর মাতা
রাজমহিষী ছিলেন না। দ্বিতীয়ত
ভিতরী, জুনাগর বা অন্যান্য কোন ঐতিহাসিক
উপাদানের কুমারগুপ্তর পর ভ্রাতৃঘাতি দ্বন্দ্বের কোনরূপ কোন ইঙ্গিত নেই। তাছাড়া ভিতরী স্তম্ভলেখ চতুর্থ স্তবকে উল্লেখিত ‘অমিত্রান’ শব্দটি
ভুল, সঠিক পাঠে তা হবে ‘পুষ্যমিত্রান’ অর্থাৎ স্কন্দগুপ্ত পুষ্যমিত্রদের পরাজিত করেছিলেন। তাছাড়াও ভিতরী স্তম্ভলেখর শেষ ছত্রেত্ বলা হয়েছে যে স্কন্দগুপ্ত বিজয়ী রাজাদের উপর রামপদ
স্থাপন করেছিলেন। গৃহযুদ্ধে
লিপ্ত যুবরাজদের কখনোই রাজা হিসাবে উল্লেখ করা যায় না। সুতরাং রমেশচন্দ্র মজুমদারের বক্তব্যকে অস্বীকার করে বলা যায় যে পিতার মৃত্যুর পর
স্বাভাবিক নিয়মেই ৪৫৪ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ ১৩৫ গুপ্তাব্দ স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে
বসেন (পিতরি-দিবম-উপেতে)।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে স্কন্দগুপ্ত পর্যন্ত সকল গুপ্তরাজাই ‘দিনার’ ওজন মান বিশিষ্ট স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করেছিলেন, যেখানে পরবর্তী রাজারা ‘সুবর্ণ’ ওজন ব্যবহার করেছিলেন। এই তথ্যের মাধ্যমেও কুমারগুপ্ত স্কন্দগুপ্তর
ধারাবাহিকতা প্রমাণ করা যায়।
লেখসূত্র থেকে অবশ্য একথা সুনিশ্চিতভাবে
প্রমাণ করা যায় যে সাম্রাজ্যের এক অতি সংকটময় সময়কালে স্কন্দগুপ্ত রাজ সিংহাসন লাভ
করেছিলেন। সংকট
এতটাই গভীর ছিল যে স্কন্দগুপ্তকে একটি গোটা রাত্রি খোলা আকাশের নিচে মাটিতে কাটাতে
হয়েছিল। ভিতরী স্তম্ভলেখ
অনুসারে পুষ্যমিত্র বংশই ছিল এই সংকটের
কারণ। পুরাণে
প্রায় ১৩ জন পুষ্যমিত্র রাজার নাম পাওয়া যায় যাদেরকে পার্গিটার খ্রিস্টীয়
তৃতীয় শতাব্দীতে স্থান দিয়েছেন। খ্রিস্টীয়
পঞ্চম শতকের মধ্যভাগে এদের ক্ষমতা যেকোনো কারণেই হোক বেড়ে গিয়েছিল এবং তারা
গুপ্ত সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ছিল। নিজের ক্ষমতা ও বাহুবলে স্কন্দগুপ্ত
পুষ্যমিত্রদের হাত থেকে গুপ্ত বংশকে রক্ষা করেছিলেন এবং সাম্রাজ্যের মধ্যে তাঁর গৌরব বৃদ্ধি
পেয়েছিল। জুনাগর
প্রশস্তির একটি স্তবকে বলা হয়েছে যে মনুজেন্দ্র পুত্রদের মধ্যে থেকে (উপস্থিত
রাজাদের মধ্যে) লক্ষ্মী স্কন্দগুপ্তকেই স্বামী হিসাবে
বরণ করেছিলেন (‘স্বয়মেব শ্রীয়া গৃহীত’)।
প্রথাগত এই সয়ম্বরের বিবরণ থেকে
স্পষ্ট যে তৎকালীন নৃপতিদের মধ্যে
যোগ্যতমকেই দেবীলক্ষ্মী (ভাগ্যের
দেবী) তার স্বামী হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন। এই বিবরণে (মনুগেন্দ্রপুত্র
কথাটির মধ্যে) গুপ্ত বংশীয়
গৃহযুদ্ধের সন্ধান করা অনৈতিহাসিক।
পুষ্যমিত্রদের হাত থেকে সিংহাসনকে রক্ষা
করার চেয়েও অধিক কৃতিত্ব স্কন্দগুপ্ত দাবি করতে পারেন শক্তিশালী বৈদেশিক শক্তি হূনদেরর হাত থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য। ভিতরী স্তম্ভ লিখতে সরাসরি বলা হয়েছে যে
স্কন্দগুপ্ত হূনদের পরাজিত করেছিলেন। জুনাগর
লেখতে হূনদের উল্লেখ না থাকলেও ‘ম্লেচ্ছ’দের উল্লেখ
রয়েছে। আর সোমদেব তাঁর ‘কথাসরিৎসাগর’ এ লিখেছেন
উজ্জয়িনীর রাজা মহেন্দ্রাদিত্যের পুত্র
বিক্রমাদিত্য ম্লেচ্ছদের পরাজিত করেছিলেন।
খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যভাগে হূনরা অক্ষু উপত্যাকায় আধিপত্য বিস্তার করেছিল। তাদেরই একটি শাখা হয়ে যা হেপাথেলাইটিস
এবং শ্বেত হূন ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে জাবুলিস্থানে আগ্রাসনের নজির রেখেছিল। স্কন্দগুপ্তর রাজত্বকালে তারা
ভারত আক্রমণ করে প্রত্যাহিত হয় এবং সাখানিয় সাম্রাজ্যকে আঘাত করে। বলাবাহুল্য হূনদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য
ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ স্কন্দগুপ্তকে ভারতের রক্ষাকর্তা বলে উল্লেখ করেছেন।
স্কন্দগুপ্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের সীমানাকে
সংকুচিত হতে দেননি। কাথিয়াবাড়
তথা পশ্চিম ভারতের উপর তার প্রভাব যে অটুট ছিলো তার প্রমাণ বহন করছে জুনাগড় লেখ এবং সম্ভবত bust altar প্রতিকৃতি
যুক্তমুদ্রা যেগুলি ওই অঞ্চলেই প্রচলিত ছিল। স্কন্দগুপ্ত উত্তরাধিকারী বুধগুপ্তের রাজত্বকালে
দামোদরপুর তাম্রশাসন প্রমাণ করে যে পুণ্ড্রবর্ধন বা উত্তর বঙ্গ স্কন্দগুপ্তর সময় অধিকারের ছিল। সুমন্ডল লেখ থেকে জানা যায় যে কলিঙ্গ ও ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গুপ্ত
সাম্রাজ্য ভুক্ত ছিল। এই
অঞ্চল স্কন্দগুপ্তর রাজত্বকালে গুপ্ত সাম্রাজ্য ভুক্ত হয়ে থাকতে পারে বলে
ঐতিহাসিক অতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অনুমান করেছেন। কোষল, বাঘেলখন্ড ইত্যাদি অঞ্চলের উপরেও স্কন্দগুপ্তর আধিপত্য ছিল তা লেখ থেকে প্রমাণিত। পুরানে বলা
হয়েছে যে (গুহ) স্কন্দ
কলিঙ্গ, মহিষ এবং মহেন্দ্রর শাসক ছিলেন। সুতরাং বলা চলে যে দেবরাজ ক্রমাদিত্য
বা বিক্রমাদিত্য উপাধিধারী স্কন্দগুপ্তর রাজত্বকালে সাম্রজ্যিক ঐক্য অটুট ছিল।
স্কন্দগুপ্ত শুধুমাত্র সামরিক প্রতিভাধরই ছিলেন না, পাশাপাশি একজন
দক্ষ সংগঠক ও ছিলেন। জুনাগর
লেখ থেকে জানা যায় যে স্কন্দগুপ্ত
সাম্রাজ্যের সবকটি প্রদেশেই দক্ষ প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ করেছিলেন। লেখটি থেকে জানা যায় যে হূন আক্রমণের অব্যবহিত পরেই সীমান্ত অঞ্চলস্থিত সৌরাষ্ট্রর শাসনব্যবস্থার
পুনর্গঠন সম্বন্ধে স্কন্দগুপ্ত যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন এবং বহু চিন্তাভাবনার পর তিনি
পর্নদত্তর হাতে সৌরাষ্ট্রের নাগরিক দায়িত্বভার
তুলে দেন। পাশাপাশি
এই অঞ্চলের সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে ভটার্ককে
নিযুক্ত করেন। অন্তবেদী বা গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলের বিষয়পত বা জেলা আধিকারিক ছিলেন সর্বনাগ, ধোমান অঞ্চল দেখাশুনা করতেন ভীমবর্মন। জুনাগর
লেখক রচয়িতা জানিয়েছেন যে স্কন্দগুপ্ত একজন প্রজাকল্যাণকামী শাসক ছিলেন। লেখাটিতে
একটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে যে ৪৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবল প্রাকৃতিক
দুর্যোগে যখন গিরনার পার্বত্য অঞ্চলের সুদর্শন বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল তখন পর্নদত্তর
পুত্র চক্র পালিত সুদক্ষ প্রশাসনের সাহায্যে সেই বাঁধ পুনরায় নির্মাণ করে দেন। এর জন্য প্রজাদের উপর কোন
অতিরিক্ত কর চাপানো হয়নি। মুদ্রায় এই কারণেই স্কন্দগুপ্ত ‘পরহিতকারী’ অভিধায় ভূষিত।
নিজে পরম ভাগবত হলেও পূর্বপুরুষদের মতোই
স্কন্দগুপ্ত পরধর্ম সহিষ্ণু ছিলেন। তার
স্বর্ণমুদ্রায় তিন ধরনের প্রতিকৃতি দেখতে পাওয়া যায় ধনুর্ধর, রাজা ও রানী এবং ছত্র। স্কন্দগুপ্ত একজন অসাধারণ ধুনধর ছিলেন, মুদ্রায়
তার ‘সুধন্বী’ উপাধি ব্যবহার তারই প্রমাণ। রৌপ্যমুদ্রার
ভিত্তিতে বলা যায় যে স্কন্দগুপ্ত ১৪৮ গুপ্তাব্দ অর্থাৎ ৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত
রাজত্ব করেছিলেন। মাত্র ১৪
বছরের রাজত্বকালের মধ্যেই তিনি নিজের দক্ষতার এতটাই পরিচয় দিয়েছিলেন যে ঐতিহাসিক মহলে অনেকেই তাকে
“the sole hero of the Gupta dynasty” বলে চিহ্নিত করেছেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন